বিদিশা বসু
বেনারসে কিছু সময় কাটানো… কুম্ভমেলার মাঝে
বাবার দ্বিতীয় মৃত্যুবার্ষিকী কয়েকদিনের মধ্যে, সেই কথা ভেবে মায়ের বহুদিনের ইচ্ছে একটি বার বেনারসে বিশ্বনাথ মন্দিরে পুজো দেওয়া। বাবা বরাবর নাস্তিক প্রকৃতির, কোনকালে কোন ঠাকুর পুজো করে নি৷ মা ঠিক তার উল্টো। মায়ের ঠাকুর আসনে মোটামুটি সবরকমের ঠাকুর মূর্তি স্হান পেয়েছে। তার মধ্যে শিবঠাকুর মায়ের সবচেয়ে প্রিয়। তিন রকমের শিবলিঙ্গকে রোজ গঙ্গাজলে স্নান করানো সহ মোটামুটি এক ঘন্টা ব্যয় করে সে তার পুজো কাজে। এমন বিপরীত মেরু বাবা-মায়ের সন্তান হিসেবে আমার উপরে বাবার প্রভাবই বেশি। আজ পর্যন্ত ঠাকুর আসনে পুজো দেওয়া কিংবা কোন উপোস বা ব্রত রাখা কোনটাই আমি করি নি। রোজের কোন পূজা অর্চনা আমার জীবনে নেই। মেয়ে বড় হওয়ার পরে ওর আবদারে বাড়িতে সবার সাথে সরস্বতী পুজোতে সামিল হই। নিজে ঠাকুর বা নানা রকম ধার্মিক নিয়মাবলি না মানলেও অন্য কারোর বিশ্বাসকে কখনো অশ্রদ্ধা করি নি। তাই মায়ের এই কাশীধামে যাওয়ার ইচ্ছেকে সম্মান জানিয়ে ট্রেনের টিকিট কাটলাম ২২শে জানুয়ারি সন্ধ্যার অমৃতসর মেলে। টিকিট কাটার সময় সবার ছুটিছাটার হিসেব করে দেখা গেল যে, মাঝে ২৪ শে /২৫শে জানুয়ারি ছুটি নিলেই হয়ে যাবে। সে মত আমরা ২৫শে জানুয়ারি সন্ধ্যার বিভূতি এক্সপ্রেসে ফেরার টিকিট কাটি। এই আড়াই দিনে দিব্যি বেনারস ঘুরে পুজো দিয়ে ভাল মতো ঘোরা যাবে… এমনই পরিকল্পনা ছিল।

এবার আসি, মহাকুম্ভ নিয়ে কথাতে। আমরা যখন টিকিট কেটেছিলাম বা কাশী যাওয়ার পরিকল্পনা করি তখন কুম্ভ মেলা সম্পর্কে কোন খবর জানতাম না৷ বস্তুত আমাদের যেহেতু ধর্ম নিয়ে এ সব ব্যাপার নেই, কোন পুজো-আচ্চার দিনক্ষণ নিয়ে কখনো খোঁজ রাখিনি, তাই কুম্ভ কি বা কবে কোথায় কখন জানতেও পারি নি৷ কিন্তু জানুয়ারিতে মকর সংক্রান্তির সময়ে নানা খবর চ্যানেল বা কাগজে মহাকুম্ভ নিয়ে নানারকম খবরাখবর চোখে পড়লো,তখন মাথার মধ্যে সেই নতুন কিছু দেখার পোকাটা নড়াচড়া করা শুরু করলাম। আমাদের যাত্রা শুরু করার ঠিক তিনদিন আগে আমরা নতুন করে প্ল্যান ভাবতে লাগলাম। কিন্তু সেক্ষেত্রে অনেক রকম প্রশ্ন এবং বাধা মনের মধ্যে চলতে থাকলো। ফলে আমরা এবারের যাত্রা নিয়ে আত্মবিশ্বাসী ছিলাম না যে, এই নতুন পরিকল্পনা সফল হবে কি হবে না। তাই কাউকে কিছু অগ্রিম না জানিয়ে বেড়িয়ে পড়েছিলাম। প্রথমত,আমরা চারজন বেনারসে যাচ্ছি,তার মধ্যে আমার মায়ের বয়স ৭০ এর কাছাকাছি এবং যিনি সেরিব্রাল স্ট্রোকের দরুন হাঁটাচলাতে খুবই ধীরগতি। মহাকুম্ভ দেখার প্রধান শর্তই যেখানে পায়ে হেঁটে চলা। এরপর আমাদের ফেরার টিকিট কনফার্ম ছিল না,ফলে সেই চাপা টেনশনটাও ছিল যেহেতু সঙ্গে বয়স্ক মা এবং ১১ বছরের মেয়ে। এছাড়া আমাদের হাতে অত্যন্ত কম সময় ছিল,মাঝখানে একটা দিন মাত্র। তাই কাশীতে পুজো দেওয়াটাই আমাদের যাত্রার আসল উদ্দেশ্য। সেটা যতক্ষণ না সম্ভব হবে,তারপরেই আমরা কুম্ভ মেলাতে যাওয়ার কথা ভাবতে পারি।

যাই হোক এতগুলো প্রশ্ন চিহ্ন মাথায় নিয়ে ২২তারিখ সন্ধ্যা ৭.১৫ র ট্রেনে রওনা দিলাম বেনারসের উদ্দেশ্যে। পরের দিন ২৩শে জানুয়ারি সকাল ৯.৩০ টার মধ্যে পৌঁছে গেলাম বারানসি জংশন স্টেশনে। সেখান থেকে আমাদের হোটেল গোদৌলিয়া মোড়ের কাছে দশাশ্বমেধ ঘাট রোডের উপরে। অটো ঐ মোড় পর্যন্ত যেতে রাজি হলো না,কারণ মাঝপথে রাস্তার কাজ চলছে। তাই বেনারসের বিখ্যাত রিক্সায় চেপে আমরা চললাম হোটেলে। দশাশ্বমেধ ঘাট যাওয়ার রাস্তার মুখে পুলিশের ব্যারিকেড। ওখান থেকে পায়ে হাঁটা রাস্তা৷ আমাদের বুকিং করা হোটেলে পৌঁছে চেক ইন করার পরে ওখানের ম্যানেজারের সাথে কথা বলে ঠিক হলো যে,সবাই স্নান সেরে পুজো দিতে চলে যাবো। সেদিন এত মানুষের ভীড় হওয়ার জন্য লাইন প্রায় ঘাটের রাস্তায়। আমরা সকাল ১১ টায় মন্দিরের চার নং গেটে পৌঁছালাম। সেখানে সুগম যাত্রার টিকিট কেটে লাইনে দাঁড়ালাম। মন্দিরের নিয়ম সম্পূর্ণ বদলে গেছে। নানারকম গেট সহ বিশ্বনাথ মন্দিরের ব্যবস্হাপনা অন্যরকম। মোবাইল বা অন্য কোন সামগ্রী নিয়ে প্রবেশ নিষেধ। পুজোর জিনিস নিয়ে প্রায় ৩ ঘন্টা লাইনে দাঁড়িয়ে মায়ের ইচ্ছা পূরণ হলো। কাশীতে বাবা বিশ্বনাথ দর্শন সহ পুজো দেওয়ার উদ্দেশ্যে এই যাত্রা ছিল। মায়ের সেই মনস্কামনা পূরণ করে আমাদের মনেও শান্তি হলো। মন্দিরের ভিতরের পরিবেশ এখন শৃঙ্খলাবদ্ধ এবং পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। পানীয় জল সহ শৌচালয় বিশ্রামাগার সব ব্যবস্হাই বেশ আধুনিক মানের। পূজার লাইনে দাঁড়িয়ে চারপাশের দর্শনার্থীদের নানা কলরবের মধ্যে থেকে এটা অনুভূতি হলো যে, ভারতবর্ষের নানা প্রান্তের মানুষ এক জায়গায় এসেছে। সামনে ছিল ওড়িয়া কয়েকজন, পাশের লাইনের এক দল দক্ষিণ ভারতীয়, পিছনে হিমাচলী টুপি পড়া এক পরিবার,আবার কিছু দূরে গুজরাটি এক অল্পবয়সী তরুণের দল। এমন নানা রাজ্যের মানুষের সমাগম ছিল। পুজোর পরিবর্তে এই বিচিত্র দেশের নানা রকম আদবকায়দা ভাষার মানুষদের দেখেই দারুণ লাগলো। তবে পুজো দিয়ে ফেরার পথের অভিজ্ঞতা মোটেই ভালো নয়৷ ঐ সংকীর্ণ রাস্তায় হাজার হাজার মানুষ পুজো দিতে আসছে কিংবা ফিরে যাচ্ছে। তার মাঝে স্হানীয় মানুষ বাইক সাইকেল নিয়ে ঐ জনস্রোতের মাঝে যাতায়াত করছে। ফলে একপ্রকার বিশৃঙ্খলা তৈরি হয় রাস্তা জুড়ে। কোন বয়স্ক মানুষ বা শিশু সেই ধাক্কাধাক্কিতে পড়ে গেলে পদপৃষ্ঠ হওয়ার সম্ভাবনা থেকে যায়। অতি সাবধানে মা কে সামলে নিয়ে আমরা প্রায় ৩০-৪০ মিনিট ঐ বদ্ধ রাস্তায় যুদ্ধ করে হোটেলে দুপুর ৩.৩০ টে নাগাদ ফিরে আসি,যেখানে হোটেল থেকে মন্দিরের গেটের দূরত্ব ১০ মিনিট মত। এই ভীড়ের একটা বড় কারণ… কুম্ভ মেলা। অধিকাংশ মানুষ মেলা ঘুরে কাশীধামে পূজা দিতে এসেছে। ফলে এই বিপুল মানুষের সমাগম। এরপর তাড়াতাড়ি দুপুরের আহার করেই বেড়িয়ে পড়লাম বেনারসের সন্ধ্যারতি দেখার উদ্দেশ্যে। বিকেল ৪.৩০ টের মধ্যেই ঘাটের দুপাশে ভীড় উপচে পড়ছে। সামনের দিকে বসার জায়গায় লোকজন বহু আগে থেকে এসে জায়গা নিয়েছে। নদীর সামনের দিকের নৌকা বা লঞ্চগুলোতেও লোকজন নজরে এলো। আমরা একটা বড় লঞ্চের উপরের ডেকে টিকিট কেটে প্রায় সামনের সারিতে বসার জায়গা নিলাম৷ প্রায় এক ঘন্টা অপেক্ষার পরে আরতির প্রস্তুতি চাক্ষুষ করলাম। সেই সাথে কাতারে কাতারে মানুষের ঢল নেমেছে ঘাটে, নদীর পাড়ে, নৌকাগুলোতে। ঘাটে আসার রাস্তা,সিঁড়ি জুড়ে মানুষ জায়গা নিয়েছে এই বিখ্যাত সন্ধ্যারতির সাক্ষী থাকার জন্য। সেই সাথে আছে প্রচুর বিদেশী মানুষের আনাগোনা। কত অবলীলায় তারা আমাদের এ দেশের পোষাক পরম্পরাকে রপ্ত করে এই পরিবেশকে উপভোগ করছে। গঙ্গা আরতি করে ছয়জন নবীন পুরোহিত এক তাল ছন্দে নানা আঙ্গিকে আধ ঘন্টার উপর সময় ধরে সন্ধ্যারতি করেন। তাদের মধ্যে যে মেলবন্ধন, তা খুব নজর কাড়ে। পঞ্চ প্রদীপ,ধুনো,শঙ্খনিনাদ, নানারকম আচার সহযোগে যে পরিবেশ রচিত হয় তা সত্যি প্রশংসনীয়। বেনারসের সন্ধ্যারতি অন্যান্য জায়গার তুলনায় স্বতন্ত্র এবং নিজছন্দে তালে পরিবেশে অনন্য হওয়ার কারণে তা সারা বিশ্বেও প্রখ্যাত। কিন্তু এই সময় বিপুল জনজোয়ারের কারণে শান্ত মনে এই পরিবেশকে উপভোগ করা অতোটাও যায় নি। তবে এত মানুষ এক জায়গায় বসে আরতি দেখছে চুপচাপ, সেটাও অন্য অনুভূতি। আরতি শেষে লঞ্চ করে রাতের বেনারসের নানা ঘাটের দৃশ্য দেখতে দেখতে সময় কেটে গেল বেশ। প্রতিটা ঘাটের আলাদা ইতিহাস, সে গল্প অনেকেরই জানা৷ তাই সে কথা আর বললাম না৷ সারাদিন বেনারসে পুজো,আরতি দেখে ক্লান্ত শরীরে হোটেলে ফিরলেও মনে প্রশান্তি ছিল যে… মা কে যে উদ্দেশ্যে এখানে নিয়ে আসা সেটা পূরণ করতে পেরেছি। ফেরার পথে বেনারসের বাসনপত্র, নানা পুজাসামগ্রীর দোকানে ঘুরে কিছু কেনাকাটা করে ফিরলাম।
এছাড়া বেনারসের চাট এর দোকান খুব বিখ্যাত, সেখানে মানুষের ভীড় নজরে এলো। এছাড়া পানের দোকান এবং বেনারসী শাড়ির দোকানেও লোকের আনাগোনা অনেক। দশাশ্বমেধ ঘাটের রাস্তায় এমন নানা ছোট বড় দোকান.. এছাড়া রথযাত্রা মোড়ে পুরনো বেনারসী শাড়ি সহ অনেক দোকান রয়েছে। পরের দিন JDS নামক বেনারসী শাড়ির সবচেয়ে পুরনো শাড়িমহল থেকে একটা শাড়িও কিনে এনেছি। আমার কাছে এটাও বেনারস ভ্রমণের এক নতুন অভিজ্ঞতা, এত বিপুল আয়োজন এবং শাড়ি সম্ভার খুব কমই আমি দেখেছি। ফিরে আসার দিন সকালে অবশ্য অসি ঘাট সহ বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয় ঘুরে দেখেছি। বেনারসের অলিগলি জুড়ে নানা কথকতা,নানা গল্প… এত কম সময়ে সে সব কিছু দেখা সম্ভব হয় নি৷ পরে আরেকবার বেনারসের নিজস্ব সৌন্দর্য উপভোগ করবো বলে যেতে হবে।
আমরা পরের দিন অর্থাৎ ২৪শে জানুয়ারি ভোর বেলা রওনা দিয়েছিলাম প্রয়াগে। মহাকুম্ভ মেলার বিশালত্ব নিজ চোখে দেখাটাই ছিল আমাদের কুম্ভমেলায় যাওয়ার উদ্দেশ্য। আমরা কোনোরূপ স্নান বা পুণ্য অর্জন করার স্বার্থে কুম্ভ দর্শনে যাই নি। ভারতবর্ষের সবচেয়ে বড় মেলার এত কাছে এসে তা না দেখে যেতে মন চাইলো না,তাই বেনারস থেকে ২.৫ ঘন্টা দূরের প্রয়াগের উদ্দেশ্যে রওনা হলাম ভোর ছয়টায়। তারপরের অভিজ্ঞতা পরবর্তী সময়ে বলবো। প্রতিভাস ম্যাগাজিন
(পরবর্তী অংশ আগামী সংখ্যায়)