বিদিশা বসু
গল্পের বইয়ের পাতা থেকে জঙ্গলের আনাচকানাচে — জিম করবেট ন্যাশনাল পার্ক
বন্যপ্রাণীদের বসবাসভূমি এবং চিড়িয়াখানায় পশুপাখির থাকার ধরনের মধ্যে পার্থক্যটা বুঝলে তবেই জঙ্গল ভ্রমণের স্বাদ অনুভব করা যায়। সে বনভূমি পশুদের নিজস্ব জগৎ, সেখানে আমরা মনুষ্যকূল বাইরে থেকে আসা অতিথি। তাই তাদের মেজাজ মর্জি অনুযায়ী তারা তাদের রাজত্বে ঘুরবে ফিরবে, সেসময়ে আমরা অতিথিরা সে রাস্তা যদি পার করি,তবে তাদের দেখা মিলতে পারে, আবার নাও মিলতে পারে…. এমনই জঙ্গলের নিয়মাবলি। এ তো চিড়িয়াখানা নয় যে, মুক্ত প্রাণকে বন্দী করে এনে আটকে রাখা,আর আমাদের আনন্দ দানের জন্য তাদের খাঁচার অন্য প্রান্ত থেকে দর্শন সুখ মেটানো।
যাই হোক… পশুদের দেখা মিলবে কি মিলবে না সে আশা না রেখেই শুধু মাত্র জঙ্গলের আদিমতার অনুভূতি উপভোগ করতে ২০২৪ সালের মে মাসের শেষে চারদিনের জন্য বেড়িয়ে পড়েছিলাম উত্তরাখণ্ডের প্রখ্যাত এবং ভারতবর্ষের সবচেয়ে প্রাচীন ন্যাশনাল পার্ক ” জিম করবেট ন্যাশনাল পার্ক “।১৯৩৬ সালে তৈরি এই পার্কে সবার্ধিক সংখ্যক বাঘ সংরক্ষিত আছে। দিল্লি থেকে প্রায় ৬-৭ ঘন্টার রাস্তা গাড়িতে গিয়ে আমরা প্রথম দিন উত্তরাখণ্ডের রামনগরের একটি সুন্দর সাজানো রিসোর্টে রাত্রিবাস করি। রামনগর থেকে প্রায় ১৫ কিমি দূরত্বে অবস্থিত আমাদের প্রথম গন্তব্য ” ঢিকালা জোন”।
ঢিকালা জোনে আমরা প্রথম দিন ” গইরাল ফরেস্ট রেস্ট হাউস ” এ ছিলাম। রাম গঙ্গা নদীর পাড়ে অবস্হিত জঙ্গলের মধ্যে এই পুরনো ব্রিটিশ আমলের থাকার জায়গায় রাতের অভিজ্ঞতা বেশ অনবদ্য। সারারাত ধরে পাহাড়ি নদীর কুলকুল আওয়াজ আর সাথে জঙ্গলের নিস্তব্ধতার মাঝে নানারকম পতঙ্গ এবং নাম না জানা জন্তুর ডাক এক আলাদা শিহরণ এনেছিলো। তবে এই রকম ছোট্ট ছোট্ট ৪-৫ টি বনদপ্তরের থাকার জায়গাগুলোতে কোন বিলাসিতার আশা করা অত্যন্ত বোকামো হবে। ইলেক্ট্রিসিটি এই সব অঞ্চলে নেই, সোলার ব্যবস্হার উপরে নির্ভরশীল এখানের বৈদ্যুতিক সিস্টেম। তাই রাত ৯ টার পরে ফ্যান চলে। সেই সাথে ভাত রুটি ডালের মত সাধারণ খাবার খেয়েই নিজেদের পেটপুজো সারতে হবে। অধিকাংশ জায়গায় নিরামিষ আহারই মিলবে। কোনরকম বাহুল্য আশা করলে এমন জঙ্গলের মধ্যে না থাকাই বাঞ্ছনীয়। তবে পুরনো আমলের বাড়ি হওয়ায় ঘর গুলো বহরে খুব প্রশস্ত এবং সুন্দর থাকার ব্যবস্হা।
তৃতীয় দিন আমরা ছিলাম, ” ঢিকালা ফরেস্ট রেস্ট হাউস ” এ। এই জায়গাটা সবচেয়ে পুরনো এবং এখানেই একমাত্র ইলেকট্রিক লাইন সহ বনদপ্তরের সব অফিস আছে। ৩২ টি নতুন পুরনো বাংলো সহ ঘর এবং খাবার সহ পানীয় জল এবং বাইরের ক্যান্টিনের সুব্যবস্হা আছে।
ঢিকালা জোনটি জিম করবেটের সবচেয়ে জনপ্রিয় এবং চাহিদা সম্পন্ন জোন। প্রধানত ফটোগ্রাফারদের প্রিয় জায়গা এটি। বছরের ২-৩ বার ভারতবর্ষ সহ পৃথিবীর নানা প্রান্তের ফটোগ্রাফাররা এখানে এসে ৩ রাত কাটিয়ে যান। নাওয়া খাওয়া বাদ দিয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা অপেক্ষা করে বাঘ সহ নানা পাখিদের একটা অসামান্য ছবি তুলতে ওঁনাদের আবেগ এবং উৎসাহ চোখের পড়ার মত। জিমমকরবেট ই এমন জঙ্গল, যার কোর এরিয়াতে টুরিস্টদের থাকা সহ ঘোরার বন্দোবস্ত আছে। তবে জীপ সাফারি করতে পারেন,যাঁরা ঐ ফরেস্ট রেস্ট হাউসগুলোতে রাত্রি বাস করবেন। বাকি বাইরের হোটেলে থাকা টুরিস্টদের জন্য ক্যান্টার সাফারি হয় ৫ ঘন্টা মত। কিন্তু ঐ ক্যান্টার বাসগুলো জঙ্গলের অনেক ভিতরের নদীর পাড় কিংবা গভীর বনভূমিতে যেতে পারে না। তারা বড় রাস্তা ধরেই ঘোরাঘুরি করে সারাদিন। কিন্তু জীপ সাফারি দিনের মধ্যে দুইবার হয়। সকাল ৫.৩০- ৯ টা এবং বিকেল ৩.৩০ থেকে ৭ টা পর্যন্ত। ফলে শিবালিক শৃঙ্গের পার্বত্য উপত্যকা সহ ঘন ঘাসের জঙ্গল কিংবা রামগঙ্গা নদীর পাথুরে জলের উপর থেকে ঘন্টার পর ঘন্টা ঘুরে জঙ্গলের আস্বাদন পাওয়া যায়। আমরা ঢিকালা জোনে দুইদিনে মোট চারবার সাফারি করেছি। এবার আসি পশুপাখিদের দর্শন সংক্রান্ত কিছু কথায়…
সম্বর সহ বার্কিং ডিয়ারের মত হরিণের যত্রতত্র ঘুরে বেড়ানো ওখানের খুব সাধারণ দৃশ্য। ময়ূর পাখনা মেলে রাস্তার মাঝে দাঁড়িয়ে সে ছবিও কয়েকবার চোখে পড়েছে। এছাড়া বুনো হাতিদের আাবাদভূমি এ জঙ্গল। তারাই এখানের রাজা, সে কথা নানা ভঙ্গিতে কত বার যে বুঝিয়েছে। কখনো নদীর পাড়ে দল বেঁধে ধূলো ওড়াচ্ছে,আবার ঘন ঘাসে বাচ্চাসহ ঘুরে বেড়াচ্ছে, কখনো বা বড় বুনো দাঁতাল হাতি একটা মোটা গাছের শিকড় সহ উপড়ে দিয়ে রাস্তায় ফেলে চলে যাচ্ছে, কিংবা বিশাল আকার শরীর নিয়ে সাফারির গাড়ির দিকে এমন ধেয়ে আসছে যে গাড়ি সব পালাতে পারলে বাঁচে।
এবার আসি সেই জঙ্গলের মহারাজার কথাতে… সবসময় তাদের দেখা মেলে না এ কথা জঙ্গলে প্রবেশের মুখেই ড্রাইভার দাদা ইরফান ভাই বলে দিয়েছিলেন। আমরাও আশা করি নি। কিন্তু মহারাজা যে আমাদের নিরাশ করবেন না,তা আমরা ভাবতেও পারি নি। চারটে সাফারিতে তিন তিনবার বাচ্চা সহ বাঘিনীর দর্শন… সে এক ঈশ্বর দর্শনের সমান। কয়েকটা উদাহরণ এমন…. ঘন ঘাসের জঙ্গল থেকে বাঘিনী মা ‘পারওয়ালি’ যার নাম,সে আমাদের সাফারি গাড়িগুলোর সামনে থেকে রাস্তা পেড়িয়ে অন্য দিকে গেলো।সেখানে এক পলাশ গাছে লেজ দুলিয়ে তার ছোট বাঘ ছানা খেলা করছে। তার একটু পরেই সে মা বাঘিনী মুখে করে এক হরিণ শাবককে শিকার করে সামনের নদীতে নিয়ে গেলো।তারপর হুঙ্কার ছাড়লো।দেখলাম,দুটো ছোট্ট বাচ্চা উল্টো দিক থেকে নদীর জল পেড়িয়ে মায়ের কাছে আসছে। হরিণ শাবকের এমন মৃত্যু খুব কষ্টদায়ক দৃশ্য হলেও মায়ের স্নেহ এবং সন্তানের প্রতি তার দায়িত্ব এ বাঘিনীর শিকার করার মধ্যে স্পষ্ট। প্রকৃতির নিয়ম তো এমনই!! মা নিজে না খেয়ে সন্তানদের ঐ খাবার ভাগ করে দিচ্ছে… এও তো এক মাতৃত্বের উদাহরণ।
বিকেলে আরেকজন বাঘমামাকে একই জায়গায় ডালপালার মধ্যে পা উঁচিয়ে বিশ্রাম রত অবস্হায় দেখলাম দুইবার মত।
আরেকবার সাফারিতে সকালে সে এক অনির্বচনীয় দৃশ্য, মা বাঘিনী শিকার ধরে ঘন ঘাসের মধ্যে রেখে এসেছে। তারপর সে নদীর জলে নেমে তার চারজন বাঘ শাবককে ডেকে নিয়ে সে রাস্তার অন্য প্রান্ত থেকে যাওয়ার চেষ্টা করছিলো। সমস্ত গাড়ি সহ ক্যামেরা তাক লাগিয়ে সবাই একদিকে অপেক্ষারত ছিল। কিন্তু বাঘিনী তার বাচ্চা সহ অন্য দিক থেকে যাওয়ায় ব গাড়ি তাদের পিছনে দৌড়াতে থাকে। বস্তুত সে এক বিরল দৃশ্য, কারণ চার চারটে বাচ্চা সহ মা বাঘের এই চলন,ফটোগ্রাফারদের কাছে এক অমূল্য সম্পদ। সেই মা বাঘ একে একে তার বাচ্চাদের ঐ গাড়ির মেলাসহ মানুষের ভীড় থেকে ঘন ঘাসের জঙ্গলের দিকে নিয়ে চললো। তারপর এ ঘাসের মাঝে তারা একে একে মিলে গেল। আমরাও এই অসামান্য দৃশ্য দেখে মন সম্পূর্ণ তৃপ্ত করে ঢিকালা জোনে দুইদিন কাটিয়ে প্রসন্ন চিত্তে অন্য গন্তব্যে রওনা দিয়েছিলাম।
আরেক বিষয় উল্লেখ্য — ঢিকালা জোনের কোথাও কোনরকম মোবাইল পরিসেবা কার্যকরী নয়। জঙ্গলের শান্তি এবং তার পরিবেশের সমতা বজায় রাখতেই আধুনিক কোনরকম পরিসেবা এখানে চালু নয়। ঢিকালা জোন বছরের ১৫ ই জুন থেকে ১৫ই নভেম্বর পর্যন্ত বন্ধ থাকে। আর এই ফরেস্ট রেস্ট হাউসগুলো তিনমাস আগে অনলাইনে বুক করতে হয় এবং সাফারিও অনলাইনে বুক হয়। বনদপ্তরের নির্দিষ্ট পরিমাণ সাফারি গাড়িই একদিনে প্রবেশ করতে পারে এবং সে সংখ্যা খুব সীমিত হওয়ায় এখানের বুকিং খুব দ্রুত শেষ হয়ে যায়।
এছাড়া জঙ্গলকে আবর্জনামুক্ত রাখতে বনদপ্তরের একটি পদক্ষেপও খুব প্রশংসনীয়। আমরা যখন জঙ্গলের সদর গেটে ভিতরে যাওয়ার অনুমতিপত্র পেলাম,তখন আমাদের হাতে একটা চটের বস্তার মত বড় ব্যাগ জিপসি গাড়িতে দেওয়া হলো। ড্রাইভার দাদা বললেন যে, যে তিনদিন আমরা এই ঢিকালা জোনে থাকবো,আমাদের ফেলে দেওয়া সামগ্রী আবর্জনা বক্সে না রেখে এই ব্যাগে পুড়ে রাখতে হবে। জঙ্গল থেকে বেড়োনোর সময়ে এই চটের ব্যাগটি গেটের বাইরে বড় এক ডাস্টবিনে ফেলে যেতে হবে। এর ফলে মানুষের ব্যবহৃত কোন প্ল্যাস্টিক বা খাবার প্যাকেট কিংবা কোন বাতিল জমা কিছু জঙ্গলের রাজত্বে থাকবে না। অতিথির মত এসে সঙ্গে করে নিজেদের বাতিল করা সামগ্রীও সাথে নিয়ে বেড়োতে হবে। তাহলে এ জঙ্গলও থাকবে কলুষমুক্ত।
চতুর্থ দিন,আমরা জিম করবেটের অন্য একটি জোনে ছিলাম,রামনগর থেকে ১১ কিমি দূরে ” ঢেলা জোন” এ। এটি অনেকটাই শহরের কাছাকাছি এবং সাধারণ টুরিস্টদের জন্য সারাবছর খোলা থাকে। আমরা ঢেলা জোনের ফরেস্ট রেস্ট হাউসে ছিলাম। এখানে মোবাইল টাওয়ারসহ বিদ্যুৎ সংযোগ সবই ব্যবস্হা আছে। সাফারির সময় সীমা এখানেও একই, তবে গাড়ি সংখ্যা অনেক কম এবং জঙ্গলের সীমানা অতি কম। এই ঢেলা জোনের সীমানা শেষে শুরু হয় আরেকটা জোন- ঝিরণা জোন। ঢিকালা জোনের অভূতপূর্ব অভিজ্ঞতার পরে শেষের দিনটা শুধু মাত্র জঙ্গলকে উপলব্ধি করতেই সাফারিতে বেড়িয়ে ছিলাম। কিন্তু সেখানেও এমন সৌভাগ্য হবে তা কল্পনার বাইরে ছিল। জঙ্গলের রাস্তা ধরে ৫ মিনিট যাওয়ার পরে নজরে এলো রাস্তার একটা ছোটো জলের কুয়োর মধ্যে বাঘ মশাই তার শরীর অর্ধেক ডুবিয়ে বসে বিশ্রাম নিচ্ছেন। প্রায় ২০ মিনিট মত আমরা তার বিশ্রামের নানা ভঙ্গিমা দেখার পরে তিনি সেই জলাধার থেকে আধা ভেজা অবস্থায় জঙ্গলের মধ্যে চলে গেলেন। পরের দিন সকালের সাফারিতেও সেই বাঘ মশাই আবারও রাস্তা পার করে একেবারে গাড়ির সামনে এসে উপস্থিত হোন। এ এক বিস্ময়কর ব্যাপার ছিল… এতবার বাঘের দেখা মিলবে তা কখনো আশাও করে যাই নি। কিন্তু এত কাছের থেকে নানারকম ভঙ্গিতে তার চলন গমন নজরে আসা,আমাদের জন্য জিম করবেট সফরনামাকে সার্থক করে।
চারদিনে মোট ছয়বার সাফারিতে পাঁচবার বাঘের দর্শন,সাথে নানারকম পশুর দিনলিপি চাক্ষুষ করা এবং নাম না জানা পাখিদের রূপের বাহার সহ তাদের গাছের কোটরে নানারকম বাসা তৈরি… এক অবাক পৃথিবীর সন্ধান দিয়েছে। শাল সহ নানা দামী গাছের নিজস্ব ভঙ্গিমায় বেড়ে ওঠা এবং গাছের গায়ে কীটপতঙ্গদের অবাধ বিচরণ সেও কিন্তু কম বিস্ময়কর নয়!!
ছোটবেলার জিম করবেট অবনিবাস এবং সেই জঙ্গলে কাটানো চার চারটে দিন মিলেমিশে এক হয়ে গেলো।