পাতাউর জামান

এই রাস্তা দিয়ে রোজ সকালে হেঁটে যাওয়ার সময়, একটা ডাক আমি শুনতে পেতাম, ‘হেই বিষ্ণু?’। এই ডাকের প্রত্যুত্তর রাস্তার ওপারে, লটারি কাটার দোকানের সামনে থেকে যেটা আসত, সেটা ছিল এই রকম – ‘কেস দেব কিন্তু’। 

যে উত্তর দিত, বয়স ঠিক বোঝা না গেলেও বছর চল্লিশের হবে, আমার অনুমান। লুঙ্গি পরা, গায়ে সাদা টেরিকটের শার্ট। ল্যাম্পপোস্ট আঁকড়ে ধরে সে উত্তর দিত। লোকটা ডাকের উত্তর দেওয়ার পর আর ল্যাম্পপোস্ট আঁকড়ে ধরে থাকত না। আদিম বটগাছের ঝুরি জমতে জমতে যেভাবে দুর্ভেদ্য হয়ে বটগাছের গুড়িকে বেষ্টনীর মধ্যে চেপে রাখে, চারিদিকে একটা আশ্রয়ের গোলাকার ক্ষেত্র তৈরি করে, আমি দেখতাম লোকটা কেস খাওয়ার কথা বলে ল্যাম্পপোস্টের গায়ে গজিয়ে ওঠা ঝুপড়ির মধ্যে বিলীন হয়ে যায়। যদিও ল্যাম্পপোস্টের মধ্যে বিলীন হয়ে যাওয়ার কথা নয়, ওর নীচে যে ঝুপড়ি গজিয়ে উঠেছিল, তাতে ঢুকে পড়ে। 

আমি দেখতাম ডাক দেওয়ার লোক রোজ না হলেও, সপ্তাতে অন্তত দুদিন বদলায়। পরে অবশ্য লোকগুলোর মুখ চেনা হয়ে গেছিল। ওরা এখানে, এই চত্তরেই কাজ করে। আমি শুনেছিলাম, এরাই মহম্মদ বিষ্ণু অ্যালফ্রেডকে দেখভাল করে। কেউ গাঁট বয়ে বেড়ায়,  কেউ ঠেলা বয়, কেউ ফুটে বাহারি আইটেম নিয়ে বসে। এরাই মহম্মদ বিষ্ণু অ্যালফ্রেডের পেছনে লাগলেও দুপুরের খাবারটা, রাতের খাবারটা এমনিতে দিয়ে যেত।   

ফেরার সময় যখন এ পথ দিয়ে ফিরি, তখন আর লোকটাকে দেখি না। কিন্তু এমন নয় যে আমি লোকটাকে চিনি না। আমি কেন, এই চত্তরে প্রায় সবাই চেনে মহম্মদ বিষ্ণু অ্যালফ্রেডকে। 

ব্যাপারটা আমি আমার অফিসের বন্ধুদের বলেছিলাম। কেউ হেঁসে উড়িয়ে দিয়েছে। কেউ আবার পাত্তাই দেয়নি এই বলে যে – এটা আবার চমকপ্রদ কী এমন ঘটনা! এরকম কত কিছু হয়। আর নামের ব্যাপারটা, হিন্দি সিনেমা-টিনেমা দ্যাখো না বুঝি – অমর আকবর অ্যানটনি। আমি তর্কের বিড়ম্বনায় যায়নি। জানি এটা খুব একটা চমকপ্রদ ঘটনা নয়, কিংবা অভিনবও নয়। তবে ব্যাপারটা আমাদের গা সওয়া হয়ে গেছিল।

রোজ সকালে হাওড়া স্টেশনে নেমে, হেঁটে ব্রিজ পার হয়ে স্ট্যান্ড রোড পিছনে ফেলে বুড়টোলা রোড ধরে এগোলে তিন নম্বর ক্রসিংএর ডান দিকে ঢুকেই আমার অফিস। আর এই ব্যাপারটা ঘটে ঢুকতেই দুনম্বর ক্রসিংএ। ছেলেবেলায় নামতা শিকতে গিয়ে শুনেছি, দুই থেকে তিনের কী এমন আর দূরত্ব! দুয়ের পরেই তিন আসতে কয়েক সেকেন্ড সময় লাগে। কিন্তু তিন নম্বর ক্রসিং থেকে দুনম্বর ক্রসিংএ যেতে আমার মিনিট পাঁচেক লাগত।

আমাদের হিসেবরক্ষার কাজে যখন মাথা ধরে যায়, তখন আমরা, মানে আমাদের অফিস কলিগরা মিলে এক সাথে চা খেতে বের হই দু নম্বর ক্রসিংএ নাটুর চায়ের দোকানে। বেশ গাড়, কড়া লিকার এবং চিনি দিয়ে চা। পাশে লটারির দোকান আছে। আমাদের মধ্যে কেউ না কেউ হপ্তার কোনো না কোনো দিন লটারি কাটবেই কাটবে। ভাগ্য পরীক্ষার একটা বড়ো উপায় হল এই লটারি। আমি যদিও কাটি, জেনেই কাটি যে আমার লটারি লাগবে না কোনো দিন। তবুও কাটি। কিন্তু মহম্মদ বিষ্ণু অ্যালফ্রেডের উল্টো দিকে লটারির দোকান থাকলেও কখনো দেখিনি ওকে লটারি কাটতে। পরে মনে হয়েছিল, ও তো পুরো জীবনটাকে লটারি বানিয়ে ফেলেছে। 

নাটু, আমাদের যেদিন দেরি হত, সেদিন বলত, এই যে ম্যানেজারবাবু আজ দেরি করে? এর মানে এই নয় যে  – নাটুর দোকানে কোনো ভীড় থাকে না। একদিকে বড়ো ডেকচিতে অনবরত লিটার কুড়ি দুধ ফুটতে থাকে, অন্যদিকে বড়ো চায়ের কেতলি থেকে চায়ের ভাঁড় ভরতেই থাকে। তাও নাটু আমাদের সাথে কথা বলে। আড্ডা মারে। বাড়িতে পুজো-টুজো হলে প্রসাদ নিয়ে এসে খাওয়ায় আমাদের। আমরা গণেশচতুর্থীর দিনে অফিস থেকে পাওয়া লাড্ডুর দু-একটা এক্সট্রা বাক্স নাটুর জন্য আলাদা করে রাখি। ফলে আমাদের কোনো দিন চা খেতে গিয়ে ওয়েট করতে হত না। নাটু চালাকি করে সবাইকে এড়িয়ে আমাদের চা বাড়িয়ে দেয়। কোনো দিন বলত, বাবুলোককো সাইট দো। কানো দিন বলত, সাহেবলোক আ গয়া। থোড়া সাইট পিলিজ। কখনোও আবার অন্য কিছু। আসলে আমাদের এখানে ‘দোপেহের কা চা’ বলে একটা রেয়াজ আছে। দেড়টার মধ্যে লাঞ্চ খেয়ে কাজে লেগে পড়তে হয়, ফলে তিনটের সময় এক কাপ চা খুব জরুরি হয়ে পড়ে। ঐ সময় প্রায় সব দোকান থেকে কর্মচারীরা এসে, আমরা যেমন নাটুর দোকানে জড়ো হয়েছি, অন্যরাও তেমনি হয়। মালিক কিছু বলে না। মাড়োয়ারি মালিক, কাজ বোঝে, কীভাবে কর্মচারীদের দিয়ে কাজ করিয়ে নিতে হয়, সেটা ভালো ভাবেই জানে। তাছাড়া এই চত্তরে এটাই রেওয়াজ। মালিক রেওয়াজকে এড়াবেন কী করে ! 

আজ কাজে আসার সময় আমি কোনো ডাক শুনতে পাইনি। রাস্তা পুরো ক্লিয়ার ছিল। ট্রাফিকও নর্মাল। ল্যাম্পপোস্টের গোড়ায় ঝুপড়ির দিকে অভ্যাস বশত আমার চোখ চলে গেছিল। কিন্তু মহম্মদ বিষ্ণু অ্যালফ্রেডকে আমি দেখতে পাইনি। দেখি ফেরার সময় একবার ঢু মারব। 

আমি যেদিন প্রথম কাজে আসি, সেদিনও আমি এই ডাকটা শুনতে পেয়েছিলাম। প্রথমে ভেবেছিলাম পাগোল টাগোল হবে। কিন্তু না, আমি যার পরিবর্তে কাজে যোগ দিয়েছিলাম, সেই ব্যানার্জীবাবু যখন আমাকে কাজ বুঝিয়ে দিচ্ছিল, তখন আমি ‘হেই বিষ্ণুর’ ব্যাপারটা জিজ্ঞেস করেছিলাম। উনি হেঁসে বলেছিল, পাগোলের কাণ্ডকারখানা আরকি। ওর কথায় কান দিও না। যে কাজ করতে এসেছো সেটা কর। কিছু উপরি কামাইয়ের চেষ্টা কোরো। অফিসের যে সিস্টেম আছে, সেটা বজায় রেখো। তোমরা আবার নিউ-জেরারেশন, কোনো বিপ্লবগিরি দেখাতে যেও না। কাজ কর, বাড়ি যাও, টাকা কামাও, সুখে থাক – এটাকে জীবন-মন্ত্র কর।  

পরে অবশ্য নাটুর কাছ থেকে বিষ্ণুর কথা জেনে ছিলাম। নাটুর কথা শুনে মনেই হয়নি বিষ্ণু পাগোল। বরং মনেছিল, ও আমাদের থেকে অনেকাংশেই বেটার। 

রোজ আসি, কিন্তু কাজের চাপে ভুলেই যেতাম ব্যাপারটা জিজ্ঞাসা করতে। তা কাজের মাস দুয়েক হয়ে গেছিল তখন, যখন আমি প্রথম ব্যাপারটা জানি। সেদিন বন্ধ ছিল কোনো একটা কারণে। আমরা যদিও প্রাইভেট সংস্থায় কাজ করি, সরকারের বাধ্যতামূলক আসার ফরমানের মধ্যে পড়ি না। সুতারং আমাদের আর কি, আমরা যথারীতি আসি। আসি কিন্তু আসার পথে দেখি সেই রোজকারের মতো ভীড় থাকে না, ব্যস্ততা থাকে না, চিৎকার চেঁচামেচি থাকে না। ট্রেনে উঠেই বাগনান থেকে হাওড়া অব্দি সিট পেয়ে যাই, তাও আবার জানালার ধারে। হেঁটে হাওড়া ব্রিজটা পার হওয়ার সময় ধাক্কাধাক্কি লাগে না। হাওড়া ব্রিজের রেলিয়ে একদণ্ড দাঁড়িয়ে গঙ্গা দেখে কপালে মাথা ঠুকে প্রণাম করে একটা পাঁচ টাকার কয়েন ফেলে দিই। দিয়ে ধীরেসুস্থে অফিসের পথে রওনা দিই। সেদিন আমি অন্য দিনের তুলনায় খুবই স্পষ্ট ভাবে ডাকটা শুনেছিলাম, হেই বিষ্ণু। বিষ্ণু উত্তর দিয়েছিল, কেস দেব কিন্তু। 

বিষ্ণু কি নিজেকে পুলিশ ভাবত? আমি জানি না। জানবার সুযোগ হয়নি। নাটুকে একবার জিজ্ঞাসা করেছিলাম, নাটু বলেছিল, মহম্মদ বিষ্ণু অ্যালফ্রেড ভায়ের কথা বলছ? আরে ছেড়ে দাও। এখন পাগোল হয়ে গিয়েছে। আগে কিন্তু এমন ছিল না। 

আমি বলেছিলাম, ব্যাপারটা একটু খোলসা করে বলবে? নাটু চা দিয়ে খুব ব্যস্ত হয়ে পড়েছিল। বলেছিল, সাহেব পরে কোনো দিন। আমারও ব্যস্ততা ছিল সেদিন, অফিসের মাসের জমা খরজের হিসেব মালিককে আজ দেখাতে হবে। 

বন্ধের দিনে আমার অফিসের চাপও কম। নাটুর দোকানেও কাস্টামারের চাপ কম। সেদিন নাটু বলেছিল, আসলে ওর নাম যে কী কেউ জানে না। মসজিদের সিড়ির পাশে ওকে কুড়িয়ে পাওয়া যায়। চার পাঁচ দিনের শিশু। ওর আবার কী নাম। ইমামবাবা ভোরের আজান দেওয়ার সময় সিড়ির কাছে কাপড়ে জড়ানো অবস্থায় পেয়েছিল। নিজেই মানুষ করেছিল। নাম দিয়েছিল মহম্মদ। ইমামাবাবা যখন মারা যান হার্ট অ্যাটাকে, তখন ওর বয়স সাত। একটু আধটু পড়তে শিখেছিল। কিন্তু লাশ দাফনের সময় গোরস্থানে কে যেন বলেছিল, বেয়ারিশ ছেলেটার কী হবে? কথাটা ওর কানে গেছিল। কথাটা ওর দিলেও আঘাত দেয়। 

সেবার রাস্তায় কে যেন ওকে বেয়ারিশ বলেছিল। তখন ও শব্দটার মানে জানত না। রাতের বেলা ইমামবাবার কাছ থেকে জেনেছিল, বেয়ারিশ মানে হল, যার কোনো ওয়ারিশ নেই। ওয়ারিশ মানে মালিক, অভিভাবক। ইমামবাবা আরো বলেছিল, এটা শেরেকি কথা। আমাদের মালিক তো তিনি। আমরা কেন বেয়ারিশ হতে যাব! যারা বলে তারা মূর্খ। কিছু জানে না। আর মূর্খের সাথে কখনো থাকবি না। 

না, আর থাকেনি। এমজি  রোডের ধারে চালু হোটেলে কাজ নিয়েছিল। সে সময় চারিদিকে এন আর সি চালু হবে হবে রব। মালিক বলেছিল, এক কাজ কর, তুই আজ থেকে বিষ্ণু হয়ে যা। এটাই তোর নাম। ও কোনো কথা বলেনি, মাথাও নাড়েনি হ্যাঁ বা না সংকেতে। প্রথম প্রথম বিষ্ণু বলে ডাকলে তৎক্ষণাৎ সাড়া দিত না। কে বিষ্ণু? কাকে ডাকে! পরে মনে হত, আরে সেই তো বিষ্ণু। বারো বছর অব্দি কাজ করেছিল বিষ্ণু হোটেলে। ঐ বয়েসেই ছ ফুটের কাছাকাছি হয়ে গেছে। মালিক এক দিন খোটা দিয়েছিল। বলেছিল, এত খাস কিন্তু কাজ তেমন করিস না। আমার লস করে ছাড়বি যে। বিষ্ণু কিছু বলেনি। কিন্তু যেদিন বেয়ারিশ বলেছিল, সিদ্ধান্ত সে করেই নিয়েছিল।  

পরের দিন সকালে মালিকে বলেছিল, আমার মাইনের টাকা দাও, আমি কাজ করব না। মালিক বলেছিল, টাকা মানে, এই যে তোকে একটা নাম দিলাম, তোকে এত বছর এখানে পুষলাম, মানুষ করলাম, থাকতে দিলাম, খেতে দিলাম, কই একটাও টাকা নিয়েছি? সাধে বলে বেয়ারিশ বেজম্মাদের লাই দিতে নেই। 

বিষ্ণু কথা বাড়ায় নি, ওর যে সম্বল পুটলি, সেটাও নেয়নি। বেরিয়ে গেছিল দোকান থেকে।    

আমি বলেছিলাম নাটুকে, তুমি কী করে জানলে এত সব?

নাটু বলেছিল, এটা বড়াবাজার সাহেব, এখানে কোনো খবর গোপন থাকে না। গোপন থাকে শুধু টাকা। এই যে দেখ না, দোকানের সামনে দিয়ে বটগাছের শিকড়ের মতো অজস্র ঝুরির মতো তার চলে গেছে এমাথা থেকে ও মাথা। এই তার বেয়েই খবর যাতায়াত করে। 

আমি হেঁসে বলেছিলাম, তারপর কী হয়েছিল? 

নাটু বলেছিল, সাহেব চায়ের দোকানে ভিড় বাড়ছে। বাকিটা আরেকদিন বলি!

আমি জানি, আমাদের জীবনের গল্পের বেলায় ঠিক এমনটাই হয়। এমন একটা জায়গায় এসে জীবন থেমে যায়, ঠিক কোন দিকে যাবে বুঝতে পারে না! মহম্মদ বিষ্ণু অ্যালফ্রেডের গল্পের বেলায় তাই-ই হয়েছিল। নাটু উৎকণ্ঠা জিইয়ে রেখেই মহম্মদ বিষ্ণুর গল্প পর্যন্ত এসে গল্পের খেই ছেড়ে দিয়েছিল। এখনো অ্যালফ্রেড চ্যাপটারটা বাকি। 

পরে অবশ্য আমি এদিক ওদিক থেকে শুনেছিলাম, এরপর থেকে ও যে কাজ পেত সেই কাজই করত। এখানে কাজের অভাব! কাজ পেতে গেলে এখানে শরীরে জোর থাকা জরুরি। অনেক টাকা করতে গেলে যেমন মাথায় বুদ্ধি থাকা জরুরি। আমার ধারণা মহম্মদ বিষ্ণু অ্যালফ্রেডের দুটোই ছিল। কিন্তু ও অনেক টাকার পথা হাঁটে নি। নাটু বলেছিল, মহম্মদ বিষ্ণু অ্যালফ্রেড খুব ভালো মানুষ। কোনো কিছুতে না নেই। এই খালাসির কাজ, এই কুলির কাজ, এই মাল প্যাকিংএর কাজ কর, এই কারো দোকানে লোক চলে গেলে ম্যানেজ দেওয়া কাজ – সবই করত। একদিন নাটু আমার উৎকণ্ঠা দেখে বলেই ফেলেছিল, সাহেব আপনার এত খোঁজ কিসের? আপনি সিনেমা টিনেমার গল্প লেখেন না! রাখেন শুধু টাকার হিসেব। কী করবেন এত কিছু জেনে!

আমি কোনো উত্তর দিইনি। সবার মতো আমারও একটা আত্মপক্ষ সমর্থনের যুক্তি আছে। শুধু বলেছিলাম, ও কী কোনো পার্মানেন্ট কাজ পায়নি?

নাটু বলেছিল, পায়নি মানে, করেনি। 

নাটু ঠিক রাস্তার বিপরীত দিকে আঙুল দেখিয়ে বলেছিল, ঐ যে আগারওয়ালবাবুদের অপিস দেখছেন, একবার ওনাদের অপিসের সামনে থেকে পাঁচ লাখ টাকার ব্যাগ ও কুড়িয়ে পেয়েও ফেরত দিয়েছিল। এক টাকাও বকশিস নেয়নি। একদিন জিজ্ঞেস করেছিলাম ওকে, পার্মানেন্ট কাজ কেন কর না? মহম্মদ বিষ্ণু আলফ্রেড বলেছিল, কারো খোটা শুনতে পারব না। রাস্তায় কাজ করি, ফুটে শুই। এই গতর খেটে একদিন অনেক টাকা ইনকাম করব, একটা বাড়ি কিনব। পার্মানেন্ট কাজে আর কত আয়! 

আমি নাটুর কাছে জানতে চেয়েছিলাম, ও কী বিয়ের কথা ভাবেনি!

নাটু বলেছিল, এ প্রশ্ন করলে ও আর এই চত্তরে আসত না দিন কয়েক। ফলে আমরা কেউ ওর পিছনে লাগতাম না। তা ছাড়া বড়বাজারে টাকা ওড়ে। মানুষের পিছনে লেগে সময় নষ্ট না-করে কাজ করে টাকা ধরে বেড়ানো অনেক ভালো নয় কি! 

আমি আমার জীবনের ভালোমন্দ জানি, মহম্মদ বিষ্ণু আলফ্রেডের জীবনের ভালো মন্দের খবর আমি জানি না। কিন্তু ওর জীবনের ঘটনা আমি যত শুনি আমাকে তত টানে। কিন্তু এই টানের কারণ আমি জানি না। এক হতে পারে আমার সহজাত অভ্যাসের কারণে, আর এক হতে পারে আমার রোজকার সেই একই বাগনানের পরিচিত ট্রেনের কামরা, সেই একই ভাবে জানালার ধারে সিট পাওয়ার চেষ্টা এবং ব্যার্থ হওয়া, এই একই ভাবে, চারপাশের বকবকানি, রাজনীতি, ধর্মের নৈতিকতা, হকারের কিশোর কন্ঠী গানের সুরে দরদ খোঁজার চেষ্টা এবং হাওড়াতে ঢোকার আগে পাঁচ মিনিট দাঁড়িয়ে থাকার উৎকণ্ঠা – এ সবের থেকে মুক্তি পাওয়া আরকি। 

নাটু বলেছিল, সেবার একটা দুর্ঘটনা ঘটে গিয়েছিল। সকালে রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকা লড়ি খালাশ হচ্ছিল। ও ফুটে দাঁড়িয়ে গাঁট মাথায় নিচ্ছিল। একটা চার চাকা অচমকা নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ধাক্কা মারবিতো মার সোজা ফুটে দাঁড়ানো ওকেই মেরেছিল। পা ভাঙার চোট নিয়ে দুমাস হাসপাতালের বিল ওকে মেটানো হয়নি। প্রথমে গাড়ির মালিক দিতে চায়নি, থানা পুলিশ অনেক করে শেষ অব্দি রফা হয়েছিল এই শর্তে শুধু হাসপাতালের বিল দেবে। অন্য কোনো জরিমানা নয়। বেয়ারিশ লোক ফুটে থাকলে হাল্কা-ফুল্কা আঘাত পাবে, এটা আবার নতুন কি! বেশি ব্যাগড়বাই করলে, গাড়ির মালিক বলেছিল, উপর মহলে চেনা আছে, কেস দেবো কিন্তু। এমন কেস খাবে আর জিন্দেগীতে বের হতে পারবে না। 

ও বের হয়েছিল হাসপাতাল থেকে, ভালো পা নিয়েই বের হয়েছিল। কিন্তু আর কাজে ফেরেনি। বড়বাজারেও ফেরেনি। কে যেন বলেছিল, হাসপাতাল থেকে ওকে কোন ফাদার কাজ দেবে বলে নিয়ে গেছে। নাটু বলেছিল, আমি আর মাথা ঘামায়নি। বড়বাজারে এত মানুষ, পিঁপড়ের মতো আসে যায়। দু দণ্ড থাকে তাও নিজের স্বার্থে। এখানে যারা যারা আসে, হয় কিছু কেনে, না হয় কিছু বিক্রি করে। এর বাইরে গিয়ে ওর খবর কে রাখবে!

ফের এই চত্তরে ওকে প্রথম দেখা যায়, নাটু বলেছিল, তা পাঁচ বছরের বেশি বই কম হবে না। কোনো কাজ-বাজ করত না। কেমন কেমন কথা বলে। যে কারো কাছ থেকে মাগনা চেয়ে খেত না, এখন সে হাত পেতে খায়। আমার কাছে একদিন চা খেতে এসেছিল? আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম, কী হে মহম্মদ বিষ্ণু ভাই, এত দিন কোথায় ছিলে? ও বলেছিল, আমি এখন মহম্মদ বিষ্ণু অ্যালফ্রেড। চার্চেই ছিলাম। আর থাকতে পারিনি ওখানে। চলে এসেছি। 

আমি বলেছিলাম, কাজ কম্মের খবর কী? 

ও বলেছিল, মহম্মহ বিষ্ণু অ্যালফ্রেড কোনো কাজ করে না। 

নাটু বলেছিল, আর কখনো ও আমার কাছে আসেনি চা খেতে। 

নাটুর মুখে এত কিছু শোনার পর অ্যালফ্রেড ব্যাপারটা অনুমান করতেই পারচ্ছিলাম। মাঝে মধ্যে অবশ্য মনে হত, যাই, লোকটার সাথে কথা বলে আসি। কিন্তু আমাদের আর কথার দাম! আজ এই কাজ তো কাল সেই কাজ। আজ এই টাকার হিসেব তো কাল সেই রিপোর্ট পাঠানোর তাগাদা। আসলে ঐ যে বলে না, মানুষ অভ্যাসের দাস। রোজ সকালে, হেই বিষ্ণুর ডাক আর কেস খাওয়ার উত্তর শোনাটা আমার একটা অভ্যাসে পরিণত হয়ে গেছিল। এটা না-শুনলে মনে হত, কিছু একটা মিস করছি। আজ সকালে সেই ডাক না-শুনতে পেয়ে, সারাদিন কেমন একটা খচখচানি হচ্ছিল মনের মধ্যে। কাজ করতে করতে মাঝমধ্যেই ওর কথা মনে হচ্ছিল। সকালেই ঠিক করে নিয়েছিলাম, আজ যাব। গিয়েও ছিলাম। ল্যাম্পপোস্টকে গোল করে ঘেরা এদিক ওদিক থেকে কুড়ানো ত্রিপল, বিজ্ঞাপনের ব্যানার দিয়ে। এর মধ্যে ফুটের দিকে একটা ত্রিপল এলানো। ওটা সরিয়ে ভেতরে ঢোকা যায়। এই ত্রিপলটা একটা ঠান্ডাপানীয়র বিজ্ঞাপনের ব্যানার ছেড়া। একটা ছেড়া হাতের অংশ থামস্‌ আপ করে আছে। আমি থামস্‌ আপ সরিয়ে ভেতরে ঢুকতেই দেখি অন্ধকারের মধ্যেও দেখার আলো আছে। কিন্তু ওকে দেখতে পেলাম না। থালাতে কিছু ভাত তরকারি, না-মাখানো অবস্থায় পড়ে থাকা সবজী, একটা জলের বোতল – সবই আছে। কিন্তু ও নেই। আমি একবার দুবার হাঁক দিলাম। কেউ কোনো উত্তর দেয়নি। ভালো করে দেখার জন্য পকেট থেকে মোবাইল বের করে লাইট জ্বালিয়ে দেখেছিলাম, ল্যাম্পপোস্টের গোড়ার দিকে গোল করে টাইলস্‌গুলো আলগা হয়ে আছে। আমার কেন জানি সন্ধেহ হচ্ছিল, খ্যাপা লোকটা মাটির নীচে চলে যায়নি তো! আমি ল্যাম্পপোস্টের গোড়ার কাছে আলগা টাইলস সরিয়ে ‘হেই বিষ্ণু’ বলে ডাক দিয়েছিলাম। বাইরের লোক শুনতে পেয়েছিল কি না জানি না, কারণ এরপর যে উত্তর আমি শুনতে পেয়েছিলাম, সেটা শোনার জন্য আমি একদম প্রস্তুত ছিলাম না, ‘কেস দেবো কিন্তু’। 

1 thought on “মহম্মদ বিষ্ণু অ্যালফ্রেড

  1. খুব ভালো গল্প। লেখক ছুঁয়ে আছেন সত্যের বাস্তব এবং বানানো বাস্তবকে।
    বানানের সমতা নিয়ে প্রশ্ন আছে।এ দায় কেবল লেখকের নয়,প্রধানত সম্পাদকের।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *