রাজেশ ধর

(১)

শহিদবেদিটা ঠিক তেমাথার মাঝখানে।  মটর, বাগল, কাজলা তিনটে নাম।বেশ গোল করেই বানানো।বৃত্তাকার তিনটে ধাপ, একের পর এক,  যার নীচেরটা  মাটি থেকে প্রায় তিনফুট মত উঁচু। নিরেট করে গাঁথা। প্রত্যেকটা ধাপের মাঝখানে ফুট দুয়েক করে পাথর বাঁধানো একই রকমের গোলাকার দেওয়াল।সব মিলিয়ে শঙ্কুর আকৃতি । মটর, বাগল, কাজলা  নামের ফলকগুলো একেকটা দেওয়ালে গাঁথা।  একবার বিশুকে; বিশু আসলে বিশ্বনাথ দাস, বর্তমান কাউন্সিলার। বিশু আমাদের পাড়ারই বাসিন্দা। আগে লক্ষ্মী-নারায়ণ বিল্ডার্সে সাইকেল-ভ্যান চালিয়ে বাড়ি বাড়ি ইট, পাথর, বালি পৌছে দিয়ে আসত।সে অবশ্য আগের আমলের ঘটণা। তবে পাবলিকে বলে ও নাকি বোম বানায় সরেস।তো সেই বিশু কাউন্সিলার এই তেমাথায় দাঁড়িয়ে একদিন কথায় কথায় বলেছিল;

‘ ধোপা হলে কি শহিদ হতে পারে না? সায়েব নাই মারুক!পাড়ার লোক শহিদ বলছে তাহলেই  শহিদ।’

এদিকে বিশুর এই ওয়ার্ডে ওনারশিপ আর ওনারশিপ। আর সেটাই প্রকৃতির স্বাভাবিক নিয়ম। সাত পুরুষের বাসিন্দাদের মধ্যে গড়ে উঠছে শরিকি ঐক্যজোট। এক-এক শরিক ফ্রিতে ছশো,সাতশো স্কোয়ার ফুটের কার্পেট এরিয়া পাচ্ছে।তারপর কখনও এক বছর কখনও দুবছর আবার কখনওবা রেজিস্ট্রির দিনেই নিজের স্কোয়ার ফুটের পুঁজি চুন-গুটখা-মহাবীর-গণ্‌পতি সংস্কৃতির হাতে তুলে দিয়ে এক-দেড়শো কিলোমিটার দূরে শান্তির নীড় খুঁজে নিচ্ছে। তবে আমাদের মতই কিছু ঝড়তিপড়তি ভোটারও আছে বিশুর। তারা এই এলাকার মায়া কাটাতে পারছে না।তাদের এখানে থাকতে হবেই।পুরোনো খোয়াড়ির ঢেকুর তুলতে হবে।ভোর-সকালে হাঁটাহাটির শেষে,  রাতে কাজ থেকে ফেরার পর চলে আসতে হবে এই তেমাথায়। 

তেমাথায় দুটো চায়ের দোকান। নামে দোকান আসলে ফ্ল্যাটবাড়ির নীচের চিলতে খুপড়ি। দশ-বিশ বছর আগের মত একটা ছোট চা নিয়ে দুঘন্টা ফুক্কুড়ি কাটার জায়গা নেই।কী আর করা!ধুলোবালি, কাকচিলের শুকনো গু ঝেড়ে ঐ শহিদবেদির নীচের ধাপটাতে আমরা কয়েকজন বসি। উপরের ধাপগুলোয় ফলওলা, সবজিওলাদের পেটিফেটি থাকে। ইদানিং দেখছি আমাদের এই নীচের ধাপটাতেও ওরা প্রায়দিন পেটি রাখছে। আমাদের ভুতো সেদিন বেশ রেগে গেছিল। রাস্তার ওপারের ফলওলা সেলিমকে ডেকে চোটপাট করল খুব। চেঁচাচ্ছিল ভুতো;

‘যেমনই হোক একটা শহিদবেদি। তার ইজ্জত রাখবি না?   কামাবি এখানে, ঢালবি পদ্মার ওপারে ! চলবে না, এখানে এসব চলবে না। শহিদবেদির ইজ্জত না দিলে…’

মোল্লাপাড়ার মিঠু হাতের ডলা খৈনি সাবধানে ঠোটের ভিতর ঢুকিয়ে নিল। তারপর  নির্বিকারভাবে বলল;

‘ সবাই, সব জানে? মটর-বাগল-কাজলা; বাপ, ঠাকুদ্দা, ছেলে; সব্বাই শহিদ।  ধান্দাবাজি। একেবারে শহিদবেদির শহিদ!’

 এই এলাকাটা আদতে সাবর্ণ চৌধুরীদের মহাল। গ্রামের দুই প্রান্তে দুটি মহল্লা।  একটা মুসলিম চাষীদের অন্যটা হিন্দু ধোপাদের। মাঝখানে মাইল চারেকের জলা আর জঙ্গলএকটা ।এই ধোপারা শুধু চৌধুরীদেরই কাপড় কাচত না, কলকাতার বাবুদেরও কাপড় কাচত বংশপরম্পরায়। মিঠু সেই আদি বাসিন্দা চাষীপরিবারের ছেলে। বর্তমানে সস-জেলি-আচারের মাঝারি ডিলার। মোটের ওপর আয়। ওর কথার উত্তর দিতে পারত উত্তম, রজকপাড়ার ছেলে। বারুইপুরে প্রাইমারি মাস্টারি করে। কিন্তু সে ফেসবুক খুলে বসল। তারপর মিঠুও তাই করল। বাকি কয়েকজন এমনকি ভুতোও উৎসাহ হারিয়ে পকেট থেকে ফোন বের করল। সবাই তাই। আমি চেষ্টা করলাম ফলকে মটরের নামটা দেখতে। মটরের ‘ট’ আর ‘র’-এর মাঝখানের চিড়টা বেশ চওড়া হয়ে দুটোকেই অনেকটা খেয়ে ফেলেছে। মনটা চা,চা করছে। উত্তমের দিকে তাকালাম।ও ফোনের দিকে তাকিয়েই বেশ আস্তে আস্তে বলল,

‘দেশের মানুষকে বাঘের কামড় থেকে বাঁচাতে গিয়ে কেউ মরলে শহিদই হয়!’

আস্তে হলেও কথাটা আমাদের সবারই কানে গেল। মিঠু কিন্তু উঠে দাঁড়াল। তারপর  হাঁটা দিল। ডাকলাম, বলল;

‘এমার্জেন্সি অর্ডারের মেসেজ এসেছে।’

মিঠু চলে যাওয়ার মিনিট খানেক পরে ফোনের দিকে তাকিয়েই বেশ জোরে বলল উত্তম;

‘ এমার্জেন্সি? জ্যামজেলির অর্ডার তাও এমার্জেন্সি?’

মিঠু তখন চলমান অটো, বাইক, সাইকেল আর প্রাইভেট কারের ব্যাকগ্রাউন্ডে হারিয়ে যাচ্ছে। আমরা সেদিকেই তাকিয়েছিলাম।

(২)

‘ সত্যি এমার্জেন্সি কাকে বলে তোমরা জান?’

আমরা পেছন ঘুরে তাকালাম। বেদির ফলক সরিয়ে  বেরিয়ে এসেছে মটর।  আমরা সবাই ওর দিকে তাকালাম। পরনে ছেড়াখোড়া শুকনো রক্তমাখা ধুতি। অঘ্রানের শেষ প্রায়। এই ধোঁয়া, ধুলোর শহরেও ঠান্ডা ঠান্ডা ভাব। ওর গায়ে বেশ কয়েকটা দগদগে আঁচড়। ওর কি খুব জ্বালা করছে?

‘কী হল, বললে না? সত্যি এমার্জেন্সি দেখেছ?’

মেঘলাল ছোট্ট করে বলল;

‘ ওটা ঢপ। ঢপ দিয়েছে মিঠু।’

‘কিন্তু পরপর সন্ধেবেলায় একটা করে বাচ্চা যদি, নিখোঁজ হয়ে যায় আর পাড়ার জোয়ান, বুড়ো, মেয়ে-বউদের দল বলছে… পীরবাবার বুড়ো বাঘ নিয়ে যাচ্ছে বাচ্চা। তখন সেটা কি এমার্জেন্সি মনে হবে নাকি ঢপ?’

ভাল করে বুঝতে পারছিলাম না জোয়ান মদ্দ লোকটা রেগে বলছে নাকি ক্ষোভে;

‘দেশজুড়ে হিঁদু-মোছলমানের মনে সে কি অশান্তি। কেউ কাউকে সহ্য করতে পারছে না! জলার ঐ যে  পীরবাবা, সে তো মোছলমানের দেবতা! তাই নাকি সেও হিঁদুদের ওপর ক্ষেপে গেছে। তার বাহন বুড়ো চিতাবাঘ পাঠিয়ে দাওয়ায় ঘুমোনো একলা বাচ্চা পেলেই তুলে নিয়ে যাচ্ছে!’

 কাউন্সিলার বিশুর বানানো শহিদবেদিতে বসে আমরা মটরের প্রশ্নের উত্তর দিতে পারছিলাম না। তবে উত্তর দেওয়ার দায়ও তো আমাদের নেই। তবু কেন যে আমাদের  লজ্জা লাগছিল! কিন্তু আমাদের উত্তর শোনার মত সময় ওর ছিল না। ও বলতে থাকল;

‘তোমাদের মত লেখাপড়া জানা ছেলে উত্তর দিতে পারলে না! কিন্তু সত্যিটা জেনে নাও ! অজ্ঞ  রজকপাড়ার লোকেদের কাছে ব্যাপারটা মোটেও ঢপ ছিল না।  মার কোল থেকে বাচ্চা হারিয়ে যাওয়াটা…  চিরকাল এমার্জেন্সি! মা-বাপগুলোর কান্না ভুলে যাও কিন্তু  বাচ্চা হারাতে শুরু করলে একদিন তুমি, তোমার পাড়া, গেরাম, দেশ মায় এই দুনিয়া থেকে তোমাদের চিহ্ন এক্কবারে উবে যাবে না?’

 উত্তম, ধোপা-রজকদের ছেলে। বলেই ফেলল,

‘ আচ্ছা, রজকপাড়ার ওরা অজ্ঞ। তবে তুমি কী?’

‘ না হে, শ্যামবাজারে মামারবাড়িতে মানুষ। চার ক্লাস পড়েছিলাম। এখানে তখন পাঠশালা কোথায়? জান, অনেক বোঝালাম পীরবাবার নামে এমন আজগুবি কথা ছড়ালে মোল্লাপাড়ার লোকেরা আরও ভুল বুঝবে। ওদের পাড়ার সবাই তো আমাদেরই খদ্দের, নাকি? এ নিশ্চই বুড়ো শেয়ালগুলোর কাজ!  দল বেঁধে জলায় ঢুকে পিটিয়ে মারতে হবে। কিন্তু কেউ বুঝল না। কেউ যাবে না। বলে কিনা  মোল্লারা তেড়ে আসলে মারামারি করবে কিন্তু কিছুতেই রাতে জলায় যাবে না। বাধ্য হয়ে, আমিই একদিন সন্ধের পর, তেল মাখানো লাঠি আর একটা টেমি নিয়ে গেলাম জঙ্গলে।’

‘তারপর’

আমরা সমস্বরেই বললাম।

‘ ঘেয়ো বুড়ো শেয়াল একটা না বেশ কয়েকটা ছিল। মারলাম সবকটাকে। ওরাও ছাড়ল না। দেখ না দাগগুলো, কী জ্বলছে এখনও!’

সিরাজ সাহস করে বলল;

‘কেউ যায়নি তোমার সাথে?’

‘না হে না। তোমরা বিশ্বাস করছ না তো! কোরো না…আমার কী? গলা বেশ শুকিয়ে গেছে। একটু চা খাওয়াবে?’

নটা বেজে গেছে দুটো চায়ের দোকানই বন্ধ।

‘তা একটা বিড়িই নাহয় দাও!’

বিড়ি আমরা কেউ টানি না। সিগারেট চলে। তবে ছটাকার নীচে কোন সিগারেট নেই। দুম করে তো কাউকে দেওয়া যায় না।

‘ধুত্তোরি…কী বেয়াক্কেলে লোক তোমরা!’

ফলকটা সরিয়ে ভেতরে ঢুকে পড়ল মটর।  আমরা চুপ করে  গেলাম। কেন?  জানি না! একটু পরে উঠে দাঁড়ালাম। বাড়ি যেতে হবে। মোড়ের মাথায় তখনও আওয়াজের নরকগুলজার। তার মধ্যে অসহ্য আমাদের সেই একঘেয়ে নৈশব্দের ঢালাই-স্ল্যাবটা ভেঙে গেল উত্তমের টিটকিরিতে;

‘ কী ঢপটাই না মারল  শুডঢাটা! শালা ছোটবেলা থেকে পাড়ার বুড়োবুড়ির থেকে গল্প শুনে আসলুম। ও ব্যাটা দলবল নিয়ে ঢুকেছিল জংগলে। নিজে মরে , বাঘটাকেও মারে। তাতেই ভয় পেয়ে পীরবাবা পালায়!  আজ পাক্কা ঢপ মেরে গেল। সব ক্রেডিট নিজে নিয়ে নিল? কী মাল!’

(৩)

সিনেমার মত রাস্তায় চাকা ঘষটানোর একটা বদখত আওয়াজ। সন্ধেবেলায় সবে এসে বসেছি আমরা।  মুখ তুলে তাকালাম। মোল্লাপাড়া-ট্রামডিপো রুটের একটা অটো শাটল ব্রেক কষেছে।  ঢোলা পায়জামা আর রক্তের শুকনো ছিটের দাগপড়া একটা হাফ ফতুয়া রাস্তা পেরিয়ে আমাদের দিকে এগিয়ে আসছে। তারপরেই দেখলাম বছর সতেরোর বুলেট গতির একটা কে এম টি এসে পড়ল ঐ লোকটার ঘাড়ে। আমি একা না, সবাই চোখ বুজে ফেলল। চোখ খুলতে ইচ্ছে করছে না।দলামোচা পাকানো বডি আর রক্তের স্রোত কে দেখতে চায়? কিন্তু শ্বাস টানতে টানতে অনুরোধের একটা অচেনা গলা;

‘শিগগির চলুন , শিগগির…’

রক্ত দেখার ভয় থাকল না বটে কিন্তু এ আবার কী ঝঞ্ঝাট! কোথায় যাব, কেন যাব? আর শিগগির, শিগগির বলার কারণটাই বা কী? কিন্তু  হাঁফ আর কথা দুটোই থামছিল না।  মেঘলাল বলল;

‘ভুতো সরে বস।  ওনাকে বসতে দে…’

‘বসার সময় নেই। তাড়াতাড়ি চলুন…এখনও গেলে হয়ত রঞ্জনকে মানে আপনাদের বাগলকে বাঁচানো যাবে, চলুন !’

সে সিরাজের হাত ধরে ঝাঁকাতে শুরু করল। এতক্ষণে বুঝলাম তার গলাটা বেশ কর্কশ! সিরাজ পরে আমাদের বলেছিল তার হাতের গোটা পাতাটাই নাকি কড়াপরা।  কিংকর্তবিমূঢ়’র বাংলা মানে চলতি কথা বমকে যাওয়া আমাদের তখন সেই অবস্থা। তাই…বাগল, মটরের ছেলে, ধোপাপাড়ার আর এক শহিদ, যার বেদিতে বসে আছি, তাকে বাঁচাতে যাব? এসব কথা কিছুই মনে আসছিল না তখন! আমরা সবাই কি তখন নিজেদের মাথার ভেতরে ভোরবেলার দমকলের ঘন্টা শুনতে পাচ্ছিলাম?  উত্তম বলল;

‘আপনার কী নাম, কোথায় থাকেন, কী করেন?’

‘টাইম চলে যাচ্ছে, চলুন যেতে যেতে সব বলছি।’

রাশভারী মিঠুর বলল;

‘ থামুন…আগে বলুন কে আপনি?’

ঘিয়েভাজা নেড়ি কুকুরের মত সেই অপুষ্ট লোকটা এবার থেমে গেল। তারপর আমাদের সবার দিকে ভাল করে দেখে নিয়ে থেমে থেমে বলতে শুরু করল;

‘ আমি রোশন আলি, রঞ্জন আর আমি বজবজ জুটে কাজ করি। ছটা –দুটো শেষ করে একসাথেই বেরিয়েছিলাম। জিঞ্জিরাবাজারের কাছে ওরা ধরল আমাদের, তারপর…’

‘ধরল! ধরল মানে কী? সারাদিন জিঞ্জিরাবাজারে ট্রাফিক-পুলিস।  জ্যাম সামলাচ্ছে। ওখানে কে, কাকে ধরবে?’

রোশন আলি কি লোকটার আসল নাম? কে জানে? কিন্তু লোকটা মিঠুকে পাত্তাই দিল না;

‘কদিন বাদে ডাইরেক্ট অ্যাকশান ডে, এর কাছে, ওর কাছে শুনতে পাই পাকিস্তান-দিন্দুস্তান, হিন্দু-মুসলমান। এইসব হৈচৈহৈচৈ । কিন্তু আমরা খাটি, খাই, আমাদের কীসের ঝামেলা !… আল্লাহ, আগে জানলে রোড দিয়ে না এসে ভেতরভেতর দিয়ে আসতাম। হল না…’

এবার লোকটা মাথায় হাত দিয়ে রাস্তায় বসে পড়ল। তারপর কাঁদতে শুরু করল;

‘ রঞ্জন মানে আপনাদের পাড়ার বাগলকে তো ওরা নাম শুনেই ছেড়ে দিল।  কিন্তু গোঁয়ার-গোবিন্দ সেকথা শুনলে তো, আমার হাত ধরে মারল এক টান। তারপরেই পগার পেরিয়ে রেললাইনের দিকে দৌড়। শ্বাসের টান! আমি আর পারছিলাম না। ও আমাকে ধাক্কা মারল। রেললাইনের নীচে গড়িয়ে পড়লাম। ওরা ততক্ষণে দেখে ফেলেছে ওকে । ও লাইন ধরে কালিঘাটের দিকে দৌড় লাগাল…এবার তো চলুন আপনারা!’

সিরাজ এগিয়ে গিয়ে লোকটাকে টেনে তুলে বসিয়ে দিল বেদিতে। তারপর বলল;

‘পানি খাবেন ভাই?’

লোকটার গায়ে যেন কেউ বিচুটি ঘষে দিয়েছে। দুই হাত নেড়ে পাগলের মত বলছে;

‘দেরি না, দেরি না…এখনও গেলে হয়ত বেঁচে যাবে!’

‘ভাই আপনি ঠান্ডা হন। পানি খান, চা খান। আপনার ভুল হচ্ছে একটা।’

‘ঠিক গলতি হয়ে গেছে আমার! এর থেকে কারখানার দিকে গেলেই ভাল হত। বসে থাকুন আপনারা…আমি যাই।’

সে পিছন ঘুরে রাস্তার ওপাশে গেল আর বাসরাস্তায় যাওয়ার খালি একটা অটো থেমে গেল। কেউ কোনদিন বিদ্যুতের যাওয়া-আসা দেখতে পায় না, পায়নি। ঠিক তখন আমি এই চামড়ার দুই চোখে  বিদ্যুতের গতি দেখেছিলাম।

(৪)

কার্বন-সালফার,ধুলোর কলকাতায় দুটো ঋতু, বৃষ্টি মেশানো গরম আর দিন পনেরোর শীত। সেই শীত পেরিয়ে গরম আর বৃষ্টি শুরু হয়ে গেছে তখন মাস তিনেক। আমরাও নিয়মিতই সন্ধে পেরোলে শহিদ বেদিতে বসতে চলে আসি। কাউন্সিলার বিশু আলোটা লাগিয়ে দিয়েছে। উত্তম গিয়েছিল বলতে। বিশু তখন কার একটা ছেলেকে ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি করার সুপারিশপত্রে সই করছিল। উত্তমের দিকে তাকায়নি। কিন্তু বলেছে;’

‘পার্লামেন্টে তোমার পাড়ায় মার্জিন নেমে গেছে!এখনও মাস পাঁচেক বাকি, তারপর কর্পোরেশান। দেখ…’

এই নিয়েই গুলতানি চলছিল।সিরাজ বলছিল;

‘ তোর চাপ কী? তুই কি পার্টি করিস? যাকে ইচ্ছে তাকে ভোট দিবি? পাড়া নিয়ে তোর কী?’

‘ বুঝতে পারছিস না, আমাদের  রজকপাড়ায় প্রায় নশো-সাড়ে নশো ভোট। সব জ্ঞাতিগুষ্ঠি। ছ-সাতশো ভোট  একদিকে পড়ে, পড়বেই।’

‘ সে তো আমাদের পাড়াতেও।’

মেঘলাল খুচিয়ে দেয়। খোঁচানো ওর স্বভাব;

‘সে তো তোরা আগের রাতে ঠিক করিস। আর আমরা ট্র্যাডিশনাল। ভাই, ইংরেজকে তাড়িয়েছে অহিংসা। আমরা অহিংসার রাস্তায়…পঁচাত্তর বছর ধরে অহিংসা যেদিকে আমরা সেদিকে।’

‘হুঁ…তাই তো, এখন চারিদিকে রমরম করছে অহিংসার ফুল আর তোরা সব কুল! কুলকুল করে বইছে নদী। হরে কৃষ্ণ হরে রামের নদী, ওদিকে অহিংসার পতাকাই হাওয়া।’

এইবার লেগে যেতে পারে! আমি কথা ঘোরাই। নজর পড়ে নীচ থেকে দুনম্বর ফলকটায়। লেখা আছে বাগল। বলে ফেলি;

‘ শালা, সেই লোকটা কিন্তু ধান্দাবাজ, কী বল?’

‘জনা তিনেক একসাথেই বলল;

‘কোন লোকটা?’

‘আরে সেই যে ,বলছিল বাগলের বন্ধু, বাঁচাতে যেতে।’ 

মিঠুর যেন এতক্ষণে মুখ না খোলার শপথ  ভাঙল;

‘ঠিক…কোথায় মরার সময় দুটোকে মেরে মরবি, তা না পালিয়ে এসেছে! এরা নাকি  ইমানদার?  ছিঃ’

ভুতোটাও বেশিরভাগ সময় চুপচাপ থাকে, এখনই মুখ খুলল;

‘ মারামারি আর মারামারি! বাদ দে দেখি। রক্ত, কাটাকাটি নাহলে কী কথা হয় না?’

নাহ, আবার আমাকেই মাঠে নামতে হয়;

‘ কোথায় হচ্ছিল ভোটের কথা আর সেখান থেকে…’

মিঠুর আজ কথার রোগ পেয়েছে মনে হয়;

‘তুই থামালেই কি সব থামে? আর ঐ ভোটটুকুই তো আছে, আমাদের হাতে!’

মেঘলাল আবার গলা খাঁকারি দেয়;

‘যে যতটা সেটা ইউস করতে পারে, আর কী?’

‘ইউস সবাই করে ভাই! আমরা না হয়, ভোটে এককাট্টা। কিন্তু এই যে বাগলের কথা হচ্ছে। বাপ, মটর আগে মরল কিছুদিন পরে মা। গোঁয়ার্তুমির জন্য বাচ্চাটাকে নিয়ে বৌ চলে গেছিল বাপের বাড়ি। সেই লোকটাকে কীভাবে হিরো বানানো হল, সেটা কেউ জানে না? বাগলকে তখনও ইউস করা হয়েছে এখনও হচ্ছে। কিন্তু আসলে কি সে বেচারার হিরো হওয়ার ইচ্ছা ছিল?’

উত্তম প্রশ্ন ছুড়ল;

‘ কী কতটা জানিস তুই?’

মিঠুর আগেই উত্তর দিল সিরাজ;

‘ ছেচল্লিশের কাটাকাটি লাগার পর, তোদের পাড়া থেকে ভলেন্টিয়ারের দলে নাম লিখিয়েছিল যে একটামাত্র লোক সে নাকি ঐ বাগল, মটরের ছেলে বাগল। মুন্সিপাড়ার বস্তি পোড়াতে গিয়ে ফিরল না। সে তোদের পাড়ার শহিদ।’

নাহ, এদের যেকরেই হোক থামাতে হবে। আজ সন্ধেটা মাটি হবে দেখছি। আমি বললাম;

‘ ওসব বুড়োবুড়িদের গল্পকথা বাদ দে! দেখলি তো মটর নিজে কী বলে গেল। রোশন আলিও তো বাগলকে বাঁচাতে বলল আমাদের। আমরাই গেলাম না…’

জোরে-আস্তে যে যা বলছিল সব থামিয়ে কটমট করে তাকাল আমার দিকে। আমি কী করি রাস্তার বাঁদিকে তাকালাম।

(৫)

একটা মারুতি ভ্যান তখনই সেখানে এসে থামল। তিন-চারটে ছেলে মেয়ের দল কয়েকটা ধাতব বাক্স নিয়ে রাস্তা পেরিয়ে  আমাদের সামনে এসে দাঁড়াল।সব থেকে চটপটে মেয়েটি বয়েজ কাট চুল। বিদঘুটে ঢোলা জামার বুকপকেট থেকে একটা লালসুতোর ছোট্ট বিড়ি বের করে ধরাল। তারপর বলল;

 ‘আপনাদের মধ্যে উত্তম  কে?’

আমরা বসেছিলাম এখন দাঁড়িয়ে আছি তাই উত্তমও দাঁড়িয়ে। তাকে দেখে না খুশি না দুঃখী; বুঝতে পারছি না। আমরা আঙুল তুলে ওকে দেখিয়ে দিলাম। মেয়েটি ওকে উদ্দেশ্য করে বলল;

‘আমরা মিডিয়া রিসার্চ সেন্টার থেকে আসছি। আমার নাম ওলগ।’

তারপর বাকিদের পরিচয় দিল। ছেলেদুটো বুচি আ্রর সায়না, মেয়েটা নাকি গোমুখ। কী উদ্ভট নাম রে বাবা! মেঘলাল খুব আস্তে আস্তে বলল;

‘ টাইটেলগুলো কী? মানে পদবী?’

ওলগ নামের মেয়েটা বিড়িটা ফেলে দিল মুখ থেকে। তারপর দাঁত আর জিভ দিয়ে চিকচিক একটা আওয়াজ করে বলল,

‘২০৭১ এও টাইটেল…কারা এরা?’

ওদের সবার ভুরু কপালে। ওলগই উত্তমকে বলল,

‘আপনার একটা ইন্টারভিউ হবে। ভয় পাবেন না। কাজলা, কাজল যে আপনাদের পাড়ার বাগলের ছেলে, মটরের নাতি তাকে চিনিয়ে দিতে হবে।’

ভুতোর চোখ চিকচিক করছে।আমাদের মধ্যে একমাত্র ওকেই বউ-এর সাথে বসে রাতের সবকটা সিরিয়াল দেখতে হয় ;

‘টিভিতে দেখাবে ইন্টারভিউটা?’

ওলগ বিষম খেল;

‘টিভি? টি ভি আপনাদের আছে? ও ইয়েস, আপনারা তো এখনও…বাদ দিন টাইম কিল করা যাবে না,ইনভেস্টিগেশনের একটা কন্ট্র্যাক্ট পেয়েছে আমাদের এজেন্সি। আপনাকে কাজলাকে চিনিয়ে দিতে হবে?’

কী বলে এই মেয়েটা। কাজলা মরেছে তাও বছর সাতাশ-আঠাশ হবে, তার আবার কীসের তদন্ত? উত্তম বলল;

‘কীভাবে চেনাব?’

‘আপনাকে একটা স্পেক পরিয়ে দেওয়া হবে। তারপর আপনি একটা লম্বা  ভিডিও দেখতে পাবেন। ঐ ভিডিওয় আপনি চিনিয়ে দেবেন। উনি তো আপনার বাবার কাকার বড় ছেলে। তাই আপনি চিনতে পারবেন। আপনি চেনাবেন। তারপরেই জাজমেন্ট শুরু হবে।’

‘কীসের বিচার? উনি তো পুলিসে কাজ পেয়েছিলেন।’

বাগল মারা যাওয়ার পর তার স্ত্রী ফিরে আসে এখানে। কাপড় কেচে, ইস্তিরি করে কাজলাকে বড় করে। এক পুলিসের কর্তা তার খদ্দের ছিল। সে বাড়ির সব কাপড় বিনা পয়সায় কাচত বাগলের বউ।ঐ অফিসার কাজলাকে হোমগার্ডে ঢুকিয়ে দিয়েছিল। সেই কাজলা ডিউটির সময় মারা গিয়েছিল…চাল, কেরোসিন, কাপড়ের আন্দোলনে।

‘বিচার? বিচারের প্রয়োজনে বিচার হয়। ছাড়ুন, শুরু করুন!’

গোমুখ নামের মেয়েটা জোর দিয়ে বলল। এদিকে ছেলেদুটো বাক্সগুলো বেদির ওপর রেখে ঢাকনা খুলে ফেলেছে। ভেতরে অসংখ্য অচেনা রঙের উজ্জ্বল ডিস্প্লে। ওলগ একটা বাইক চালানোর চশমা পরিয়ে দিল উত্তমকে। উত্তম কেন যে সব মেনে নিচ্ছে। আমায় বললে আমি কি শুনতাম নাকি পালাতাম! উত্তম আচমকাই হুট করে জানাল, সবাইকে ঐ চশমা না পড়ালে সে পড়বে না। কাজলাকে সে কোন ছোটবেলায় দেখেছে তার মনে নেই।আমরা সবাই কাজলার কথা জানি, চিনতে পারলে আমরা সবাই নাকি পারব। ওলগ, বাকি তিনজনের সাথে কথা বলে রাজী হল। আমরা সবাই চশমা পেলাম।

আমাদের সামনে কোন পর্দা নেই। আমরা আকাশের দিকে তাকিয়ে আছি। সামনে তারা, নক্ষত্র। একটা অদ্ভূত সুরের বাঁশি বাজল। আর তারপরেই মোল্লা পাড়ার মাঠ।জনা কুড়ির একটা দল।ওরা তেমাথায় আসছে। একটা লরি দাঁড়িয়ে আছে। ওরা উঠল।লরিভর্তি লোক। শ্লোগান শোনা যাচ্ছে…চাল চাই, ভাত চাই, পুলিস তুমি যতই…। লরিটা থামল। মোল্লাপাড়ার ওরা দলের সাথে হাঁটা দেবে। আরে! ঐ তো,ঐ তো…উত্তমদের কাছে যেমন শুনেছি মাকুন্দ, টেকো, রোগাটে একটা লোক। ওটা কাজলা নয় তো? ঠিক তাই, মোল্লাপাড়ার লোকেরা ওকে কাজলা বলে ডাকছে। খাকি হাফপ্যান্ট, হাফজামা,  হাতে লাঠি সে এগিয়ে যাচ্ছে ওদের দিকে। কী বলছে? হ্যাঁ  শুনতে পাচ্ছি। কাজলা বলছে,

‘লালবাড়ির দিকে যেওনি! পিটুন দেবে জোদ্দার!একপাক ঘুরে ব্রিজ পেরিয়ে চেতলা দে পালাও।’

 কথাকটা বলেই কাজলা চলে গেল।আমরা ওলগের গলা পেলাম।

‘কাজলাকে চিনতে পেরেছেন আপনারা?’

আমরা মাথা নাড়লাম। শুনতে পেলাম;

‘দেখতে থাকুন।’

ওরা হাটছে মিছিলের সাথে। রাজভবনের সামনে ব্যারিকেড। লাঠি উচিয়ে দাঁড়িয়ে আছে  পুলিশের দল। ওরা এগোচ্ছে। চেনছেড়া অ্যালসেশিয়ানের মত দৌড়ে আসছে পুলিসগুলো। লাঠিপেটা করছে, মোল্লাপাড়ার বুড়োবুড়ি, জোয়ানমদ্দ মাটিতে পড়ে চেঁচাচ্ছে। গলগল করে গড়াচ্ছে রক্ত। একটা পোয়াতি বৌ পড়ে গেছে, বেঁটে, মোটা একটা পুলিস রুল দিয়ে মেয়েটার পেটে গোত্তা মারছে। সত্যিই একেবারে মাটি ভেদ করেই বেরিয়ে এল কাজলা, মেয়েটাকে টেনে সরিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। মেয়েটার মুখভর্তি গ্যাঁজা। অনেকটা দূরে মেয়েটাকে নিয়ে গেছে কাজলা। এতক্ষণে বেঁটে পুলিসটার হুশ হয়েছে। ও মেয়েটাকে খুঁজছে। দেখতে পেয়ে গেছে। পুলিসটা ছুটে আসছে। এসে পড়ল তারপর কাজলার কোমরে প্যান্টের প্রান্ত ধরে হিড়হিড় করে নিয়ে যাচ্ছে। কাজলা হাত জোর করে বলছে…

‘ছোড় দিজিয়ে, ছোড় দিজিয়ে।’ শুনছে না পুলিসটা। নিয়ে যাচ্ছে ওকে। আমরা আবার ওলগের গলা পেলাম;

‘স্পেকগুলো দিয়ে দিন।’

ভুতো বলল;

‘আমাদের এবার কী করতে হবে?’

গোমুখ নামের হালকা-পাতলা মেয়েটা বলল;

‘কে, কাজলা কে? ঐ রোগাসোগা হোমগার্ডটা তো?’

আমরা সবাই ঘাড়কাত করলাম;

‘ওকে, কাজ শেষ। আমরা চলে যাব।’

‘কাজলার কেন বিচার হবে? ওর কী দোষ?’

কাঁদোকাঁদো এই গলা তো মিঠুর! রাশভারী মিঠু কি আজ রেকর্ড ভাঙবে? দুটো ছেলে সায়ন আর বুচি একসাথে বলে উঠল;

‘ অ্যাডিশনাল চার্জশীট হতেই পারে। কে, কোথায়, কখন, কেন, কার বদলে কাঠগড়ায়… কেউ জানে?’

আমরা যে এককাপ করে চা খাওয়াব, সেই সুযোগও দিল না। ওরা চলে গেল। আমরাও চুপ করে থাকলাম। কিন্তু আবু নড়েচড়ে উঠল। আমরা বুঝলাম ও কথা বলবে।ও কোনদিন একটাও কথা বলে না। সবেতেই হুঁ, হাঁ। হাজারবার পেছনে লাগলেও ঠোট আর গালের পেশি নাড়িয়ে সব উড়িয়ে দেয়।মেঘলালের দিকে তাকিয়ে বলল আবু;

‘ তোদের পাড়ার লোকে মিছিলে নাকি আমাদের পাড়ার হাভাতে লোকগুলো ইট ছুড়ে কাজলাকে মেরেছে!শোধ নিয়েছে!’

মেঘলাল কোন পাত্তাই দিল না, ভুতোকে বলল;

‘ মালগুলো কি চামকি, না? কিন্তু দ্যাখ ছেলেগুলোর মেয়ের নাম আর মেয়েগুলোর ছেলের! টাইটেল নেই। বাবা আছে তো এদের ?’

ভুতো হাসল, মেঘলাল হাসল, উত্তম হাসল, সিরাজ হাসল। মিঠু কিছুতেই হাসছিল না মেঘলাল ওকে ঝাঁকিয়ে ঝাঁকিয়ে হাসাল। আমরা কলকাত্তাইয়া; বন্ধুত্বে আবার জাতধর্ম কী! আমিও হাসলাম। অনেক অনেকদিন পর আমরা হসলাম। হাসতে পেরে আমরা বেঁচে যাচ্ছিলাম। দুম করেই হাসিটা থেমে গেল আমাদের।                

 আবুটা কখন  চলে গেছে জানতেই পারিনি।

(৬)

আরও বছরখানেক চলে গেছে। কর্পোরেশান ইলেকশান সামনে। বিশু কাউন্সিলার একদিন সন্ধেবেলায় এসেছিল শহিদবেদিতে। ভাল করে ওপর, নীচ, আশেপাশে সব দেখে নিয়ে বলল;

‘শহিদবেদিটা তো ঠেক আর মালখানা বানিয়ে ফেলেছে। না রংটং করে গ্রিল দিয়ে ঘিরে দিতে হবে!’

ভুতো বলল;

‘তাহলে আমরা বসব কোথায়?’

‘ সে বাল, আমি কী জানি?’

একটু থেমে বিশু উত্তম, মেঘলাল, ভুতো তিনজনের জন্যই যেন বলল;

‘পুলিস থেকে কমপ্লেন আসছে, ট্রাফিক আটকাচ্ছে। একবারি ভাবি বেদিটা তুলে দি। তারপর ভাবি…দেখি, ধোপাপাড়ার বুথের মার্জিনটা কী হয়! শুধু রঙ করে , আলো পাল্টে রেখেও দিতে পারি!’

সিরাজ জিজ্ঞেস করল;

‘কবে ভোট?’

‘বলছে তো এপ্রিলে।’

সিরাজ ঠোট নাড়াচ্ছে। আমার মনে হল ও বলে উঠবে;

‘ভোট নিয়ে এত চিন্তা কেন তোমার? তোমাদের তো…’– কিন্তু না, ও   বলল;

‘ আমার পোলিং ডিউটি পড়ে। কাটিয়ে দেবে?’

সিরাজ, সেলস-ট্যাক্সের ক্লার্ক। মিঠুর মত দু-একজন ছাড়া আমরা সবাই সরকারি চাকর।  ভোটযজ্ঞের দিন বুথে বুথে আমাদের পৌরহিত্য করতে হয়। যারা করে তারা জানে সেই হিতের কী মজা!

‘হবে হবে। তোমাদের পাড়ায় কোন চাপ নেই।’

মিঠুর গলা থেকে খুব আস্তে একটা আওয়াজ বেরোল;

‘সেই’ 

সে ভোটে যা হয় হবে। কিন্তু আমাদের কেন যেন মনে হচ্ছিল; ঠেকের আয়ু শেষ হতে চলল। তার সাথেই আর একটা কথা, আমরা কেউ কাউকে কোনদিন বলিনি । কিন্তু আমরা নিশ্চিত  জানতাম। মটর, বাগল, কাজলা তিনপ্রজন্মের অভিশাপ লেগে গেছে বেদিটার ওপর। এর কি, কোন যুক্তি আছে? অহিংস বাবার ছেলে অস্ত্র হাতে বিপ্লবপন্থী  হয়ে যায় আবার তার ছেলেই সোনার চেন, বালা, স্নিকার, স্করপিও, সমৃদ্ধ সমাজসেবী হয়ে ওঠে …তারও তো যুক্তি নেই! সে যাক,আমরা ইদানিং ফোনের পর্দা আর পথচলতি স্বাস্থ্যবতীদের থেকে নজর সরিয়ে রেখে নিজেদের দিনগুজরান আর ছোটবেলার দুনিয়াটা নিয়ে বেশি কথা বলি।লক্ষ্য করেছি মিঠু, সিরাজদের সাথে উত্তম, ভুতো, মেঘলালের তর্ক লাগেই না। আর ঘুনাক্ষরেও  আমরা কেউ মটর, বাগল, কাজলার নাম উচ্চারণ করেনি। এভাবেই ভোট চলে এল। বিশু কিন্তু কথা রাখল।

 (৭)

আমাদের কারুরই ভোটের ডিউটি আসেনি। সকাল সকাল চলে এসেছি। আজ সারাদিন আড্ডা। কিন্তু শহিদবেদিটা রাস্তার ওপারের প্রাইমারি স্কুল থেকে ২০০ মিটারের মধ্যে। তাই এপারের চায়ের দোকানগুলোয় ঘুরেফিরে গুলতানি। সামনের রাস্তা ফাকা, ইস্কুলের বুথে কেউ ঢুকছে না, বেরোচ্ছেও না। ভুতো বলছিল, কেমনভাবে ছোটবেলায় বন্ধের দিন আমরা রাস্তায় ক্রিকেট খেলতাম। আজ আবার, ওর ছেলেকে ফোন করে ব্যাট উইকেট দিয়ে যেতে বলবে কিনা! মিঠু নিষেধ করল। বুড়ো বয়সের পাগলামো। কোমড়ে, ঘাড়ে লেগে গেলেই হল।তাছাড়া আজ কেউ ঘর থেকে ছেলেপুলেকে বার করে? বাইরে থেকে আসা কর্মীরা তো চিনবে না! যতই টিমে একজন করে পাড়ার সমাজসেবী থাকুক! ভুতো লজ্জায় জিভ কাটল। ওর শাস্তি হল। একটা করে সিগারেট সবাই পেলাম। ফ্রির মজাই আলাদা।

 চায়ের খুপরি দোকানে এতগুলো লোক একসাথে সিগারেট খেলে ধোঁয়ায় ধোঁয়াক্কার। বাইরে এলাম। মৌজ করে ধোঁয়া ছাড়ার পর কানে এল একটা চেচামেচি, হৈচৈ। সিগারেট বাগানোর মৌজে এতক্ষণ খেয়ালই করিনি। গোলমালটা একেবারে আমাদের সামনে।একটা লোককে ঘিরে রয়েছে জনা ছয়-সাতেক উঠতি কর্মী। ওদের মোরগঝুটি চুলে দলের রঙ। ভেতরের লোকটা কে? কী বলছে লোকটা? লুকিয়েচুরিয়ে কান পাততে হচ্ছে না! কিছুতেই থামবে না লোকটা;

‘ আমি ভোট দেব না কেন? আমার ভোটটা দেবই। যেতে দেবে না মানে?’

ছেলেগুলো  লোকটাকে নিয়ে পাসিং দ্য বাক খেলতে শুরু করেছে। একজন ধাক্কা মারছে, আরেকজনের কাছে চলে যাচ্ছে, সে আবার ধাক্কা মারছে! লোকটা হঠাৎ ঐখান থেকে বলে উঠল;

‘ ঐ মেঘা, উত্তম দ্যাখ। এরা আমাকে স্কুলে ঢুকতে দিচ্ছে না, মারছে। আমি ফড়িং কাকা রে ফড়িং কাকা। আমি তো কথা দিচ্ছি, বাপ-ঠাকুরদা থেকে যেখানে ভোট দিয়েছি সেখানেই দেব, তোরা দেখে নে। তবুও ঢুকতে দেবে না। ওরে বাবা রে মরে যাব রে! বুকে ধাক্কা দিস না রে…’

ভুতো ফিসফিস করে বলল;

‘ ফড়িংজ্যাঠাকে বাহাত্তুরে ধরেছে। বুঝিয়ে এলুম, এবার বাদ দাও। ভোট হবেনি এবার। কিন্তু না…কাজলার ছেলে না! মটর, বাগলের রক্ত বইছে শিরায়। বুনো শুয়োরের জেদ! নে মর এখন! আমি কী করব?’

ভুতো দোকানের ভেতরে ঢুকে গেল। সিরাজ এবার ফিসফিস করছে;

‘মিঠু; দ্যাখ, দ্যাখ ওটা জয়নাল চাচার ছেলে সুমের  আর ঐ দ্যাখ তোর খালাম্মার ছেলে নাসির। ইস কীভাবে হাতটা মুড়িয়ে ধরল বুড়ো মানুষটার!’

মিঠু ডাকতে যাচ্ছিল নাসিরকে। মেঘলাল ওর মুখটা চেপে ধরল। কেউ এভাবে বিপদ বাড়ায়? ওরা ফড়িংকে মাটিতে উপুড় করে শুইয়ে পা দিয়ে চেপে ধরেছে। একজন বলছে;

‘ আগেরবার বড় ছাপে বোতাম টিপেছিস। ছেড়ে দিয়েছি। আবার দিবি? এক্ষুনি জবাই করে দেব।’

বুড়োটা রক্তমেশানো থুতু ফেলছে। গলাটা ফ্যাসফেসে হয়ে গেছে। তাও থামছে না;

‘ ওরে আমি তোদের আসল শ্ত্রু না। আমায় ভুল করে মারছিস। যেদিন কাজে লাগবে না, উল্টোকথা বলবি, তোদেরই কেস দেবে, জেলে পুরবে,  সরিয়ে দেবে। ওদের কিচ্ছু হবে না!’

‘সে তোকে ভাবতে হবে না। তুই বাড়ি চলে যাবি কি …না?  এই বুথে বিশুর হান্ড্রেড পার্সেন্ট পোলিং হবে! বিশুদা আমাদের সাথে আছে। আর তোরা তো দেশ থেকেই তাড়াবি!  পার্লামেন্টের খেলা এবার হবে না। যাবি কিনা…জলদি বল!’

ফড়িংবুড়োর সেই শুয়োরে জেদ। সে মানবে না কিছুতেই । চেস্টা করেই যাচ্ছে। যদি একজনকেও বোঝানো যায়! বিশু, তার বাপ, তার বাপ, তারও বাপ ওরা কেউ নিজের লোক না। এবার সুমের কোমর থেকে একটা দিশি ওয়ান শটার বার করল। বাকিরা বুড়োকে ছ্যাঁচড়াতে ছ্যাঁচড়াতে নিয়ে যাচ্ছে।

স্কুলের গেটে পুলিস, আর্মি ফোনে আর গল্পে ব্যস্ত। ব্যস্ত হয়ে পড়লাম আমরাও। কে কত আগে ঐ চাগুমটির শামুকখোলে ঢুকতে পারি! একটু পরেই দূরে কোথায় যেন একটা চকলেট বোম ফাটার আওয়াজ পেলাম। পুলিস এসে বলল;

‘ভোটের দিন বাইরে কেন? সব বাড়ি চলে যান। কেউ বেরোবেন না!’

(৮)

আমরা চলে এসেছিলাম সঙ্গে সঙ্গে। তারপর আর যাইনি ঐ মুখে। বাঘে ছুলে আঠারো ঘা আর কোর্ট-পুলিসে বত্রিশ ঘা। বিশুই জিতেছে। মোল্লা, ধোপা দু পাড়াতেই একশো শতাংশ পোলিং। তবে তেমাথায় এখন আর কোন শহিদ বেদি নেই। যদিও বিশু কথা দিয়েছে রজকপাড়ায়। গ্রিলের ঘের দেওয়া চারধাপের শহিদ বেদি হবে। মন্ত্রী ফিতে কাটবে।

গাড়ির তোলা তুলতে সিভিকরা এখন ঠিক ওখানটাতেই দাঁড়াচ্ছে।  

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *