তাপস সরকার

লেখক পরিচিতি 

( সৃজনশীল সাহিত্য কর্মে নিয়োজিত কিশোর  বয়স থেকেই। প্রথম পঠিত গ্রন্থ রামায়ণ, মহাভারত ও গীতা। গদ্যসাহিত্য ও উপন্যাসেই সাবলীল। যদিও শতাধিক গল্প ও দশ-বারোটি উপন্যাসের রচয়িতা কিন্তু সেসব হারিয়ে গেছে অপ্রীতিকর কারণে। প্রিয় বিষয় মহাকাশবিদ্যা। কল্পবিজ্ঞান ও কিশোর সাহিত্য প্রিয় লেখা।কিছু গল্প নব্বইয়ের দশকে বাণিজ্যিক ও অবাণিজ্যিক পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত। উন্মীলন নামে প্রকাশিত সাহিত্য পত্রিকায় নিজের গল্প ও দুটি উপন্যাস ছাপা হলেও সেই উদ্যোগ থেমে যায়।প্রতিভাস সাহিত্য ম্যাগাজিন চলছে পনের বছর যা মায়ের নামে। সেখানে মায়ের উদ্দেশ্যে নিবেদিত লেখা স্মৃতিচিত্রণ ও বেশ কিছু ছোটগল্প। নব্বইয়ের দশকে কলেজ স্ট্রিট কফি হাউসে কিছুদিন লিটল ম্যাগাজিন গোষ্ঠীর সঙ্গে যুক্ত থেকে জেলায় জেলায় সাহিত্য আসরে ঘোরাঘুরি। বিশ্বকে নিজের ঘর বলে ভাবতে অভ্যস্ত। মায়ের মৃত্যুর পর অবসাদে দীর্ঘদিন লেখায় বিরত। তারপর আবার লেখা শুরু কিশোর সাহিত্য ‘গাছবাড়ির বাসিন্দা ‘ দিয়ে। পেশায় অর্থনীতি বিষয়ের অধ্যাপক। ) 

অধ্যায় : এক 

ইদানীং আমার কী যে হয়েছে আমি নিজেই জানিনা।

আমার কোনকিছুতেই মন বসে না।  ভালো লাগে না। কোন কাজ করতে ইচ্ছে করে না। কোন কাজে উৎসাহ খুঁজে পাই না।

ভুক্তভুগী না হলে আমার এই সংকট বুঝতে পারবে না কেউ। কোন কাজ ভাল না লাগলে বসে থাকতে পারি। বসে বসেই যদি জীবন কেটে যায় তো ক্ষতি কী? আসলে এখানেই যত গন্ডগোল। খানিকটা সময় কিছু না করে বসে থাকলেই মনে হতে থাকে, কিছুই তো করা হচ্ছে না, অথচ দিন কেটে যাচ্ছে। তখন আবার কিছু না করে বেকার বসে থাকার জন্য হা-হুতাশ করতে থাকি। এই হয়েছে আমার অবস্থা। কিছু করতে ভাল লাগে না, আবার কিছু না করলেও ভাল লাগে না। 

