বিদিশা বসু

কিন্নর – কৈলাসের পথে

প্রথম পর্ব

প্রথম দিন – সারাহান

হিমাচল প্রদেশের প্রায় অনেক জায়গা দেখা হলেও কিন্নরের সৌন্দর্য দেখার সুযোগ হয় নি।তাই  কিন্নর কৈলাসের দিকে যাওয়ার ইচ্ছে থাকলেও সময় হাতে কম থাকায় কিছুতেই যথাযোগ্য প্ল্যান করা যাচ্ছিলো না। ব্যাংকারের সাথে সংসার করার জ্বালা অনেক, আপাত দৃষ্টিতে ক্যালেন্ডারে ছুটি অনেক দেখালেও ব্যাঙ্কে চাকুরীজীবিদের ছুটি নেওয়া বড্ড মুসকিল। আমরা এত ঘুরে বেড়াই, কিন্তু তার পিছনে ছুটির হিসেব নিকেষ নিয়ে কতটা মাথা ঘামাতে হয় তা শুধু নিজেরাই জানি। আমার চাকরির ক্ষেত্রে এই সমস্যা কম,কিন্তু সংসারের অন্য মানুষটার কাজের প্রতি কর্তব্যকে সম্মান জানাতে আমরা প্রায় প্রতিবারই পুজোর সময়ে বেড়িয়ে পড়ি। এরজন্য আমাদের নিজভূমির সবচেয়ে বড় উৎসবের আনন্দকে ফেলে রেখে বেড়োতেই হয়। যাই হোক,এবারে অনেক ভেবে ঠিক করা হলো যে, ষষ্ঠীর দিন অফিস করে তারপর রাতের ফ্লাইট ধরে দিল্লি যাওয়া হবে। পরের চার দিন ছুটি এবং মাঝে দুটোদিন মাত্র নিজস্ব ছুটি নিয়ে লক্ষ্মীপুজোর দিন আবার ফিরে এলে টানা সাতদিনে এই ট্রিপ করা সম্ভব হবে। এর জন্য আমাদের কিছুটা হলেও শারীরিক কষ্ট সহ্য করে অনেকটা পথ পাড়ি দিতে হবে,তবু কিন্নরের স্বপ্ন পূরণ সম্ভব। 

ষষ্ঠীর দিন রাতে দিল্লি এয়ারপোর্ট থেকে সোজা নিউ দিল্লি স্টেশনের পাশের এক হোটেলে রাত প্রায় ১২ টায় এলাম। পরের দিন ভোর ৫.৫০ এর বন্দে ভারত এক্সপ্রেসে করে চন্ডীগড়ে নামলাম সকাল ৮.৪০ এ। সেখান থেকেই আমাদের প্রথম দিনের দীর্ঘ পথ যাত্রা। আমরা সপ্তমীর দিন যত রাস্তা এসেছি,তার জন্য শারীরিকভাবে সুস্থ থাকা এবং পাহাড়ি পথে শরীরে যে সমস্যা থাকে তা থেকে মুক্ত হওয়াটা জরুরি। নাহলে চন্ডীগড় থেকে সারাহান পর্যন্ত দীর্ঘ পাহাড়ি প্রায় ২৭৫ কিমি পথ প্রায় ১০ ঘন্টায় যাওয়াটা অত্যন্ত কঠিন। আমাদের ড্রাইভার দাদা বিচক্ষণ এবং শান্ত প্রকৃতির হওয়ায় সকাল ৯ টায় যাত্রা শুরু করে সন্ধ্যা প্রায় ৬.৩০ টায় পৌঁছে দিলেন আমাদের প্রথম কিন্নরের গন্তব্য…  সারাহান। 

এই যাত্রাপথেই আরেক লোভনীয় জিনিস নজরে এলো… কিন্নরী আপেল বাগান এবং সারা রাস্তা জুড়ে আপেল বোঝাই গাড়ির আনাগোনা। সন্ধ্যায় যখন আমরা সারাহানে আমাদের থাকার জায়গায় পৌঁছালাম,পথের সব ক্লান্তি দূর হলো হোটেলটির নিজস্ব লোকেশনের জন্য। আমরা হিমাচল টুরিজম এর ‘হোটেল শ্রীখন্ড’ এ ছিলাম। এই দীর্ঘ পথ অধিকাংশ যাত্রীরা একবারে আসেন না। একটা দিন সিমলাতে থেকে পরের দিন সারাহানে থাকাটাই ঠিকঠাক। 

সারাহান বিখ্যাত ভীমকালি মন্দির এর জন্য। এটি সতীর ৫১ টি পীঠস্থানের মধ্যে একটি। আমাদের হোটেল থেকে হাঁটাপথে ২ মিনিট এই মন্দির। হোটেলের কটেজের ঘরটি সাবেকি ও বহরে এত বড় এবং সুন্দর যে রাস্তার ধকল মিটে গেলো রাতে আরামের ঘুম দিয়ে। রাতে মন্দির থেকে পুজোর ঘন্টার আওয়াজ এবং সকালের আরতির ধ্বনি মনকে প্রশান্তি দিলো। সেদিন ছিল অষ্টমী শেষে নবমী পুজোর দিন। সকাল সকাল স্নান সেরে সেদিন মন্দিরে পুজোও দিয়েছিলাম। তবে এ মন্দিরের বৈশিষ্ট্য আমাদের এখানকার মন্দিরের মত নয়। তিব্বতি প্যাগোডার আদলে তৈরি এ মন্দির বৌদ্ধ এবং হিন্দু সংস্কৃতির বৈশিষ্ট্য বহন করছে। রুপায় মোড়া গেট সহ ছোট্ট কাঠের সিঁড়ি দিয়ে উপরে মন্দিরের গর্ভগৃহের গঠন আলাদা রকমের। মন্দিরে পুজো দিয়ে আসেপাশে ঘুরে হোটেলে এসে আবার সব গুছিয়ে বেড়িয়ে পড়েছিলাম পরের গন্তব্যের উদ্দেশ্যে।

ভীমকালি মন্দিরের ভেতরে মোবাইল ক্যামেরা নিষিদ্ধ এবং মাথা ঢেকে সবাইকে প্রবেশ করতে হয়।

মন্দির সহ সারাহানের হোটেল থেকে শ্রীখণ্ড মহাদেব শৃঙ্গ দেখা পাওয়া যায়। 

দ্বিতীয় দিন –সারাহান থেকে সাংলার পথে…

সারাহান থেকে প্রায় ৮৫ কিমি দূরে কিন্নরের পুরনো এই জনপদ… সাংলা ভ্যালি অথবা যাকে বাসপা ভ্যালিও বলা হয়। বাসপা নদীর সৌন্দর্য এবং কৈলাস পর্বতের উল্টোদিকের বরফাবৃত শোভা এই ভ্যালিকে আরও মনোরম করে তুলেছে। সারাহান থেকে সাংলা যাওয়ার পথে পাহাড়ের নানা রকম ভঙ্গিমা নজর কেড়েছে। সাংলা ভ্যালি ঢোকার মুখেই বিখ্যাত কামরু ফোর্ট যাওয়ার রাস্তা এবং ছোট্ট সাংলা বাজার জুড়ে কিন্নরী আপেল বোঝাই দোকান,স্টোর রুম আর আপেল রপ্তানির নানা কার্যকলাপ চোখে পড়লো। 

আমাদের থাকার জায়গাটি সাংলা ভ্যালি থেকে একটু দূরে প্রায় ২ কিমি,ছিটকুলের দিকে। দুপুর বাড়ার সাথে সাথে মনে দ্বিধা বাড়ছিলো যে,কোন দূরে নিরিবিলিতে কি পরিবেশে গিয়ে উপস্হিত হবো এই নির্জন জায়গায়। পথ সংকীর্ণ হওয়ায় এবং রাস্তায় বড় মিলিটারি গাড়ি আটকে থাকায় পৌঁছাতে দেরি হচ্ছিল, সাথে সাথে উদ্বেগও বাড়ছিল। 

পাহাড়ি চড়াই রাস্তা ধরে নীচে নেমে যখন ” sattva pine resort,sangla” তে পৌঁছালাম সব মনের দ্বিধাদ্বন্দ্ব একনিমিষে দূর হলো। নদীর আওয়াজ এবং সামনে বরফ ঢাকা পাহাড়ের শোভার মাঝে বৌদ্ধিক সাজে সজ্জিত এই ১০ টি কটেজ নিয়ে তৈরি রিসোর্টটি নিজেই একটা দর্শনীয় স্থান। সেই সাথে ওখানের কর্মীদের আতিথেয়তা মনে জায়গা করে নিলো। পথের ক্লান্তি দূর করতে ওদের স্হানীয় ভেষজ চা শরীরকে আরাম দিলো। তারপর লাঞ্চের সাধারণ খাবারের পরিবেশন ছিল অনন্য…  কাঁসার বাসন, পিতলের ঘড়ার জল, সাথে নিজস্ব বাগানের পালং শাকের পালংপনীর বড্ড মুখরোচক। খাবার দাবারের পরে আমরা কাছেই নদীর পাড়ে ছোট্ট ব্রিজের দিকে এগোতে লাগলাম। 

স্হানীয় বাসপেরি গ্রাম,যা এই সাংলা ভ্যালির একটা আলাদা বৈশিষ্ট্য তা এই রিসোর্টের কাছেই। আমরা বিকেলের হালকা রোদে সেই গ্রামের দিকে যাওয়ার পথে বাসপা নদীর তীরে গিয়ে উপস্থিত হয়েছিলাম। কোন বাইরের ভীড়ভাট্টা ছাড়া স্হানীয় মানুষদের কাজ থেকে ফিরে আসার দৃশ্য মনে আলাদা অনুভূতি আনলো। এই ট্রিপে সব জায়গাই সুন্দর, কিন্তু এই সাংলার রিসোর্টটি অবস্থানগতভাবে ইউনিক হওয়ায় এর সৌন্দর্যের স্বাদ সবার চেয়ে আলাদা। ছোট্ট সাঁকো পেরিয়ে গ্রামের দিকে যাওয়ার মুখে একটি মন্দির। আর তার ফাঁক দিয়ে সূর্য ডোবার আলো ঝকঝক করছে। তবে গ্রামে যাওয়ার পথটা একটু চড়াই এবং কিছুটা দূরে থাকায় বিকেলে আর যাওয়া হলো না। শারীরিক সমস্যার কারণে আমি পরের দিন সকালেও যাই নি,কিন্তু বাবা মেয়ে প্রায় ১.৫ ঘন্টা ছোট্ট ট্রেকিং করে বাসপেরি ভিলেজ ঘুরে এসেছিলো। গ্রামের প্রতিটা বাড়ি সম্পন্ন এবং সব বাড়ির সামনে আপেল বাগান। সেখানে বাইরে থেকে ব্যবসায়ীরা এসেছেন এবং আপেল পেড়ে গাড়ি করে বাইরে নিয়ে যাওয়ার প্রস্তুতি চলছিলো। ওদের দেখে স্হানীয়রা বেশ কিছু আপেল উপহার হিসেবে খেতে দেয় এবং গাছের তলা থেকেও তিতির কয়েকটা আপেল কুড়িয়ে আনে। এই আপেলের স্বাদ সম্পূর্ণ ভিন্ন। এত রসালো মিষ্টি যেন অমৃতসম। আমাদের এখানে সাধারণত এমন আপেল পাওয়া যায় না।মন ভরে আপেল বাগানে আপেলের ঝাঁক দেখে এবং বাসপা নদীর তীরে বসে সূর্যাস্ত দেখে সাংলা ভ্যালির অপরূপ শোভা ভীষণ রকমভাবে উপভোগ করেছিলাম। 

এর সাথে রাতে রিসোর্টে বনফায়ারের ব্যবস্হা এবং ঘরোয়া ভেজ সুপ বাইরের প্রায় ৫-৬° উষ্ণতাকেও গ্রহণযোগ্য করে দিয়েছিলো। রাতে ডিনারে স্হানীয় হিমাচলী কড়াই চিকেন সহ স্হানীয় খাবারের ব্যবস্হা থাকায় হিমাচলী খাবারের স্বাদও নেওয়া হয়। রাতে ঠান্ডা ভীষণ ছিল,কিন্তু কটেজের ঘরে সবরকম আরামদায়ক ব্যবস্হা থাকায় কোন অসুবিধা হয় নি।সাংলাতে বাসপা নদীর তীর সহ আপেল বাগানে ঘোরার অভিজ্ঞতা অসাধারণ ছিল। প্রতিভাস ম্যাগাজিন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *