সিদ্ধার্থ শেখর চক্রবর্তী

স্থানীয় পুলিশের জিপে শান্তি যখন বাড়ি এসে পৌঁছালো, পুরো লেবার লাইন উপচে এসেছিলো সঙ্গে। 

ডিসেম্বরের ছোটো দিনে মরচে বিকেলের শেষ আভাটুকু শরীরে লেপ্টে থাকার অধিকার চায়। সারাদিনে নিয়মমাফিক পাতা তুলে ক্লান্তি বয়ে ঘরে ফিরে আসে একাকি মেয়েরা। মরদগুলো হাড়িয়ার ঠেকে দিনযাপনের লড়াইয়ের উৎস খোঁজে। ছড়িয়ে ছিটিয়ে আয়েস করে বসে নির্জন অন্ধকার ঘিরে রাখে নিস্তেজ জনপদটিকে। 

দারোগাবাবুকে অনুরোধ করেছিলো, আরো কিছুক্ষন পর তাকে নিয়ে বেরোতে। শুনলোই না। সূর্য ডুবে যাবার পর পৌঁছালে, অনেকটাই গোপনে বাড়ি ঢুকতে পারতো। অনেকদিন পর অন্তত একরাত গভীর ঘুমের কোণে হারিয়ে যাওয়া যেত। অন্তত পুলিশ জিপটি যদি বাগানের প্রথম মোড়েই তাকে নামিয়ে দিতো, তবে চুপিসাড়ে ঢুকে পড়া যেত। কিন্তু দারোগাবাবু কোনো ঝুঁকি নিতে চাননি। জীবনের একটা গোটা অধ্যায় পার করার পর, সবাই হয়তো ঝুঁকি ব্যাপারটা এড়িয়ে চলতে চায়। 

বাড়িতে নেমে উঠোনে ঢুকে বোঝা গেলো, মিনতি কেনো বলেছিলো সমস্ত ফিরে যাওয়াই কিন্তু পুরোনো আস্বাদনের খোঁজে নয়। 

মা পিঁড়িতে বসে ঠাঁয় তাকিয়ে রয়েছে তার দিকে। মা’কে ঘিরে জনা পঞ্চাশেক মহিলা। সবার চোখ স্থির। মা’র কাছে এগিয়ে যাবার ইচ্ছেটা দলা পাকিয়ে উঠলো। এগোতে চেয়েও এগিয়ে যাবার প্রত্যুৎসাহের অনুপস্থিতি তাদের মাঝের দূরত্ব বাড়িয়ে দিলো কয়েক যোজন। পা আটকে গেলো। দাওয়ায় কঠিন দৃষ্টির নিরীক্ষণের কাছে নিজেকে সমর্পণ করতে বাধ্য হলো শান্তি। ফের আরেকবার আবিষ্কার করলো এই শরীরটাই তার আগামী ঠিক করবে। 

কুশল বলেছিল, তার শরীরের সমস্ত ভাঁজে ঢেউ আছে। গভীর নিশ্ছিদ্র পর্যাপ্ত পরিমাণে নদী বয়ে চলে স্পর্শের অনুরণনে। কুশলের জন্যে গোটা সমুদ্র পেতে বসে ছিল সে। তার ইচ্ছেমত স্নান করতে পারতো, ভেসে বেড়াত, ডুব দিয়ে তুলে আনতো অচেনা বোধের মুক্তো মানিক্য। সামুদ্রিক সে জোয়ারের সামনে দৃশ্যত অসহায় শান্তি পাড়ে বসে সারাজীবন খেলা দেখার স্বপ্ন দেখেছিলো। তখনো বোঝেনি কুশল শুধু ডুবুরি হিসেবে সন্তুষ্ট থাকার যুবক ছিলো না। 

‘এই যে আপনাদের মেয়েকে দিয়ে গেলাম। হরিয়ানা কতদূর জানেন? গুরগাঁও?’ 

দারোগাবাবু ভীড়ের মাঝে কাজের বাহবা চাইছিল। তবে এই দু বছরেই পৃথিবীর অনেকটা জেনে ফেলা শান্তি বোঝে, ভীড়ের নিজস্ব মতবাদ নেই। তারা শুধু মাথা নাড়াতে পারে। সিদ্ধান্তহীনতায় ভোগা মানুষেরাই ভীড় হয়। মুখ চাওয়াচাওয়ি করার পর যে কোনো একজন ভুল করেই কিছু করার চেষ্টা করলে বাকি সবাই অনুসরণ করে। মিনতি বলেছিল, ভেড়ার পালের সর্দার সব ভেড়ার পেছনে লাঠি হাতে দৌড়ায় না। যে কোনো একজনকে এগিয়ে দেয় ফিরতি পথের দিকে, বাকিরা তার পেছনে অন্ধের মত হেঁটেই বাড়ি ফিরে আসে। 

‘লৌটানো কো কৌন বোলা।’ কণ্ঠ চেনার চেষ্টা করেও চিনতে পারলো না শান্তি। মা বলেনি নিশ্চিত। এখনো বড় বড় গোল চোখে তাকে আপাদমস্তক পড়ছে মা। একা মা নয়, চারপাশের সমস্ত মহিলারা তাদের হাজার কোটি চোখ দিয়ে পড়ছে তাকে। চোখের স্পর্শ পাবার অভিজ্ঞতা তার প্রথম নয়। শরীরের পরীক্ষা আগেও হয়েছে। যেমন করে তাকে টিপে দেখে সুইটিদি বলেছিলো, একটু মেরামত করে নিলেই এ মেয়ে চলবে, ঠিক তেমনি ভাবেই উঠোনে বসে তার আত্মীয় প্রতিবেশীরা ঠিক করে নিচ্ছে সে চলবে কি না। ফিরে আসার উপযুক্ত কিনা। 

টলোমলো পায়ে বাবা বেরিয়ে এলো। বেশ বোঝা যাচ্ছে সন্ধ্যে হতে না হতেই অনেকটা চড়িয়েছে। সস্তা হাঁড়িয়ার উৎকট গন্ধ বেশ কয়েকমাস পর পেলো শান্তি। চিরকালীন রুগ্ন লোকটি আরো শীর্ণ হয়েছে। উজ্জ্বলহীন মুখে অসুস্থতার লক্ষণ স্পষ্ট। কটু গন্ধে দারোগাবাবু রুমাল চাপলো নাকে। ইতিমধ্যে পৌঁছে যাওয়া স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের সদস্যরা ইতস্তত করছে। আশ্চর্যজনকভাবে শান্তিও টের পেলো, ছোটো থেকে যে গন্ধ মেখে বড় হয়ে ওঠা তাই এই কয়েক মাসের অনভ্যাসে দুর্গন্ধ রূপে চিনছে। 

‘আমার কাজ শেষ, আমি চললাম।’ 

দারোগাবাবু ফিরে যেতেই নিরাপত্তাহীনতার অপ্রীতিকর পরিস্থিতি জাঁকিয়ে বসলো ভেতরে। সামনে দাঁড়িয়ে বাবা মা আত্মীয় প্রতিবেশী। নিরাপত্তার চাদর মুড়ে শান্তির ঘুম দেবার কথা যাদের সামনে, তাদের নজরেই অস্বস্তি বাড়ছে। ফ্যাকাশে আলোতেও শান্তি স্পষ্ট বুঝতে পারছে, নজরের কোনো লিঙ্গ বৈষম্য হয়না, হয় মানসিকতায়। 

বন্ধ চা বাগানের এই চরাচরে সবাই সুযোগ খোঁজে কাজের। ছোটো থেকেই বোঝে স্কুলের চাইতে ফ্যাক্টরির আকর্ষণ অনেক বেশি। নিদেনপক্ষে শহরে ছোটো খাটো মজুরির কাজ। বাগানের মরদরা 

যখন যা পায় তাই করে। বেশিরভাগ দিনই কোনো কাজ থাকেনা। শান্তিকে যখন কুশলদা কাজের প্রস্তাব দেয় কলকাতার বড় হোটেলে, সিদ্ধান্ত নিতে একদমই দেরি করেনি সে। 

কুশলদার সঙ্গে পরিচয় বাগানেই। মাঝে মাঝেই সাইকেল নিয়ে তাদের মোড়ের মাথায় দাঁড়িয়ে তার আসা যাওয়া মুগ্ধতার সঙ্গে জরিপ করতো।  খেয়াল করলেও উপেক্ষা করার চেষ্টা করেছিলো সে। উঠতি যৌবনের শান্তির কাছে লোলুভ পুরুষের দৃষ্টি নতুন নয়। আলাদা করে বিচলিত হয়নি। অন্যরকম কিছু মনে হয়নি। আচমকা একদিন সাহস করে এগিয়ে এসে নাম জিজ্ঞেস করেছিল। উত্তর দিয়েছিল। তারপর প্রতিদিন একই সময়ে একই জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকতো শান্তিকে দেখার ইচ্ছেয়। 

প্রায় মাস খানেক পর শান্তি এগিয়ে এসে কারণ জানতে চেয়েছিল। ‘তোমাকে দেখতে ভাললাগে।’ পরিষ্কার উচ্চারণ করেছিলো সে। দ্বিধাহীন পুরুষরা বেশ ব্যক্তিত্বময়। শান্তি বন্ধুত্ব করতে উৎসাহী হয়েছিল। কয়েক সপ্তাহ মেশার পর কুশলদা যখন বড় শহরে কাজের কথা বললো, সম্মতি দিতে দ্বিধা করেনি সে। নদী দেখা হয়ে গেলে সব মাছই কি সমুদ্রের ঠিকানা খোঁজে না?

‘তু শান্তি নেহি হ্যা।’ 

কাছে এসে বাবা যেন পরীক্ষার ফলাফল ঘোষণা করলেন। কিছুটা ক্ষুণ্ন হলেও শান্তি বোঝার চেষ্টা করলো গত দু আড়াই বছরে তার চেহারার পরিবর্তন সহজে তাকে পরিচিত অবয়বের ছাঁচে ফেলছে না। যে শান্তি দুর্বল বুকে আশান্বিত চোখে বাগান ছেড়েছিল সে শান্তি ফিরে আসেনি। সুইটিদি তাকে নিজের হাতে ভেঙে নতুন করে গড়েছে। আধুনিকতার পাঠ পড়িয়েছে। কাস্টমারদের সামনে কি করে দাঁড়াতে হয়, হাঁটতে হয়, কোন প্রসাধন ব্যবহার করে মোহময়ী হয়ে উঠতে হয় সব শিখিয়েছে। বদলে যাওয়া শান্তি পুরোনো শান্তির থেকে অনেক বেশি আত্মবিশ্বাসী। 

বন্ধ চা বাগানে এই আত্মবিশ্বাসটাই তাকে অচেনা করে তুলেছে। 

বেঈমান কুশল যখন সুইটিদির হাতে তাকে তুলে দিয়ে আর ফিরলোনা, কিছু কিছু দরজা চিরতরে বন্ধ করে দেওয়ার কথা ভেবেছিলো সে। প্রথম রাতেই বুঝেছিল সম্মান নেই, টাকা আছে। সেই কাঁচা টাকার লোভেই পড়েছিলো শান্তি। কয়েক ঘণ্টার অত্যাচারের পর হাতে আসা রাশি রাশি টাকা নিজের মত খরচ করতে পারতো। বড় হোটেলের বাঁধা মেয়েমানুষ রূপেই পরিচিতি পেয়েছিল। কয়েক মাসেই উন্নতি। দ্রুততার জীবনের খাপে মানিয়ে নেবার চেষ্টায় বাগানের ফেলে আসা অলস রোদ ভেসে উঠতো যে না তা নয়, তবে পূর্বজন্মের স্মৃতি হিসেবে সরিয়ে রাখতে হতো তাকে। শান্তিলতা এক্কা মৃত, তার নতুন পরিচয় স্যান্ডি হিসেবেই। 

হোটেল থেকেই পাঠানো হয়েছিল গুরগাঁও শাখায়। সেই হোটেলটি ছিল আরো বড়। অধিক পেশাদার। এখানে তার ডিউটি পড়তো বিদেশি অতিথিদের আপ্যায়নে। বিভিন্ন কোম্পানির প্রতিনিধি অথবা চুক্তি করতে আসা বিদেশি অভ্যাগতদের মনোরঞ্জনে ব্যবহার করা হতো স্যান্ডিকে। যত বেশি বৈচিত্র্য ততো বেশি টাকা। অর্থের সবচেয়ে বড়ো বৈশিষ্ট্য হলো নির্মিত বৃত্তের মধ্যেই ভুলিয়ে রাখতে সক্ষম। মানুষ বৃত্তের বাইরে মুখ তুলে চাইতে ভুলে যায়। 

‘তু মেরা শান্তি নেহি হ্যা।’

বাবা বলছে নাকি সস্তার হাঁড়িয়া বলছে বুঝতে না পারলেও, দ্বিতীয়বার একই কথার পুনরাবৃত্তিতে নিশ্চিত হলো উপলব্ধিটি অনুরণিত হচ্ছে তার ভেতরে। আচমকা চেনা মানুষ অপরিচিত হয়ে ওঠার বোধ অস্বস্তি বাড়াচ্ছে। শান্তির যৌবন বহু পুরুষের স্পর্শের আতিশয্যে আকর্ষণীয় হলেও, হৃদয়ের অন্তরে ঘাপটি মেরে থাকা মেয়েটিকে বাবার তো চেনা উচিৎ। হাত ধরে টেনে তোলার ভূমিকা তো বাবারই নেওয়া দরকার। শান্তি খুব করেই চাইছে, একবার কাছে এসে কেউ অন্তত তাকে বলুক, আয় গুড়িয়া, কাছে আয়। অনেক দৌড়েছিস, শান্তিতে এবার বস। 

সে তো ফিরে আসার জন্যেই কোনো এক শীতের আধো আলো ভোরে বাড়ি ছেড়েছিল। 

গুরগাঁওয়ের হোটেলে দু পার্টির চুক্তি ভেস্তে যাওয়াতে বিক্ষুব্ধ গোষ্ঠী এসে যখন নির্মমভাবে হত্যা করলো প্রতিহিংসায়, পুলিশ বাকি অনেকের সঙ্গে শান্তিকেও তুলে এনেছিল থানায়। জিজ্ঞাসাবাদের সময় ঠিকানা জিজ্ঞেস করাতে সে বলতেই পারতো সুইটিদির কলকাতার ঠিকানা, নিদেনপক্ষে এ লাইনের একমাত্র বন্ধু মিনতির ভাড়ার বাড়ির ঠিকানা, কিন্তু সে স্পষ্টভাবে উচ্চারণ করেছিলো ডুমদুমি চা বাগান, মালবাজার, জলপাইগুড়ি। তার আগ পর্যন্ত তার কাছেও ধারণা ছিল না বাড়ি ফেরার ইচ্ছে এতটা তীব্রভাবে বেঁচে ছিল। 

গুরগাঁও পুলিশ মালবাজার পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ করে নিশ্চিত হয়েছিলো। খবরও পেয়েছিলো শান্তির নামে বছর দুই আগের নিরুদ্দেশ সংবাদের বিজ্ঞপ্তির। খুশি হয়েছিল সে। তার খোঁজ করছে কেউ, এই বোধ তার একান্ত নিজস্ব পাওনা। জীবনের একমাত্র সম্পদ। সমান ভাবে সমান দৈর্ঘ্যে ছাটা চা গাছগুলোর সামনে দাঁড়িয়ে কেউ তাকে খোঁজার কথা ভাবছে, চোখ বন্ধ করেই এ দৃশ্য কল্পনা করে স্থবির হয়ে থাকতে চেয়েছিল সেদিন। বাড়ি ফেরার অদম্য জেদ তাড়িয়ে নিয়ে বেরিয়েছিল। 

‘যে কোনো দরকারে জানাবেন। আমরা আছি। এখন ঘরে গিয়ে বিশ্রাম নিন।’ 

অনেক্ষন ধরে একই জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকা শান্তি মুখ ফেরালো। স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের দাদা আশ্বাস দিলো সাহায্যের। ইতিমধ্যে অনেকটা করেছে। ভিন রাজ্যের পুলিশের সঙ্গে অনবরত যোগাযোগ রেখে সমস্ত কাগজপত্র তৈরি করে তাকে ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা করেছে। সতর্কও করেছিল। জানিয়েছিলো বাগানের প্রায় সবাই শান্তির বর্তমান কাজ সম্বন্ধে জেনেছে কুশলের পরের শিকারি রম্যার থেকে। বুদ্ধিমতি রম্যা সুইটিদির খপ্পর থেকে পালিয়ে আসতে পেরেছিল দিন কয়েকের মধ্যেই। অভিজ্ঞতার বর্ণনা দেবার সময় খবর দিয়েছিলো শান্তি স্বেচ্ছায় দেহ বিক্রি করছে। সুযোগ থাকলেও ফেরত আসেনি।

তার পরে আরো দু বোন আছে। ভীড়ের মধ্যে তাদের দেখছে পাচ্ছেনা শান্তি। দিদি ফিরেছে জন্যে একবার ছুটে এসে জড়িয়ে ধরবে না? অনেকদিন নির্মোহ স্পর্শের অনুভব পায়নি সে। ফিরে আসার শর্তই তো পুরোনো জীবন ছেড়ে আসা। ভালোলাগার রেশটুকু পুনরায় প্রত্যক্ষ করা। ভুলতে বসা মাথার ছাদের নিচে গিয়ে দাঁড়ানো। কিন্তু একবার ভেতরে যেতে না বললে নিজের ঘরে এভাবে কি অতিথির মতো গিয়ে ওঠা যায়!

দ্বিধাগ্রস্ত শান্তি মুখ ফিরিয়ে দাদাদের দিকে চেয়ে থাকলো। 

বাবা আরো কাছে এগিয়ে এলো। আপাদমস্তক জরিপ করছে শান্তিকে। শরীরের প্রত্যেকটা কোণে চোখ ফেলে আলোকিত করছে বাড়ন্ত যৌবন। ভালোমতই বুঝছে, বাবা কিসের নেশায় এভাবে দৃষ্টি হাতড়ে বেড়াচ্ছে। সুইটিদি যেভাবে হাতে মেপে নিয়েছিল তাকে, বাবা যেন নজর দিয়ে মাপছে। অস্বস্তি বাড়ছে তার। পুরুষের অন্বেষিত লোলুপ দৃষ্টির ছারখার করে দেবার বোধ ফিরে ফিরে আসছে। পরিণত শান্তি বোঝে প্রতিটি বাবাই পুরুষ। হোটেলে যারা মস্তি করতে আসতো তারাও হয়তো কোনো কন্যার পিতা। নতুন দুনিয়ার গোপন নিয়মনীতিতে অভ্যেস গড়ে ওঠার পর বাড়িতে ফিরে বাবাকে সাধারণ বাকি পাঁচজন পুরুষ হিসেবে আবিষ্কার করা তার কাছে বড়ো ধাক্কা। 

আকর্ষণীয় যৌবনের জোয়ারে দু বছর পর তার বাবাও কি তাকে আর ছোট মেয়ে হিসেবে গ্রহণ করতে পারছে না? 

তার নিজের বাড়ি, চেনা পরিবেশ, গোল্লাছুট খেলে বেড়ানোর উঠোন ধীরে ধীরে গুরগাঁওয়ের হোটেলের মত হয়ে উঠছে যেন। শান্তি পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছে, সুইটিদি উল্টোপাশের সোফায় কিছু সিনিয়র মেয়েদের সঙ্গে বসে নিরীক্ষণ করছে তাকে। দামি বিদেশি মদ গিলে নেশাগ্রস্ত বিদেশি বাবু টলোমলো পায়ে এগিয়ে এসে মাপছে শান্তিকে। ভুল পছন্দে একটা গোটা রাত নষ্ট করার কোনো ইচ্ছে পয়সাওয়ালা অতিথিদের নেই। 

অবনত মুখ তুলে সে দূরে বসা সুইটিদির দিকে চাইলো। শেষ আস্বাসটুকুর নিশ্চয়তায়। পরীক্ষাতে উতরে যাবার চিরাচরিত ইচ্ছেয়। বাকি দুজন বোনকে এখনো দেখতে পাচ্ছে না। একটা বয়সে এসে ছোঁয়াচ বাঁচিয়ে রাখার লড়াইয়ে হাল ছেড়ে দিতে হয়। এ লড়াই সম্পুর্ন একপেশে। 

‘তু কৌন হ্যাঁ?’

বাবা প্রায় গা’য়ে উঠে এসেছে। হাঁড়িয়ার নেশায় অচেনা মেয়েটিকে চিনতে চাইছে নাকি তার পরিচয় নাগালে আনার চেষ্টা? এভাবেই কি প্রতি সন্ধ্যেতে পেটে সস্তা নেশা নিয়ে পরীক্ষা নিতে আসবে?

কয়েক পা পিছিয়ে এলো শান্তি। বাবার থেকে বেশ কিছুটা দূরে। মা আরো ছোটো হয়ে এলো। মুখ ফিরিয়ে স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার দাদাদের দিকে চাইলো শান্তি। লেবার লাইন উপচে পড়া ভীড়ে ছোটো পরিসরের উঠোনে শ্বাসরুদ্ধ হয়ে আসছে। বুঝতে পারছে,বুক ভর্তি স্বাচ্ছন্দ্যের নিশ্বাস নিতে চাইলে বাইরে গিয়ে দাঁড়াতে হবে। সবকিছু থেকে দূরে। নির্মিত বৃত্তের ঊর্ধ্বে। যুদ্ধক্ষেত্রের বাইরে বসে লড়াই দেখার ইচ্ছে প্রতিটি সৈনিকেরই কি হয়? 

বাবার শেষ প্রশ্নে অস্ফুটে শুধু স্বগতোক্তি করলো, ‘ম্যাই কৌন হু?’ 

নতুন উপলব্ধিতে সওয়ার হয়ে এতক্ষণ গ্রহণযোগ্যতার আশায় নুইয়ে রাখা মাথা তুলে, ওপরের জ্যোৎস্না মাখা বিরাট আকাশের দিকে চাইলো সে। এই আকাশের নিচেই ডুমদুমা, এই আকাশের নিচেই গুরগাঁও। এই আকাশের নিচেই শান্তি।

প্রতিভাস ম্যাগাজিন | Prativas Magazine

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *