হিরণ্ময় গঙ্গোপাধ্যায়
মন খারাপ হলেই, কী আশ্চর্য, বাগানে এলেই ফুরফুরে হয়ে যায় গাঙ্গুলি। পাখি প্রজাপতির ওড়াউড়ি, চোখখোলা রাতচরা ফুল, দিনের ফুল পাপড়ি গোটায়, পত্রপল্লবফুলফলে সবুজ চরছে, রাঙারঙিন কিড়ামাকড়ার সরসরানি—সারা বাগানে জেগে ওঠা-ঘুমিয়ে পড়ার আয়োজন। এইসব সাবেকি কাজকারবার বড়ো জোর আর বছর কতক, আশঙ্কিত গাঙ্গুলি মোবাইলে ফটো তুলে রাখে, কলকাকলির রেকর্ডও করে। পুরনো সব দৃশ্যশব্দগন্ধের ধারণাগুলো ধীরে ধীরে লুপ্ত হয়ে নবতর কনসেপ্টে প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে, এবং সেটাই পৃথিবী।
সমস্ত পৃথিবী মানুষের উপযোগী করতে এত এত বিপ্লবপ্রতিবিপ্লব, এত এত উদ্ভাবনবিধ্বংস একটি তত্ত্বেই থমকে আছে —যত যত জঙ্গল পিছিয়ে যাবে, ততদূর আমার ভুবন।
একটা মানুষের জন্য কত জমি লাগে?
মানুষকে সভ্য সমাজ দিতে কতটা জমি অধিগ্রহণ করতে হয়?
মানুষের বাড়ি লাগে,
উঠোন লাগে,
ঘর থেকে বেরোনোর রাস্তা লাগে,
রাস্তা থেকে রাস্তায় যেতে রাস্তা লাগে,
ইস্কুল লাগে,
কলেজইউনিভার্সিটি লাগে,
হাসপাতাল লাগে,
ক্লাবমদভাটিকারখানাঅফিসকাছারিজেলখানাসংসদআলবালছাল কত কী লাগে…
—রোদবৃষ্টিজ্যোৎস্নাও লাগে!
—সেই জন্যই ত বলছি কাকা…
মোহনলাল পঞ্চায়েতের প্রধান, অনভ্যাসের রিভলভিং চেয়ারে গোটা বডিটাই রেখে দাঁত বার করে, তুমরা ত তিনটি প্রাণী, ১৯ একর জমি…
—তিনজনের জন্য ত অনেকটাই বেশি, না?
—নিজের জন্য কিছুটা রেখে ত বিলিয়ে দিতে পার।
গাঙ্গুলির ডান হাত আপনিই চলে এসেছে গালে, কপালে চিন্তাজনিত রেখাবলী, ঘাম হতে পারছে না এয়ারকন্ডিশনার হাই ফেজ, চোখ ঊর্ধ্বমুখী।
জুলাই শেষের তালস্তমালবনরাজিনীল আশমানে দুদস্যি রোদ শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ঘরের জানলায় ঠোক্কর মারছে, রাতে তো এখানেই শুতে পারিস?
—নাকি,
—ঘরেও এয়ারকন্ডিশনার?
—না কাকা…
অক্ষমতায় কুঁকড়ে যাচ্ছে ভাইপোটি, সবার কপালে সবকিছু থাকে না কাকা…
—বুদতাল্লে কাকা ,
—আমাদের পাটি…
—গুড়িয়ে দাও,
—উড়িয়ে দাও, ভাট স্লোগান দেয় না,
—জবরদখল নাই,
—উচ্ছেদ, বর্গা কিছুই নাই…
—থাকলে,
—সত্যি, কাকা, তোমার জমি দখল করতাম।
—তোদের পার্থ চ্যাটার্জিদের অত অত ফ্লাট বাড়ি কোটি কোটি টাকা…
—কেষ্টর অত অত জমিজায়গা মিল টাকা…
—দিদি না হয় চটি পরেই কাটিয়ে দিল…
—ভাইপোর …
—আমার সব জমি,
—হাসতে হাসতে দিয়ে দেবো…
—টাকাগুলোকেও জবরদখল কর তবে,
—বুঝব তোরা মরদ!
—অইত, সবেতেই তুমরা পাটিপলিটি টান!
—পাটিপলিটি কই, ইটা ত নিউজ,
—ইকোনোমিক্স।
—ইডির নিজস্ব এলাকা।
মোহনলাল, গ্রাম পঞ্চায়েতের প্রধান, আদালতের হেরিফেরি ঘটলেও না ঘটলেও ফির নির্বাচন হলেও মোহনলালই প্রধান, এমনি দাপটে ঘোরানো চেয়ার ঘুরিয়ে উঠে দাঁড়ালো।
—ভাইপ?
—বুথ ক্যাপচার করেছিলি?
—না কাকা, ফ্রেস পোল,
—সিপিএমের যেমন নাইন্টি ফাইভ পার্সেন্ট ভোট ছিল, আমাদেরও নাইন্টি ফাইভ পার্সেন্ট ভোট।
—ছাড়ো লচরপচর,
—যদি ধান রুয়ার মেশিন কিনবে, ফরম লাও।
—তুমি ত এখানের ভোটার পর্যন্ত না,
—তবু লিখে দুব,
—রেসিডেনসিয়াল সাটিকপিটিক।
—আমাদের পাটি উন্নয়ন চায়,
—বেঙ্গলের।
গাঙ্গুলি কৃষি বিভাগের একটি লিফলেট উল্টে যাচ্ছে, যেমন কোনো বই পড়তে গেলে করে, ইম্পর্টেন্ট লাইনের তলায় দাগ মারা, মোহনলালের টেবল থেকে কলম তুলে করছিলো : “কৃষি শ্রমিকের শহরমুখী ও ভিনরাজ্যে গমণ বা বিভিন্ন কর্মনিশ্চয়তা প্রকল্পে বিকল্প কর্মসংস্থানের সুযোগের জন্য কৃষি শ্রমিকের অপ্রতুলতা, ধানরোপণের কাজ সুসম্পন্ন করা কৃষকের মাথা ব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়ায়।”
—লিয়ে যাও। মোহনলাল গুচ্ছের লিফলেট টেবিলে রাখে, ঘরে পড়বে।
—পড়ার আবার ঘরবার।
—পড়ার আছেটাই বা কি!
—তোদের পাটিটা হোমো-ইরেকটাস স্টেজে,
—বুদ্তাল্লি?
—হাঁরে ব, গাঁয়ের খেতমজুরগুলা গুরগাঁও চেন্নাই কেনে পালাচ্ছে, বলবি?
—ধান রুয়ার মেশিন,
—কাকা…
—কিনে লাও সিক্সটি পার্সেন্ট সাবসিডি।
—ছাড়ো পলিটিক্স …
—দেড় লাখ টাকায় পাচ্ছো সাড়ে তিন লাখের মেশিন।
—প্রশ্নটার উত্তর দে, খেতমজুরগুলো…
—আইনত তুমি পাও না,
—তুমি এখানের ভোটার না…
—তাহালে দিসনা।
গাঙ্গুলি লিফলেটটির লাস্ট পেজে, “চাষবাস এখন একটা ফোনকলের অপেক্ষামাত্র।”
—তোদের কৃষিমন্ত্রক জিন্দেগিতে চাষ দেখেছে?
—স্বচক্ষে?
—তাহালে ধানরুয়া মেশিন লিচ্ছ নাই?
— না-ন্না, তা কেনে,
—লুব।
—একটা পাম্পসেটও সাবসিডিতে পাওয়াই দে।
—ধান কাটা,
—ধান ঝাড়া,
—যা যা আছে সব লুব।
—কত পার্সেন্ট দিবে?
—২৪-এ ভোট আসছে…
—একটু অনেস্ট হ’।
—সব কি অনেস্টিতে হয় কাকা?
—তোদের জমানায় সব না-হওয়াই ত হচ্ছে।
মিটিমিটি হাসে মোহনলাল, কাকা কৃষক বন্ধুর টাকা বাপ বেটা বউ মিলে ত বছরে তিরিশ হাজার মারছ!
—সে ত আমার বুদ্ধিতেই?
—দুর্বুদ্ধি…
—দুর্বুদ্ধিটাও ত লিচ্ছ?
—তাহালে, প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনায় একটা ঘর পাওয়াই দে…
—কত কমিশন দিবে ?
—বল?
—ফিফটি ফিফটি।
—আমি কিন্তু ঘরফর বানাবো না।
—কে বলেছে বানাতে?
—একটা ইঁটাও গাঁথবো না।
—কে গাঁথতে বলেছে?
—ফাঁসবো না ত?
এই রকম একটি স্টেজে আসতে গাঙ্গুলির কতগুলো বিপ্লব প্রতিবিপ্লবের সিঁড়ি টপকাতে হয়েছে গাঙ্গুলি বলতে পারবে না। বলতে না পারাটাই মেটাফিজিক্স এবং ভায়োলেন্স। সামনে কোনো নতুন জন্ম নেই, তুমুল তুলকালাম নেই, মৃত্যু নেই, কোনো ভোর নেই, রাত্রি নেই, সত্য নেই, মিথ্যাচার প্রতারণা নেই কেবল একটি নিরেট হাহুতাশপূর্ণ বর্তমান। গাঙ্গুলি নিরেট কংক্রিট বর্তমানে থিতু হতে চাইছে, বিপ্লবী হওয়া এ জমানায় অসম্ভব, হতে চাইলেও, সদর্থক তত্ত্বতত্ত্বাদি বিশ্লেষণ কেউ নেয় না, না ঘরকা না ঘাটকা কমিউনিস্ট জীবনেও আর শান্তি নেই।
মানুষ শেষ পর্যন্ত কী কিছু মনে রাখে? লেনিনমাওসেতুংহোচিমিন ছবি মাত্র, পার্টি অফিসের বিউটি; চে গুয়েভারা গেঞ্জির ফ্রন্ট পিকচার। অবচেতনের সত্যই হলো আত্মবিস্মৃতি। জীবনের সব সবকিছু মনে রাখলে মানুষের জিনাটাই অলৌকিক, স্মৃতিকে শ্রদ্ধা করলে মরে যাওয়াটাই তখন রিয়েল অ্যাকটিভিটি, তার চেয়ে অনেক বাস্তব, ভুলে গেছি— কী ভুলে গেছি, সেটাও মনে নেই। মানুষ বিস্মরণের বিস্মরণ! অর্থাৎ মৃত।
মৃত্যু একটা তত্ত্ব
মৃত্যুর জট খুলতে খুলতে নিজেই তাত্ত্বিকভাবে মরে যাচ্ছি
মধুবাতায়তঋতায়তে।
গ্রাম পঞ্চায়েতের লেটারহেড নিয়ে, নিশ্চিত হেতু আছে, মোহনলাল তখনো নাড়াচাড়া করছে; কলমটা অহেতুক ঠুকছে টেবিলে। ডেসপারেট কোনো শালার অমন ঠোকাঠুকি, অমন নাড়ানাড়ি, অপরাধ বিজ্ঞান কী বলে?
—ইডি সিবিআই আসার মতন কামালি?
মোহনলাল ফস করে বলে উঠলো, তোমার দোষটা কোথায় জানো কাকা?
—তুমি প্রেমিক।
—প্রেমিকের চক্ষু অন্ধ।
—বুড়া বয়সে আর কী প্রেম করবো?
—তুমি কমিউনিস্ট পার্টিকে বড়ো ভালোবাসো।
—জ্যোতি বসু প্রমোদ দাশগুপ্ত বিমান বসু সমীরণ মাস্টার বাসুদেব আচারিয়া লিডারদের… খুউব ভালোবাস…
—তুমাদের লিডাররা কিন্তু ক্যাডারদের ভালোবাসে না।
—ওনলি বশ্যতা চায়।
—প্রশ্নহীন আনুগত্য।
—আমরা শালা কাকেও, পার্টি কী এমন তালেবর, লিডারফিলার কোনো শালাকেই ভালোবাসি না।
—আমরা কারো বশে নাই।
—ভালোবাসি না বলে, সটাক করে মুতে দিতে পারি মুখটায়।
—পাছার ধুলা ঝেড়ে অন্য পাটির মাদুরে পা ছড়িয়ে বসি…
—ভালোবাসি না বলে সব রাগটার সবটাই উগুরে দিতে পারি।
—তুমরা গুমরে গুমরে কাঁদো।
—থুকতে শিখো।
—সিবিআই ইডি কিচ্ছু করতে পারবে না…
—কয়েকটা দিন হুজ্জত!
—পার্থ অনুব্রত মানিকদের জন্য কষ্ট হচ্ছে…
—নসিবের ব্যাপার কাকা।
—সবার কপালে কি জেল লেখা থাকে?
—শালাদের জনমকুণ্ডলীতে জেলখাটা ছিল…
মুসকুরায় গাঙ্গুলি, such men are dengerous.
—যে শালা thinks so much,
—reads too much.
—সে হারামিই ডেঞ্জার।
—মনে নেই তোর?
মোহনলাল ভাবতে পারে নি, তার কাকা, একদার নীতিনিষ্ঠ সিপিএম, হোক কমরেড, হোক জ্ঞাতিসম্পর্কের, একদার মাস্টারমশাই, হোক টিউশন মাস্টার, গুরুজন, ছাত্র সবসময়ই ছাত্র, তার কাছে, মৃদু হলেও খিস্তি দেবে! পরিস্থিতি কতটা অসহনীয় হলে একজন ভদ্রলোক জিভ নোংরা করে, একজন ভদ্রমহিলা ঘোমটা খুলে কোমরে শাড়ি বেঁধে ঝাঁটা তোলে মোহনলালের বোঝার মতো মেধা থাকলেও অনুভূতি নেই। অনুভূতি পুরোপুরি না মারতে পারলে এ সময়ে সফল ও সার্থক মন্ত্রী মিনিস্টার পঞ্চায়েত প্রধান মেম্বারফেম্বার কিছুই হওয়া যায় না সফলভাবে। এক একটি পাওয়ারফুল অনুব্রত মণ্ডল হতে চাওয়ার চেষ্টাই টিএমসির পাটিক্লাশ? মোহনলাল উঠেই চলে যাচ্ছিল, তার মাথার ভেতর ঝোলাঝুলি করে শালা আর হারামি শব্দ দুটো।
—লেখে লাও কাকা যা লেখবার।
গাঙ্গুলি যা পারলো লিখলো, মোহনলাল বহু ব্যবহৃত সই, তার নিচে ততোধিক ক্ষয়ুটে সিল মেরে বলল, হাঁ লাও।
—তুমার হ্যান্ডরাইটিং…
—তুমার লেঙ্গুয়েজ…
—তুমার নিড…
—তুমার দুর্নীতি…
—তুমার কনসপিরেসি…
—ধরা পড়লে পোঁঙাটি মারাবে নিজেই…
—আমি পাটি পজ্জন্ত হব নাই।
—সইটা তোরই ত?
—যেটা করলি?
—ওরিজিনাল?
—সই সিল?
—তুমার হ্যান্ডরাইটিংটা বাদে, সব অরিজিনাল।
—অফিসে কোনও রেকড রইল না…
সার্টিফিকেট হাতে নিয়ে গাঙ্গুলি ভাবে, কোন শালা বলে গেছে, ভাবতে প্রাকটিস করুন। ভাবতে শিখুন। দুস্ শালা, ভাবনার দিন শেষ।
পোঁঙা শব্দটি মাথার ভেতর খচখচ করছে গাঙ্গুলির—শব্দটি হয়ত অপরাধ জগতের মহত্তম ল্যাঙ্গুয়েজ। হয়তো শব্দটি ব্যবহৃত হতে হতে শ্লীল হয়ে গেছে। মোহনলালকে ডাকে, শোন শোন, আমরা ত সব সময়ই ভোটার।
—প্রজার অধম হয়ে বেঁচে থাকা…
—আমাদের অস্তিত্ব শুধু ভোটদানের জন্য।
—অনুগ্রহজীবী…
তবে, এখনো তোর ভোটার নই, সত্যি।
—ভোটার আই-কার্ড ট্রান্সফার করালেও তোর ভোটার নই।
—একসময়ের টিউশন-টিচার হিসেবে তোর কাছে আসা।
—টিচারদের ইজ্জতটাও মায়ের ভোগে তুলে দিলি তোরা…
—বিডিও এসডিও ডিএম এসপি সবকটাকে ফাঁসিয়ে দিলি…
ঠিক যেভাবে ডেয়ারি ফার্মে পশু, কেবল দুধ আর মাংসেই যার অস্তিত্ব এমন দৃষ্টিতে দেখতে গিয়েও মোহনলালের দৃষ্টি জিগজ্যাগ।
স্তন-যোনি বিশিষ্ট বলেই নারীদেরই উলঙ্গ হতে হয় সবযুগে।
সবদেশে।
দুধের জোগান অব্যাহত রাখার জন্য সদ্য ভূমিষ্ঠ বাছুর, ছাগল-ভেড়ার বাচ্চাদের নিহত হতে হয়।
মাত্র পাঁচ বছরের জীবৎকালে সবসময়ই গাভীটিকে গর্ভবতী হয়ে থাকতে হয়।
সবসময়ই দুগ্ধবতী হয়ে থাকতে হয়।
বাঁট শুকিয়ে গেলে কসাইয়ের কাছে বেচে দিতে হয়।
ভোটারের পরমায়ুও ঠিক ওই পাঁচ বছরের।
সে সব সময়ই দুগ্ধবতী।
সব সময়ই গর্ভবতী।
পূর্বাপর মুহূর্তাবলী গাঙ্গুলি সাজাচ্ছে, লেটারহেডের ওপর কলমটা ঠোকা, কেবল মৃদু ঠুকঠুকের আওয়াজ, তারপর ঘসঘস লিখে ছিঁড়ে ফেলে দেওয়া, তৎপর গাঙ্গুলিকে লেখার অফার, তারপর মোহনলাল কী একটা কাগজে। গাঙ্গুলিও তখন খবর চ্যানেলে, মোবাইলে; প্রধান বিচারপতি চন্দ্রচূড় তখন কেন্দ্রীয় সরকারকে প্রশ্ন করছেন, Why do you have to make so many committees? It seems that everytime you have an adverse report from one committee you form a new committee. You keep appointing committees till you get a favourable decision.
—দেশ থেকে বিচার ব্যবস্থা তুলে দিলে দলগুলো হাতপা খুলে দেশটাকে শাসন করতে পারতো।
—কি বলিস?
—আইন আইনের পথেই চলুক…
— যদি পুরো পঞ্চায়েত ভোটটাই বাতিল হয়, প্রধান তুইই ত থাকবি।
—না কাকা, এটা একটা খারাপ প্রবণতা…
—কার?
—আদালতের?
—মোদির?
—মমতার?
—কংগ্রেসের?
— সিপিএমের?
—তো?
মোহনলাল কী মিষ্টি করে হাসলো, কাকা পার্থ অনুব্রতকে বেঙ্গল চিনতো,
—কিন্তুক,
—বাকি মালগুলোকে?
—বিশবাস করো, মনেপ্রাণে চাইছি সিবিআই ইডি আমার দরজা খটখটাক।
গাঙ্গুলি বুঝছে, পৌরুষের উত্তুঙ্গতায় নিঃসঙ্গ হতে চাইছে মোহনলাল, নির্বাণে থাকতে চাইছে। বুদ্ধ হতে চাইছে গৌতম।
—পঞ্চায়েতে অত টাকা নাই…
—সিবিআই ইডি আসার মতন…
—কোটি টাকা হতে কতবছর প্রধান থাকতে হবে বল দেখি!
গাঙ্গুলি বুঝছে, এখন মোহনলাল ঈশ্বর।
গাঙ্গুলি বুঝছে, অরূপা সকল দেহে মনে সত্তায় ধরা দিলেই মোহনলাল অনির্বাণসত্তা।
তাই সে মুখর।
তুমি বাঞ্চোত গায়ত্রীর কবি।
তুমি তখন শালা অরূপা নৈরাত্মদেবী
সপ্তদশী প্রজ্ঞা
পারমিতা।
ক্ষণশাশ্বতী।
বাল!!!
পার্থ অনুব্রতর প্রেসিডেন্সি তিহার নামচা ভেসে ওঠে মোবাইলে।
আহা! সে শিবের সতী নয় কখনও।
মোহনলাল, প্রায় লুপ্ত মূল্যবোধটুকু ধিকিধিকি ছিল বলে নিরুত্তরে চলে গেল।
ফিরে এলো, হাতে, অনেকগুলো ফরম।
—লাও।
—ভরে, জমা কর।
—সব স্কিমের সব সুবিধা ভোগ কর।
—বাঁশ যখন লিবেই,
—পুরা বেম্বুই লাও!
তার বাগিচায় যেই যায়, গাঙ্গুলি তাকেই কিছুটা শাকসবজি দিয়ে বলে, দেশিবীজ নিয়ে যাও, লাগাও।
—নিজের প্রয়োজন নিজেই মেটাও।
—সার কীটনাশক একদম দেবে না।
—পোকামাকড়েরও ভাগ আছে…
এই পরপোকাররূপ দাতব্যটি, যতটা তিরিশ বছর পর সদ্য গাঁয়ে এসে অর্গানিক ফার্ম খোলা, কৃষিতে নতুন পন্থা দর্শানো, ষাটোর্ধ্ব লোকের উদ্যম, উৎসাহব্যঞ্জক অবশ্যই। কিন্তু মাস কমিউনিকেশন? সমাজ সচেতনতার ডায়লগবাজি? ভালো? সমাজের পক্ষে? ব্যক্তির পক্ষে??
দুশ্চিন্তার।
তুমি শালা বই পড়ো, বেশ করো; বই লেখো, বেহতর; রিটায়ার্ড প্রফেসর, জ্ঞানী লোক, জ্ঞান দেবে, স্বাভাবিক; কিন্তু তুমি তো পলিটিক্স করছো। তুমি পপুলার হতে চাইছো, তুমি মোটিভেট করছো বৃহত্তর জনগণকে। তুমি ভুলঠিক চেনাচ্ছো, তুমি ভোট ভাঙাচ্ছো…
মোহনলাল, বাধ্য হয়ে, সরজমিনে আসে, গাঙ্গুলির বাগান পরিদর্শন করে কী বিষ্ফারিত বিষ্ফোরণ :
তুমি শালা প্যাপলা, একদা টিউশন টিচার বলে অনায়াসে তোমার বেদখল জমি এক ফুঁয়ে উদ্ধার করে দিলাম, তোমার ডিসপিউটেড পড়চা ঠিকঠাক ডিজিটাল করে দিলাম, এ-যুগেও এক পয়সাও ঘুষ নিইনি, বিএলআর অফিস নেয় নি, পঞ্চায়েত অফিস নেয়নি, কৃষি আধিকারিকের করণ নেয়নি, কেউ নেয়নি, স্রিফ মোহনলালের টিচার বলে; তোমার জমিজমা তিনভাগে ছেলে বউয়ের নামে ভাগ করে দুটো পিএম কিসানের টাকা, তুমি তো পেনশন হোল্ডার, পাবে না, সরকারের টাকা, বছরে বিয়াল্লিশ হাজার ঢুকবার ব্যবস্থা করে দিলাম। জমিতে চাষ হলেও তোমার ফায়দা, না হলেও ফায়দা —শস্য বীমার টাকা মারবে —তারপরও তুমি একটি খাঁটি রাজনৈতিক দুশমন হয়ে উঠবে?
এই ধরনের লোকগুলো যে-কোনো পাটির জন্যই বিপজ্জনক। দীক্ষিত ছাড়া রাজপুরুষ হওয়া যায় না, তবুও, মোহনলালের পেছনে লাগতে এই অস্ত্রটিকে ব্যবহার করবে না তো সিপিএম? দাঁড়াও না; ফ্রেস ভোট হতে দিলে ত!
যদি হয়ও, would he were fatter. হারামজাদাকে fattest করে দাও। পার্থ অনুব্রত সব শালারাই মোটা হওয়ার জন্যই ফেঁসেছে।
ফার্ম ঘুরে-ঘুরে দেখতে-দেখতে মোহনলাল, ঊর্ধ্বমুখী লঙ্কার ঝাঁকে হাত বোলায়। লঙ্কা এখন ৫০০ টাকা কিলো।
—বৃক্ষের ফল বৃক্ষের অনুমতি ছাড়া তুলে নেওয়াই ত এগ্রিকালচার কাকা।
—তদ্রূপ ধর্ম।
—শাস্ত্র বলছে, মা ফলেষু কদাচন।
—মানে বুঝলি?
মোদি একটু একটু করে প্রকট করে দিয়েছেন আমাদের সুপ্ত ধর্ম উগ্রতা। আমাদের মেনে নেওয়াগুলি, আমাদের অস্বীকার করাগুলি, ধর্ম স্থাপনায় সম্ভবামী যা কিছু করা সম্ভব সবকিছুই, ধর্মের বিশুদ্ধ আদিমতাকে বিশুদ্ধ করতে আধুনিকতার সংযোগে মুক্তি দিতে, ধর্মমতে সংসদকে প্রতিষ্ঠা করে মোদি জানান দিলেন, ভারতীয়দের দেবদ্বিজে ভক্তি অচলা। এখানে আদানি আম্বানি গৌণ। আধুনিক ভারতের সঙ্গে প্রাচীন ভারতবর্ষের মিলন ঘটানোই তাঁর প্রয়াস। ব্রাহ্মণ গাঙ্গুলি, মোদির ধর্ম স্থাপনায় যৎপরোনাস্তি উল্লসিত হও—তোমার এখন বাণপ্রস্থে যাওয়ার এজ, তুমি গৃহী, লোভীর দৃষ্টিতে পরাগ-মিলন দেখে যাচ্ছো। পেট শালা আদিম অন্ধকারেই রয়ে গেছে, ফাস্ট ফুডে আদিম শালার কিছু হয় না।
—we would like to be surrounded by men
—who are fat, কাকা।
গাঙ্গুলি একটু হাসলো, সেক্সপিয়ার পড়ার সঙ্গে সঙ্গে যদি একটু মার্ক্সইজমটাও পড়তিস, টিএমসি ৩৪ বছর লাস্টিং করতো।
—৩৪ বছরকেও ক্রশ করতো।
—তিন হাজার বছর রাজত্ব করবে দিদি।
ফুক করে হাসলো গাঙ্গুলি, তারপরই গম্ভীর, তা অবশ্য ঠিক। দিদির প্রভাব তেত্রিশ কোটি বছর মিথষ্ক্রিয়া চালাবে।
—তোমাকে জমির দখল পাইয়ে দেওয়াটাই বোকামি হয়েছে।
—আমার মতো লোকদের জমির সঙ্গে সম্পর্ক ঠিক কী রকম?
—কি রকম?
—irreparable rift in the interdependent process of social metabolism.
—তুমি মার্ক্স মারাচ্ছ!
যত বন কেটে জমি বাড়ছে, তত বেশি করে মাইক্রোব জনবসতির ভেতর চলে আসছে। ৭.৮ বিলিয়ন ভিড়ের পৃথিবীকে, বিভিন্ন ঘটনার একসাথে ঘটে যাওয়াকে, কী সুখের সংজ্ঞায় ব্যাখ্যা করবো, বল? কোন কবি বলেছিলেন না, পৃথিবীর গভীর গভীরতর অসুখ এখন?
—সবকিছু ছেড়েছুঁড়ে ঈশ্বরের নামগান করো।
—ধর্মচর্চা কর…
—পরকালের পথ বানাও…
—একটা মন্দির প্রতিষ্ঠা কর…
—পঞ্চায়েত থেকে মন্দির বানিয়ে দেবো…
—লুকিয়ে থাকা ভাইরাসকে কি মন্দির খুঁজে পাবো?
—প্রাণী জগতের ভাইরাসকে মানুষের দুর্দৈব করে তুললে মানুষের পাপপুণ্য কিছুই থাকে না।
—পরিবর্তনের মাঝে মুনাফার উদগ্র আকাঙ্ক্ষা…
—আধিপত্যের দুর্মর বাসনাও অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।
—জানিস ত, ১৯৮০ থেকে ২০০০-এর মধ্যে দক্ষিণ আমেরিকায় ১০ কোটি হেক্টর ট্রপিক্যাল ফরেস্ট হারিয়ে গেছে পশুখাদ্যের জন্য?
—পশুগুলোকে বাঁচতে হবে না?
—অনুব্রতর জন্য ?
—সর্বগ্রাসী নিওলিবারাল অর্থনীতি ও কর্পোরেট পুঁজি সমস্ত অণুজীবের বাসস্থান কেড়ে নিয়েছে। —তাদের বাসভূমি এখন মানুষের শরীর।
খরা না অতি বৃষ্টি, চাষীকে প্রকৃতিই বলে দিতো। বৃষ্টি বুঝে চাষবাস। বনা পাখিরা জৈষ্ঠিমাসে বাচ্চা তুললে সে বছর বর্ষায় বৃষ্টি, লিপিপাখি ব্যাদ কানালি জমিতে বাসা করলে বৃষ্টি হবেই। বর্ষায় বৃষ্টি না থাকলে সামকাহালরা বাসা করবে না।
ঠিক মতন বর্ষা না হলে ডাঙায় চাষ—অড়হর, বিউলি, জনার, কোদো, সাঁও। ঠিকঠাক বর্ষা হলে, মারমার ধান। তারপর সবুজ বিপ্লব হলো। তারপর একটি-ফোনকলের চাষবাস।
গাঙ্গুলি তখনও বলছে, দেখছিস, তাপমাত্রা স্বাভাবিক, বাগিচাও ফুল-গ্রিন। ৩৪ থেকে ৩৬ ডিগ্রির বেশি তাপমাত্রা হলে লঙ্কা কেন, কোনো শাকসব্জিতেই পরাগ মিলন হয় না। শাকসবজির দাম বেড়ে যাওয়া তাহলে উৎপাদনের ঘাটতি নয়, উষ্ণতা।
উষ্ণতা বৃদ্ধির জন্য বৃক্ষছেদন…
বৃক্ষছেদনের জন্য…
তারপরটাই ত খতরা।
তারপরটাই শোচের।।
তারপরেরটাই পলিটিক্স।।।
এত পলিটিক্স শম্ভু রায় শিখিয়ে যায়নি, অত পলিটিক্স ডাস ক্যাপিটলও জানে না।
শেখানো হয় নি…
শেখানো হবে না…
শিক্ষা আনে চেতনা
চেতনা আনে খতরা…
একসারে, গুনলে হবে ২০/২৫-টা, ফুলেফলে ভর্তি লঙ্কাগাছের মাথার ওপর বিশ্বভুবনকে অবজ্ঞায় দেখছে গাঙ্গুলি, চোখ ফিরিয়ে, নজর ফেলা ফোকাসে লঙ্কা গাছের দিকে নজর দিলো পুনরায়, তথায় ডিপ বিরহ বিছিয়ে নধর মাগির মতো হাসছে শালিরা গর্ভপাত করে। গাছের সব ফুলজালি ঝরে গেছে; তলাটি হলদেটে, শরতে শেফালী ওইভাবে কুড়াতে কী-কষ্ট পড়ে থাকে, ফুলফলে ভর্তি। সফল সার্থক সঙ্গমের সম্ভাবনা ভূমিষ্মাৎ এই অবৈধ সময়ে।
ভয়ানক রোদের জন্য ঝরছে হয়তো, গাঙ্গুলি ভেবেছিল; ডিগ্রিতে, সেলসিয়াসে, ৪৮ দেখাচ্ছে ত পুরুলিয়া । বিপদকে ফিগারে ফেলে গাঙ্গুলিবাবু এখন চিন্তাশীল।
—কন্সপিরেসি।
—ক্যাপিটাল সব সময় তার যাবতীয় বিপক্ষকে বিনাশ করে;
—শক্তি মাইনুট অবস্টাকলকেও গুরুত্ব দেয়।
—বুঝলি, পৃথিবীতে আর লঙ্কা ফলবে না। —কর্পোরেট ফলতে দেবে না।
—কর্পোরেটের সোল অথরিটি এখন এগ্রিকালচার।
—নিজের প্রয়োজনের শাকসবজি নিজেকে ফলাতে হবে।
—বুঝলি?
মোহনলাল ছোট করে ঘাড় নোয়ায়।
—ছোট ছোট বাগান দিয়ে ফার্মকে রুখতে হবে।
মোহনলাল মাঝারি ঘাড় নোয়ায়।
—ইনসেক্টিসাইট আর ফার্টিলাইজার-ফ্রি ইন্ডিয়া তৈরি করতে হবে।
মোহনলালের ঘাড় একদম ঝুলে যায়।
দেশপ্রেম না থাকলে বামপন্থাও অচল, আন্তর্জাতিকতাবাদ হাওয়াই লাড্ডু, মার্কসের সঙ্গে ধর্মের অ্যামালগামেট দিয়েই হিন্দি বেল্ট দখল করতে হবে। ছাতুখোররা হনুমান আর শিউজি ছাড়া বোঝে না।
—ম্যাটারটা এখনই ডিসক্লোজ করিস না।
—ডি…
শ্লোগানের জন্মবৃত্তান্তে ইস্যু থাকা চাই, মৌকার সদ্ব্যবহার দিয়েই বিপ্লব সার্থক হোক ব্যর্থ হোক যতটুকু ঘটেছিল ওয়ার্ল্ডে, গাঙ্গুলি বলতে গিয়ে থামলো, এত বিপ্লব মোহনলালকে বলে দিলে ও এখনই তামাম মনিহারায় মাওসেতুং হয়ে যাবে।
টিএমসির পোর্টফোলিওতে সেটা বেমানান, বড়ই।
—কাকা, তোমার পাশে পঞ্চায়েত সবসময় আছে।
—ঘাড়ে চেপে বসলেই বা আমার কী?
সোভিয়েত যেমন নির্দেশ দিতো তৃতীয় বিশ্বের কমিউনিস্ট পার্টির প্যালিটব্যুরোকে, দিনের শেষে প্রতিদিন ফুটে ওঠা বহুব্যবহৃত অন্ধকারের দিকে অঙ্গুলিনির্দেশে প্রায় তদ্রূপ প্রত্যাদেশ দিলো, সবুজের সাহচর্যে তুইও গ্রিইন হয়ে যাবি।
মোহনলাল, বুদ্ধিজীবীরা যেমন তাবেদারি হাসে, মুশকুরালো; বড়ো জ্ঞানী-জ্ঞানী লাগছে কনেদেখা আলোক।
জ্ঞান তাহলে অভিজ্ঞতার ঔরসজাত, ফোকাশিত আলোকসঞ্জাত— আপসে পাওয়া জ্ঞান কোনো শালা সহিসলাবত কাজে লাগায় নি এইজন্যই। অন্যের দ্রব্য না বলিয়া লইবে না উহাকে চুরি বলে। চুরি বড়ো নিন্দনীয় কর্ম্ম, জ্ঞানের মুখে মুতে দিয়ে শিক্ষা প্রদানের বরাত-নেওয়া মালগুলো এখন তিহারে প্রেসিডেন্সিতে।
মনিহারাতে আজি ঝরো ঝরো মুখর চুতিয়া বাদর, না ভিজছে মাটি, না হবে চাষ, কেবল কেবলই কাদা। পুরুলিয়া এই আগস্টেই খরা ডিকলিয়ার করে দিয়েছে সরকার। পাড়ার অনলাইন গুমটিতে শস্যবীমার ফরম নিতে ভিড়, প্রয়োজনীয় তথ্যাদি জেরক্সের ভয়াবহ গ্যাঞ্জাম, তারমধ্যেই গাঙ্গুলি ফরম কাশিপুর কৃষি বিভাগে জমা দিয়ে টিপিটিপি বরসে পানি শুনতে শুনতে, ঠিক সলাবত সিনেমাটি, বাগানে ছোড়াছুড়ি খেলছে কয়েক মুঠো বৃষ্টি। ছাতাটি ডানা মেলে দুবার উড়তে গিয়ে গুটিয়ে নিলো পালখ, আজ ভিজবার দিন। গাঙ্গুলি কি নবযৌবনে পদার্পণ করছে?
ছাতা মাথায় দেওয়া সব লোকগুলোকে গালাগাল দেয় গাঙ্গুলি, তুই ভোঁসড়ি টিপাটিপি বৃষ্টির মাঝখানে একটি না-বৃষ্টি হয়ে শুখা মাথায় চলে যাবি? বাপের জমিদারি! পিথিমিতে জায়গার বড্ডো কমি, একটি মাত্র মাথা বাঁচাতে দশটা মাথা বরাবর জায়গা আগলে নিবি ছাতার পরিধিতে! এটা মানুষী কারবার না।
লম্বা একটি দীর্ঘশ্বাস সবুজ পাতা ঝরাতে ঝরাতে তোমারো অসীমে প্রাণমন নিয়ে, ধায়। ধাবমান দীর্ঘশ্বাস, তাহাতে অন্ধের দৃষ্টি, গাঙ্গুলি এইমাত্র অনুভব করলো জীবনের পরিসমাপ্তি, আমরা কেবল সারভাইভ করছি, এখন। অজানা ভাইরাসের আতংক সবকিছুই আমাদের গ্রাস করছে।
শ্রাবণ মাস, কে বলবে, মাটি খটখটে, গাছগাছালি দড়িদড়ি, ফুলজালি আসে আর ঢলে যায়, সবুজ রংটাকে চেটেপুটে খাচ্ছে রোদ, রৌদ্র।
সমস্ত সম্ভাবনা, সমস্ত পসিবিলিটিতে মূত্রত্যাগ করে গেছে খণ্ডিতবিখণ্ডিত ইন্ডিয়ান লেফ্ট। ইন্ডিয়ান ক্লাইমেট। মনসুন আর বাল্যের মতো আসবেনা, ১৯১৭ আর রিপিট করবে না।
—কাকা একটা পাম্প লাও।
—সাবসিডিতে…
—পাম্পটাকে কি ঘরে সাজাই রাখবো?
—হাফ দামে কেন, ফিরিতে দিলেও লুব নাই।
—পাম্প না দিয়ে মেঘে জলটা দিতে বল তোর দিদিকে।
—জল?
—মেঘে!
—হুঁ। মেঘে।
গাঙ্গুলি জল বৃষ্টি হওয়া না-হওয়া নিয়ে, সবুজ বিপ্লব, ইন্সেকটিসাইট, কেমিক্যাল সার, বনোচ্ছেদ, দূষণ, সরকারি প্রকল্প, দুর্নীতি, জনবিরোধী জনমোহিনী আইন, কর্পোরেট এলিট উন্নয়ন কর্মসূচির পাপ, বলসেভিক সাংস্কৃতিক বিপ্লব হেনতেন যা তার মগজে থাকেথাকে স্তরীভূত মজুত স্পিচ দেবার জন্য তৈরি, বলতে শুরু করলেও, আপারহ্যান্ড তো মোহনলাল; বললো, অফিসে এসো।
—অফিসিয়ালি শুনবো।
—কাল…
দেহতত্ত্বের লোকের মতো পুরো শরীর দিয়ে গান শোনার, প্রতিটা লোমকূপ দিয়ে জল পান করার তৃষ্ণার্ত, পুরো নিবেদন দিয়ে বিয়োগান্তক ট্রাজেডি হয়ে ওঠা নৃত্য, আকাশে মেঘ দেখেই পা ফাঁক করা মাটি, অলৌকিক স্পেস ও বিষণ্ণ উইজ়ডমে গাঙ্গুলি তাহার বাল্যকাল পাঠ করে। দশহাত মাটি না ভিজলে যে ধান হয়না।
যখনই সময় পায়, এ-পাতা সে-পাতা উল্টে দুচার লাইন পড়ে আর চোখ বুঁজে বসে থাকে একটি বিকেল একটি সন্ধ্যে একটি গোটা রাত, এখনো, হতাশ আশাবাদী গাঙ্গুলি।
মোটা প্লাস্টিক কাগজে ঝকঝকে অক্ষরে ছাপা কার্ল মার্কসের ছবিছাপা রাদুগা প্রকাশনীর এই বইটি গাঙ্গুলি ছুঁতে চায় কিন্তু পারে না, বই এতো অধরা! এত পবিত্র!! ডাস ক্যাপিটালের মতো লাগে জগৎ সংসার। অমনি ঝকঝকে ছাপা অমনি প্লাস্টিক মোটা কাগজের মতো একটি সমাজ—কার্ল মার্কস তাকেই তো বলেছেন, সমাজতন্ত্র! অমনি রাদুগা প্রকাশনীর প্রোডাক্টের মতো ঝকমকে কিছু আকাঙ্ক্ষা করেছিল গাঙ্গুলি।
আমার ত কিছু করার নেই কমরেড।
যে বাপ আমাকে জন্ম দিয়েছিল, সে শালা জাতে বামুন, মা-মাগিটাও জাতে বামুন। পিতৃপিতামহের জমিসম্পত্তির উত্তরাধিকারে সামন্ত প্রভুর মতো জিন্দেগি কাটিয়ে গেছে ‘জোতদার’ ‘রক্তচোষা’ বাপটা। আমি বোকাচোদা, কিশোর বয়সে আন্ডারগ্রাউন্ডে থাকা কমরেড শম্ভু রায় ওরফে নিশাপতি বাগের সান্নিধ্যে মার্কসবাদে দীক্ষিত হয়ে বাপকে শ্রেণিশত্রু গণ্য করে বাপের বিরুদ্ধে লড়ে যাই। বর্গা অপারেশন, খাসজমি উদ্ধার করতে গিয়ে ত্যজ্যপুত্র হই। অধ্যাপিকা সুমিতা চক্রবর্তীর অর্থানুগ্রহে এমএ পাশ করি। কলকাতায় ভিখিরির দশায় যৌবন কাটাই। ডিক্লাসড হয়ে যাই।
শম্ভু রায় ওরফে নিশাপতি বাগ, মার্কসবাদের সব শিখিয়ে ছিলেন, শেখান নি, নেতৃত্বের বিরুদ্ধে যাবে না; চোখের সামনে মার্কসবাদ-বিরোধী কার্যকলাপ দেখলেও মুখ ফুটে কিচ্ছুটি বলবে না; দুর্নীতির প্রমাণ তোমার হাতে থাকলেও প্রতিবাদ করবে না; বামফ্রন্ট জামানার নতুন বিপ্লবে বিপ্লবী হতে চেষ্টা করে যাবে লাগাতার…
আমি তো আপনাদের দেওয়া চাকরি নিই নি কমরেড। বলেছিলাম, নিজের যোগ্যতায় চাকরি পেলে করবো, হাজার হাজার বেকার যুবক আমার ভাই। সমাজের আমূল পরিবর্তন না হলে তো প্রকৃত কর্মসংস্থান হয়না।
শুনেছি, নিশাপতি বাগ পার্টি ছেড়ে দিয়েছিলেন। নাকি, নিশাপতি বাগকে পার্টি বহিষ্কার করেছিল —আমি জানিনা। আমার সৌভাগ্য, পার্টি আমাকে বহিষ্কার করে নি, রিনিউল করতে না দিয়ে বসিয়ে দিয়েছিল।
তবুও, উপযুক্ত কমিউনিস্ট পার্টি খুঁজে না পেয়ে আপনার পার্টিকেই সাপোর্ট দিয়ে গেছি কমরেড। কারণ, বিপ্লব আমার ভাই। ভয়াবহ দুঃসময়েও পার্টির নির্বাচনী কার্যক্রমে অংশ নিয়েছি। পোলিং এজেন্ট হয়েছি সমস্ত বিপদকে উপেক্ষা করে।
আমি মনে করি, বামফ্রন্ট সরকার গঠন ছিল বিপ্লবের স্বার্থে মস্ত একটি ভুল। ৩৪ বছর রাজত্ব মহাভুল। সিপিএম তার বৈপ্লবিক চরিত্র হারিয়েছে। রাইটার্স বিল্ডিং-এর ঠাণ্ডাঘরে, কমরেড, আপনার লালহাত শ্রমিকের-রক্তচোষা কর্পোরেটের হাত মর্দন করছিল।
এত কনফেশন, এইজন্যই, শুনলাম, বিশ্বস্তসূত্রে, সিপিএম রাজ্য কমিটির জনৈক সম্পাদক মণ্ডলীর সদস্য (কলকাতার) আমার মূল্যায়ন করেছেন, আমি ব্রাহ্মণ্যবাদী, সামন্ত মানসিকতার লেখক। প্রতিক্রিয়াশীল। কমরেড, আপনিও তো নামের পর একটা সারনেম ব্যবহার করেন। সেটাও তো একটা জাতের পরিচয় বহনকারী। আপনিও তো বুর্জোয়াই, প্রলেতারিয়েত হতে পেরেছেন কি? বুঝলাম, ‘নন্দন’ পত্রিকা আমার গল্প চেয়ে নিয়েও কেন প্রকাশ করেনি।
কমরেড, সরি!
আপনার বিপ্লবপন্থায় আমার বিশ্বাস নেই। আমার অবিশ্বাসের উৎসস্থল কমরেড, আপনার পার্টিই।
গাঙ্গুলি, তুমি শালা, আদগান্ডু, নির্বোধ, এসব কখনো বলে?
জানো না, পার্টির ভেতর ঢুকে গেলে, তারপর যদি বেরিয়ে যাও, বার করে দেওয়া হয়, বসিয়ে দেওয়া হয়, তত্ত্বগতভাবে তুমি শালা প্রতিক্রিয়াশীল, পার্টির চোখে ট্রটস্কি, সংস্কৃতিকর্মীদের চোখে পস্তেরনাক?
তুমি শালা বিজেপির না, কংগ্রেসের না, টিএমসির না, বিপ্লবের না, গণতন্ত্রের না, তুমি একটি খুচরা বাল, ছিন্ন বালের ওজনহীনতায় শেকড়হীন উড়ছো, যে ফুঁ দিচ্ছে, তার ফুঁয়েই।
তুমি শালা কি বুদ্ধ ভটচাজ, পার্টির পুরো বিপক্ষে গিয়ে, দিব্যি পুরনো ক্ষয়ুটে লাল জুতুয়া পায়ে দিয়ে কনভয় হাঁকিয়ে রাইটার্স যাবে? ফাঁকা বোতলের দিকে চেয়ে আছো, তোমার মাথা টলছে নেশায়, জিভ আড়ষ্ট।
তোমার কাকা তোমাকে পার্টির নীতিনৈতিকতার প্রশ্ন তুলে, তোমাকে বিশুদ্ধ করছিল, না গাঙ্গুলি, তোমাকে কেবল তাতিয়েছিল, তোমার অন্তর্গত রক্তের গভীর মাপতে চেয়েছিল। তুমিই যে একদিন ধান্দাবাজ সে-শালার পোঁদ খাল করে দেবে অভিযোগে অভিযোগে, সুনিশ্চিত অনুমানে তোমাকে একটি বিষ্ফোরক বানিয়ে তোমার বিষ্ফোটেই তোমাকে উড়িয়ে দিয়েছে।
তোমার শত্রুও তোমাকে অতীব সৎ বলে জানে, এবং, স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে। অত সততা সিপিএমে চলে না কমরেড। রাজনীতি হিজিবিজি বিজিহিজি গিজিগিজি। বাজপেয়ীর সঙ্গেও বিপ্লব করা যায়; মমতার সঙ্গেও বিজেপি হঠানোর মঞ্চ গড়া যায়।
সব কাজের শুরুটা মহৎ ও মহত্তর, গাঙ্গুলি ঠিক করলো চাষ করবে। কীটনাশক রাসায়নিক সারের বিপরীতে অর্গানিক পদ্ধতি ইমপোজ করবে ধ্যাড়ধ্যাড়ে গন্ডগ্রাম মনিহারায়। নেটের দৌলতে পৃথিবী একটি বিন্দুবৎ মনিহারা তারই একটি অঙ্গ, জেনেও, তবুও, হন্যে হয়ে খুঁজে খুঁজে যৎসামান্য দেশিধান শাকসবজির বীজ লাগিয়ে প্যারালাল সবুজ বিপ্লবের ডাক দিয়ে বসলো।
এখন, দেশ বিপ্লবের উপযুক্ত নয়, নাবালক এ-দেশ স্থিতাবস্থা চেনে, পরম্পরা চেনে, প্রথার ভেতর থেকে প্রথাবিরোধিতা খুঁজে নিতে গাঙ্গুলি তখনো মরীয়া।
শুধু ধান নয়, ধানের পাশাপাশি শাকসবজি ফলমূল চাষও।
ফেসবুক থেকে জানলো, আম্রপালি আম চাষে খুব লাভ ও কাল্টিভেশনটিও সহজ। সরকার কিছু সাহায্যও করবে।
আম লাগানোর মাটি পর্যন্ত তৈরি না, প্রায় বিঘা সাতেক জমি দেখিয়েই পঞ্চায়েতে দরখাস্ত করে দিলো, সরকারি সহায়তার জন্য।
পেয়েও গেল চারা, অর্থসাহায্য।
বিশ্বকর্মা সূক্ষ্ম একটি ছিদ্রই তো রাখেন বৃহতের প্রবেশাধিকারে।
আমাদের কৃষিশাস্ত্র বলেছে, অন্তঃপুরের দায়িত্ব পিতাকে, পাকশালার দায়িত্ব মাতাকে, বাহনের দায়িত্ব মিত্রকে, কিন্তু কৃষির দায়িত্ব নিজের। গাঙ্গুলি মনিহারায় জেঁকে বসলো।
গাঙ্গুলির ঠাকুমা প্রায়ই বলতো, গতে চাষ বেগতে বাণিজ্য। হিন্দু মতেই তবে, আদানি চাষ করবেন ভারতে, কয়লা তুলবেন ইন্দোনেশিয়ায় সেই কয়লা ভারতে আমদানি হবে। কয়লাখনির কী প্রয়োজন ভারতে?
গাঙ্গুলি আদানি তত্ত্বের ঘোর সমর্থন। চাষ করবে মনিহারায়, বাণিজ্য করবে আসানসোলে। ইতিমধ্যেই তিনজন গাঙ্গুলিকে বরাত দিয়ে রেখেছে, আমাদের ঢেঁকিছাঁটা চাল চাই। মিলেই হালকা পেষাই চাল ঢেঁকিছাটা বলে চালিয়ে দেবে। সুস্থ দীর্ঘ জীবন-আকাঙ্ক্ষী বানচোদদের কে বোঝাবে, ঢেঁকিতে পাহার দেবার কামিন পাওয়া অসম্ভব সর্বব্যপ্ত যন্ত্রের যুগে।
হাজার হাজার বছর ধরে কৃষক জনগণের মধ্যে থেকেও ব্যক্তিগত অর্থনীতি গড়ে তুলে কৃষিব্যবস্থা টিকিয়ে রেখেছিল, আদানির অর্থনীতি সেই অর্থে সম্পূর্ণ ভারতীয়—ভূমি সংস্কারের লক্ষ্য হবে ধনী কৃষি অর্থনীতি গড়ে তোলা। ট্রাকটারে চেপে কৃষির স্বার্থে বিক্ষোভ মিছিল করা।
ইন্দিরা গান্ধী হত্যার পর খালিস্তানি মুভমেন্ট শেষ, রাজীব গান্ধী হত্যার পর তামিল আন্দোলন শেষ, রামমন্দির জ্ঞানবাপী আন্দোলনে, আর কতগুলো লাশ পেলে ভারত একটি ধার্মিক অথবা ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র হবে?
একটি ক্রিমিনাল ভারতবর্ষ গাঙ্গুলির সামনে।
হতভম্ব গাঙ্গুলি মোহনলাল প্রদত্ত সার্টিফিকেট হাতে, দ্বিধাগ্রস্ত; মোহনলাল বললো, কাকা সৎ কাজ করতে চরিত্রের জোর লাগে।
—অসৎ কাজ করতে তার চেয়েও বেশি ক্যারেকটার লাগে।
—তুমার বারোটা বাজিয়ে দিয়েছে তোমার দুর্বলতা।
—তুমি ফিবল্…
আরো কী বলছে মোহনলাল, কে জানে!
গাঙ্গুলি কিছুই শুনছে না।