সাধন চট্টোপাধ্যায়
হঠাৎই কেজি দেড়েকের ব্যাঙটা রাস্তা পেরোতে গিয়ে জিরন-লাফে থুপিয়ে পড়ল ভেজা পিচের ওপর। জানে না, সামান্য দম নিয়ে ফের লাফের আগে, এখন, সম্পূর্ণ সে নিরাপত্তাহীন। মরশুমের বাদলসন্ধ্যায়, রাস্তাটি-বিশেষত পিচেমোড়া লম্বা অঞ্চলটা–চাকায়-চাকায়, আলোয়-আলোয়, ডিজেলের ধোঁয়া ও গন্ধে, শব্দের যন্ত্রণা ও পেট্রলের পিচ্ছিল ও ময়ূরকণ্ঠি বাতাবরণে – নির্বোধভাবে কুটিল।
মানুষের মাথায় মাথায় ছাতার শরীরে আকাশ যেন ভারি হয়ে নেমে এসেছে। ট্যারা-বাঁকা জলকাদার মাটি ও কাঁকড়ের ফুট দূরে সাবধানে শিবু আসছিল উল্টোমুখ ধরে। সে প্রথমে বেঢপ ব্যাঙটা দেখে নি। ফ্রকভেজা মেয়েটা মায়ের সাথেসাথে যখন বলে গেল–বাব্বা! দেখলে! দাদুর সেই ব্যাঙ রাজাটার সাইজ! তখনই শিবু তাকায়, বিস্ময়ে দাঁড়িয়েও পড়ে। খুব ব্যস্ততা ছিল না ওর। তা ছাড়া ছেলেবেলায় মাঠ-ঘাট থেকে যে কাঁচ চিবোনো কট্ কট্ ডাকতে থাকা আওয়াজ–তালে এরাই? গলা থেকে পেট অবধি সাদা চামড়ায় সদ্য পেট্রোলের ময়ূরকণ্ঠি ছাপ। সামনের দুটো পায়ে ভর দিয়ে হুমদো মেরে হাঁপাচ্ছে এবং পেছনের পাজোড়া নেতিয়ে বেজায় পেল্লাই; কদাকার আঙুল। পিঠের চামড়া জীবনের বহু ধকল এড়িয়ে গুটিগুটি শ্যাওলা লেগে থাকা হলুদ। ঝিরঝিরে বৃষ্টির জল আটকে আছে সেখানে, পোস্টের আলো প্রমাণ দিচ্ছে তা। ন্যাতানো, মাংসল পা দুটোর আশ্রয়ে ব্যাঙটা হেঁচড়ে টেনে নিয়ে চলেছে একটি গর্ভ-পেট; থকথকে ডিমরাশির একটি পিণ্ড। এক্ষুনি ঠেলে বেরিয়ে পড়বে সব। ঘাড়হীন মাথায় একজোড়া চোখ কেমন বোকাবোকা! ব্যথায় কেমন ঘোরঘোর। ব্যাঙটা আড়াল পেলেই বিয়োবে। চরম মুহূর্ত উপস্থিত। তাই, আলো-রাস্তা, গন্ধ-চিৎকার, চাকা ও নিষ্কাষণ পাইপের মরণ-ধোঁয়া বাঁচিয়ে একটু ঝোপ, নর্দমা বা নির্জন ঘেরাটোপ খুঁজছিল, যেখানে সে নিজেকে লুকিয়ে রেখে প্রবাহিত জীবনের অমোঘ কর্তব্যটি সারবে।
ভাগ্যিস এই মুহূর্তে স্পটটি ফাঁকা। দূরে দূরে কদমফুলের হেডলাইট নিয়ে বাস, লরি বা চঞ্চল তিনচাকাগুলো পাল্লা দিয়ে পৌঁছে যাবার আগে, সময় ও স্থানটুকু ব্যাঙটাকে ধারণ করে বিপদের সংকেত হয়ে ঝুলছে। কড়ায়ে ঝামা ঘষলে কানে যে প্রতিক্রিয়া হয়, শিবুর ভাবনাটা তেমনই উদব্যস্ত করে তুলল নিজেকে। ঘষটে চলা একটি টায়ার কয়েক টনের ভার ও গতি নিয়ে, থমথমে, ফুলো পেট এবং হাড়গোড়, মাথাটার ওপর উঠে বসলেই পিষে, থেঁতলে, পেছল ডিমরাশি দলাদলা, প্যাচ করে ছিটকে… … …!
ব্যাঙটার চোখ তেমনই ঘোরঘোর। ব্যথায় কি অক্ষিগোলক কোটরে ঢুকে যাচ্ছে? মনে হলো, ব্যাঙটা উঠতে পাচ্ছে না। ক্লান্ত ও নিঃশক্ত হয়ে পড়েছে। আপ্রাণ চেষ্টা করছে রাস্তা পেরনো লাফের জন্য শরীর থেকে একটু ঝাঁকুনি আদায় করতে।
শিবু দেখে গলার নিচে, তুলতুলে চামড়ায় থিরথির কল্পনা এবার হয়ত লাফ দেবে। কিন্তু যদি না দিতে পারে? শিবুর তর সইল না। দুপা এগিয়ে এসে, ব্যাঙটার পাছার কাছে বুটজুতার ডগাটি রেখে আলতো টুসকি দিল। আর তাতেই প্রাণীটা উড়ে এসে কাদার ফুটপাতে। থপাস্! কিন্তু একি? চার ঠ্যাং ছড়িয়ে চিৎ হয়ে সেই যে পড়ল, নড়ে না চড়ে না। এমনকি থাই, জননেন্দ্রিয়র চামড়া হলদে-সাদায় করুণ। শিবুর ভয় হয়। গূঢ় পাপবোধ চোঁয়াতে থাকে অন্ধকার মনের দেওয়াল থেকে। হত্যা করল? কেজি দেড়েকের শরীরটা, শিথিল পা, বে-সমান আঙুলগুলো সব চিৎ হয়ে থেকে রইল। শিবু নিজেকে বোঝাতে পারে না, এক পেট ডিমরাশি–প্রাণের কোটি কোটি অনু, যা একটু পরেই ফুটে বেরুত মাটির পৃথিবীতে এবং ফুলকা ও ব্যাঙাচি পর্বের পর চুলবুলিয়ে ঘাসের আড়ালে মহাপ্রাণচক্রের কুশীলবদের ভূমিকা পালন করত — আমরা শেষ করে দিয়ে কোথাও দায়ি রয়ে গেল নাতো?
একজন পাশ দিয়ে মন্তব্য করে গেল – উল্টে রাখুন। নইলে সাত দিনেও আকাশ ধরবে না।
শিবু মন দিল না মন্তব্যে। জুতোর ডগাটুকু ভেদ করে ব্যাঙটার সেই ছুঁয়ে ফেলা অংশটির চামড়ার ঠান্ডা যেন আঙুল বেয়ে সমস্ত দেহে ছড়িয়ে যাচ্ছে। হয়ত মরেনি ; আমার জুতোর উটকো ঘা’তে মাটিতে থুবড়ে পড়ে সামান্য বেঁহুশ – ভাবল সে। কিন্তু চেতন, অবচেতন বা মৃত যে অবস্থাতেই থাকুক না কেন, ঐ ভাবে পড়ে থাকাটা কি নিরাপদ? গাড়ি সাইড কাটাতে প্রায়ই নামতে বাধ্য হচ্ছে ওখানে। ডগা দিয়ে আর সামান্য সরিয়ে দিতে পারলে – অন্তত ভেজা ঝোপ বা নর্দমার পাশ – আপাতত উদাস নির্মমতার হাত থেকে রেহাই। প্রাণতো বিচ্ছিন্নভাবে ফুরোয় কিন্তু নিষ্ঠুরতা সহ্য হয় না। শিবু কৃতকর্ম নিয়ে আর কিছু ভাবতে পারল না। হন হন করে স্টেশনমুখো সোজা।
কিন্তু ওখানে দাঁড়িয়েও অবসরের শান্তি পেল না। কুড়ি-পঁচিশ মিনিট বাদে এ পথেই ফিরতে হল। বুক ঢিপ ঢিপ। কি দেখবে ঐ স্পটটিতে? যে স্পটটি নিজে সে তৈরি করে গেছে? চাকা নেমেছিল কি? সমস্ত কিছু ফেটেফুটে ছত্রাকার, জেলি পিণ্ড-প্রায় এবং কাদা-রক্তে… … …? অথবা চেতন ফিরতেই কাতরে কাতরে ব্যাঙটা সরে গেছে একটু। চাকার শব্দে ভয়ে আশ্রয় নিয়েছে ঝোপে এবং সব ঋণ নিকাশ করে মুক্ত।
এই সব ভাবতে ভাবতে স্পটে এসে কিছুই দেখতে পেল না শিবু। কোনো কিছুই নয়। কাদায় চাকার দাগ, কিন্তু থ্যাঁতলানো মাংস নেই। তবে কি বৃষ্টিতে, চাকায়-চাকায়, পায়ে পায়ে ধুয়ে গেছে সব? আর কাতরে কাতরে ঝোপে ঢুকলেও কে সাক্ষী দেবে তার? শিবু অশান্তি নিয়ে বাড়ি ফেরে।
সে রাতে মাছ খুঁটে মুখে দিতেই বমি-বমি। খেয়েদেয়ে কখন ঘুমোয় টের পায় না। কোথায় কি ভাবে, কেন সে দৃশ্যটি দেখল বুঝতে পারে না। জানালার শিক গলিয়ে ব্যাঙটি মানুষের মতো তাকিয়ে।
— ধন্যবাদ! দৃষ্টি মৃদু হাসে।
শিবু অবাক হয়ে বলে — কেন? কিসের ধন্যবাদ?… … … মানে, আপনি … … …?
দৃষ্টি এবার আরও স্নিগ্ধ।
— জুতোর ডগার ঘাতটি বেশ মোক্ষম! … … চাকাগুলোর কথা মনে থাকলেও বেভুল হলে কে কি করতে পারে? … … …আপনাকে ধন্যবাদ! শিবু ধরতেই পারল না ও কি পাশে সরতে পেরেছিল, নাকি ফট্ করে বেলুন ফাটিয়ে ধোঁয়া-ধুলো ও চাকাগুলো ছুটেছিল আপন যাত্রায়? ব্যাঙটার দৃষ্টিতে মানুষের মতো স্বস্তির হাসি আছে বটে, অন্য দিকে একটি চোখের কোন থেকে রক্তফোঁটা গড়াচ্ছে। ভারি ধন্দে পড়া গেল। ব্যাঙটা ঐ ভাবে দাঁড়িয়েই রইল এবং শিবু ক্রমে ক্রমে রূপান্তরিত হয়ে গেল একটা ব্যাঙ-এ। মস্ত থলথলে একটা গর্ভ, পেছনের দুই ঠ্যাংয়ে আড়াল দিয়ে রাস্তার পাশে হাঁসফাঁস করছে। রাস্তাটুকু পেরুবে। এত ব্যস্ততা কখনো দেখেনি রাস্তায়। ধোঁয়াধুলো, চাকা হর্ণ, কার্বনমনোক্সাইড এবং নিষ্ঠুর উদাসীনতায় টায়ারগুলো ছুটছে স্যাটস্যাট। এত দ্রুত ছুটছে সব, ছিটোনো পেট্রলের ফোঁটাগুলো পর্যন্ত, শিবু-ব্যাঙটিকে গাঢ় প্রলেপ দিচ্ছে। দম নিতে পারছে না। অসহ্য যন্ত্রণায় থলথলে গর্ভটি সহ শরীর হটিয়ে অপেক্ষা করছে। কিছুতেই এক টুকরো অবসর বা মুহূর্তের সুযোগ তাকে দেওয়া হচ্ছে না যাতে রাস্তাটা পেরিয়ে নির্জন একাকিত্বে মহাপ্রাণের কাছে আপন ঋণটুকু শোধ করতে পারে।
ভোর হয়। স্বপ্ন ভাঙে। বালিশের পাশে শোওয়ান ট্রাঞ্জিস্টারে খবর শুনে শিবু, পৃথিবী নামক অতিপরিচিত গ্রহটির আকাশ ফুটো হয়ে রুদ্র-আলোককণা হর্ণ, হেডলাইট এবং টায়ারের গতির লক্ষগুণ বেগে ছুটে আসছে এবং সেই পথের দুধারে কয়েক ‘বিলিয়ন ব্যাঙ’ অপেক্ষা করছে কি ভাবে পারাপার করবে লাফিয়ে লাফিয়ে।
(পুনর্মুদ্রিত)