এইভাবেই চলছিল দিনগুলি, এইরকম বিপদের মধ্যে। বিপদ বলে বিপদ! আসল বিপদের কথা তো বলাই হয়নি। শুনলে সবাই বুঝবে কী যন্ত্রণার মধ্যে দিন কাটছে আমার। কিভাবে বলব বুঝতেও পারছি না। কেউ বিশ্বাস করবে কিনা সন্দেহ আছে। এই ভয়েই এতদিন মুখ খুলিনি। দেখছিলাম, সবকিছু যদি আবার স্বাভাবিক হয়ে যায়। পরিস্থিতি কিছুই পাল্টায়নি, বরং যত দিন যাচ্ছে সমস্যা যেন বেড়েই চলেছে। মুশকিলটা তো এখানেই, কোনকিছুই ঠিকঠাক বুঝতে পারি না। সমস্যা বেড়ে যাচ্চ্ছে নাকি একই আছে বুঝতেও গণ্ডগোল। তবে কমছে না নিঃসন্দেহে। সারাদিন মনে হয় ঘাড়ে একটা বোঝা চেপে আছে। সমস্যার বোঝা। এই বোঝাটা কিছুক্ষণের জন্য নামিয়ে রাখতে পারলে স্বস্তি পেতাম।অ্যাটলাসের ঘাড়ে গোটা পৃথিবী ! বোঝাটা অন্যের ঘাড়ে চাপিয়ে দিতে পারলে বেশ হত। কার ঘাড়ে চাপাব ? সেই লোকটাকে পাই কোথায় ?
এইরকম এক মনোবাঞ্ছা থেকে নিজেকে জানাবার এই প্রয়াস। যদি কোথাও একজন এমন লোক পাওয়া যায় যার কাঁধে আমার সব সমস্যার বোঝা চাপিয়ে দেওয়া যেত ! পাব কি ? ঝামেলা পাকিয়ে ফেললাম গোড়াতেই। অভিসন্ধিটা জানিয়ে দিলাম। এবার সবাই সতর্ক হয়ে যাবে। হয়তো কেউ আর পড়তেই চাইবে না কী বলছি। কিজানি বাবা, শুনতে গেলে যদি কোন ফ্যাসাদে পড়তে হয় ! বলেই তো ফেলেছি যে আমার ঘাড়ে যে সমস্যার বোঝা তা অন্যের ঘাড়ে চাপিয়ে মুক্তি পেতে চাই। আসলে ওটা কথার কথা। যার বোঝা তারই, অন্যের হয় না। বড়জোর আমি বলতে পারি, আমার চুলটা পাকা, গায়ের রঙটা কালো। এই নিয়ে যদি কারো কাছে দুঃখ করি, আর সেই লোকটার গায়ের রঙ ফর্সা চুলের রঙ কালো হলে তা কি উল্টে যাবে ? সে আমাকে সান্ত্বনা দিতে পারে, তাতে আমার চুল কালো আর গায়ের রঙ ফর্সা হয়ে যাবে না। তাই বলছি, আমার সমস্যা একান্ত আমারই। তা আমি অন্যকে দিয়ে দেব কোন্ কৌশলে ?
তাছাড়া সারা পৃথিবীর লোকেরা কম চালাক নয়। আমি আমার ঘাড়ের বোঝা লোককে ডেকে কায়দা করে দিয়ে দেব আর লোকেরা তা কিছু না বুঝেই ভালমানুষের মত নিয়ে নেবে এমনটা হয় নাকি ? আজ পর্যন্ত যত লোকের সঙ্গে কথা বলেছি প্রত্যেককে মনে হয়েছে আমার চেয়ে বেশি বুদ্ধিমান। পৃথিবীর কোন মানুষেরই আমি আজ অব্দি গোটাটা বুঝে উঠতে পারিনি। গোটা তো দূরের কথা, খানিকটাও কি বুঝতে পেরেছি ? এই পৃথিবীতে মানুষরাই আমার কাছে বেশি রহস্যজনক। আমি একজন লোকেরও চরিত্র বুঝতে পারি না।যাকে যেমন ভাবি পরে দেখি সে ঠিক তার উল্টো। মানুষকে যত দেখি তত আমি অবাক হই। মানুষের কাজকর্মের ধারাই বিচিত্র। তার সঙ্গে তুলনা করতে পারি এমন কিছুর হদিশ পাই নি জগতে। সাধে কি আর নিজেকেই নিজে সে বলে সবচেয়ে বুদ্ধিমান প্রাণি !
মানুষের চিন্তাভাবনার রকমসকমও বিস্ময়কর। প্রত্যেকেই মনে করে সে অন্যের চেয়ে বেশি জানে। বেশি জানুক বা কম জানুক, কাউকে ছোট করে বোকা বানানো যায় না। সারাজীবনই দেখেছি। অন্যের কথা জানিনা, আমি নিজে চিরকাল কাউকে বোকা বানাতে গিয়ে নিজেই বোকা বনে গেছি। অহরহ এমন ঘটনা ঘটেছে। উদাহরণ দিতে চাইছি না, তালিকাটা খুব লম্বা হয়ে যাবে। ব্যাপার-স্যাপার দেখে মনে হয়েছে যে পৃথিবীতে আমিই একমাত্র বোকা। 
এসব কথা কেন বলছি ? আসলে সবাইকে বোঝাতে চাইছি যে আমার লেখা পড়লে ভয়ের কোন কারণ নেই। যারা আমার লেখা পড়বে আমি কোনদিক থেকেই তাদের চেয়ে বেশি বুদ্ধিমান নই। আমার মত এমন একজন উৎকৃষ্ট বোকা লোক লিখে এমন ফাঁদ পাতব যে কেউ বুঝতে না পেরে ফেঁসে যাবে এমন ভাবনা অবান্তর। ঘুরিয়ে-পেঁচিয়ে কিছু বলার উদ্দেশ্য নেই আমার। যা বলব সব সাদাসিধে। কোন লুকোন মতলব নেই। 
হ্যাঁ, নিজের সমস্যাগুলির কথা দশজনকে বলতে চাই। এই কারণে যে বলে যদি কিছুটা হালকা হওয়া যায়। তার মানে এই নয় যে আমি চাই অন্যেরাও আমার মত সমস্যায় পড়ুক। আমি কী ঝামেলায় পড়েছি তারই বিবরণ দিতে যাচ্ছি। কেউ ধৈর্য ধরে পড়লেই বর্তে যাব। সান্ত্বনা দেওয়ার ইচ্ছে প্রকাশ করলে তো কথাই নেই। আর আন্তরিকভাবে বলছি, আমি চাইনা অন্য কেউ আমার মত বিপদে পড়ুক। এই লেখা তৈরি করার এটাও একটা উদ্দেশ্য। যাতে আমার সমস্যাগুলির কথা জেনে সবাই সাবধান হতে পারে। 
বিপদ কার না হয় ? মানুষের বিপদের অন্ত নেই। সব বিপদের চরিত্র কি জানে সবাই ? আমি অন্তত জানি না। ইদানীং নিজে গুচ্ছ গুচ্ছ বেয়াক্কেলে সব বিপদের মুখোমুখি হয়ে বুঝতে পারছি বিপদ কত রকমের হয়। আবার মনে এই প্রশ্নও দেখা দিচ্ছে, আমার বিপদগুলির সঙ্গে অন্যদের বিপদের মিল আছে কিনা। অন্যরা কী কী বিপদে পড়ে ? আগে এসব নিয়ে ভাবিনি কখনও। তাই নিজের বিপদগুলি এত বিচিত্র মনে হচ্ছে। আসলে এই লেখাতে নিজের বিপদগুলির কথা বলে আমি জানতে চাই অন্য কেউ কখনো এসব বিপদের মোকাবিলা করেছে কিনা। 
ওপর-ওপর দেখে তো কিছুই বোঝা যায় না। কে যে কিভাবে আছে বা কী করছে। কেউ ঢাক পিটিয়ে বলতেও যায় না নিজের সব গোপন কথা। হ্যাঁ, ঢাক পেটায় অনেকেই নিজেকে জানাতে, তবে সেই ঢাক পেটানো সত্যিসত্যি যে যা তার উল্টোটাই প্রকাশ করে। চোর ঢাক পিটিয়ে জানায়, সে সাধু। সত্যিকারের সাধুরা ঢাক পেটায় কিনা জানা নেই। তবে আমি যতবার ঢাক পিটিয়ে কোন লোককে নিজের কথা ঘোষণা করতে শুনেছি ততবার খোঁজ নিয়ে দেখেছি, লোকটা আসলে যা ঢাক পিটিয়ে বলে মোটেই সে সেটা জানাতে চায় না। 
ওই যে বললাম, দেখে বোঝা মুশকিল কে কী বা কী করছে। রোজ রাস্তায় নামলে হাজার হাজার লোক দেখা যায়। এই লোকরা সবাই যেমন দেখছি তেমন কি ? প্রত্যেকেরই কিছু না কিছু গোপন চেহারা আছে যেটা বাইরে প্রকাশ পায় না। দেখে যাকে মনে হয় ভাজা মাছটি উল্টে খেতে জানে না সে-ই হয়তো কোন এক সময় মাছটি ভেজে রেখেছে। এই যে হাজার হাজার লোকের সঙ্গে রোজ কর্মব্যস্ত সময়ে আমার দেখা হয় তাদের প্রত্যেকেরই একটা অন্য চেহারা আছে। একটা কেন, একাধিকও হতে পারে। রহস্য ঘিরে রেখেছে প্রত্যেকটি মানুষকে। কেউ আমরা টের পাই না। এই দুনিয়ায় এটাও সম্ভব, এই যে হাজার হাজার মানুষের দেখা পাচ্ছি রোজ, অনেকের সঙ্গেই কথাবার্তা বলছি আবার নানা কাজেকর্মে জড়িয়ে পড়ছি তারা সবাই হয়তো মানুষ নয়। মানুষের ছদ্মবেশে ঘুরে বেড়াচ্ছে আসল মানুষদের চোখে ধুলো দিয়ে। 
রিক্তর স্বভাব হল লোকের পিছু নেওয়া। না জানিয়ে। পথচলতি যে কোন লোককে সে বেছে নেয় আর গোপনে অনুসরণ করে। দেখে সারাদিন সেই লোকটা কী করে, কোথায় যায়, কোথায় থাকে। তার কাছেই আমার এই কথাটা শোনা। সে আমাকে একদিন বলেছিল, 
‘তুই যে মানুষগুলোকে রোজ দেখছিস তারা সবাই কিন্তু মানুষ নয়।’
আমি ভারী অবাক হয়ে চমকে গিয়ে জানতে চেয়েছিলাম,
‘মানুষ নয় তো কী ?’
‘কী সেটা তোকে ঠিক বোঝাতে পারব না। এটুকুই জেনে রাখ্ যে হাজার মানুষের ভিড়ে অনেকেই আছে যাদের দেখলে মনে হবে মানুষ, কিন্তু আসলে তারা অন্যকিছু। মানুষের চেহারা নিয়ে ঘুরে বেড়ায়। কেউ দেখে বুঝতেই পারবে না।’
রিক্ত ব্যাখ্যা দিয়েছিল। আমি প্রশ্ন করেছিলাম, 
‘তারা কি ভিনগ্রহী ?’
‘না, ঠিক ভীনগ্রহীও নয়। এই পৃথিবীই তাদের বাসস্থান। হলেও তারা ঠিক মানুষ নয়। সবার চোখের সামনে মানুষ সেজে থাকে। দেখে বোঝে সাধ্যি কার !’
কাকপক্ষিতেও টের পাবে না এই শর্তে রিক্ত একদিন রাস্তায় একটি মেয়েকে দেখিয়ে জানাল,
‘ওর কিছু রহস্য আছে। ও ছাড়া কেউ জানে না।’
মেয়েটির নাম স্বাদিতা সেন। বয়স তেইশ-চব্বিশ হবে। দেখতে-শুনতে খারাপ নয়। একটা ট্রাভেল এজেন্সির অফিসে চাকরি করে। এসব কথা রিক্তর কাছেই শুনলাম। তারপর আমাকে নিয়ে একদিন বিকেলের দিকে সে মেয়েটির অফিসের সামনে অপেক্ষা করতে লাগল। অফিস ছুটির পর মেয়েটি ব্যস্ত রাস্তায় এসে দাঁড়াল। রিক্ত আমার কৌতূহলটা জাগিয়ে রাখতে বলল,
‘দ্যাখ্ না কী হয়।’
মেয়েটি অনলাইনে একটি ক্যাব ভাড়া করল। রিক্ত হাতের কাছে পেয়ে আমাকে নিয়ে একটা ট্যাক্সিতে চড়ে বসল। মেয়েটিকে অনুসরণ করে ঘন্টাখানেক পর আমরা একটা হাউজিং কমপ্লেক্সের সামনে এলাম। মেয়েটি, অর্থাৎ স্বাদিতা  ক্যাবের ভাড়া মিটিয়ে ভিতরে চলে গেল। সে এই কমপ্লেক্সের কোন এক বাড়ির কোন এক ফ্ল্যাটে থাকে। রিক্ত আমাকে নিয়ে বাইরে অপেক্ষা করতে লাগল। শহরে ইতিমধ্যে সন্ধে নেমে গেছে। এলাকাটা মোটামুটি নিরিবিলি হলেও লোক চলাচল মন্দ ছিল না। বাইক-রিকশা যাচ্ছিল একটু পর পর। আমরা অপেক্ষা করেই গেলাম। বিরক্তি ধরে গেল আমার একসময়। রিক্ত নির্বিকার। আমাকে মৃদু ধমক দিয়ে বলল,
‘কোন রহস্য জানতে হলে ধৈর্য ধরতে হয়। এত ছটফট করিস বলেই তোরা কিছু দেখিস না।’
সন্ধে পেরিয়ে রাত তখন আটটা। দু’ঘন্টার ওপর অপেক্ষা করা হয়ে গেছে ততক্ষণে। মনে মনে রিক্তর মুণ্ডুপাত করছি আর ভাবছি, রহস্য চুলোয় যাক। আর ঠিক তখনই দেখলাম, স্বাদিতা নামের মেয়েটি কমপ্লেক্স থেকে বেরিয়ে এসে রাস্তায় দাঁড়াল। আবার সে একটি ক্যাব ভাড়া করে তাতে চড়ে বসল। রিক্তও তৈরি ছিল। সে-ও একটা ক্যাব ডেকে নিয়ে এল। আমরা স্বাদিতাকে আবার অনুসরণ করতে লাগলাম। প্রায় পঁয়তাল্লিশ মিনিট যাওয়ার পর শহরের প্রান্তে বাইপাসের ধারে জল থৈ-থৈ বিশাল ভেরিগুলির সামনে এলাম। স্বাদিতা তার ক্যাব ছেড়ে দিল। রাস্তায় বাস, ট্যাক্সি, গাড়িঘোড়া অনেক চলাচল করলেও পায়ে-হাঁটা লোকজন নেই-ই প্রায়। আলো থাকলেও একটা অন্ধকারাচ্ছন্নতা চেপে বসে আছে চারপাশে। রাট ন’টা বেজে গেছে। স্বাদিতা ভেরির জলের খানিকটা দূরে একটা বেঞ্চির ওপর গিয়ে বসল। চুপচাপ বসেই রইল।আলো কম থাকায় তাকে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছিল না। কাছাকাছি আর কোন লোকের চিহ্ন নেই। আমরা একটা বড় গাছের আড়ালে লুকিয়ে বসে সব দেখছিলাম। সময় কেটে যাচ্ছিল। আমার ধৈর্যের বাঁধ আবার ভাঙ্গতে লাগল। ভেরির জলের কাছাকাছি বেঞ্চিতে স্বাদিতা বসে আছে তো বসেই আছে। কী তার মতলব বোঝা যাচ্ছিল না। কেউ তার সঙ্গে দেখা করতে এলেও নাহয় কিছু বোঝা যেত। এভাবে অনন্তকাল অপেক্ষা করে যাওয়ার কোন মানে আছে ? রাস্তায় পুলিশের পেট্রল ভ্যান টহল দিচ্ছিল। তাদের নজরে পড়লে কী যে হবে ! কিন্তু রিক্ত আমাকে মৃদু ধমক দিয়ে চুপচাপ অপেক্ষা করে যেতে বলল। 
রাট তখন প্রায় এগারোটা। স্বাদিতা বেঞ্চি থেকে উঠে দাঁড়াল। পায়ে পায়ে হেঁটে এগিয়ে গেল ভেরির জলের কাছাকাছি। তারপর সে ঝাঁপ দিল জলে। রাস্তা জুড়ে প্রচুর আলো, তবুও এলাকাটার সমস্ত অন্ধকার দূর হয়ে যায়নি। ভেরির জলকে আলোকিত করার কোন ব্যবস্থা ছিল না। কিন্তু যতটুকু আলো ছিল তাতেই জলে ঝাঁপিয়ে পড়া স্বাদিতাকে দেখা যাচ্ছিল, অস্পষ্টতা থাকলেও। আমার চোখের সামনে মিনিটখানেকের মধ্যেই সে একটা প্রকাণ্ড মাছে পরিণত হয়ে গেল আর মনের আনন্দে সাঁতার কাটতে কাটতে চলে গেল অনেক দূরে, জলের অনেক গভীরে। 
তারপর আমাদের বাড়ি ফিরে আসা উচিত ছিল। কিন্তু রিক্ত আমাকে সারারাত ওখানেই বসিয়ে রাখল। খুব ভোরে, রাতের অন্ধকার পুরো কাটেনি তখনও, দেখলাম একটা বিশাল মাছ জলের গভীর থেকে পারের কাছে এগিয়ে আসছে। ওখানেই সে ঘোরাফেরা করতে লাগল ঘন্টাখানেক সময় ধরে। অন্ধকার ক্রমশ ফিকে হতে লাগল, আকাশ পরিষ্কার হয়ে আসছিল। ওই বিরাট মাছটা এবার জল থেকে এক লাফ মেরে ডাঙায় উঠে এল। এক মিনিটের মধ্যেই মাছটা আবার স্বাদিতা হয়ে গেল, ঠিক কাল রাতে জলে ঝাঁপিয়ে পড়ার আগে তাকে যেমন দেখেছিলাম। কিছুক্ষণের মধ্যেই সে অনলাইনে আবার একটা ক্যাব ভাড়া করে নিজের হাউজিং কমপ্লেক্সে ফিরে গেল। বেলা দশটার সময় তাকে দেখলাম অফিসের দিকে রওনা দিচ্ছে, মোবাইল ফোনে কারোও সঙ্গে অনর্গল কথা বলতে বলতে। 
তারপর আমি রিক্তর চ্যালা হয়ে গেলাম। বলতে গেলে তাই বলতে হয়। অন্তত কিছুদিনের জন্য তো অবশ্যই। তার সঙ্গে ঘুরে ঘুরে বিচিত্র সব মানুষের সন্ধান পেলাম। তারা সবাই মানুষ হলেও ঠিক মানুষ নয়। তাদের প্রত্যেকেরই কিছু না কিছু রহস্য আছে। রাস্তার ভিড় থেকে একজন লোক বেছে নিয়ে তাকে অনুসরণ করে যাওয়া। কারো পিছনে দিনের পর দিন লেগে থাকতে হত। কাউকে আবার কিছুক্ষণ নজরে রাখলেই তার গোপন রহস্যটা বোঝা যেত। 
কতরকম বিচিত্র ব্যাপার রয়েছে লোকজনের। আগে এসব সম্পর্কে কোন ধারণাই ছিল না। মানুষকে দেখলে ভাবি আমরা সে মানুষই। সে যে অন্যকিছু হতে পারে ভাবি কি কেউ ? রিক্ত আমার সামনে একটা অজানা জগতের দরজা খুলে দিল। আমি জানতে পারলাম, মানুষরা সব মানুষ নয়। তারা অন্যকিছু হলেও হতে পারে। 
গদাধর পাকড়াশির কথাই ধরা যাক। দুই ছেলেমেয়ের বাবা এই ভদ্রলোক সকালে বাজার করে খেয়েদেয়ে অফিসে যান। সারাদিন মন দিয়ে অফিসের কাজকর্ম করেন, সহকর্মীদের সঙ্গে সময় পেলে আড্ডা মারেন, মিটিং-মিছিলেও যান দরকার হলে। রোজ সন্ধেবেলা নিয়ম মেনে বাড়ি ফেরেন। তাঁর কী গোপন রহস্য থাকতে পারে ? একমাত্র রিক্ত জানত সেটা। দিন তিনেক তাঁর পিছনে আমাকে নিয়ে লেগে রইল ব্যাপারটা দেখাবার জন্য। একদিন অফিস ছুটির পর গদাধরবাবু বাড়িতে যাওয়ার বাস না ধরে ময়দানের দিকে হাঁটা দিলেন। আমরাও লুকিয়ে তাঁর পিছু নিলাম। খোলা মাঠের মধ্যে দিয়ে হেঁটে তিনি এমন একটা জায়গায় গেলেন যেখানে বেশ কিছু গাছপালা, ঝোপঝাড় রয়েছে। পারতে কেউ আসে না এখানে, আবার এই সময়ে, বিকেল ফুরিয়ে যখন সন্ধে আসতে চলেছে। এই নির্জন এলাকাতে এসে গদাধরবাবু ঘাসের ওপর বাবু হয়ে বসে পড়লেন। তারপর নাক দিয়ে সশব্দে শ্বাস গ্রহণ করতে লাগলেন। তাঁর শরীরটা ক্রমশ ফুলে উঠছিল। ফুলতে ফুলতে ভদ্রলোক একটা গোল বস্তুতে পরিণত হয়ে গেলেন। তাঁকে আর আলাদা করে মানুষ বলে চেনা যাচ্ছিল না। তখনও তিনি শ্বাস নিচ্ছিলেন আর কেবলই ফুলছিলেন। তারপর একসময় ফটাস করে ফেটে গেলেন। ফেটে যাওয়ায় শরীরের মধ্যে থেকে একটা খোলা ছাতার মত বস্তু তীব্রবেগে সাঁ-সাঁ করে উঠে গেল আকাশের দিকে। অনেকটা ওপরে ওঠার পর বস্তুটা হাওয়ায় ভেসে বেড়াতে লাগল। তখন দেখলাম, ছাতাটার বাঁট ধরে ঝুলছে লেজওয়ালা একটা প্রাণি। ওটা যে কী প্রাণি বুঝতে পারলাম না। 
কতটা সময় ছাতাটা আকাশে ভাসমান ছিল ? আধঘন্টা ? হলেও হতে পারে। তারপর সেটা নিচে নেমে আসতে লাগল। সঙ্গে ওই উদ্ভট প্রানিটাও ছিল। সেটা যে কী চেনা গেল না। একসময় ছাতা নেমে এল মাটিতে ঘাসের ওপর। ঠিক সেখানটায় যেখানে গদাধরবাবু বসেছিলেন। খাড়া দাঁড়িয়ে রইল মিনিটখানেক। অদ্ভুত প্রাণিটা ছাতার বাঁট বুকে আগলে জড়িয়ে রেখেছিল। ছাতা তারপর গুটিয়ে যেতে লাগল এবং গুটিয়ে গেল ওই প্রাণিটাকে নিজের ভিতরে রেখে। সঙ্গে সঙ্গেই আবার গদাধরবাবুর আবির্ভাব। স্বমূর্তিতে নয়, বিকট ফোলা চেহারায়। এবার তিনি নাক দিয়ে ক্রমাগত শ্বাস ছাড়তে লাগলেন। অল্প সময়ের মধ্যেই আবার সেই অবিকল আগের মত গদাধরবাবু ফিরে এলেন। চটপট উঠে দাঁড়িয়ে দ্রুতপায়ে হাঁটা দিলেন বাসরাস্তার দিকে। তারপর রোজদিনের মত বাড়ি ফেরার বাস ধরলেন। 
আমি রিক্তকে জিজ্ঞেস করলাম,
‘এই মানুষগুলি কি সত্যি মানুষ ?’ 
সে আমার প্রশ্নটার উত্তর না দিয়ে পাল্টা প্রশ্ন করল,
‘সত্যি মানুষ বলতে তুই কী বুঝিস ?’
আমি একটু থতমত খেয়ে গেলাম। ভেবেচিন্তে বললাম,
সত্যি মানুষ বলতে বুঝি যারা সবসময় মানুষই থেকে যাবে। কখনও কোন অবস্থাতে স্বাদিতা বা গদাধর পাকড়াশির মত অন্য কিছু হয়ে যাবে না।’
‘তুই তাহলে কিছুই বুঝিস নি। গোড়াতেই গণ্ডগোল। তোর মত সবারই এই একই অবস্থা। সবাই তোর মতোই ভাবে। তোর মতোই দেখে।’
আমি রিক্তর দিকে বোকার মত তাকিয়ে থাকলাম।   

অধ্যায় : দুই 

আমার কী বিপদ বলতে যাচ্ছিলাম। বিপদ একটি নয়, একাধিক। বিপদগুলির কথা বলতে হবেই। কিন্তু মুশকিলটা অন্য। রিক্তর সঙ্গে ঘুরে যেসব মানুষকে দেখছি মানুষ নয় আমাকে কি তাদের মত মনে হচ্ছে না ? আমার বিপদগুলির জন্য ? সত্যি যারা মানুষ তাদের কি এমন আজব বিপদ হয় ? এখন আমার মনে ক্রমাগত এই সন্দেহ জোরদার হচ্ছে, আমিও সত্যি মানুষ কিনা। আমার মধ্যে যেসব বিপদ ঘটছে, যেসব সমস্যার শিকার হয়ে চলেছি আমি তাতে তো নিজেকে আর সত্যি মানুষ বলে ভাবতে ইচ্ছে করছে না। সত্যি মানুষ তাহলে কে ?

রিক্তকে গিয়ে ধরলাম আমি। 

‘তুই তো আমাকে আচ্ছা ফ্যাসাদে ফেলে দিয়েছিস ! সব লোককে দেখলেই মনে হচ্ছে অস্বাভাবিক। কাউকে আর বিশ্বাস করতে পারছি না। এমনকি, নিজেকেও মানুষ বলে মনে হচ্ছে না।’

রিক্তকে চিন্তিত দেখাল। একটু সময় নিয়ে ভেবে সে বলল,

‘এক কাজ করি চল্। আমাদের খোঁজার দৃষ্টিকোণটা উল্টে দিই।’

‘কী রকম ?’

‘এতদিন কী দেখলাম ? হাজার হাজার মানুষের ভিড় থেকে খুঁজে বার করছিলাম কারা ঠিক মানুষ নয়। এবার বরং খুঁজে দেখি এই হাজার হাজার মানুষের ভিড়ে কারা ঠিক ঠিক মানুষ।’

‘তাতে কী হেরফের হবে ?’

একটু উষ্ণ ছিল আমার গলার স্বর। রিক্ত বোঝাবার চেষ্টা করল। 

‘এতে সান্ত্বনার জায়গা থাকবে। এখন তুই প্রথমেই সবাইকে মানুষ ভেবে এগোচ্ছিস। পরে মানুষ নয় দেখে হতাশ হয়ে যাচ্ছিস। আর উল্টোভাবে চললে তুই প্রথমেই ভেবে নিবি যে এই হাজার হাজার মানুষের কেউ ঠিক মানুষ নয়। তারপর দেখতে হবে তার মধ্যেও কেউ ঠিক মানুষ কিনা। যদি দু’-একজনও ঠিক ঠিক মানুষ পেয়ে যাস তো তোর সব দুঃখ কেটে যাবে। মনে হবে পৃথিবীটা সত্যি সুন্দর এবং এখানে বেঁচে থাকা যায়।’

কথাটা আমার পছন্দ হল। কে মানুষ নয় খোঁজার চেয়ে কে মানুষ সেটা খোঁজা অনেক বেশি আশাব্যঞ্জক। সেই কাজটা কিভাবে শুরু করা যেতে পারে ?

‘এতদিন আমি লোক বাছাই করতাম। সেই লোকগুলিকে আমি জানতাম ঠিক মানুষ নয়। তোকে তাই দেখাতাম। এবার তুই লোক বাছাই করে নে। এমন লোক যাদের আমি চিনি না। তারপর খোঁজ নিয়ে দেখব তারা আসলে কী।’

কোন্ লোক বাছাই করব ? লোকে লোকারণ্য এই শহর থেকে লোক বেছে নিতে গিয়ে দেখলাম, কাজটা মোটেই সহজ নয়। ওপরে দেখে তো সবাইকে মানুষ বলেই মনে হয়। কিন্তু এই ক’দিন রিক্তর সঙ্গে থেকে আমার ধারণা পাল্টে গেছে। মানুষ দেখলেই মনে হয়, এটা একটা ছদ্মবেশ। আড়ালে লুকিয়ে আছে কোন রহস্য। লোক বাছতে গিয়ে মহা বিড়ম্বনায় পরে গেলাম। কয়েকদিন কয়েকজন লোককে যথাসম্ভব দেখে গেলাম। কোন অস্বাভাবিক আচরণ নজরে এলোনা কারোরই। মনে হল, এদের সবাই ঠিক ঠিক মানুষ। এদের মধ্যেই একজনকে বেছে নিলে হয়ে যায়। বাছাই করেই সন্দেহ হল, রিক্তর মত দেখার ক্ষমতা নেই আমার। তাই, যাকে বাছাই করেছি সে ঠিক তো ? প্রথমে ঠিক মনে হলেও এখন কেমন সন্দেহ হচ্ছে। হয়তো দেখা যাবে লোকটার দু’টো শিং আছে, কখনো গজায় কখনো লুকিয়ে থাকে। অর্থাৎ লোকটা ঠিক মানুষ নয়। সবার ক্ষেত্রেই এইরকম মনে হতে লাগল আমার। আজ একে বাছি তো কাল বাদ দিই। এই করে করে কাউকে আর বাছাই করা হয়ে ওঠেই না। 

আসলে আমার মধ্যে একটা ভয় ধরে গিয়েছিল। যাকে বাছাই করছি সে যদি ঠিক মানুষ না হয় ? রিক্তর কল্যাণে এই ভয়। তার সঙ্গে এই ক’দিন ঘুরে ঘুরে যাদের দেখেছি তারা সবাই কোন না কোনভাবে অন্যরকম। ওপরে তাদের দেখে কে বলবে তারা ঠিক মানুষ নয় ? কেউ চব্বিশঘন্টা লেগে থাকলেও বলতে পারবে না। একেবারে অতি আপনজনের পক্ষেও কারো গোপন রহস্য জানা প্রায় অসম্ভব। আমি বাজি রেখে বলতে পারি যে গদাধর পাকড়াশির স্ত্রী কিংবা ছেলেমেয়েরা কেউ জানেই না ভদ্রলোকের গোপন ব্যাপারটা। কিন্তু রিক্ত জানে, আর তার কল্যাণে জেনেছি আমি। আসলে এইসব গোপন বিষয় জানতে হলে দরকার বিশেষ চোখ, বিশেষ অনুভুতি। সেটা সবার থাকে না।  

ইন্দ্রায়ুধ মুখুজ্জেকে শেষপর্যন্ত আমি বেছে নিলাম। আমার পাড়াতেই থাকেন। অনেকদিন ধরে লোকটাকে আমি দেখে আসছি। মৌখিক আলাপও আছে তাঁর সঙ্গে। তেমন কিছু দহরম-মহরম ভাব না থাকলেও কোনদিন অস্বাভাবিক কিছু চোখে পড়েনি। বেশ সুপুরুষ, বয়স চল্লিশের কোঠায়। ইঞ্জিনীয়ার। রোজ নিজেই গাড়ি চালিয়ে কাজে বেরোন। সঙ্গে স্ত্রী দ্রোহিনীকে নিয়ে যান। ভদ্রমহিলা সুন্দরী এবং কোন একটা অফিসে চাকরি করেন। তাঁদের কোন ছেলেমেয়ে নেই। পাড়াতে রয়েছে সুন্দর দোতলা বাড়ি। ছুটির দিন ছাড়া রোজ সকালে দু’জনে একই সঙ্গে বেরিয়ে যান, রাতে ফেরেনও একসঙ্গে। বাড়িতে এছাড়া আর কেউ থাকে না। 

দিন কয়েক রিক্ত আর আমি বাইরে বিভিন্ন জায়গায় তাঁদের পিছনে লেগে রইলাম। তেমন কিছুই নজরে এল না। নিয়ম করে অফিসে যাওয়া, অফিস সংক্রান্ত কাজেই অন্য কোথাও ঘোরাঘুরি, এক-দু’দিন কোন হোটেল বা রেস্তোরাঁতে খাওয়া-দাওয়া—- এর বাইরে আর কিছু নেই। রাতে দু’জনে একসঙ্গে বাড়ি ফিরে গাড়ি একতলার গ্যারেজে ঢুকিয়ে দিয়ে ভিতরে চলে যান। আবার পরদিন সকালে একসঙ্গে কাজে বেরোন। তাহলে কি এঁদের কোন রহস্য নেই ? এঁরাই কি ঠিক ঠিক মানুষ ? রিক্ত সহজে হাল ছেড়ে দেওয়ার পাত্র নয়। সে যে কী বোঝে কেজানে ! আমাকে বলল,

‘বাড়ির বাইরে এঁদের কোন রহস্য নেই। এঁদের সব রহস্য রাত্তিরে, বাড়ির ভিতর।’

‘তুই কি ভাবছিস এঁরাও ঠিক মানুষ নয় ?’

আমার প্রশ্ন শুনে রিক্ত দায়সারা ভঙ্গিতে জানাল,

‘মানুষের আসল রূপ কখন প্রকাশ পাবে কেউ জানে না। অন্যের কথা বাদ দে, সে নিজেও অনেক সময় জানে না সে আসলে কে।’

বড়োই গোলমেলে ব্যাপার। বুঝতে চেষ্টা করলে পাগল হয়ে যাব। তার চেয়ে ভাল রিক্ত যা করে তার সঙ্গে তাই করে যাওয়া। আমরা এবার ইন্দ্রায়ুধ ও তাঁর স্ত্রী দ্রোহিনী বাড়ি ফেরার পর সারা রাত কিভাবে কাটান, কোন রহস্যজনক কাজে লিপ্ত হন কিনা সেইদিকে মনোযোগ দিলাম। বড়জোর দু’দিন পরই ঘটনাটা ঘটল। রাত তখন একটা হবে। অনেক আগেই তাঁরা খাওয়া-দাওয়া সেরে শুয়ে পড়েছিলেন। ঘুমিয়েও গিয়েছিলেন অবশ্যই। হঠাৎই ইন্দ্রায়ুধ বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন। ঘরে হালকা নীল আলো জ্বলছিল। তার মধ্যে দিয়ে হেঁটে হেঁটে ভদ্রলোক বাথরুমে গেলেন। আলো জ্বালালেন। বাথরুমের মধ্যে রয়েছে একটা জলভর্তি বাথটাব। ইন্দ্রায়ুধ সেই জলে সারা শরীর ডুবিয়ে শুয়ে পড়লেন। বাথরুমের দরজা খোলাই ছিল। মিনিট পাঁচেকের মধ্যে দ্রোহিনী বাথটাবের পাশে এসে দাঁড়ালেন। তাঁর হাতে একটা বোতল। ছিপি খুলে সেই বোতল থেকে হলদে রঙের কিছু একটা তরল পদার্থ জলে ঢেলে দিয়ে সেখান থেকে চলে গেলেন। গিয়ে আবার নিজের বিছানায় শুয়ে ঘুমিয়ে পড়লেন। আর ওদিকে বাথরুমে কী কাণ্ড ঘটছিল ? ইন্দ্রায়ুধের শরীর একটু একটু করে জলের মধ্যে গলে যেতে লাগল। মনে হচ্ছিল তাঁর শরীরটা যেন চিনির ডেলা। ঘন্টাখানেকের মধ্যে সমস্তটা শরীর জলে গুলে মিশে গেল। ইন্দ্রায়ুধের চিহ্নমাত্র অবশিষ্ট রইল না। বাথটাবের জল যেমন ছিল তেমনই থেকে গেল। জলের রঙ বা পরিমাণের কোন পরিবর্তন ঘটল না। 

ভোরবেলা দ্রোহিনী আবার বাথরুমে এলেন। প্রথমেই বাথটাবের ছিপি খুলে দিলেন। গলগল করে সব জল বেরিয়ে গেল। পরে রইল সাদামতন কী একটা পদার্থ। অন্য একটা বোতল থেকে দ্রোহিনী তাতে সবুজ রঙের তরল ঢেলে দিলেন খানিকটা। সেই থকথকে সাদা পদার্থটা ফুট ফুট করে ফুটতে লাগল। খানিকটা সময়ের মধ্যেই বাথটাবে আবার ইন্দ্রায়ুধ ফিরে এলেন। অবিকল আগের চেহারায়। 

পরদিন রাতে একই কাণ্ড ঘটতে দেখলাম দ্রোহিনীর ক্ষেত্রে। আমরা তারপর আবিষ্কার করলাম যে ইন্দ্রায়ুধ আর দ্রোহিনী সপ্তাহে অন্তত একদিন রাতের বেলায় চার-পাঁচ ঘন্টার জন্য জলের সঙ্গে মিশে যান। এবং এভাবেই তাঁরা বেঁচে থাকেন। 

আমাদের পরবর্তী লক্ষ্য হল রাধামাধব বস্ত্রালয়ের মালিক জনার্দন সাহা। ভদ্রলোক ঘোর সংসারী, পোড় খাওয়া ব্যবসায়ী। কল্পনা-টল্পনা তাঁর ধাতে নেই। চা ভেবে চা-ই খান, মুড়িকে মুড়িই বলেন। আমি মোটামুটি নিশ্চিত ছিলাম যে এই ব্যক্তির ক্ষেত্রে অন্যরকম কিছু ঘটার সম্ভাবনা নেই। এমন কাঠখোট্টা লোক, আবেগ বলে কোন বস্তুর সঙ্গে যাঁর কোন পরিচয় নেই তাঁর ক্ষেত্রে কী আর রহস্য থাকতে পারে ? রিক্ত আমার কথা মন দিয়ে শুনল এবং বলল,

‘একটা কথা তুই বারবার গুলিয়ে ফেলছিস। ওপর দেখে মানুষ চেনা যায় না। মানুষের আসল রূপ একটা অন্য ব্যাপার। সব ধারণা গোলমাল করে দেয়।’

আমি উত্তর দিলাম না, প্রতিবাদ জানাবার কোন কারণ ছিল না বলে। এখন পর্যন্ত যা দেখেছি তাতে আমার কোন ধারণা দাঁড়াতেই পারছে না। রিক্ত যা সন্দেহ করছে মিলে যাচ্ছে যেমন করেই হোক। 

জনার্দনবাবুর তিন ছেলেমেয়ে। বিশাল তিনতলা বাড়ি। স্ত্রী ছাড়াও বাবা আছেন তাঁর। কাজের লোকও আছে একজন। ছেলেমেয়েরা পড়াশুনা করে। স্ত্রী ভদ্রমহিলার দশাসই চেহারা, সবসময় সেজেগুজে থাকেন। আর ব্যবহারও বিশেষ মধুর নয়। সবার সঙ্গে রেগে রেগে কথা বলেন। যেমন স্বামী তেমন স্ত্রী। 

বাড়ির একতলায় গোডাউন। সেখানে কর্মচারীদের আনাগোনা। দোকান বন্ধ করে দশটার মধ্যে বাড়ি ফিরে একতলার একটা ঘরে বসে জনার্দনবাবু ঘন্টাখানেক কর্মচারীদের সঙ্গে কাটান। হিসেবে-নিকেশ করেন। যাই হোক না কেন, রাত বারোটার মধ্যে খাওয়া-দাওয়া ইত্যাদি সমস্ত কাজকর্ম সেরে বাড়ি অন্ধকার করে ঘুমিয়ে পড়েন সবাই মিলে। এটাই নিত্যদিনের নিয়ম। কোন ব্যতিক্রম হয় না। 

বাড়ি তো অন্ধকার হয়ে যায়, তারপর কী হয় ? কী আর হবে, সবাই মিলে অবশ্যই ঘুমিয়ে পড়ে। এটাই স্বাভাবিক। সবাই তাই ভাববে। রিক্তর ভাবনা অন্যরকম। তার ধারণা, বাড়ি অন্ধকার হওয়ার পরই কিছু ঘটে। কী ঘটে সেটাই রহস্য। সেটাই আমাদের দেখার বিষয়। 

তিনতলায় একটা বড় হলঘর আছে। দোতলার সব আলো নিভিয়ে জনার্দন সেই ঘরে উঠে এলেন। সঙ্গে তাঁর তিন ছেলেমেয়ে, স্ত্রী এবং বাবা। একতলার আলো আগেই নেভানো ছিল। সারা বাড়িতে তখন কেবল তিনতলার ঘরেই আলো জ্বলছে। ঘরের দুই প্রান্তের দুই দেয়ালে একটা করে মোটা হুক পোঁতা। শক্তপোক্ত ও লম্বা একটা দড়ির একপ্রান্ত জনার্দন একদিকের দেয়ালে হুকের সঙ্গে বাঁধলেন। দড়ির অন্যপ্রান্ত বাঁধলেন অন্যদিকের দেয়ালটার হুকে। দু’প্রান্তে হুকের সঙ্গে বাঁধা দড়ি টানটান হয়ে রইল। জনার্দন এবার তাঁর সবচেয়ে ছোট ছেলেটাকে কোলে নিয়ে উঁচু করে তুলে ধরলেন। বাচ্চা ছেলেটা দু’হাতে দড়ি আঁকড়ে ঝুলে পড়ল। তাঁর বড়ছেলে আর মেয়ে ওপরদিকে লাফ মেরে মেরে দড়িটা ধরে নিয়ে ঝুলতে লাগল। স্ত্রী দু’হাত তুলেও একটুর জন্য দড়ির নাগাল পাচ্ছিলেন না। জনার্দন কোমর ধরে একটু তুলতেই ভদ্রমহিলা দড়িটা দু’হাত দিয়ে ধরে ফেললেন। তাঁর বাবা পায়ে ডিঙি মেরে দড়ির নাগাল পেয়ে গেলেন। সবশেষে জনার্দন। তিনি প্রথমে ঘরের আলো নেভালেন। চারদিক অন্ধকার হয়ে যেতে প্রথমে কিছুই দেখা যাচ্ছিল না। চোখ সয়ে যাওয়ার পর জনার্দন সতর্ক পায়ে তাঁর বাবার পাশে এসে দু’হাত তুলে একটু চেষ্টাতেই দড়ির নাগাল পেয়ে গেলেন। অন্ধকার হলঘরে সবাই এভাবে দড়ি ধরে ঝুলতে লাগল। মিনিট দুয়েক পর জনার্দনের গলা শোনা গেল। অস্ফুট গলায় তিনি বলছিলেন,

‘হিটিঙ্গা ফিচিফিচি নাটিঙ্গা। নাটিঙ্গা হিচিহিচি ফিটিঙ্গা।’

তারপর দেখা গেল আজব কাণ্ড। জনার্দনের বউ হয়ে গেলেন একটা শাড়ি, ছেলে দু’জন দু’টো শার্ট, মেয়েটা ফ্রক, বাবা ধুতি আর জনার্দন নিজে একটা লুঙ্গি। সারারাত দড়িতে মেলে দেওয়া অবস্থায় ধুতি, শার্ট, লুঙ্গি, ফ্রক আর শাড়ি হয়ে ঝুলতে লাগল জনার্দন সাহার গোটা পরিবার। বাড়ির কাজের লোকটার যে কী হল বা সে কোথায় কিভাবে থাকল তা অবশ্য বোঝা গেল না। 

একসময় রাতের অন্ধকার ফিকে হয়ে এল। পাখিটাখি ডাকতে লাগল। তিনতলার হলঘরে ঘষা কাচের জানলা দিয়ে আলোর আভাষ পাওয়া গেল। বোঝা যাচ্ছিল ভোর হয়ে আসছে। ঘরের ভিতর থেকে অন্ধকার কেটে যেতেই দড়িতে ঝুলন্ত লুঙ্গি হয়ে গেল জনার্দন, ধুতি তাঁর বাবা, শাড়ি আবার স্ত্রী এবং শার্ট ও ফ্রক ছেলেমেয়েরা। দড়ি ছেড়ে দিয়ে ঝুপ ঝুপ করে নেমে এল সবাই মেঝের ওপর। হুক থেকে খুলে দড়িটা জনার্দন ঘরের কোণায় গুটিয়ে রাখলেন। 

এরপর আর কোন পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালাবার ভরসা পাচ্ছিলাম না। রিক্ত আমার অবস্থা বুঝে বলল,

‘আর একটু দেখতে পারিস।’

‘আর দেখে কী হবে ? আমার তো মনে হচ্ছে কেউই ঠিক মানুষ নয়।’

হতাশ গলায় বললাম আমি। রিক্ত আশা দিয়ে জানাল,

‘না রে, আছে। কেউ না কেউ ঠিক মানুষ হতে বাধ্য। তাদের খোঁজ পাওয়াটাই শক্ত কাজ। তবুও তারা আছে। তারা না থাকলে মানুষের চেহারা বরাবরের জন্য অন্যরকম হয়ে থাকত। কোন মানুষকেই তুই মানুষের চেহারায় দেখতে পেতিস না। সে একটা বিচ্ছিরি অবস্থা হয়ে যেত।’

রিক্তর কাছে উৎসাহ পেয়ে ভাবলাম, আরও একটু দেখাই যাক। আবার আরেকজন কাউকে বেছে নিতে হবে। পছন্দ করার দায়িত্বটা আমার ওপরই থাকল। খুব একটা ভাবনা-চিন্তা করতে গেলাম না। হাতের কাছে পেয়ে গেলাম মৌনাক্ষিকে। রিক্তকে বললাম তার কথা।  

মৌনাক্ষি গুহ। একাই ভাড়া থাকে একটা বাড়ির একতলাতে। এই বাড়িতে থাকছে সে তার জন্ম থেকে। বাড়িটা ভাড়া নিয়েছিলেন তার বাবা। তিনি চাকরি করতেন ব্যাঙ্কে। বাবা-মা দু’জনেই মারা গেছেন অন্তত সাত-আট বছর হবে। বাড়িটা ছেড়ে সে অন্য কোথাও যায়নি। বাড়িওয়ালা মাসিমা-মেশোমশাইও তাকে স্নেহ করেন। নিজে মৌনাক্ষি একটা স্কুলে পড়ায়। 

তার তেমন বন্ধুবান্ধব নেই। স্কুলে সহকর্মীদের সঙ্গেও খুব যে ভাব-ভালোবাসা এমন নয়। কারো স্বভাব এরকমই, খুব একটা মিশুকে হতে পারে না। মৌনাক্ষি তাই একা হয়ে আছে। নিজের একাকিত্ব দূর করতে সে অনেকগুলি বেড়াল পোষে। ঘটা করে আবার নাম রেখেছে প্রত্যেকের। কেউ কুচি, কেউ ঘোলা, কেউ হামি, কেউ ঝোলা—- এমনধারা নাম সবার। স্কুল না থাকলে সারাদিন কাটে তার বেড়ালগুলির সঙ্গে। তাদের জন্য সে রান্না করে, খাওয়ায়-দাওয়ায়। গল্পগুজব করেও সময় কাটায়। পাড়ার সবাই মৌনাক্ষিকে চেনে তার বেড়ালগুলির জন্য। 

রিক্ত আর আমি তার অলক্ষে তার পিছনে লেগে রইলাম। অবশ্য লেগে থাকার আর কী আছে ? স্কুলে ছাড়া সে কোথাও যায় না। স্কুলের সময়টুকু বাদ দিয়ে সে বাড়িতেই থাকে সবসময়। প্রথমদিন তার সঙ্গে গেলাম, আবার বাড়ি পর্যন্ত ফিরে এলাম। দ্বিতীয়দিন আবার সে যখন বাড়ি থেকে বেরিয়ে স্কুলের দিকে যাচ্ছে আমরা তার পিছু নিলাম। যেতে যেতে রিক্ত আমাকে হঠাৎ জিজ্ঞেস করল,

‘গতকাল তুই মেয়েটিকে ভাল করে দেখেছিলিস ?’

‘হ্যাঁ।’

একটু অবাক হয়ে উত্তর দিলাম। রিক্ত পাল্টা প্রশ্ন করল,

‘আজকেও ভাল করে দেখছিস ?’

‘দেখছি তো। হয়েছেটা কী ?’

আসলে তুই ওকে ঠিকমত কালও দেখিস নি, আজও দেখছিস না।’

রিক্ত গম্ভীর গলায় তার অভিমত জানাল। আমি উত্তর দিতে গিয়ে একটু রেগেই গেলাম,

‘মানে ? কী বলতে চাইছিস ?’

‘ভাল করে দেখলে তুই বুঝতে পারতিস, কালকের মৌনাক্ষি আর আজকের মৌনাক্ষি এক নয়।’

ব্যাপারটা আমার কেমন গোলমাল পাকিয়ে গেল। হতভম্ব গলায় প্রশ্ন তুললাম,

‘তুই কী করে বুঝলি ?’

‘দেখে। এমনি দেখলে বোঝা যাবে না। মনে হবে একজন মৌনাক্ষিকেই দেখছিস। কিন্তু একজন নয় মোটেও। সূক্ষ্ম একটা পার্থক্য আছে। এইযে অদল-বদল, আমার বিশ্বাসটা ঘরেই হয় এবং রাত্তিরে।’

বাড়ি ফেরার পর সেদিন রাতে আমরা তার ওপর নজর রাখলাম। বেড়ালদের নিয়ে তার ব্যস্ততা চলল রাত ন’টা পর্যন্ত। রান্নাবান্না, গল্পগুজব, খাওয়া-দাওয়া। নিজেও খেয়ে নিল সে। বেড়ালদের সঙ্গে নিয়ে টিভিও দেখল কিছুক্ষণ। রাত দশটা নাগাদ ঘুমোবার আয়োজন করল। বেড়ালদের শোওয়ার জন্য খাট আর বিছানারও ব্যবস্থা আছে। সবাইকে তাদের বিছানায় শুইয়ে দিল। তারপর কুচি নামের বেড়ালটাকে তুলে নিল তাদের মধ্যে থেকে। কুচিকে নিয়ে সে শুয়ে পড়ল নিজের বিছানায়। দেখা গেল, সে জড়িয়ে ধরে আছে কুচিকে এবং কুচিও তার সামনের দু’টো পা দিয়ে তাকে ধরে রাখল। তারপর দেখা গেল একটা রূপান্তর প্রক্রিয়া। মৌনাক্ষি আস্তে আস্তে কুচি হয়ে গেল আর কুচি পাল্টে গেল মৌনাক্ষির চেহারায়। এই কাণ্ডের পর দু’জনেই ঘুমিয়ে পড়ল। 

পরদিন মৌনাক্ষি বেড়াল হয়ে বাড়িতে থেকে গেল আর তার চেহারা নিয়ে কুচি চলে গেল স্কুলে। বিকেলে বাড়ি ফেরার পর মৌনাক্ষিরূপী কুচি অন্য বেড়ালদের নিয়ে মাতামাতি করতে লাগল, যেমন দেখেছিলাম আগের রাতে। রাত দশটার পর মৌনাক্ষি, অর্থাৎ কুচি অন্য বেড়ালদের তাদের বিছানায় শুইয়ে দিয়ে ঘোলাকে নিয়ে এল নিজের সঙ্গে। তারপর আবার সেই রূপান্তর প্রক্রিয়া। ঘোলা পেয়ে গেল মৌনাক্ষির শরীর আর কুচি হয়ে গেল ঘোলা। পরদিন মৌনাক্ষিরূপী ঘোলাই গেল স্কুলে পড়াতে। 

আমার কেমন সব তালগোল পাকিয়ে গিয়েছিল। রিক্তর কাছে জানতে চাইলাম,

‘রোজ রাতেই তো পরিবর্তন ঘটে যাচ্ছে। একেকটা বেড়াল পেয়ে যাচ্ছে মৌনাক্ষির শরীর। কোন্ বেড়ালটা ছিল আসল মৌনাক্ষি, যেখান থেকে এই পরিবর্তনের সূচনা ?’

রিক্ত কিছুটা হতাশ ভঙ্গিতে জানাল,

‘আসল মৌনাক্ষি হারিয়ে গেছে। হারিয়ে গেছে তার বেড়ালদের মধ্যেই। তাকে আর কোনদিন খুঁজে পাওয়া যাবে না।’  

অধ্যায় : তিন

এবার আমার সত্যি সন্দেহ হচ্ছে, আমিও ঠিক মানুষ কিনা। হয়তো নিজের অগোচরেই আমি অন্যকিছু।

আমার মধ্যে যেসব উদ্ভট ব্যাপার ঘটে চলেছে এগুলিকে কোনভাবেই স্বাভাবিক বলা যায় না। এসব তো মানুষের লক্ষ্মণ নয়। যদি আমি সত্যিই মানুষ না হই তো কী করা উচিত ? এমন কোন ব্যবস্থা আছে কি যার আশ্রয় নিলে মানুষ নয় এমন কেউ মানুষ হয়ে যেতে পারে ?

ধরা যাক, আমি সত্যিই মানুষ নই। মানুষের ছদ্মবেশ নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছি। এখানে দু’টো প্রশ্ন আছে। আমার এই গোপন রহস্যটা আমি নিজেই কেন জানি না ? যদি আমি মানুষ না হই তো আসলে কী ? এই দ্বিতীয় প্রশ্নটা বেশি গোলমাল পাকিয়ে দিল। মানুষ না হলে কী হতে পারি ? জন্তু-জানোয়ার হওয়ার কোন সম্ভাবনা নেই। রাক্ষস-খোক্কস, ভূত-প্রেত অথবা অপদেবতা এমনও বলতে পারি না নিজেকে। ভিনগ্রহীও হব না অবশ্যই, কারণ নিজেই জানি পৃথিবীতেই আমার বসবাস। কোনজন্মে অন্য কোন গ্রহে-টোহে ছিলাম বলে জানিনা। তাহলে আমি কী ?

কলম ধরেছিলাম নিজের সমস্যাগুলি বলব বলে। সমস্যা অথবা বিপদ। এখন দেখছি নতুন আরেক বিপদ জুটল কপালে। নিজেকেই নিজে চিনতে পারছি না। নিজের কাছেই নিজের পরিচয়টা অস্পষ্ট। তাহলে এতক্ষণ যাদের কথা বললাম তারাও কি আমার মতোই বিপদগ্রস্ত ? তারা কি তাদের অন্যরকম অস্তিত্ব সম্পর্কে সচেতন ? নাকি তারাও তাদের আসল পরিচয় হাতড়ে বেড়াচ্ছে ?

আজকাল আমি আর কোন মানুষকেই মানুষ বলে ভাবতে পারি না। কাউকে দেখলেই মনে হয় সে আসলে অন্যকিছু, মানুষ সেজে আছে। অথবা কেউ হয়তো এখন মানুষ, কিন্তু যেকোন সময় অন্যকিছু হয়ে যাবে। ব্যাপারটা এমন দাঁড়াল যে কারো সঙ্গে প্রাণ খুলে কথা বলতে পারি না। মনে হতে থাকে, যার সঙ্গে কথা বলছি সে মানুষ তো ! মানুষ হোক বা না হোক, আমার ক্ষতিবৃদ্ধির কোন ব্যাপার নেই। বোঝাতে চেষ্টা করি নিজেকে। কিন্তু ভিতরে কী যে একটা কাঁটা খচ খচ করতেই থাকে, তাকে ভুলতে পারি না। 

এমনিতেও যে লোকজনের সঙ্গে আমার মেলামেশা বা যাদের দেখছি রাস্তায় নামলে অথবা যাদের কথা শুনিটুনি তারা সবাই মানুষ হলেও স্বভাবে বা আচরণে হামেশাই অন্যরকম হয়ে যায়। কোন মানুষের চেহারা বা চালচলন দেখে তাকে প্রায়ই অচেনা মনে হয়। কারো সম্পর্কে আমরা বলেও থাকি যে অমুক ব্যক্তি কেমন পাল্টে গেছে। চেনা লোককে প্রায়ই বিশেষ কারণে অচেনা মনে হতে থাকে। সেসব তো আছেই। আমি নিজেকে বোঝাবার চেষ্টা করলাম, এই যে কোন পরিচিত ব্যক্তির কারণে-অকারণে চেহারা-চরিত্রের অপরিচিত প্রকাশ এটাওতো কম বিস্ময়কর নয়। অথবা করোও চারিত্রিক স্খলন, যাকে যা ভাবতে পারি না তার তা হয়ে যাওয়া, যাকে যেমন ভাবি তার তেমন না হওয়া, এসব বিষয়ওতো প্রতিমুহূর্তে প্রমাণ করছে যে প্রত্যেকেরই অন্যরকম প্রকাশ রয়েছে। তাহলে আমি ব্যাপারটাকে নিয়ে কেন এত ভাবছি ?

সকালবেলাতেই বাড়ির সামনে রাস্তায় চেঁচামেচি। যদুপতি বাজারের ব্যাগ হাতে নেমেছে রিকশা থেকে। রিকশাচালকের সঙ্গে ভাড়া নিয়ে তার ঝগড়া। চালক বলছে, ভাড়া এগারো টাকা। যদুপতি দশ টাকার বেশি দেবে না কিছুতেই। একটাকার জন্য তুলকালাম কাণ্ড। প্রায়ই হয় এমন। যদুপতি রিকশায় চাপবে আর ভাড়া নিয়ে সব রিকশাচালকের সঙ্গেই ঝামেলা পাকাবে। চালক যা ভাড়া বলবে সবসময় যদুপতি তার চেয়ে একটাকা কম দিতে চাইবে। ওই একটাকা নিয়ে রিকশাচালকের সঙ্গে ঝামেলা হবেই হবে। এটা চেনা দৃশ্য। এই যদুপতিরই আবার অন্যরকম একটা চেনা চেহারা আছে। রোজ অফিসে যাওয়ার সময় স্টেশনের পাশে কালীমন্দিরের সামনে দাঁড়িয়ে সে যুক্তকরে প্রণাম করবে। তারপর পকেট থেকে একটাকা বার করে প্রণামী বাক্সে ফেলে দেবে। দু’টোই চেনা দৃশ্য, তবুও চেনা যায় না। 

বাজারে হরিপদ মুরগির মাংস বিক্রি করে। পোল্ট্রি মুরগির দোকান। খাঁচায় থাকে মুরগিগুলো। বটি নিয়ে নিজেই বসে হরিপদ। খদ্দের এসে দাঁড়ায় আর সে কচাৎ-কচাৎ করে মুরগির গলা কাটে। গলাকাটা মুরগিগুলির ছটফট করতে থাকা শরীর পা চাপা দিয়ে সে মাংস কাটতে থাকে। সকাল-বিকেল দু’বেলাই সে দোকান খোলে। ভাবলেশহীন মুখে মুরগির গলা কেটেই যায়। রাতে ঘুমোবার আগে বসে বসে হিসেবে-নিকেশ করে। সারাদিনের বেচাবিক্রির হিসেব। সে নাহয় হল। কিন্তু হিসেব শেষ করেও কেন সে ঘুমোতে যায় না ? অন্য একটা খাতা নিয়ে কী আবার লিখতে বসে ? অন্য কোন হিসেব ? এই অন্য হিসেবের কথা একমাত্র হরিপদই জানে। সে জানায় না কাউকে। সংকোচে অথবা ভয়ে। কারণ, ঘুমোবার আগে সে কবিতা লেখে। হিসেব মেলে না। 

চন্দ্রিকার ছিল পুতুল খেলার শখ। ছোটবেলায়। শখ না বলে নেশা বলাই উচিত। পুতুল ছিল দু’-চারটে। তাদের সে রোজ সাজাত-গোজাত, খাওয়াত, স্নান করাত, ঘুম পাড়াত। তাদের সঙ্গে কথা বলত, খেলা করত। এই নিয়ে মায়ের কাছে রোজ বকুনি খেত বেচারা। পড়াশুনা পড়ে থাকত, মা কিছু কাজ করতে বললে ফাঁকি দিত, এমনকি স্কুলেও যেতে চাইত না। ওই এক পুতুল খেলার নেশায়। তার মা তাকে আর পুতুল কিনে দিত না। দোকানে রঙ-বেরঙের কত কত পুতুল ! সে কান্নাকাটি করত, বায়না ধরত। মা শুনত না। বাবাও ছিল কড়া ধাতের লোক। তার কাছে আবদার করার সাহস পেত না। চন্দ্রিকা ভাবত, বড় হয়ে সে দোকানের সব পুতুল কিনে নেবে। সারাদিন কেবল পুতুল খেলবে। সেই চন্দ্রিকা এখন বড় হয়েছে। তার মেয়ের নাম ইত্রিশা। সে এখন স্কুলে পড়ে। সকাল আটটায় স্কুলে যায়, ফেরে বিকেল পাঁচটায়। স্কুল থেকে ফিরে ঘন্টাখানেক ঘুমোয়। ঘুম থাকে উঠে ইত্রিশা খেলতে চায়। তার শোকেস ভর্তি প্রচুর পুতুল। সবই জন্মদিনের উপহার। চন্দ্রিকা মেয়ের কথায় কান দেয় না। ঘুম থেকে তুলেই তাকে পড়াতে নিয়ে বসে। পুতুলরা শোকেসে থেকে যায়। ইত্রিশা সজল চোখে তাদের দিকে তাকায়, ভয়ে ভয়ে, মাকে লুকিয়ে। তার মা ভীষণ কড়া। সব পড়া তৈরি না হলে রেহাই নেই। পুতুল খেলবে কখন ইত্রিশা ? সে জানে না তার মা চন্দ্রিকার ছোটবেলাটা কেমন ছিল। ওইসময়ে মাকে তো সে দেখেনি। আর মেয়েকে নিজের ছোটবেলার সব গল্প শোনায় নি চন্দ্রিকা, বিশেষ করে নিজের পুতুল খেলার গল্প। পড়িয়েই সময় পায় না, গল্প শোনাবে কখন ?

কিছু কিছু লোক আছে যারা সঙ্গে থাকলে স্বচ্ছন্দে সময় কেটে যায়। রত্নেশ তেমনই একজন। সে থাকলে আর কারো কথা বলার দরকার হয় না। অনুকৃতি জানে, প্ৰায়ণ জানে, সবাই জানে যে রত্নেশ সঙ্গে থাকলে ঘন্টার পর ঘন্টা আড্ডা মারে জোরসে। কথা ফুরোতেই চায় না। বাড়িতে আসর জমিয়েই হোক বা পথেঘাটে হাঁটতে হাঁটতে। সপ্তাহে না হোক মাসে অন্তত এক-দু’বার দেখা হত ওদের। অনুকৃতি আর প্ৰায়ণ যেত তার বাড়িতে, তাদের বাড়িতেও আসত সে। কত যে বিচিত্র বিষয় নিয়ে গল্প হত তাদের ! তারপর একদিন রত্নেশ কর্মসূত্রে হঠাৎ শহরের বাইরে চলে গেল। দূরে গেলে যোগাযোগও ক্ষীণ হয়ে যায়। রত্নেশের আর কোন খবর পাওয়া যাচ্ছিল না। প্ৰায়ণ আর অনুকৃতি কখনো-সখনো নিজেদের মধ্যে বলে রত্নেশের কথা। দেখতে দেখতে কেটে গেল কয়েক বছর। চারপাশে অনেক কিছু পাল্টে গেল। তারপর একদিন হঠাৎই আবার রত্নেশ ফিরে এল শহরে। সে নিজেই যোগাযোগ করল অনুকৃতি আর প্ৰায়ণের সঙ্গে। নিজের বাড়িতে যেতে নেমন্তন্ন করল তাদের। একদিন সময় করে তারা দু’জনে গেল রত্নেশের বাড়ি। ঘন্টাখানেক থাকল। এই এক ঘন্টা সময় তাদের কাছে দুর্বিষহ হয়ে গেল। তারা দেখল, রত্নেশ কথা বলতে ভুলে গেছে। সেই যে তার আড্ডা মারার অফুরন্ত দম তা আর নেই। এখন সে কথা বলে থেমে থেমে, সাজানো-গোজানো কথা। সে আর আগের মত নিজে থেকে অনর্গল কথা বলতে পারে না। তাকে কথা বলাতে হয়। বললেও একটি-দু’টি কথা বলেই সে চুপ করে যায়, বেশি বলার কিছু খুঁজে পায় না।

অনেকদিন পর দৃকের সঙ্গে আবার দেখা হওয়ার পর নির্লিপ্তার মনে হল, দেখা না হলেও ভাল হত। কারণ, ‘কেমন আছো’, ‘ভাল আছি’, এইরকম মাপা মাপা ভদ্রতা বিনিময় করেই তাদের কথা ফুরিয়ে যাবে ভাবা যায়নি। দৃক তাদের বাড়িতেই মানুষ, জন্ম থেকে। দাদা থাকত দেশের বাইরে, বউদি ছেলেমেয়ে নিয়ে তাদের সঙ্গে। বাচ্চা বয়স থেকেই তার নিজের মায়ের চেয়েও নির্লিপ্তা তার বেশি আপন। পিসিমণিকে সে চোখে হারাত। বাইরে কোথাও গেলে নির্লিপ্তার হাত ধরে দৃক, ঘরে থাকলেও তার পিছন পিছন ঘুরঘুর। মায়ের সঙ্গে ঝগড়া পর্যন্ত করত সে পিসিমণির পক্ষ নিয়ে। নির্লিপ্তার বন্ধুরা তার চেয়ে দৃককেই বেশি চিনত। তাকে ফেলে নির্লিপ্তা কোথাও গেলে সে মুখ অন্ধকার করে বসে থাকত পথের দিকে তাকিয়ে। বউদি তারপর চলে যায় দাদার কাছে, দৃক হোস্টেলে। নির্লিপ্তারও বিয়ে হয়ে যায়। সাংসারিক কারণে দাদার সঙ্গে সম্পর্কের অবনতি হয়। তবুও নির্লিপ্তা ভাবত, দৃক সেই ছোট্টবেলার দৃকই আছে, যদিও যোগাযোগ প্রায় ছিলই না। তার ভুল ভাঙ্গে চাকরি পেয়েও দৃক যখন তাকে জানায় না, খবরটা সে শোনে অন্যের কাছে। আর এতদিন পর দৃককে মুখোমুখি দেখে নির্লিপ্তা বোঝে যে ফেলে আসা ওই সম্পর্কটা জাদুঘরে চলে গেছে। 

ঘরে যে লোকটা চরিত্রবান সেজে থাকে আর বউকে সারাক্ষণ শোনায় সে কতটা ধন্য এমন স্ত্রী পেয়ে, সেই ব্যক্তি দেখি বাইরে গিয়ে অন্য মহিলার মন ভেজাতে বলে যাচ্ছে তার স্ত্রী তার জীবনটা তছনছ করে দিয়েছে। যে লোকটা পকেটমারকে পেটায়, চোরকে ধরে, তাকে কি দেখছি না ঘুষ খেতে ? আজকে যে লোকটা একরকম কালকে তার আরেকরকম হয়ে যাওয়ার ঘটনা তো ঘটে চলছে হরদম। এসব দেখে প্রায়ই যদি মনে হয়, যাকে এখন দেখছি তাকে সত্যিই তখন দেখেছি কিনা বা যাকে দেখে আসছি সেই লোকটিকেই দেখছি কিনা তাতে কি খুব একটা দোষ দেওয়া যায় ? মানুষের পরিচিতি বড়ই গোলমেলে ব্যাপার, এতদিনে এটাই বুঝতে পারলাম যে কাউকে আমি চিনি বলে বড়াই করতে পারি না। 

হরেনের মুদিখানার দোকান। দুই ছেলেমেয়ে। ছেলে সোমেন বড়, মেয়ে কাকলি ছোট। দু’-আড়াই বছরের তফাৎ। হলে কী হবে, সোমেন তার বোনকে খুবই ভালবাসে। তাকে ভাল খাবার দিলে আগে সে বোনকে খাওয়ায়। পুজোয় তার নিজের জামাকাপড় হোক না হোক বোনের জন্য নতুন জামা-জুতো কেনা হল কিনা তাই নিয়ে সে ব্যস্ত থাকে। ছোটবেলায় সে বাবা-মায়ের কাছে বায়না ধরত বোনকে এই পুতুল সেই পুতুল বা খেলনা কিনে দিতে। বড় হওয়ার পরও তার এই ভালবাসা অটুট ছিল। নিজের হাতখরচ বাঁচিয়ে সে বোনের জন্য নানা জিনিস কিনে আনত। মেয়ের বিয়েতে হরেন যা খরচ করবে ভেবেছিল তার চেয়ে বেশি খরচ করে ফেলল, কারণ তার ছেলে। সোমেনের দাবি মেনে গয়নাগাটি ও অন্য উপঢৌকন বাড়াতে হল, জাঁকজমক ও খাওয়া-দাওয়ার আয়োজনও কম করা গেল না। দুর্ভাগ্যক্রমে বোনের বিয়েটা টিঁকল না। তিন বছরের মাথায় কাকলি শ্বশুরবাড়ি ছেড়ে হরেনের বাড়ি চলে এল। সঙ্গে তার দু’বছরের একটি ছেলে। হরেন আর কী করে, মেয়ের জন্য বাড়ির একতলায় দু’খানা ঘর নির্দিষ্ট করে দিল। মেয়ে যাতে চাকরি পায় তার জন্য এক-দু’লাখ টাকা খরচ করে কোন একটা কোর্স করাতে লাগল। ততদিনে সোমেনেরও বিয়ে হয়ে গেছে। চাকরিও জুটিয়েছে একটা। একদিন গভীর রাতে সে তার বউকে বলল,

‘বাবা তো দেখছি কাকলিকে সবই দিয়ে দেবে। আমাদের জন্য কী আর থাকবে ? বাড়ির একতলাটা তো গেল, দোকানটাও না যায়! একটা বুদ্ধি করেছি শোন। তুমি এখন থেকে বাবার সঙ্গে দোকানে গিয়ে বসো। বাবার বয়স হয়েছে, তুমি বলবে যে তুমি তাকে সাহায্য করবে দোকানে থেকে। আমি পারব না, চাকরি আছে। কিন্তু তোমাকে গিয়ে দোকানে বসতে হবে, দোকানটার দখল রাখতে হবে।’

হরেন ছেলে আর ছেলের বউয়ের কথা মেনে নিল। সন্ধের পর ছেলের বউ তার সঙ্গে দোকানে বসতে লাগল। সোমেন এখন নিশ্চিন্ত। দোকানটা তার দখলে থেকে যাবে এভাবেই। বোন সেটা দাবি করতে পারবে না কোনদিন। আর এভাবেই পুরোনো সোমেন এখন অন্যরকম সোমেন হয়ে গেল। ভেঙেচুরে গুঁড়ো গুঁড়ো হয় জীবনের সূচনালগ্ন। 

কেউ অন্যরকম হয়ে যায় কোন এক নির্দিষ্ট প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে, কেউ আবার যখন-তখন অন্যরকম। রিমঝিম বোঝে না দু’দিন পর পর কী হয় সিক্তার। আলাপ তাদের অনেকদিনের। সিক্তার বিয়ে হয়নি, হবে বলেও মনে হয়না। এনজিও-টেনজিও অনেককিছু করে বেড়ায় সারাদিন। কোনটাই তেমন কাজের কাজ নয়, তবে সবসময় এমন ভাব দেখায় যেন সে জগতে সবচেয়ে ব্যস্ত কেউ। এর সঙ্গে চেনা, ওর সঙ্গে চেনা, শুনলে মনে হয় উত্তর থেকে দক্ষিণ মেরুর মধ্যে যত দেশ আছে সব দেশের লোক তাকে চেনে। এত ব্যস্ত এবং সময়ের এত অভাব হলেও সে নিজেই রিমঝিমকে যখন ফোন করে কথা ফুরোতেই চায় না। রিমঝিমের নিজের সংসার আছে, সে সত্যি ব্যস্ত হলেও সিক্তার সঙ্গে আড্ডা মারার সুযোগ পারতে ছাড়ে না। সময় করে কোন কাফেতে বা রেস্টুরেন্টে যায় দু’জনে, আবার সিক্তা তার বাড়িতেও আসে। এটা হল সিক্তা যখন চেনা চেহারায় থাকে তার কথা। হঠাৎ সে একদিন নোটিশ না দিয়ে অচেনা হয়ে যায়, রিমঝিম ফোন করলে ধরে না, পরে কলব্যাকও করে না। রহস্যজনকভাবে সে চুপ করে থাকে, কোন যোগাযোগ রাখে না রিমঝিমের সঙ্গে। এক-দু’মাস, কখনও বা তারও বেশি সময় এভাবে হারিয়ে থাকে, আবার একদিন নিজেই যোগাযোগ করে। 

করুণাশিসবাবুকে সবসময় হাসিখুশিই দেখতাম। খুব আমুদে মানুষ, অচেনা লোকের সঙ্গেও ভাব জমাতে ওস্তাদ। আমরা আবার তাঁর উৎসাহের বহর দেখে মাঝেমধ্যে বিরক্তও হতাম। মেজাজ তো সবসময় সবার প্রসন্ন থাকে না, হতেই পারে কখনো কেউ ঠাট্টা-ইয়ার্কি করার মত অবস্থায় থাকত না। সেসব ভ্রূক্ষেপ ছিল না তাঁর। সবাইকে নিয়ে মজা করেই যেতেন। এই স্বভাবের জন্য পিছনে অনেকে তাঁর সমালোচনাও করত। কেউ কেউ আবার তাঁকে এড়িয়েও চলত। সেই করুণাশিসবাবুকে কয়েক মাসের ব্যবধানে কিছুদিন আগে দেখে অবাক হয়ে গেলাম। ভদ্রলোক হাসতে ভুলে গেছেন। কেউ কথা বললেও তিনি কথা বলতে চান না। চুপচাপ, গম্ভীর হয়ে গেছেন। একজন প্রাণবন্ত লোক কিভাবে এমন নীরব হয়ে যেতে পারেন মাথায় ঢোকে না। 

এভাবেই সব মানুষকে চলাফেরা করতে দেখছি সবসময়। তাদের চেনা চেহারা কখনো অচেনা হয়ে যায়, কখনো অচেনা চেহারা চেনা-চেনা ঠেকে। কেউ ঘরে একরকম, বাইরে অন্যরকম। কারো চেহারা ব্যক্তি বা স্থান বা সময়বিশেষে পাল্টে পাল্টে যায়। একেক পরিস্থিতিতে একেকরকম। লোকেরা পাল্টে যায় জানা ছিল, কিন্তু কী আকৃতি ধারণ করতে পারে জানতাম না। যতই অন্যরকম হোক না কেন, ভাবতাম মানুষ সবসময় মানুষই থাকে। রিক্ত আমাকে দেখিয়ে দিল একটা অন্য জগৎ। মানুষ কতভাবে অন্যরকম হয়ে যায় এবং কতভাবে তার সেই বিচিত্র প্রকাশ ঘটায় এসব আমি কল্পনাও করতে পারতাম না। আগে আমি জানতাম যে সবাই ঠিক মানুষ, আর এখন আমি বুঝেছি যে জীবনে একজনও ঠিক মানুষ দেখিনি। ঠিক মানুষ সত্যিই কি কেউ আছে ? ক্রমশ এই সন্দেহ বদ্ধমূল হতে চলেছে। এটা আমার জন্য ভাল না খারাপ বুঝতেও সমস্যা হচ্ছে। তবে কেমন যেন হতাশা গ্রাস করেছে আমাকে। গোড়াতেই তার কথা উল্লেখও করেছি। এতকিছুর মধ্যে এটুকুই আশার কথা যে রিক্ত বলেছে, কেউ না কেউ ঠিক মানুষ সত্যিই আছে। রিক্তর কথা অবিশ্বাস করার কারণ নেই বলেই ভরসা পাই। সে যে আমার চেয়ে অনেক বেশি খোঁজখবর রাখে তা তো প্রমাণিত সত্য। 

রহস্যের অন্য আরও দিক আছে, সেটাও আমি জানতাম না। রিক্ত জানত, আর আমাকে একদিন বলল,

‘এমনও হতে পারে, তুই যাকে দেখছিস সে হয়তো অন্য কেউ, সে নয়।’

‘সে তো দেখলামই, মৌনাক্ষি বেড়াল হয়ে গেছে, বা বেড়াল হয়ে গেছে মৌনাক্ষি।’

রিক্ত বাধা না দিয়ে শুনল আমার কথা। তারপর ধীরস্থির ভঙ্গিতে বলতে লাগল,

‘ব্যাপারটা ঠিক তা নয়। মানুষরা সব ঠিক মানুষ নয় সেটা তো তুই দেখেছিস। এই বিষয়টা তোর আর বোঝার বাকি নেই। আমি এখন সেই প্রসঙ্গটা বলছি না। তোকে বলতে চাইছি আরেকটা নতুন বিষয়। এখানে মানুষ অন্যকিছু বা অন্যরকম হয়ে যায় না। মানুষরা মানুষই থাকে, পরিচয়টা ওলোট-পালোট হয়ে যায়। আমাকে হয়তো তুই রিক্ত বলে জানিস, কিন্তু আমি আসলে রিক্ত নই। আমার মধ্যে ঢুকে বসে আছে অন্য কেউ।’

আমার সব গোলমাল হয়ে যেতে লাগল। চোখমুখ দেখে রিক্ত আমার অবস্থাটা বুঝতে পারল। থেমে গিয়ে সময় দিল আমাকে ধাতস্থ হওয়ার জন্য। সে থামতেই আমি সপাটে প্রশ্ন করলাম,

‘তাহলে তুই রিক্ত কোথায় আছিস ?’

‘আমি হয়তো অন্য কোন পরিচয়ে আছি।’

‘যেখানে খুশি থাক্। তোকে যখন তোর চেহারায় দেখছি, তাকে তুই ভাবতে সমস্যাটা কী ? আমার জেনে কী লাভ আসল তুই কার মধ্যে ঢুকে আছিস ?’

রিক্ত চিন্তিত গলায় বলল,

‘লাভক্ষতির ব্যাপার নয়। বিষয়টা অন্য। তুই রেগে যাচ্ছিস। আমি তোকে জোর করতে চাই না। কেবল জানাচ্ছি যে মানুষের মধ্যে অনেকরকম রহস্য আছে। মানুষ যে পাল্টে অন্যকিছু হয়ে যায় তাই নয়, অন্যকিছু না হয়ে সে শুধু তার পরিচয়টা পাল্টে নিতে পারে। বিশ্বাস করবি কি করবি না সেটা তোর ব্যাপার।’

আমার উষ্ণতা কমে গিয়েছিল। বললাম,

‘বিশ্বাস করব না কী রে ! হান্ড্রেড পার্সেন্ট বিশ্বাস করছি। কিন্তু ব্যাপারটা গোলমেলে ঠেকছে। বুঝিয়ে দে, বা দেখিয়ে দে।তাহলে আর অস্পষ্ট থাকবে না।’

‘বুঝিয়ে দিতে পারি। মনে করতে পারিস, তুই জন্ম থেকে একজনকে জানিস ভুবনবাবু বলে। আর একজন আছে রবিনবাবু। তাকে তুই চিনতে পারিস বা না পারিস। একটা সময় পর ভুবনবাবু হয়ে গেল রবিনবাবু, আর তুই জানতেও পারলি না পরিবর্তনটা। ভুবনবাবু তারপর থেকে রবিনবাবু হয়েই বাঁচতে লাগল। কেউ ব্যাপারটা টেরই পেল না। এই পরিবর্তনের পর সবাই যাকে রবিনবাবু বলে ভাবল সে আসলে ভুবনবাবু।’

‘রবিনবাবু গেল কোথায় ?’

‘এই ব্যাপারটাই গোলমেলে। রবিনবাবু পারস্পরিক বোঝাপড়ায় ভুবনবাবু হয়ে যেতে পারে, আবার না-ও পারে।’

‘কিন্তু তাকে তো কোথাও যেতেই হবে, ভুবনবাবু তো তার মধ্যে ঢুকে গেছে !’

‘সে না যেতেও পারে, যেমন ছিল তেমন থেকে গেলেও ক্ষতি নেই। আবার সে দরকার হলে অন্য কেউ হয়ে যেতে পারে। সেটা যে ভুবনবাবু হতেই হবে এমন নয়।’

গোটা ব্যাপারটা হজম করতে একটু সময় নিলাম। রিক্ত সেই সুযোগটা দিল। নানা প্রশ্ন জাগছিল মনে। জিজ্ঞেস করলাম,

‘ভুবনবাবু তো রবিনবাবু হয়ে গেল। কিন্তু ভুবনবাবুর চেহারা নিয়ে কে থাকল ?’

‘বোঝাপড়া থাকলে রবিনবাবু চলে আসবে। এখানটা একটু গোলমেলে। ভুবনবাবু নিজেও থেকে যেতে পারে দু’জায়গায়। তৃতীয় অন্য কেউও আসতে পারে।’

‘এই ব্যাপারটা কি প্রত্যেকের জীবনে একবারই ঘটে ?’

‘একদমই না। কারো জীবনে বারবার, এমনকি দিনে কয়েকবারও ঘটতে পারে ঘটনাটা। নিজের মধ্যে যখনই আমার থাকতে ভালো লাগে না আমি তখন ভুবনবাবু, রবিনবাবু, মধুবাবু, হরিবাবু ইত্যাদি নানাজন হয়ে যেতে থাকি। ঘুরে ঘুরে দেখি কোথায় থাকতে ভাল লাগে। কার মধ্যে যাব তার কোন বাধা নেই। বিখ্যাত-অখ্যাত যে কোন লোকের মধ্যেই যেতে পারি। কেউ এভাবে ঘন ঘন অন্য লোকের মধ্যে গিয়ে আশ্রয় নেয় বা নিজেকে অন্য লোকের সঙ্গে পাল্টে নেয়। আবার কেউ হয়তো একবারই জীবনে এমন পাল্টাপাল্টি করে। যাই হোক না কেন, প্রত্যেকের জীবনে এই ঘটনা ঘটবেই। একবার বা হাজারবার। কেউ নিজেকে সম্পূর্ণ পছন্দ করে না। ভুবনবাবু হয়ে যায় রবিনবাবু বা মধুবাবু বা হরিবাবু বা যোগেনবাবু। চলতেই থাকে পাল্টাপাল্টি। কেউ সারাজীবন কেবল ভুবনবাবু হয়ে বাঁচে না।’

বুঝলাম। কিন্তু এই ব্যাপারটা ঘটে কিভাবে ?’

‘সেটা না দেখলে বুঝবি না। সবসময় দেখে যে বোঝা যাবে তারও কোন গ্যারান্টি নেই, কারণ কেউ হয়তো যদুবাবু হয়ে গেল, সারাজীবন থেকে গেল যদুবাবু হয়েই। তাকে দেখতে তোরও সারাজীবন কেটে যাবে। এসব দীর্ঘস্থায়ী পরিবর্তন। তবে ক্ষণস্থায়ী পরিবর্তন ঘটেই চলেছে। সেসব দেখা যেতেই পারে। দেখলেই বুঝবি কিভাবে ঘটে।’

রিক্তকে নিয়ে শুরু করতে চলেছি এবার এক নতুন অনুসন্ধান। এবার আমরা দেখব কিভাবে মানুষে মানুষে পাল্টাপাল্টি চোখের সামনে ঘটে চলেছে সবার অজান্তে।      

অধ্যায় : চার

আমার অসুখগুলির কথা বলছিলাম। আর সেই কারণে কী কী বিপদ মোকাবিলা করতে হচ্ছে। 

একটি-দু’টি নয়, নানারকম উদ্ভট অসুখের শিকার হয়েছি আমি। নাম জানিনা কোনটারই। লক্ষ্মণ দেখে বুঝি। একেবারে মাল্টিপল ডিজিজ সিনড্রোম। কার কথা ছেড়ে কার কথা বলি ? সবগুলোর কথাই বলা উচিত। আবার ভাবি, এত এত অসুখের ঘ্যানঘ্যানানি শুনতে কার ভাল লাগে ? তবুও কয়েকটির কথা তো বলতেই হয়। বিশেষ করে, যেগুলি খুব বেশি ভোগাচ্ছে অহোরাত্র। 

আমার ঘন ঘন রঙ পাল্টে যাচ্ছে। এই অসুখটা প্রথম দেখা গিয়েছিল আমার মধ্যে। তারপর এতদিনে এর প্রকোপ কিছুমাত্র কমেনি। বেড়েছে কিনা বলতে পারব না। অসুখটা বেশ কাবু করে রেখেছে আমাকে। যখন-তখন এর ধাক্কায় আমি বিপর্যস্ত হয়ে পড়ি। অপদস্থও হতে হয় যথেষ্ট। রঙ পাল্টে যাওয়ার ব্যাপারটা কি ভাল ? গায়ের রঙের কথাই ধরা যাক। বাড়ি থেকে বার হওয়ার সময় দেখলাম রঙটা কালো, বাড়ি ফেরার পর দেখি লালরঙা হয়ে গেছি। ব্যাপারটা বোঝাতে পারলাম কি? মনে হচ্ছে, এটুকু শুনে কেউ বুঝতে পারছে না এই রঙ পাল্টে যাওয়ার মধ্যে কী বিপদ থাকতে পারে। বরং অনেকেই ভাববে, এতে তো বেশ মজাই আছে। একটা কথা বলে রাখছি, রঙ পাল্টানো মানে গায়ের রঙই হবে তা না-ও হতে পারে। তবে কেবল গায়ের রঙের কথা ভাবলেও ব্যাপারটা বিশেষ সুবিধের নয়। এই আমার রঙ হলুদ, দেখতে দেখতে রঙ পাল্টে আমি সবুজ হয়ে গেলাম। এক-আধবার এমন ঘটলে মজা পেলেও পাওয়া যেতে পারে। কিন্তু এমন ব্যাপার যদি ঘটতেই থাকে এক নাগাড়ে ? আর এই রঙ পাল্টে যাওয়া যদি আমার ইচ্ছের বিরুদ্ধে হয়ে যায় ? মনে করি, ব্যাপারটা আমার ইচ্ছের বিরুদ্ধে ঘটছে না। আমি যখন-তখন স্বেচ্ছায় নিজের রঙ পাল্টে ফেলতে পারছি। যদি তাই হয় তো সেটাও কি সুখের কথা ? আমি কি আমাকে সুস্থ বলে দাবি করতে পারি ? মুশকিল হল এই যে আমার রঙ পাল্টানোটা স্বেচ্ছায় না অনিচ্ছায় ঘটছে সেটাই আমার কাছে পরিষ্কার নয়। কেবল দেখছি রঙ পাল্টে যাচ্ছে। কেন যাচ্ছে কিভাবে যাচ্ছে তার কোন ব্যাখ্যা নেই। রঙ পাল্টে যাচ্ছে, এটুকুই জানি। আর এই অশান্তির কোন শেষ নেই। কী অশান্তি তা সব না বললে বোঝা যাবে না। 

এটা এক ঘোরতর বিপদ, আমার জন্য। এই রঙ পাল্টে যাওয়াটা। আমাকে এভাবে রঙ পাল্টাতে দেখে সবাই অবাক হয়, আবার ভ্রূ কোঁচকায়। আমার বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তোলে কেউ কেউ। প্রশ্ন তো রয়েছে আমার নিজের মধ্যেও। এটা কি কোন প্রাণির স্বাভাবিক ধর্ম ? এই ঘন ঘন রঙ পাল্টিয়ে যাওয়া ? যদি অন্যদেরও দেখি ঘন ঘন রঙ পাল্টায় তো আশ্বস্ত হতে পারি। তাহলে সব মানুষকে দেখে যেতে হয়। ক্রমাগত দেখলে বোঝা যাবে, রঙ পাল্টানোর ব্যাপারটা অন্যদের ক্ষেত্রেও ঘটছে কিনা। সেটা অবশ্য অন্য প্রসঙ্গ। যদি দেখি অন্যদের মধ্যেও রঙ পাল্টানোর অভ্যেসটা রয়েছে তাতে কি আমার বিপদ কাটবে ?

প্রথম প্রথম আমি বুঝতেই পারিনি যে আমার ঘন ঘন রঙ পাল্টিয়ে যাচ্ছে। নানাজনের মুখে অভিযোগটা শুনতাম, বিশ্বাস করতাম না। তারপর একদিন বুঝতে পারলাম যে অভিযোগটা মিথ্যে নয়। নিজের রঙ পাল্টানোর বহর দেখে নিজেই অবাক হয়ে গেলাম। নিজের ওপর নিজে নজর রাখতে লাগলাম। সবাই এভাবে নিজেকে দেখে কি ? দেখুক না দেখুক আমার কিছু যায়-আসে না। আমি নিজের কথাটাই বলছি। নিজেকে গভীর পর্যবেক্ষণে রেখে বুঝতে পারলাম যে আমি রঙ পাল্টাই। এই কাজটাতে আমার অসম্ভব দক্ষতা। ব্যাপারটা আবিষ্কার করার পর খুশি হব না দুঃখ পাব বুঝতে পারলাম না। এভাবেই কেটে গেল বেশ কিছুদিন। নিজেকে নিজে গবেষণা করে। আর এখন আমি নিশ্চিত যে এটা আমার একটা অসুখ। 

আরও কিছু অসুখের প্রাদুর্ভাব দেখা যাচ্ছিল আমার মধ্যে। মাথা ঘামাতে লাগলাম। এক এক করে সবগুলি অসুখের চরিত্র বোঝা গেল। এদের কেমন চেহারা সে সম্পর্কে কিছু কথা বলা দরকার। 

একটা অসুখ হল, আমি যা-তা কথা বলে ফেলছি। অধিকাংশ সময় দেখা যাচ্ছে, যা বলতে চাইছি তা বলা হল না, যা বলার কথা ভাবছি না তা মুখ দিয়ে বেরিয়ে আসছে। মনে আমার কী আছে লোকেরা তা দেখে না, মুখে যেটা বলছি সেটাই ধর্তব্য হয়ে যায়। মুখ দিয়ে যদি ভাল কথা বার হয় তো ভাল, আর মন্দ কথা বার হলে হয়রানির একশেষ। মুশকিল হল এই যে একবার খারাপ কথা বলে ফেললে তা আর পাল্টানো যায় না। পঞ্চাশটা ভাল কথা বললে লোকেরা শোনে না, কিন্তু একটা মন্দ কথা বললেই সবাই ঠিক শুনে নেয়। একবার খারাপ কী বললাম সেটাই লোকে মনে রাখে, হাজারটা ভাল কথা বললেও তাকে ঢাকা যায় না। উল্টোপাল্টা কথা বলে ফেলার অসুখটা খুবই ভোগাচ্ছে আমাকে। মনে হয়, এর চেয়ে কথা বলতে না পারা ভাল ছিল। যেসব প্রাণি কথা বলতে পারে না তারা এদিক থেকে বেশ নিরাপদ। আমি নিজেও জানি না কেন মুখ থেকে এমন সব কথা বেরিয়ে যায় যা কাউকে চটিয়ে দেবে। অন্যকে চটিয়ে দেওয়ার মত কথা বলে আমার কিছু লাভ হয় কিনা তাও বুঝি না। কেবল যে অন্যকে চটিয়ে দেওয়ার কথা বলি এমন নয়, মুখ থেকে তেমন কথাও বেরিয়ে আসে যা অস্বাভাবিক, যা কোন অস্থিরতা তৈরি করতে পারে, কোন বিপর্যয় ঘটাতে পারে। না, এসব কথা বলে আমার কোন উপকার হয় না। তাহলে কেন বলি ? আমার নিজেরই তা বোধগম্য নয়। আসলে এটাই তো অসুখ। 

 প্রায় এমনই আরেকটা অসুখ হল, আমি যা নয় তা খেয়ে ফেলছি। খাওয়ার জিনিস নির্দিষ্ট। মানুষ স্বাদ বুঝে খায়। সেভাবেই খাদ্যাভ্যাস তৈরি হতে থাকে। কিন্তু এমন যদি হয়, কেউ হাতের কাছে যা পাচ্ছে বাছবিচার না করে খেয়ে ফেলছে ? রাক্ষসরা শুনেছি এমন করে থাকে। তাদের নামটা এজন্যই, আর ওই নাম তাকেই দেওয়া যার তেমন স্বভাব। আমাকে কি রাক্ষস বলা যেতে পারে ? আসলে যেমন আমার খাওয়ার প্রকৃতি তাতে রাক্ষস বললেও কিছু বাকি থেকে যায়। রাক্ষসের খাবারে পরিমাণগত দিকটা বিবেচ্য। আমার খাওয়াতে পরিমাণের ব্যাপারটা প্রধান নয়। এমন সব বিষয় আমার খাদ্য তালিকাতে চলে আসছে যে নিজেই দেখে চমকে যাচ্ছি। কী না খাচ্ছি আমি ? নিজের এবং অন্যের ভবিষ্যৎ, বর্তমান, সুখস্বাচ্ছন্দ্য ইত্যাদি কোনকিছুই বাদ পড়ছে না। এমনসব জিনিস আমি অক্লেশে খেয়ে ফেলছি যাতে দেশের ও দশের বারোটা বেজে যায়। মানুষ সর্বভুক প্রাণি। সেই হিসেবে সে যা খুশি খেতে পারে। তাতে দোষের কিছু নেই। কিন্তু খাবার নয় এমন কিছু, ধরাছোঁওয়া যায় না এমন কিছু খেতে পারা যায় বলে শুনিনি। আমি তো সেই বিচারে মানুষও হতে পারছি না। রাক্ষসও নই, মানুষও নই, আমি তাহলে কোন্ আজব বস্তু ? নিজেকেই তো নিজে চিনে নিতে পারছি না। 

অন্য একটা অসুখও আমাকে খুব ভোগাচ্ছে, আর তা হল আমি যেখানে-সেখানে চলে যাচ্ছি। অনেকেই এটাকে অসুখ বলবে কিনা সন্দেহ আছে, তবে আমি মনে করি, এটাও আমার একটা অসুখ। রাতে ঘুমোলাম আমার বাড়িতে, সকালে ঘুম ভাঙলে দেখলাম আছি মাধববাবুর বাড়িতে, এটা কি খুব সুখের ? যাচ্ছি দিল্লিতে, পৌঁছোবার পর দেখা গেল জায়গাটা মুম্বাই, ব্যাপারটা মোটেই সুবিধের হবে না। অথবা এমন ঘটনাও ঘটতে দেখেছি যে কোথাও যেতে না চাইলেও চলে যাচ্ছি। যাওয়ার কথা হয়তো ভাবছিও না, তবুও দেখছি, যেখানে থাকার কথা সেখানে থাকছি না। উপস্থিতি নিয়ে সবসময় একটা বিপর্যয় ঘটে যাচ্ছে। এতে লোকের কাছে আমার বিশ্বাসযোগ্যতা সম্পর্কে প্রশ্ন উঠছে। আমি কে, কখন কোথায় থাকব সেটা যেমন কেউ বুঝতে পারছে না তেমনি আমিও অনিশ্চয়তায় ভুগছি। নিজেকে আজব আজব সময়ে এমন সব আজব আজব জায়গায় হাজির থাকতে দেখছি যে আমি যেমন চমকে যাচ্ছি সংশ্লিষ্ট লোকেরাও বেসামাল হয়ে পড়ছে। এসব কি মানুষের কাজ ? মানুষের মত দেখতে কেউ যদি এমন অমানুষিক কাণ্ড করতে থাকে তো তাকে তার অসুখ বলাটা কি অন্যায় হবে ? আসলে কেউ বিশ্বাস করতে চাইবে না যে এসব কাজ একান্তই আমার অনিচ্ছাকৃত। এই কারণে আমার বিপদ অন্যকে বুঝিয়ে উঠতে পারছি না। 

এই যে অসুখটার কথা বললাম, যেখানে-সেখানে চলে যাওয়ার অসুখ, এর আনুষঙ্গিক একটা উপসর্গও আমাকে ব্যতিব্যস্ত করে তুলেছে। হতেও পারে এটা সম্পূর্ণ অন্য একটা অসুখ। চুলচেরা বিচার করে বলতে পারব না, এটার সঙ্গে আগে বলা অসুখটার কোন সম্পর্ক রয়েছে কিনা। কিছু কিছু ক্ষেত্রে দু’টোর উপসর্গে মিল পাওয়া যেতেও পারে। সেসব তুলনা-টুলনার  ব্যাপার পরে হবে, আগে অসুখটার কথা বলা যাক। আমি যখন-তখন অনুপস্থিত হয়ে যাচ্ছি। এই আমি আছি, এই আমি নেই। একদল লোকের সঙ্গে বসে হয়তো জমিয়ে গল্পগুজব করছি, হঠাৎ সবার চোখের সামনে থেকে অদৃশ্য হয়ে গেলাম। ভৌতিক কাণ্ড বলেই ভাববে সবাই। তারপর ওইসব লোকেরা যদি আমাকে আবার দেখতে পায় ? পরিস্থিতিটা আমার এবং তাদের জন্য খুব একটা উল্লাসের হবে কি ? এটাকেও অনেকেই অসুখ বলে মানতে নারাজ হলেও হতে পারে, কিন্তু এর জন্য ভুগতে তো হচ্ছে আমাকেই। কেন এটা অসুখ হবে না ? 

নিজের ওপর আস্থা না থাকলে যা হয়, ওপরে বলা রোগগুলি তারই উদাহরণ। নিজেকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারছি না বলেই কখন কী করে ফেলব নিজেও জানিনা। এটাও একটা অসুখ, যা-তা করে ফেলছি যখন-তখন। তাই কিছু করতে গেলে ভাবনা-চিন্তা দরকার, মানুষ ভেবেচিন্তেই কাজ করে। পরিণামের কথা খেয়াল না রেখে কাজ করে কে ? কিন্তু এমন রোগ হয়েছে আমার যে দুমদাম উল্টোপাল্টা কিছু করে ফেলছি। তাতে হামেশাই নানারকম গণ্ডগোল পাকিয়ে যাচ্ছে। এমন সব ঝামেলা পাকিয়ে যায় যে মনে হয় আর বাঁচার উপায় নেই। যা-তা কাজ করে ফেলার কথা বললে শেষ হওয়ার নয়। অকারণে হয়তো কাউকে মেরে বসলাম, হয়তো করোও ঘরে আগুন লাগিয়ে দিলাম—- এমনই সব সৃষ্টিছাড়া কাজকর্ম। কেন করছি কোন ব্যাখ্যা নেই। কাজগুলি করে কোন আনন্দও পাই না, দুঃখ হয় এমনও নয়। করে ফেলি কোন এক অজ্ঞাত কিছুর তাড়নায়। এটা অবশ্যই একটা অসুখ, কারণ আমি আমাকে এসব ক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারি না এবং অস্বাভাবিক আচরণের শিকার হই। 

এগুলি সব আমার ছোটখাটো খুচরো অসুখ, একটি-দু’টি ছাড়া। এদের মধ্যে জবরদস্ত অসুখ হল ঘন ঘন রঙ পাল্টানোর ব্যাপারটা। অন্য অসুখগুলি আমাকে ভোগায়, কিন্তু তত বড় আকারে নয়। সবচেয়ে বড় কথা যে অসুখগুলির মধ্যে পারস্পরিক একটা সম্পর্কও রয়েছে। হামেশাই দেখি, একটার সঙ্গে আরেকটা কোন না কোনভাবে জড়িয়ে যাচ্ছে। উল্টোপাল্টা কিছু করে ফেললাম বা বলে ফেললাম তো লোকেরা রেগে যায় আর তখন আমি অদৃশ্য হয়ে যেতে পারি। এতে আমার উপকারই হয়। লোকেরা আর আমার নাগাল পায় না। কিন্তু মুশকিল হল এই যে সবসময় সবকিছু আমার ইচ্ছেমত ঘটবে তার কোন গ্যারান্টি নেই। অনেকসময় দেখেছি, বেকায়দায় পড়লেও আমি অদৃশ্য হয়ে যেতে পারছি না। আবার অন্যক্ষেত্রে হয়তো এমনসময় অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছি যে আরও বেশি সমস্যা সৃষ্টি হচ্ছে। তবুও বলব, এইসমস্ত অসুখগুলো তুলনামূলকভাবে কম প্রবল যতটা না রঙ পাল্টানোর অসুখটা। পরে নাহয় এর কথা বিশদে বলা যাবে। তার আগে বরং এর মত বা এর চেয়েও জবরদস্ত আরেকটা অসুখের কথা বলি। বৈচিত্রে আর প্রাবল্যে এই অসুখটাও কিছু কম যায় না। 

আমার ঘন ঘন চেহারা পাল্টে যাচ্ছে। 

এই ঘন ঘন চেহারা পাল্টে যাওয়ার ব্যাপারটার মধ্যে যে কত রকমফের রয়েছে তা না বললে বোঝা যাবে না। প্রথমেই বলা যাক লিঙ্গভিত্তিক চেহারা পাল্টানোর কথা। হয়তো আমি বাড়ি থেকে বার হলাম গোঁফদাড়িওয়ালা পুরুষ, রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছি সুস্থভাবে, হাঁটতে হাঁটতেই একসময় বুঝতে পারলাম যে আমি মহিলা হয়ে গেছি। মহিলা মানে নিখাদ মহিলা। এ যে কী বিপর্যয় তা বলে বোঝাতে পারব না। পুরুষ থেকে মহিলায় রূপান্তর তো ঘটে গেল হঠাৎ, নাম-ধামের কী হবে ? তো মহিলা হয়ে গেলাম তো মহিলা হয়েই যদি থাকতাম তাহলেও কিছু একটা ব্যবস্থা করা যেত। আবার দেখি, মহিলা থেকে কোন একসময় পুরুষে রূপান্তর ঘটে গেছে। কখনো আবার মাঝামাঝি অবস্থাতেও থেকে যাই। লোকেরা আমাকে নিয়ে মজা করবে কী, কাণ্ড দেখে চমকে চমকে যায়। আমিও খাবি খেতে থাকি। নিজেই বুঝতে পারি না কখন ছেলে হব আর কখন মেয়ে হব, কখন বা দু’টোর মাঝামাঝি অবস্থায় থেকে যাব, আর ছেলে বা মেয়ে যা-ই হই না কেন হলেও ওই অবস্থায় কতক্ষণ থেকে যাব। ছেলে থেকে মেয়ে বা মেয়ে থেকে ছেলে বা তাদের মাঝামাঝি চেহারায় আমার রূপান্তর যখন-তখন ঘটে যাচ্ছে। একেবারেই বেসামাল অবস্থা। কোনকিছুই নিয়ন্ত্রণে থাকছে না। এমনও ঘটনা ঘটছে যে ঘন্টায় ঘন্টায় লিঙ্গভিত্তিক রূপান্তর হয়ে চলেছে। আমি নিজেও নিশ্চিতভাবে বুঝতে পারছি না আমি কে, ছেলে না মেয়ে নাকি তাদের মাঝামাঝি কোনও একজন। এটা যে কোন্ চরিত্রের অসুখ কেউ বলতেও পারছে না। 

ঘন ঘন চেহারা পাল্টানোর এইতো গেল এক অবস্থা। এর অন্য প্রকারভেদও আছে। একটা হল বয়সভিত্তিক চেহারা পাল্টানো। ব্যাপারটা নিঃসন্দেহে গোলমেলে। মনে করি, আমি একজন যুবক, হঠাৎ দেখি হয়ে গেছি পাঁচ বছরের এক বাচ্চা, বা তারও চেয়ে ছোট সদ্যোজাত এক শিশু। তা এভাবে কমবয়সী হয়ে যাওয়াটা মন্দ নয়। অনেকেই ভাববে আশীর্বাদ। কিন্তু এর যে উল্টো দিকটাও আছে ? নিজেরই অজান্তে হঠাৎ আবার দেখি কখন চেহারা পাল্টে হয়ে গেছি আশি বছরের এক বৃদ্ধ। যখন-তখন এভাবেই বয়স পাল্টাতে থাকে আমার। এই আমি বৃদ্ধ তো পরক্ষণেই যুবক, যুবক থেকে আবার হয়ে গেলাম প্রৌঢ় বা বালক বা বাচ্চা, আবার হয়তো বৃদ্ধ। কখন কী হবে কোন ঠিকঠিকানা থাকে না। ব্যাপারটা আমার হাতে নেই। মুশকিল হল, আসলে আমি যুবক না শিশু নাকি বৃদ্ধ তা নিজেই জানি না। আবার এই বয়সভিত্তিক চেহারা পাল্টানোর সঙ্গে জুড়ে যায় লিঙ্গভিত্তিক রূপান্তর। তখন পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে ওঠে। শুরু করলাম হয়তো নব্বই বছরের বৃদ্ধ থেকে, ঝটাস করে হয়ে গেলাম এক যুবতী, সেখান থেকে চেহারা পাল্টে হলাম হয়তো এক কিশোর, তারপর আবার হয়ে গেলাম হয়তো এক প্রৌঢ়া মহিলা বা একটি বাচ্চা মেয়ে। এইসব পরিবর্তন যদি গোপনে ঘটত তা-ও নাহয় কথা ছিল, জনসমক্ষে ঘটে যায় বলেই হয়রানির একশেষ। সবার চোখের সামনে যদি আমি কখনো ছেলে কখনো মেয়ে, কখনো শিশু কখনো বৃদ্ধ হয়ে যেতে থাকি তো ব্যাপারটা কেমন হবে অনুমান করা খুব একটা কঠিন নয়। 

চেহারা পাল্টানোর এই রোগটা আমাকে এমন পেয়ে বসেছে যে কোথায় গিয়ে থামবে কেজানে ! এর দু’টো প্রকারভেদের কথা বললাম। অন্যরকম প্রকাশও আছে। একেবারে সৃষ্টিছাড়া ব্যাপার। বলে কাউকে বিশ্বাস করানো শক্ত। আমি নিজেও বিশ্বাস করতাম না যদি নিজেই না শিকার হতাম। মানুষ হিসেবেই আমি কেবল চেহারা পাল্টাই না, চেহারা পাল্টে অন্য প্রাণিও হয়ে যাই। 

জানি সবাই বলবে, আজগুবি ব্যাপার। কিন্তু ব্যাপারটা সত্যি ঘটছে। হামেশাই আমি হাতি, ঘোড়া, কুকুর, জিরাফ, সাপ, হনুমান হয়ে যাচ্ছি। আমার এই মানুষের চেহারাটা বেমালুম পাল্টে যায় যখন-তখন। মনে করি, গরু হয়ে গেলাম। দেখে তখন কেউ বুঝবে না কোনকালে আমি মানুষ ছিলাম। গরু হলাম তো আগাগোড়া গরুই হয়ে গেলাম, মানুষের ‘ম’-ও থাকবে না চেহারাতে। আচরণটাও হবে গরুর মতোই। গরুর মত ঘাস খাব, জাবর কাটব, ‘হাম্বা-হাম্বা’ ডাকব। এভাবে যেকোন প্রাণি হয়ে যেতে পারি যখন-তখন। এই হয়তো বাঘ হয়ে গেলাম, দু’-চারটে পশু শিকার করে খেলাম, তারপরই দেখা গেল গণ্ডার হয়ে গেছি। তখন আবার বাঘের আচরণ ভুলে গণ্ডারের মত কাজকর্ম শুরু করে দেব। কেন, কখন, কিভাবে মানুষের চেহারা থেকে অন্য কী হব নিজেও জানিনা। পাল্টে যেতে পারি যেকোন জন্তু-জানোয়ারের চেহারাতেই, কোন বাছ-বিচার নেই। এখানে আমার পছন্দ কাজ করে কিনা পরিষ্কার নয়। এই হয়তো মানুষ থেকে হাতি হয়ে গেলাম, পরক্ষণেই চেহারা পাল্টে ইঁদুর বা মাছ। মাছেরও আবার নানা ধরন আছে। যে কোন রকম মাছই হতে পারি—- রুই, কাতলা, কই, বোয়াল, ইলিশ ইত্যাদি। মাছ হওয়ার একটাই মুশকিল, জল চাই। তো এদিক থেকে আমার এই চেহারা পাল্টানোর রোগটা বেশ সমজদার। কোন ডাঙার প্রাণি থেকে মাছ-টাছ জলচর প্রাণি হওয়ার সময় সে বুঝে বুঝে কাজ করে। কখনও আমাকে সমস্যায় ফেলে না। মাছ বা হাঙড় যাই হোক না কেন, হওয়ার সময় হিসেব করে দেখে নেয় কাছাকাছি পুকুর, খালবিল আছে কিনা। হঠাৎ মরুভূমির মাঝখানে উট হয়ে গেল ইলিশ মাছ, এমন ঘটনা কোনদিনও ঘটেনি। তেমন ঘটনা ঘটলে কি আর এই বিবরণ লেখার সুযোগ পেতাম ? তাই বলছি, চেহারা পাল্টানোর ব্যাপারটা যতই বেয়াক্কেলে হোক না কেন, তার মধ্যে কিছু হলেও একটা কাণ্ডজ্ঞান আছে। 

মানুষের চেহারা পাল্টে আমার কেবল নানারকম জীবজন্তু হয়ে যায়, এমন নয়। অন্য কিছুও হতে পারে। যেমন, মাছ বললাম এক্ষুনি। এছাড়া ব্যাঙ, কেঁচো, পোকামাকড়, কী না হতে পারি ! হয়েছিও এমন অনেক কিছু। মাছি হয়েছি, মশা হয়েছি, আরও কতসব কীটপতঙ্গ। চেহারা পাল্টানোর চক্করে আমি নাজেহাল। কী হইনি বলা শক্ত। পাখিও হয়েছি কতরকম—- কাক, শালিক, বাজ, শকুন, চড়ুই। কিসের থেকে কখন কোন্ চেহারা পাব বোঝা মুশকিল। 

মানুষের চেহারা পাল্টে অন্য প্রাণি বা জীবজন্তু হয়ে যাওয়ার সঙ্গে আবার লিঙ্গ বা বয়সভিত্তিক ব্যাপারটাও যুক্ত হতে পারে। হলাম হয়তো মানুষ থেকে একটা ছাগল, সেখান থেকে একটা কুমিরের ছানা, তারপরই হয়তো হয়ে গেলাম একটা ময়ূরী। আমার চেহারা পাল্টানোর এত বৈচিত্র্য আর ঘনঘটার বহর ভাবলে বা দেখলে নিজেরই মাথা ঘুরে যায়, অন্যের কথা কী আর বলব !

এভাবেই আমার চেহারা ঘন ঘন পাল্টে যাচ্ছে। এর পিছনে কী কারণ বা কোন নিয়মকানুন আছে কিনা  জানিনা। রহস্যটা রহস্যই। তবে ব্যাপারটা নিঃসন্দেহে বিপজ্জনক এবং অবশ্যই একটা রোগ। মানুষের চেহারা পাল্টে পাল্টে সাপ-ব্যাঙ অথবা ইঁদুর-বাঁদর হয়ে যাওয়া কি ভাল ? মানুষ কখনো পুরুষ কখনো মহিলা হয়ে যাবে, এটাও স্বস্তির কথা নয়। আমাকে দেখে বোঝা যাবে না আমি কখন বৃদ্ধ থাকব বা কখন বাচ্চা হব, এমন ব্যাপারও কেউ পছন্দ করবে না। এই চেহারা পাল্টে যাওয়ার অসুখটা সব শান্তি কেড়ে নিয়েছে। আমার মধ্যে জন্ম দিয়েছে বিপুলায়তন এক নৈরাশ্য। ঘন ঘন রঙ পাল্টে যাওয়ার মতোই এর চরিত্র, বা তার চেয়েও বোধহয় বেশি ভয়ঙ্কর। আবার এই দু’টো রোগের মধ্যে যোগসূত্র আছে। ঘন ঘন চেহারা পাল্টাবার সঙ্গে সঙ্গে বা আগেপরে ঘন ঘন রঙও পাল্টাতে থাকে। 

মানুষ হয়ে বাঁচার আনন্দটাই আমার হারিয়ে গেছে। এতসব রোগের কারণে। মানুষ যদি মানুষই থাকে, সরল সাদাসিধে মানুষ, তার মত সুখ আর কোথায় আছে ? ঘন ঘন আমার রঙ পাল্টে যাবে এটা মোটেই ভাল কথা নয়। আমার খাদ্যাখাদ্য গরমিল হয়ে যাবে, কী করব না করব তার কোন ঠিক থাকবে না, বিচরণক্ষেত্র অনিশ্চিত হবে—- এর কোনটাই আমাকে শান্তি দিতে পারে না। আমি মানুষটা হঠাৎ অন্য কোন পোকামাকড়, জীবজন্তু হতে যাব কেন? যদি পরিস্থিতি আমাকে তেমন কিছু হতে বাধ্য করে তো তার চেয়ে বড় কোন অসুখ আর কী হতে পারে ? 

(পরবর্তী অংশ আগামী সংখ্যায়)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *