বিদিশা বসু
গল্পের বইয়ের পাতা থেকে জঙ্গলের আনাচকানাচে — জিম করবেট ন্যাশনাল পার্ক
বন্যপ্রাণীদের বসবাসভূমি এবং চিড়িয়াখানায় পশুপাখির থাকার ধরনের মধ্যে পার্থক্যটা বুঝলে তবেই জঙ্গল ভ্রমণের স্বাদ অনুভব করা যায়। সে বনভূমি পশুদের নিজস্ব জগৎ, সেখানে আমরা মনুষ্যকূল বাইরে থেকে আসা অতিথি। তাই তাদের মেজাজ মর্জি অনুযায়ী তারা তাদের রাজত্বে ঘুরবে ফিরবে, সেসময়ে আমরা অতিথিরা সে রাস্তা যদি পার করি,তবে তাদের দেখা মিলতে পারে, আবার নাও মিলতে পারে…. এমনই জঙ্গলের নিয়মাবলি। এ তো চিড়িয়াখানা নয় যে, মুক্ত প্রাণকে বন্দী করে এনে আটকে রাখা,আর আমাদের আনন্দ দানের জন্য তাদের খাঁচার অন্য প্রান্ত থেকে দর্শন সুখ মেটানো।
যাই হোক… পশুদের দেখা মিলবে কি মিলবে না সে আশা না রেখেই শুধু মাত্র জঙ্গলের আদিমতার অনুভূতি উপভোগ করতে ২০২৪ সালের মে মাসের শেষে চারদিনের জন্য বেড়িয়ে পড়েছিলাম উত্তরাখণ্ডের প্রখ্যাত এবং ভারতবর্ষের সবচেয়ে প্রাচীন ন্যাশনাল পার্ক ” জিম করবেট ন্যাশনাল পার্ক “।১৯৩৬ সালে তৈরি এই পার্কে সবার্ধিক সংখ্যক বাঘ সংরক্ষিত আছে। দিল্লি থেকে প্রায় ৬-৭ ঘন্টার রাস্তা গাড়িতে গিয়ে আমরা প্রথম দিন উত্তরাখণ্ডের রামনগরের একটি সুন্দর সাজানো রিসোর্টে রাত্রিবাস করি। রামনগর থেকে প্রায় ১৫ কিমি দূরত্বে অবস্থিত আমাদের প্রথম গন্তব্য ” ঢিকালা জোন”।
ঢিকালা জোনে আমরা প্রথম দিন ” গইরাল ফরেস্ট রেস্ট হাউস ” এ ছিলাম। রাম গঙ্গা নদীর পাড়ে অবস্হিত জঙ্গলের মধ্যে এই পুরনো ব্রিটিশ আমলের থাকার জায়গায় রাতের অভিজ্ঞতা বেশ অনবদ্য। সারারাত ধরে পাহাড়ি নদীর কুলকুল আওয়াজ আর সাথে জঙ্গলের নিস্তব্ধতার মাঝে নানারকম পতঙ্গ এবং নাম না জানা জন্তুর ডাক এক আলাদা শিহরণ এনেছিলো। তবে এই রকম ছোট্ট ছোট্ট ৪-৫ টি বনদপ্তরের থাকার জায়গাগুলোতে কোন বিলাসিতার আশা করা অত্যন্ত বোকামো হবে। ইলেক্ট্রিসিটি এই সব অঞ্চলে নেই, সোলার ব্যবস্হার উপরে নির্ভরশীল এখানের বৈদ্যুতিক সিস্টেম। তাই রাত ৯ টার পরে ফ্যান চলে। সেই সাথে ভাত রুটি ডালের মত সাধারণ খাবার খেয়েই নিজেদের পেটপুজো সারতে হবে। অধিকাংশ জায়গায় নিরামিষ আহারই মিলবে। কোনরকম বাহুল্য আশা করলে এমন জঙ্গলের মধ্যে না থাকাই বাঞ্ছনীয়। তবে পুরনো আমলের বাড়ি হওয়ায় ঘর গুলো বহরে খুব প্রশস্ত এবং সুন্দর থাকার ব্যবস্হা।
তৃতীয় দিন আমরা ছিলাম, ” ঢিকালা ফরেস্ট রেস্ট হাউস ” এ। এই জায়গাটা সবচেয়ে পুরনো এবং এখানেই একমাত্র ইলেকট্রিক লাইন সহ বনদপ্তরের সব অফিস আছে। ৩২ টি নতুন পুরনো বাংলো সহ ঘর এবং খাবার সহ পানীয় জল এবং বাইরের ক্যান্টিনের সুব্যবস্হা আছে।
ঢিকালা জোনটি জিম করবেটের সবচেয়ে জনপ্রিয় এবং চাহিদা সম্পন্ন জোন। প্রধানত ফটোগ্রাফারদের প্রিয় জায়গা এটি। বছরের ২-৩ বার ভারতবর্ষ সহ পৃথিবীর নানা প্রান্তের ফটোগ্রাফাররা এখানে এসে ৩ রাত কাটিয়ে যান। নাওয়া খাওয়া বাদ দিয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা অপেক্ষা করে বাঘ সহ নানা পাখিদের একটা অসামান্য ছবি তুলতে ওঁনাদের আবেগ এবং উৎসাহ চোখের পড়ার মত। জিমমকরবেট ই এমন জঙ্গল, যার কোর এরিয়াতে টুরিস্টদের থাকা সহ ঘোরার বন্দোবস্ত আছে। তবে জীপ সাফারি করতে পারেন,যাঁরা ঐ ফরেস্ট রেস্ট হাউসগুলোতে রাত্রি বাস করবেন। বাকি বাইরের হোটেলে থাকা টুরিস্টদের জন্য ক্যান্টার সাফারি হয় ৫ ঘন্টা মত। কিন্তু ঐ ক্যান্টার বাসগুলো জঙ্গলের অনেক ভিতরের নদীর পাড় কিংবা গভীর বনভূমিতে যেতে পারে না। তারা বড় রাস্তা ধরেই ঘোরাঘুরি করে সারাদিন। কিন্তু জীপ সাফারি দিনের মধ্যে দুইবার হয়। সকাল ৫.৩০- ৯ টা এবং বিকেল ৩.৩০ থেকে ৭ টা পর্যন্ত। ফলে শিবালিক শৃঙ্গের পার্বত্য উপত্যকা সহ ঘন ঘাসের জঙ্গল কিংবা রামগঙ্গা নদীর পাথুরে জলের উপর থেকে ঘন্টার পর ঘন্টা ঘুরে জঙ্গলের আস্বাদন পাওয়া যায়। আমরা ঢিকালা জোনে দুইদিনে মোট চারবার সাফারি করেছি। এবার আসি পশুপাখিদের দর্শন সংক্রান্ত কিছু কথায়…
সম্বর সহ বার্কিং ডিয়ারের মত হরিণের যত্রতত্র ঘুরে বেড়ানো ওখানের খুব সাধারণ দৃশ্য। ময়ূর পাখনা মেলে রাস্তার মাঝে দাঁড়িয়ে সে ছবিও কয়েকবার চোখে পড়েছে। এছাড়া বুনো হাতিদের আাবাদভূমি এ জঙ্গল। তারাই এখানের রাজা, সে কথা নানা ভঙ্গিতে কত বার যে বুঝিয়েছে। কখনো নদীর পাড়ে দল বেঁধে ধূলো ওড়াচ্ছে,আবার ঘন ঘাসে বাচ্চাসহ ঘুরে বেড়াচ্ছে, কখনো বা বড় বুনো দাঁতাল হাতি একটা মোটা গাছের শিকড় সহ উপড়ে দিয়ে রাস্তায় ফেলে চলে যাচ্ছে, কিংবা বিশাল আকার শরীর নিয়ে সাফারির গাড়ির দিকে এমন ধেয়ে আসছে যে গাড়ি সব পালাতে পারলে বাঁচে।
এবার আসি সেই জঙ্গলের মহারাজার কথাতে… সবসময় তাদের দেখা মেলে না এ কথা জঙ্গলে প্রবেশের মুখেই ড্রাইভার দাদা ইরফান ভাই বলে দিয়েছিলেন। আমরাও আশা করি নি। কিন্তু মহারাজা যে আমাদের নিরাশ করবেন না,তা আমরা ভাবতেও পারি নি। চারটে সাফারিতে তিন তিনবার বাচ্চা সহ বাঘিনীর দর্শন… সে এক ঈশ্বর দর্শনের সমান। কয়েকটা উদাহরণ এমন…. ঘন ঘাসের জঙ্গল থেকে বাঘিনী মা ‘পারওয়ালি’ যার নাম,সে আমাদের সাফারি গাড়িগুলোর সামনে থেকে রাস্তা পেড়িয়ে অন্য দিকে গেলো।সেখানে এক পলাশ গাছে লেজ দুলিয়ে তার ছোট বাঘ ছানা খেলা করছে। তার একটু পরেই সে মা বাঘিনী মুখে করে এক হরিণ শাবককে শিকার করে সামনের নদীতে নিয়ে গেলো।তারপর হুঙ্কার ছাড়লো।দেখলাম,দুটো ছোট্ট বাচ্চা উল্টো দিক থেকে নদীর জল পেড়িয়ে মায়ের কাছে আসছে। হরিণ শাবকের এমন মৃত্যু খুব কষ্টদায়ক দৃশ্য হলেও মায়ের স্নেহ এবং সন্তানের প্রতি তার দায়িত্ব এ বাঘিনীর শিকার করার মধ্যে স্পষ্ট। প্রকৃতির নিয়ম তো এমনই!! মা নিজে না খেয়ে সন্তানদের ঐ খাবার ভাগ করে দিচ্ছে… এও তো এক মাতৃত্বের উদাহরণ।

বিকেলে আরেকজন বাঘমামাকে একই জায়গায় ডালপালার মধ্যে পা উঁচিয়ে বিশ্রাম রত অবস্হায় দেখলাম দুইবার মত।
আরেকবার সাফারিতে সকালে সে এক অনির্বচনীয় দৃশ্য, মা বাঘিনী শিকার ধরে ঘন ঘাসের মধ্যে রেখে এসেছে। তারপর সে নদীর জলে নেমে তার চারজন বাঘ শাবককে ডেকে নিয়ে সে রাস্তার অন্য প্রান্ত থেকে যাওয়ার চেষ্টা করছিলো। সমস্ত গাড়ি সহ ক্যামেরা তাক লাগিয়ে সবাই একদিকে অপেক্ষারত ছিল। কিন্তু বাঘিনী তার বাচ্চা সহ অন্য দিক থেকে যাওয়ায় ব গাড়ি তাদের পিছনে দৌড়াতে থাকে। বস্তুত সে এক বিরল দৃশ্য, কারণ চার চারটে বাচ্চা সহ মা বাঘের এই চলন,ফটোগ্রাফারদের কাছে এক অমূল্য সম্পদ। সেই মা বাঘ একে একে তার বাচ্চাদের ঐ গাড়ির মেলাসহ মানুষের ভীড় থেকে ঘন ঘাসের জঙ্গলের দিকে নিয়ে চললো। তারপর এ ঘাসের মাঝে তারা একে একে মিলে গেল। আমরাও এই অসামান্য দৃশ্য দেখে মন সম্পূর্ণ তৃপ্ত করে ঢিকালা জোনে দুইদিন কাটিয়ে প্রসন্ন চিত্তে অন্য গন্তব্যে রওনা দিয়েছিলাম।
আরেক বিষয় উল্লেখ্য — ঢিকালা জোনের কোথাও কোনরকম মোবাইল পরিসেবা কার্যকরী নয়। জঙ্গলের শান্তি এবং তার পরিবেশের সমতা বজায় রাখতেই আধুনিক কোনরকম পরিসেবা এখানে চালু নয়। ঢিকালা জোন বছরের ১৫ ই জুন থেকে ১৫ই নভেম্বর পর্যন্ত বন্ধ থাকে। আর এই ফরেস্ট রেস্ট হাউসগুলো তিনমাস আগে অনলাইনে বুক করতে হয় এবং সাফারিও অনলাইনে বুক হয়। বনদপ্তরের নির্দিষ্ট পরিমাণ সাফারি গাড়িই একদিনে প্রবেশ করতে পারে এবং সে সংখ্যা খুব সীমিত হওয়ায় এখানের বুকিং খুব দ্রুত শেষ হয়ে যায়।
এছাড়া জঙ্গলকে আবর্জনামুক্ত রাখতে বনদপ্তরের একটি পদক্ষেপও খুব প্রশংসনীয়। আমরা যখন জঙ্গলের সদর গেটে ভিতরে যাওয়ার অনুমতিপত্র পেলাম,তখন আমাদের হাতে একটা চটের বস্তার মত বড় ব্যাগ জিপসি গাড়িতে দেওয়া হলো। ড্রাইভার দাদা বললেন যে, যে তিনদিন আমরা এই ঢিকালা জোনে থাকবো,আমাদের ফেলে দেওয়া সামগ্রী আবর্জনা বক্সে না রেখে এই ব্যাগে পুড়ে রাখতে হবে। জঙ্গল থেকে বেড়োনোর সময়ে এই চটের ব্যাগটি গেটের বাইরে বড় এক ডাস্টবিনে ফেলে যেতে হবে। এর ফলে মানুষের ব্যবহৃত কোন প্ল্যাস্টিক বা খাবার প্যাকেট কিংবা কোন বাতিল জমা কিছু জঙ্গলের রাজত্বে থাকবে না। অতিথির মত এসে সঙ্গে করে নিজেদের বাতিল করা সামগ্রীও সাথে নিয়ে বেড়োতে হবে। তাহলে এ জঙ্গলও থাকবে কলুষমুক্ত।

চতুর্থ দিন,আমরা জিম করবেটের অন্য একটি জোনে ছিলাম,রামনগর থেকে ১১ কিমি দূরে ” ঢেলা জোন” এ। এটি অনেকটাই শহরের কাছাকাছি এবং সাধারণ টুরিস্টদের জন্য সারাবছর খোলা থাকে। আমরা ঢেলা জোনের ফরেস্ট রেস্ট হাউসে ছিলাম। এখানে মোবাইল টাওয়ারসহ বিদ্যুৎ সংযোগ সবই ব্যবস্হা আছে। সাফারির সময় সীমা এখানেও একই, তবে গাড়ি সংখ্যা অনেক কম এবং জঙ্গলের সীমানা অতি কম। এই ঢেলা জোনের সীমানা শেষে শুরু হয় আরেকটা জোন- ঝিরণা জোন। ঢিকালা জোনের অভূতপূর্ব অভিজ্ঞতার পরে শেষের দিনটা শুধু মাত্র জঙ্গলকে উপলব্ধি করতেই সাফারিতে বেড়িয়ে ছিলাম। কিন্তু সেখানেও এমন সৌভাগ্য হবে তা কল্পনার বাইরে ছিল। জঙ্গলের রাস্তা ধরে ৫ মিনিট যাওয়ার পরে নজরে এলো রাস্তার একটা ছোটো জলের কুয়োর মধ্যে বাঘ মশাই তার শরীর অর্ধেক ডুবিয়ে বসে বিশ্রাম নিচ্ছেন। প্রায় ২০ মিনিট মত আমরা তার বিশ্রামের নানা ভঙ্গিমা দেখার পরে তিনি সেই জলাধার থেকে আধা ভেজা অবস্থায় জঙ্গলের মধ্যে চলে গেলেন। পরের দিন সকালের সাফারিতেও সেই বাঘ মশাই আবারও রাস্তা পার করে একেবারে গাড়ির সামনে এসে উপস্থিত হোন। এ এক বিস্ময়কর ব্যাপার ছিল… এতবার বাঘের দেখা মিলবে তা কখনো আশাও করে যাই নি। কিন্তু এত কাছের থেকে নানারকম ভঙ্গিতে তার চলন গমন নজরে আসা,আমাদের জন্য জিম করবেট সফরনামাকে সার্থক করে।
চারদিনে মোট ছয়বার সাফারিতে পাঁচবার বাঘের দর্শন,সাথে নানারকম পশুর দিনলিপি চাক্ষুষ করা এবং নাম না জানা পাখিদের রূপের বাহার সহ তাদের গাছের কোটরে নানারকম বাসা তৈরি… এক অবাক পৃথিবীর সন্ধান দিয়েছে। শাল সহ নানা দামী গাছের নিজস্ব ভঙ্গিমায় বেড়ে ওঠা এবং গাছের গায়ে কীটপতঙ্গদের অবাধ বিচরণ সেও কিন্তু কম বিস্ময়কর নয়!!
ছোটবেলার জিম করবেট অবনিবাস এবং সেই জঙ্গলে কাটানো চার চারটে দিন মিলেমিশে এক হয়ে গেলো।
হিমাচলের এক শান্ত রাজমহলে দিনযাপনের কথা
সিমলা – মানালি ঘুরতে যাওয়ার ইচ্ছে প্রায় সবারই থাকে। প্রকৃতি দুহাত ভরে সাজিয়েছে হিমাচল প্রদেশের আনাচ কানাচ। সেই হিমাচলেই আছে সুসজ্জিত এক রাজকীয় ব্যবস্হাপনা। সিমলার বদলে যদি সেখানে দুটো দিন কাটানো যায়,তবে কিন্তু মন্দ হয় না!! সিমলার মত জনপ্রিয় শহরের কোলাহল থেকে একটু দূরে, পাইন দেবদারু মোড়া এক রাজপ্রাসাদে থাকার অভিজ্ঞতা কিন্তু অতুলনীয়।

চণ্ডিগড় থেকে ৩ ঘন্টা যাত্রা শুরু করে, সিমলা যাওয়ার পথে একটি রাস্তা বেঁকে যায় চেইল এর দিকে। সিমলা থেকে ৪৪ কিমি দূরে এই ” চেইল প্যালেস”। প্রায় ৭৫ একর জমি নিয়ে তৈরি পাতিয়ালার মহারাজার এই সাম্রাজ্য। সে সময়ে ব্রিটিশ দের গ্রীষ্ম কালীন রাজধানী ছিল সিমলা শহর। সুন্দর সাজানো গোছানো সিমলার স্থাপত্য জুড়ে ব্রিটিশ কলোনিয়াল সংস্কৃতির ছাপ স্পষ্ট। সেই সিমলা থেকে কিছুটা উপরে অবস্থিত চেইল নামক জায়গায় পাতিয়ালার মহারাজা ১৮৯১ সালে তাঁর রাজপ্রাসাদ তৈরি করেন। পরবর্তীতে সিমলা শহরে মহারাজা ভুপিন্দর সিংহের প্রবেশ নিষিদ্ধ করেন যখন ব্রিটিশ শাষক,তখন পাতিয়ালার মহারাজাও নিজের আত্মগরিমা বজায় রেখে সিমলা থেকে উচ্চ স্হানে অবস্হিত এই ছোট্ট জায়গা চেইল কে নিজের গ্রীষ্মকালীন রাজধানী হিসেবে বেছে নিয়ে রাজপ্রাসাদের আশপাশকে সুসজ্জিত করেন। পাহাড়ি দেওদর গাছে ঘেরা এই জায়গা থেকে সিমলা সহ আশপাশের স্হানও খুব সুন্দর দেখা যায়। স্বাধীনতার পরে ১৯৭২ সালে,হিমাচল প্রদেশের সরকার সরকারি ভাবে এই প্যালেসকে অধিগ্রহণ করেন এবং এখন বর্তমানে এটি হিমাচল প্রদেশ টুরিজম ডিপার্টমেন্টের একটি হেরিটেজ হোটেল।
এই বিশাল জায়গা ‘ চেইল প্যালেস ‘ হিসেবে পর্যটকদের কাছে পরিচিত। সিমলা থেকে ১-১.৫ ঘন্টা দূরত্বে অবস্হিত এই প্যালেস দেখতে সকাল ১০ টা থেকে ভীড় লেগে থাকে পর্যটকদের। গেটের বাইরে ১০০ টাকা প্রতি জন টিকিট ক্রয় করে দর্শনার্থীরা ঘুরে দেখতে পারেন এই রাজপ্রাসাদ এবং তার চারপাশের নানা জায়গা।
আমরা একটু অন্যভাবে এই জায়গা উপভোগ করলাম। সিমলা শহরে না থেকে হিমাচল টুরিজমের এই হেরিটেজ হোটেলে দুটো দিন থেকে অপার সৌন্দর্য উপভোগ করলাম। এখানে নানা রকম দামের রুম পাওয়া যায়।প্রধান যে রাজপ্রাসাদ আছে, সেই প্যালেসে মহারাজা, মহারাণীর স্যুট রুম সহ রাজকুমার, রাজকুমারীর রুম,উজির এবং দেওয়ানের রুম নামে সব ঘর আছে। এক এক রুমের এক রাতের খরচ এক একরকম। ৫৫০০ টাকা থেকে শুরু করে ১২০০০ টাকার রুমও এই প্যালেসের মেইন বিল্ডিংয়ে আছে। এছাড়া অ্যানেক্স বিল্ডিং এবং জঙ্গলের মধ্যে কটেজেও থাকার ব্যবস্হাপনা করা আছে।
আমরা প্যালেসের মেইন বিল্ডিংয়ে থাকার জন্য এক দারুণ অভিজ্ঞতা অর্জন করেছি। প্যালেসের নীচের তলায় সাধারণ দর্শকদের জন্য সকাল থেকে খোলা থাকে। সেখানেই হোটেলের রিসেপশন কাউন্টার এবং খাবার জায়গা। সেই ডাইনিং হলের পাশে বিলিয়ার্ড রুম সহ রাজাদের ব্যবহৃত নানা জিনিস দিয়ে সাজানো মিউজিয়াম। ঠান্ডা পানীয় দিয়ে উষ্ণ অভ্যর্থনা জানিয়ে ওখানের স্টাফরা আমাদের উপরের দোতলায় নিয়ে যান,যেখানে সাধারণ ভিজিটার্সদের প্রবেশ নিষিদ্ধ। শুধু মাত্র ঐ বিল্ডিংয়ে যাদের বুকিং থাকে,তারাই উপরের ঐ অপূর্ব সুন্দর ফ্লোরে যেতে পারেন। ঝাড়বাতি লন্ঠন দিয়ে সাজানো টানা বড় বারান্দার কোণে কোণে রাজকীয়তার ছোঁয়া। বিশাল বড় বড় ঘরের বাইরে রাজকুমার, রাজকুমারী, মহারাজ, মহারাণী লেখা আর দেওয়ালে দারুণ সব হাতে আঁকা ছবির বাহার।
দুপুরে খাবার জায়গায় ভীড় নজরে এলো। কাছাকাছি পাঞ্জাব হরিয়ানার মানুষজন ডে আউটিং হিসেবে এই জায়গাকে বেশ পছন্দ করেন,দেখে বোঝা যায়। সারাদিন ঘুরে ফিরে বিকেল বা সন্ধ্যায় ফিরে যাচ্ছিলেন অনেকে। সামনের মাঠ জুড়ে বসার জায়গা, বাচ্চাদের খেলার জায়গা,ছোট্ট ঝর্ণা আর ফুলের বাহার। এখানে ব্যাডমিন্টন এবং লন টেনিসের আলাদা কোর্ট আছে। সামনের মাঠে বড় বড় কোম্পানির মিটিং কিংবা বিয়ের অনুষ্ঠানের জন্যও ভাড়া দেওয়া হয়। তেমনই কোন অনুষ্ঠানের প্রস্তুতি চলছিল,তাই মাঠ জুড়ে প্যান্ডেল হওয়ার দরুণ প্যালেসের সামনের সৌন্দর্য একটু কম উপভোগ করলাম।

তবে প্রকৃতির নিস্তব্ধ রূপ এবং কোলাহল মুক্ত পরিবেশ এর আশেপাশের দৃশ্যকে ছবির মত সাজিয়ে রেখেছে। দুপুরে লাঞ্চ করে আমরা পায়ে হেঁটে প্রাসাদের চারপাশ ঘুরে দেখতে লাগলাম। ৩ কিমি দূরে একটি মন্দির আছে,সেটিও শান্ত সুন্দর। এছাড়া চিলড্রেন পার্ক,গাড়ি রাখার জায়গা সব সুন্দর আয়োজন আছে। আর আছে পাইন রডোডেনড্রন দেওদর গাছে ঘেরা ছোট ছোট গলির মত পথ। আর তার ফাঁকে ফাঁকে পাহাড়ের কোণে কটেজ। পাহাড়ি ডেইজি ফুলে মুড়ে আছে ফাঁকা জায়গা। এত রঙ বাহারি ফুল,নাম না জানা পাখি আর ফুল… এ জায়গাকে করেছে আলাদা। প্রকৃতির কোলে নিরিবিলিতে ঘুরে প্রাকৃতিক পাহাড়ি সৌন্দর্য উপভোগ করার যথাযোগ্য জায়গা চেইল।
রাতের পরিবেশ আবার সম্পূর্ণ আলাদা। এখানে সন্ধ্যা নামে অনেক পরে। ৭ টার সময়ে হালকা আলোর ছোঁয়ায় প্যালেসের পরিবেশ মায়াবি হয়ে যায়। সকাল থেকে নানা জায়গা থেকে আসা পর্যটকের ভীড় লেগে থাকে প্যালেসের সংগ্রহশালা দেখতে। সেই কলরবে মুখরিত প্যালেস ৭ টার পরে নির্ঝুম শান্ত হয়ে যায়। কয়েকজন ওখানে রাত্রি বাস করা আমাদের মত পর্যটক ছাড়া অন্য কারোর অস্তিত্ব থাকে না। আর মহলের দোতলা তো রাতে আরও নিঃশব্দ,নিজের পায়ের আওয়াজেও বিভ্রান্তি তৈরি হওয়ার জোগার। ওত বড় ফ্লোরে রাতে আমরা কয়েকজন ঘুরে,সামনের মাঠের অন্ধকার উপভোগ করার অভিজ্ঞতাও বেশ রোমহষর্ক।
এখান থেকে পরের দিন সকালে ব্রেকফাস্ট করে সিমলার আসেপাশ ঘুরে দেখে দুপুরে সিমলা মলের কোলাহল মুখরিত পরিবেশ বেশ ভালো লাগলো। সিমলা কালিবাড়িতে গিয়ে নিজস্ব সংস্কৃতির স্পর্শ বেশ উপভোগ্য। সিমলামলে পায়ে হেঁটে,বসে,সেখানের কালচারকে চাক্ষুষ করতে বেশ লাগে। সন্ধ্যা নামার পরে আবারও ফিরে এসেছিলাম সেই মায়াবি স্বপ্নপুরীতে। সন্ধ্যায় সেই নিস্তব্ধ ফাঁকা রাস্তা ধরে ফিরতে ফিরতে মনের মধ্যে শান্তি অনুভব হচ্ছিল।
প্রকৃতির মাঝে দুটো দিন শান্তিতে নিরিবিলিতে কাটানোর জন্য “চেইল প্যালেস” খুব ভালো একটা জায়গা। এখানে রাত্রিবাস করার জন্য হবে হিমাচল প্রদেশ টুরিজম থেকে রুম বুকিং করতে হবে। চন্ডীগড় থেকে প্রায় ১০৫ কিমি দূরে, পৌঁছাতে ৩.৫ ঘন্টা মত সময় লাগে এবং সিমলা শহর থেকে ৪৫ কিমি দূরে অবস্হিত এই প্যালেস একবার ঘুরে দেখে আসতেই পারেন… আশা করি নিরাশ হবেন না।
ভরা বর্ষায় জলপ্রপাতের মুখোমুখি… রাঁচি শহরে ঝটিকা সফর
ঝর্ণা! ঝর্ণা! সুন্দরী ঝর্ণা!
তরলিত চন্দ্রিকা! চন্দন-বর্ণা!
অঞ্চল সিঞ্চিত গৈরিকে স্বর্ণে,
গিরি-মল্লিকা দোলে কুন্তলে কর্ণে,
তনু ভরি’ যৌবন, তাপসী অপর্ণা!
ঝর্ণা!
— সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত
ঝর্ণার জল বৃষ্টিস্নাত হলে কেমন অপরূপ হয়, তার রূপদর্শন করতে হঠাৎ করে বেড়িয়ে পড়লাম ঝাড়খন্ডের রাজধানী শহর রাঁচির উদ্দেশ্যে। ছোটবেলা থেকে নানাজনের কাছে মজা করে শোনা কথা যে, তোকে রাঁচির পাগলাগারদে পাঠাতে হবে। কিংবা বর্তমান সময়ের তারকা ক্রিকেটার মহেন্দ্র সিং ধোনির বাসস্হান শহর হিসেবে রাঁচির নাম বেশ বিখ্যাত। তাই এই জায়গা দেখার সুপ্ত ইচ্ছেও মনের মধ্যে নিয়ে রাঁচির উদ্দেশ্যে রওয়া দিলাম বৃহস্পতিবার রাতের ট্রেনে।
হাওড়া থেকে রাত ৯.৩০ টায় কৃয়াযোগা এক্সপ্রেসে চেপে পরের দিন সকাল ৬ টা নাগাদ রাঁচি স্টেশনে পৌঁছালাম। ট্রেন ৩০ মিনিট মত লেট ছিল। স্টেশনে পা দিতেই চারপাশের দেওয়াল জুড়ে নানারকম দেশীয় চিত্রের নিদর্শন চোখে পড়লো। স্টেশনের বাইরে সেই ভোরবেলাতেও গাড়ির লাইন আর ব্যস্ততা নজরে এলো।
আমাদের হোটেল অগ্রিম বুকিং ছিল – ঝাড়খন্ড টুরিজম এর “হোটেল বিরসা বিহার” এ। স্টেশন থেকে একটা অটো করে ১.৫ কিমি দূরের সেই হোটেলে সহজেই পৌঁছে গেলাম। রাস্তায় যেতে যেতেই নজরে পড়লো… শহর জুড়ে দেওয়াল চিত্র যা ঐ রাজ্যের পরম্পরার বাহক। হোটেলের একটি স্যুট রুম বুক ছিল৷ আয়তনে প্রায় একটি এক কামরার ফ্ল্যাটের সমান এবং চারপাশ ভীষণ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। সকালবেলা ট্রেনের ক্লান্তি কাটিয়ে ঘন্টা দুয়েক বিশ্রাম নিয়ে প্রথম দিনের গন্তব্যে বেড়িয়ে পড়লাম।

প্রথম দিন – রাঁচি শহর থেকে প্রায় ৪০ কিমি দূরে অবস্হিত বিখ্যাত দশম ফলস্। নির্দিষ্ট জায়গায় গাড়িতে পৌঁছে এবার সিঁড়ি দিয়ে নীচে নামার পালা। হালকা বৃষ্টির মত পরিবেশে দূর থেকে জলের আওয়াজ আসছিল। বাঁধানো বেশ চওড়া সিঁড়ি বেয়ে কিছুটা নামার পরে পরে পাশাপাশি ভিউ পয়েন্টের জায়গায় বসার ব্যবস্হাপনা আছে। দূর থেকেই দশম জলপ্রপাতের ফেনিল জলকণা নজরে আসছিল। প্রায় ২৫০-৩০০ সিঁড়ি পেরিয়ে জলের কাছাকাছি আসা গেল। বড় বড় পাথর টুকরোর উপরে বসে ছবি তুলে,ঝর্নার জলে পা ডুবিয়ে বসে বেশ সময় কাটাচ্ছিল সবাই। আমরাও সামিল হয়েছিলাম সবার মত। তবে বৃষ্টির ছিটেফোঁটা গায়ে পড়তেই আবার সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে তৎপর হলাম। উপর থেকে বর্ষণস্নাত ঝর্ণার রূপ দেখে আরও মুগ্ধ হলাম।
এরপর বৃষ্টি মাথায় নিয়ে দশম ফলস্ এর কাছাকাছি সূর্য মন্দিরের উদ্দেশ্যে গেলাম। সাতটি বড় বড় ঘোড়ার মূর্তি দিয়ে তৈরি মন্দিরের চত্ত্বর নিরিবিলি সুন্দর। নীচে মন্দিরের স্বেচ্ছাসেবী সংস্হার তরফে স্হানীয় স্কুলের বাচ্চাদের মধ্যাহ্ন আহারের ব্যবস্হা আছে,দেখলাম।
এরপর আমাদের উদ্দেশ্য – বিখ্যাত পত্রাত্রু ভ্যালি। কিন্তু যাওয়ার সময়ে বৃষ্টির জন্য মাঝ পথে থেমে গেলাম,আর সেখানে দুপুরের খাবার খাবো বলে ঠিক হলো। খাবার জন্য যেখানে থামলাম,সেটাও বেশ বিখ্যাত জায়গা- মাহিন্দ্র সিংহ ধোনির ফার্ম হাউসের ঠিক পাশের রেস্টুরেন্ট। বৃষ্টির মধ্যে দুপুরের আহার শেষ করার পরে এক ঝলক ধোনির বাড়িতে উঁকিঝুঁকি দেওয়ার চেষ্টা করলাম। উঁচু পাঁচিলে ঘেরা লোহার লাল রঙের গেটের সামনে কয়েকজন দর্শনার্থীকে চোখে পড়লো, বাইক নিয়ে ধোনির নাম লেখা জার্সি পরে তারা এসেছেন এতটা পথ বাইকে, পশ্চিমবঙ্গ থেকেই,শুধু মাত্র এক ঝলক ক্রিকেটের আইকনকে দেখবে বলে। গেটের ফাঁক থেকে যতদূর দেখা গেল – প্রশস্ত পিচ রাস্তা পেরিয়ে প্রসাদসম এক বাড়ি আর তার উপরে উড়ছে বিশাল এক ভারতের পতাকার জয়ধ্বজা।
এরপর বিকেল হওয়ার আগে আগে আমরা পৌঁছে গেলাম পত্রাত্রু লেকে। রাঁচি থেকে ৩৩ কিমি দূরে অবস্হিত, এই যাত্রাপথ সম্পূর্ণ অন্য রকম। পাহাড়ি চড়াই উৎরাই পথ ধরে এগিয়ে চলছিলাম হালকা বৃষ্টির মধ্যে। একটু যাওয়ার পরেই পত্রাত্রু ভ্যালির প্রকৃত আকর্ষণ চোখে এলো। আঁকাবাঁকা পথ উপর থেকে সর্পিল হয়ে নীচে নেমেছে,সেই সাথে সবুজ গাছের শোভা চারদিকে। রাস্তার দুপাশে ২-৩ টে ভিউ পয়েন্ট থেকে জিক জ্যাক লাইনের ছবি তোলার ভিড় নজরে এলো। তারপর আমরা যখন পত্রাত্রু লেকে পৌঁছালাম টিকিট কেটে, নৌকা বিহারে যাওয়ার অনুরোধ নিয়ে মাঝিদের আনাগোনা শুরু হলো। একটা স্পিডবোটে চেপে লাইফ জ্যাকেট পরে লেকটা জলপথে প্রায় ২০ মিনিট মত ঘুরে দেখলাম। বেশ চওড়া, অনেকটা জায়গা নিয়ে এই লেক। এরপর লেক সংলগ্ন পার্কে কিছু সময় কাটিয়ে সন্ধ্যায় সারাদিনের ক্লান্তি নিয়ে হোটেলে ফিরে এলাম।
তবে বর্ষায় সবুজের সমারোহ যেমন চোখে পড়ার মত,তেমনই ঝর্ণার শোভা সুন্দর।

দ্বিতীয় দিন – সকালবেলা ১০ টার মধ্যে সকালের জল খাবার খেয়ে বেড়িয়ে পড়লাম রাঁচির অন্য বিখ্যাত জলপ্রপাত গুলো দেখতে। প্রথম লক্ষ্য ছিল – জোনহা ফলস্। রাঁচি-পুরুলিয়া হাইওয়ে রাস্তা ধরে প্রায় ৪৫ কিমি দূরের এই জলপ্রপাতে পৌঁছানোর রাস্তাটাও বেশ সুন্দর। ঘন জঙ্গলে ঘেরা গ্রামের মধ্যে দিয়ে যেতে হয়। গাড়ি থেকে নেমে রীতিমতো মানসিক প্রস্তুতি নিয়ে নামতে শুরু করলাম প্রায় ৭২২ সিঁড়ি নীচের এই মোহময়ী ঝর্ণার রূপদর্শন করতে। ৪৫ মিটার লম্বা এই ঝর্ণা ধাপে ধাপে নেমে এসেছে ৩-৪ টে ভাগে, প্রকৃতি প্রেমী এবং ফটোগ্রাফার মানুষদের পছন্দের জায়গা এটি। বেশ কিছু সময় কাটানোর পরে এবার উপরে ওঠার পালা। সে এক বিষম কষ্টের যাত্রা। এতগুলো সিঁড়ি উপরে ওঠতে প্রাণবায়ু যাওয়ার জোগাড়। হাঁফাতে হাঁফাতে অনেকটা সময় নিয়ে উপরে ওঠা গেল। তবে ঝর্ণার অপরূপ রূপ সেই কষ্টকে লাঘব করে।
এখানে পাতায় সাজিয়ে দেশী মুরগির ঝোল দিয়ে যে খাবার পরিবেশন করেন স্হানীয় দোকানীরা তা বেশ সুস্বাদু।
এরপর পরবর্তী লক্ষ্য – সীতা ফলস্। জোনহা থেকে ৫ কিমি দূরে এই ফলস,আকারে অনেকটা ছোট এবং সিঁড়ির ধাপ ১০০-১৫০ মত। তাই খুব বেশি কষ্ট হয় নি আসা যাওয়া করতে।
এরপরের গন্তব্য ঝাড়খণ্ডের বিখ্যাত হুন্ড্রু ফলস্। রাঁচি – পুরুলিয়া হাইওয়ে ধরেই সেখানে যাওয়া যায়। সুবর্ণরেখা নদীর জলপ্রপাত হিসেবে বিখ্যাত এই ফলস্ দেখতে প্রায় ৭৫০ চড়াই সিঁড়ি নামতে হবে। পূর্বের দুটো ফলস্ দেখার ক্লান্তি এবং শারীরিক সমস্যার কারণে ঐ সিঁড়ি ভাঙতে ভয় হচ্ছিল। কিন্তু তখনই ড্রাইভার মশাই অভয় দিলেন যে, উনি ফলস্ দেখাতে একটা স্হানীয় রাস্তায় নিয়ে যাবেন জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে। হাইড্রো ইলেকট্রিক্যাল পাওয়ার প্রজেক্টের পাশ থেকে নদী পেরিয়ে ঝর্ণার রূপ দর্শন করা যায়। পাওয়ার প্রজেক্টের সামনে গাড়ি দাঁড় করিয়ে আমরা তার পিছনের সিঁড়ি থেকে দূরের ঝর্ণাধারা দেখতে পেলাম। এরপর স্হানীয় দুজন দোকানী বললেন যে, পাথুরে নদীর উপরে বাঁশের সাঁকো পেরোতে ২০ টাকা দিলে আরও কিছুটা কাছ থেকে দেখতে পাওয়া যাবে। ওনাকে ৫০ টাকা দিতেই উনি আমাদের বাঁশের সাঁকো পার করে আরো কিছু পথ দেখিয়ে নিয়ে গেলেন। সে পথের দুপাশে বড় বড় পাথর বিছানো,পাশে আগাছা ভরা, আবার কোথাও বেশ বিপদসংকুল পিচ্ছিল বড় পাথর পেরিয়ে আমরা প্রায় ঝর্ণার কাছে এসে পৌঁছালাম। আসেপাশে কোন লোকের আনাগোনা ছিল না,তাই মন ভরে ছবি তুলে আবার সেই পথ ধরে সাবধানে ফিরে এলাম। ফেরার পথে একদল অল্পবয়সী স্হানীয় যুবকদের নদীর জলে আনন্দের সাথে স্নান করার মজা নিতে দেখলাম। প্রকৃতির একবারে কাছে এমন সুন্দর জলপ্রপাত, মন ভরিয়ে দিলো।

ফেরার পথে আমাদের জগন্নাথ মন্দির, টেগোর হিল, রক গার্ডেন দেখে ফিরে আসার কথা ছিল। কিন্তু মেয়ের শরীর ক্লান্ত হয়ে অসুস্থ বোধ করায় হোটেলে ফেরার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। ফেরার পথে অবশ্য ড্রাইভার দাদাকে বলেছিলাম,সেই গল্প বা কথায় শোনা বিখ্যাত পাগলাগারদ যা RINPAS নামে ওখানে পরিচিত,তা দেখিয়ে আনতে। ব্রিটিশদের নির্মিত সবচেয়ে পুরাতন মানসিক হাসপাতাল এটি।
সেই সাথে রাঁচি শহরের বড় বড় রাস্তা,প্রশাসনিক ভবন,রাজভবন, মুখ্যমন্ত্রীর আবাস… সব দেখে হোটেলে ফেরা হলো। তবে রাস্তায় কোন ট্রাফিক পুলিশ নজরে আসে নি,তাই গাড়িগুলোর নিয়ন্ত্রণ একটু বেলাগাম । রাস্তার দুপাশ জুড়ে স্হানীয় আদিবাসী সম্প্রদায়ের সোহরাই শিল্পকলার মাধ্যমে গ্রাম্য সংস্কৃতি, ময়ূর সহ বন্য প্রাণীদের নানারকম ভঙ্গি,স্হানীয় জীবনযাপন সহ নানারকম সাঁওতাল পটভূমি তুলে ধরা হয়েছে দেওয়ালে দেওয়ালে।
সেদিন রাতের ১০.১৫ তে রাঁচি স্টেশন থেকে কৃয়াযোগা এক্সপ্রেস ট্রেনে ফেরার টিকিট কাটা ছিল। তাই রাতের খাবার তাড়াতাড়ি খেয়ে আমরা ট্রেন ধরার উদ্দেশ্যে ৯.৩০ টার মধ্যে স্টেশনে পৌঁছে যাই। পরের দিন ভোর ৭ টার মধ্যে হাওড়া স্টেশনে চলে আসে।
এই দুই দিনের রাঁচি সফর ব্যস্ততার সাথে বেশ দারুণ উপভোগ করে কাটলো। তবে হাতে সময় থাকলে আরও ২-৩ দিন, নেতারহাট এবং বেতলা – এই দুটো জায়গাও একসাথে ঘুরে আসা যায়।
সরকারি ওয়েবসাইট থেকে হোটেল বুকিং করা যায়। ওখানে ২০০০ এবং ৩০০০ টাকার দু রকম রুম পাওয়া যায়। আমাদের দু দিন রাঁচির দর্শনীয় স্হান ঘুরতে গাড়ি ভাড়া প্রতিদিন ৩০০০-৩৫০০ টাকার মধ্যে পড়েছিল। স্হানীয় ডোকরার কাজের জিনিস বেশ বিখ্যাত। রাঁচি থেকে স্মারক হিসেবে কিনে আনা যায়।
ঝাড়খণ্ডের রাজধানী শহরে কাটানো এই দুটো দিন থেকে এইটুকু উপলব্ধি করলাম, বর্ষার সময়ে ঘুরে আসার জন্য আদর্শ জায়গা। কারণ জলপ্রপাত গুলো বৃষ্টিতে বেশ ভরভরন্ত, সেই সাথে চারপাশে সবুজের সমারোহ।
সামনের বর্ষাতে আপনারাও ঘুরে আসতে পারেন এই শহর থেকে।
দোলের ছুটিতে একদিনের জন্য মনের খোঁজে “মনচাষা”
দোলের ছুটিতে একদিনের জন্য মনের খোঁজে “মনচাষা”
গত বছর থেকে দোলের সময় বাড়িতে বা জন্মভিটেতে থাকতে মন চায় না। বাবা….. বড্ড ভালবাসতো রঙ মাখতে, ঐ দিন উঠোনে খালি গায়ে দাঁড়িয়ে প্রচ্ছন্ন সম্মতিতে বাচ্চা বুড়ো সবার হাত থেকে রঙ মেখে খুব খুশি মনে মিষ্টি চকলেট ভাগাভাগি করতো। তাঁর সেই স্মৃতি দোলের অনুভূতির সাথে মিশে,তাই গতবছর সে চলে যাওয়ার পরে পালিয়ে বেড়াই ঐ দিনটা চেনা গন্ডি থেকে অন্য কোথাও,দূরে অচেনার মাঝে।।
2024 সালে খুঁজতে খুঁজতে এক নতুন ঠিকানায় পৌঁছে গেলাম দোলের দিন সকালে… আমরা ৫ জন। সুন্দর সাজানো এক গ্রাম্য পরিবেশে নদীর পাড়ে “মনচাষা গ্রামীণ পর্যটন কেন্দ্র “। চারটি বাঁশের এবং চারটি মাটির তৈরি কটেজে রয়েছে সব রকম আধুনিক সুবিধার আয়োজন,কিন্তু সেই সাথে গ্রাম বাংলার আবেগ মেখানো।

পূর্ব মেদিনীপুরের এক ভিতরের গ্রাম পাউশিতে বাগদা নদীর ধারে এই অনন্য ভাবনার মিশেলে তৈরি ” মনচাষা ইকো ভিলেজ “। গেট পেরিয়ে দুপাশে বাঁধানো পুকুর, তার মাঝে গাছ গাছালি ঘেরা এক বাঁশের মাচানের খোলা বৈঠকখানায় এসে রাস্তার সব ধকল নিমেষে ঘুচলো। তারপর শুরু আতিথেয়তা, মহিলারাই এখানের সব দেখভাল করেন,সাথে অবশ্য ম্যানেজার মশাই ছেলেটি অমায়িক ব্যবহারের। মনে হলো যেন,কোন এক আত্মীয়ের গ্রামের বাড়িতে এসে বসলাম। খাটের দুপাশে বড় বড় পাখা দিয়ে সাজানো বিছানায় বসে দুপাশের হাওয়ায় চোখ বুজে আসছিল। সামনে সেই আমার ঠাকুমা যেমন চেয়ারে বসতো,আমাদের সেই পুরনো বাড়ির মত খোলা বারান্দায় রাখা চেয়ারগুলো আর টেবিলের সাজসজ্জা। সামনে অবশ্য ক্যারাম বোর্ড, লুডো, দাবার মত সব অবসর কাটানোর খেলার জিনিস মজুত। রান্নাঘর সহ সংলগ্ন ঘরগুলোর নামও বেশ মনকাড়া। ” তালা ভাঙার পাঠ”, “পাকশালা” এমন সব নামকরণ মাটি লেপা ঘরগুলোতে। আয়েশ করার জন্য ঐ বারান্দায় ছোট ছোট জলচৌকি, আবার দড়ির দোলনা রাখা,সাথে দেওয়াল জুড়ে গ্রাম বাংলার নানা ঐতিহ্য… ঝুড়ি,কুলো,খড়ের চাল, এর সাথে আবার বাচ্চাদের আঁকার জন্য একটা ক্যানভাসে সাদা আর্ট পেপার সহ রঙ পেনসিল।
আমাদের বসতে বলে এক দিদি লেবুর সরবত নিয়ে এলেন যখন, শরীর সহ মন জুড়ে বড় প্রশান্তি এলো।

এরপর ঐ দাওয়ার সামনের দুটো উঁচু মাচানের উপরে বাঁশের তৈরি ঘরে আমাদের একদিনের বসত ব্যবস্হা। চারপাশে ছোট্ট জলে পদ্মপুকুর, কিংবা ছোট্ট ছোট্ট ঘড়ের চালের নীচে দোলনা বা বসার মাচান করা। কতরকম ফলফুলের গাছ। এ সব ঘুরে ঘুরে আমাদের দেখার পালা চললো।একটা মাটির বাড়ির সামনে ঢেঁকি রাখাও ছিল। এরপর ঘরে গিয়ে বিশ্রাম নেওয়া…কিন্তু ঘরে গিয়ে তার আদল দেখে বেশ অবাক হলাম। কত্ত বড় বাঁশের ঘর। দুপাশে বড় বড় দুটো খাট, উঁচু সে ছাদ গম্বুজের মত, পরিষ্কার গামছা রাখা আমাদের জন্য, সাথে দুপাশের বিছানায় মশারীর ব্যবস্হা। ঘরের প্রতিটা কোণে যেমন যত্নের ছাপ,তেমনই ব্যালকনিতে বসার আলাদা রকম ব্যবস্হা। সব মিলিয়ে আমাদের ক্লান্তি কেটে গেল এমন কলুষমুক্ত নির্মল প্রাকৃতিক পরিবেশে এসে!! সবচেয়ে দেখার বিষয় হলো… ঘরের কোণে বা মাঝের বারান্দায় বসে থাকার জায়গায় “সহজ পাঠ” এর নানা ছোট্ট ছোট্ট উক্তি লেখা..
তারপর একটু সাজগোছ করে পুকুর পাড়ে গিয়ে আবির রঙে রাঙা হলাম আমরা। নির্জন পরিবেশে নিজেদের মধ্যে এই রঙ খেলা… এক অন্য অনুভব জাগালো। হঠাৎ দেখলাম গ্রাম থেকে একদল কিশোরী দল এসে আমাদের গালে রঙ ছুঁয়ে গেল। তারপর একজন অল্প বয়সী মহিলা এসে পায়ের জুতো খুলে আমাদের আবির রাঙা প্রণাম জানালেন,সাথে মিষ্টিমুখ করাতে চকলেট দিলেন। এমন আন্তরিকতায়,সত্যি মুগ্ধ হলাম… বাড়ির বাইরে এসেও এমন করে কেউ সেই পাড়ার রঙ খেলার আমেজ এনে দিতে পারে!!
এরপর দুপুরে স্নান সেরে দুপুরের ভোজের আয়োজন দেখে কেমন পেটে ইঁদুর দৌড়তে লাগলো। বলে রাখি,বাথরুমে গিজার সহ কমোডের সব ব্যবস্হা ছিল। তাই স্নানের কোন অসুবিধাও হয় নি।
কাঁসার থালায় সাজানো গয়না বড়ি সহ নানা রকম ভাজা শাক ডাল, সাথে দুই রকম মাছ, চাটনি, মিষ্টি, লাউ চিংড়ি, পাঁচমিশালি সবজি সহ প্রতিটা পদ ভীষণ উপাদেয় এবং ঘরোয়া। সেই সাথে ঐ দিদিদের আতিথ্য, বারে বারে খাবারের খোঁজ নেওয়া… বহুদিন পরে দুপুরের একসাথে এমন খোলা পরিবেশে বসে খাবার অভ্যাসকে উপভোগ্য করলো।
বিকেলের পরিবেশ কেমন মায়া জড়ানো,সামনে ছোট নদী, রোদ পড়ে যাচ্ছে… চারপাশে কোথাও যেন সেই সহজপাঠের গল্পগাঁথা সত্যি হয়ে উঠছে। সন্ধ্যায় চায়ের আসর, সাথে নানা বয়ামে রাখা ঝুড়ি ভাজা,চানাচুর, বিস্কুটের বাহার। সেদিন আমরা ছাড়াও আরও দুটো পরিবার ওখানে সন্ধ্যার আসরে এলো। বাচ্চা সহ বড়রা নানা রকম খেলায় মেতে উঠলো,মনেই হলো না যে এরা সদ্য পরিচিত,ঐ খোলা বারান্দা কখন যেন আমার ছোট্ট বেলায় দেখা বিকেলের উঠানের মত হয়ে গেলো,যেখানে বাবা কাকারা ক্যারাম খেলতো, মায়েদের সাথে আমরা লুডো, আবার দাদারা দাবা খেলতো। ঠিক এমন পারিবারিক পরিবেশে গল্প করার ফাঁকে ঐ দিদিরা সবাইকে চা এর সাথে তেলে ভাজা মেশানো মুড়ি মাখা দিলেন। সন্ধ্যার আসর জমে গেল এমন করেই জমজমাটি… তবে সেদিন বৃষ্টি শুরু হওয়ায় চারপাশে অন্যরকম আবহাওয়াও তৈরি হয়। এরপর রাতে আবারও রুটি অথবা ভাতের সাথে একই রকম সবজি ডাল সহ মাংসের ঝোল,সাথে রাবড়ি। ঘরোয়া এমন খাওয়া দাওয়া, সাথে কাঁসার থালা গ্লাসে পরিবেশন… আলাদা রকম এক ছোঁয়া এনেছে।

আবার ঘরে ঘরে ঐ দিদিরা রাতে গিয়ে মশারী টাঙিয়ে দিয়ে আমাদের আরও আপনজনের অনুভূতি জাগালেন।
আমাদের সঙ্গী আমার বান্ধবীর সেদিন খুব শরীর খারাপ ছিল। ওখানের দিদিরা অত্যন্ত যত্নের সাথে ওর দেখভাল করেন। গরম জলের ভাঁপের ব্যবস্হা সহ রাতে সরষের তেল হাতে পায়ে দেওয়া… সবটায় খুব আন্তরিকভাবে সাহায্য করেন ওরা।
পরের দিন সকালে চারপাশে নানা রকম পাখির ডাকে ঘুম ভাঙে। তারপর ঘুম চোখে সামনের নদীর দিকে তাকিয়ে চোখের আরাম এলো। এমন দৃশ্য তো আমাদের রোজের জীবনে ঘটে না!! তারপর সকালের চা বিস্কুট খেয়ে স্নান সেরে একেবারে ফিরে যাওয়ার প্রস্তুতি। সকালের জলখাবারে আবারও নতুনত্ব। ছোট্ট ছোট্ট বেতের ঝুড়িতে কলা রাখা, তারপর লুচি আর সাদা আলুর তরকারি। সেই সাথে কতরকমের আচারের আয়োজন। মিষ্টিও এলো বাহারি। জিভে লেগে থাকা এমন সুন্দর লুচি আলু চচ্চড়ি খেয়ে এবার বাড়ি ফেরার জন্য পা বাড়ালাম । আরেকবার চারদিক ঘুরে যখন গাড়ির দিকে যাচ্ছি,তখন ঐ দিদিরা কত আপনজনের মত বললেন যে, আবার আসবেন।। মনে হলো… একটাদিন আত্মীয় বাড়ি কাটিয়ে ফিরছি। ওনাদের আতিথেয়তায় আরও ভালো কাটলো এই একটা দিন।
কলকাতা থেকে প্রায় ১৫০ কিমি দূরে মনচাষাতে পৌঁছাতে প্রায় ৩ ঘন্টা সময় লাগে। ওখানে পৌঁছানোর ঠিকানা —–
কোলাঘাট ছাড়িয়ে নন্দকুমার হয়ে দীঘা যাওয়ার রাস্তায়, হেড়িয়া পেরিয়ে কালিনগর বাসস্টপ থেকে ডান দিকে গ্রামের রাস্তায় মনচাষা গ্রামীন পর্যটন কেন্দ্র।
থাকা সহ সমস্ত বেলার খাবার খরচ – তিনজনের ৯০০০ টাকা মত। এছাড়া গাড়ি নিয়ে গেলে ড্রাইভারের আলাদা থাকার ব্যবস্হা আছে।
এমন ঘরোয়া গ্রাম্য পরিবেশ তৈরি করে অপূর্ব থাকার ব্যবস্হাপনা করার ধারণা রুচিশীলতার পরিচয় বহন করে। এর জন Nilanjan Basu মহাশয়কে অনেক শুভকামনা রইলো
বেনারসে কিছু সময় কাটানো… কুম্ভমেলার মাঝে
বাবার দ্বিতীয় মৃত্যুবার্ষিকী কয়েকদিনের মধ্যে, সেই কথা ভেবে মায়ের বহুদিনের ইচ্ছে একটি বার বেনারসে বিশ্বনাথ মন্দিরে পুজো দেওয়া। বাবা বরাবর নাস্তিক প্রকৃতির, কোনকালে কোন ঠাকুর পুজো করে নি৷ মা ঠিক তার উল্টো। মায়ের ঠাকুর আসনে মোটামুটি সবরকমের ঠাকুর মূর্তি স্হান পেয়েছে। তার মধ্যে শিবঠাকুর মায়ের সবচেয়ে প্রিয়। তিন রকমের শিবলিঙ্গকে রোজ গঙ্গাজলে স্নান করানো সহ মোটামুটি এক ঘন্টা ব্যয় করে সে তার পুজো কাজে। এমন বিপরীত মেরু বাবা-মায়ের সন্তান হিসেবে আমার উপরে বাবার প্রভাবই বেশি। আজ পর্যন্ত ঠাকুর আসনে পুজো দেওয়া কিংবা কোন উপোস বা ব্রত রাখা কোনটাই আমি করি নি। রোজের কোন পূজা অর্চনা আমার জীবনে নেই। মেয়ে বড় হওয়ার পরে ওর আবদারে বাড়িতে সবার সাথে সরস্বতী পুজোতে সামিল হই। নিজে ঠাকুর বা নানা রকম ধার্মিক নিয়মাবলি না মানলেও অন্য কারোর বিশ্বাসকে কখনো অশ্রদ্ধা করি নি। তাই মায়ের এই কাশীধামে যাওয়ার ইচ্ছেকে সম্মান জানিয়ে ট্রেনের টিকিট কাটলাম ২২শে জানুয়ারি সন্ধ্যার অমৃতসর মেলে। টিকিট কাটার সময় সবার ছুটিছাটার হিসেব করে দেখা গেল যে, মাঝে ২৪ শে /২৫শে জানুয়ারি ছুটি নিলেই হয়ে যাবে। সে মত আমরা ২৫শে জানুয়ারি সন্ধ্যার বিভূতি এক্সপ্রেসে ফেরার টিকিট কাটি। এই আড়াই দিনে দিব্যি বেনারস ঘুরে পুজো দিয়ে ভাল মতো ঘোরা যাবে… এমনই পরিকল্পনা ছিল।

এবার আসি, মহাকুম্ভ নিয়ে কথাতে। আমরা যখন টিকিট কেটেছিলাম বা কাশী যাওয়ার পরিকল্পনা করি তখন কুম্ভ মেলা সম্পর্কে কোন খবর জানতাম না৷ বস্তুত আমাদের যেহেতু ধর্ম নিয়ে এ সব ব্যাপার নেই, কোন পুজো-আচ্চার দিনক্ষণ নিয়ে কখনো খোঁজ রাখিনি, তাই কুম্ভ কি বা কবে কোথায় কখন জানতেও পারি নি৷ কিন্তু জানুয়ারিতে মকর সংক্রান্তির সময়ে নানা খবর চ্যানেল বা কাগজে মহাকুম্ভ নিয়ে নানারকম খবরাখবর চোখে পড়লো,তখন মাথার মধ্যে সেই নতুন কিছু দেখার পোকাটা নড়াচড়া করা শুরু করলাম। আমাদের যাত্রা শুরু করার ঠিক তিনদিন আগে আমরা নতুন করে প্ল্যান ভাবতে লাগলাম। কিন্তু সেক্ষেত্রে অনেক রকম প্রশ্ন এবং বাধা মনের মধ্যে চলতে থাকলো। ফলে আমরা এবারের যাত্রা নিয়ে আত্মবিশ্বাসী ছিলাম না যে, এই নতুন পরিকল্পনা সফল হবে কি হবে না। তাই কাউকে কিছু অগ্রিম না জানিয়ে বেড়িয়ে পড়েছিলাম। প্রথমত,আমরা চারজন বেনারসে যাচ্ছি,তার মধ্যে আমার মায়ের বয়স ৭০ এর কাছাকাছি এবং যিনি সেরিব্রাল স্ট্রোকের দরুন হাঁটাচলাতে খুবই ধীরগতি। মহাকুম্ভ দেখার প্রধান শর্তই যেখানে পায়ে হেঁটে চলা। এরপর আমাদের ফেরার টিকিট কনফার্ম ছিল না,ফলে সেই চাপা টেনশনটাও ছিল যেহেতু সঙ্গে বয়স্ক মা এবং ১১ বছরের মেয়ে। এছাড়া আমাদের হাতে অত্যন্ত কম সময় ছিল,মাঝখানে একটা দিন মাত্র। তাই কাশীতে পুজো দেওয়াটাই আমাদের যাত্রার আসল উদ্দেশ্য। সেটা যতক্ষণ না সম্ভব হবে,তারপরেই আমরা কুম্ভ মেলাতে যাওয়ার কথা ভাবতে পারি।

যাই হোক এতগুলো প্রশ্ন চিহ্ন মাথায় নিয়ে ২২তারিখ সন্ধ্যা ৭.১৫ র ট্রেনে রওনা দিলাম বেনারসের উদ্দেশ্যে। পরের দিন ২৩শে জানুয়ারি সকাল ৯.৩০ টার মধ্যে পৌঁছে গেলাম বারানসি জংশন স্টেশনে। সেখান থেকে আমাদের হোটেল গোদৌলিয়া মোড়ের কাছে দশাশ্বমেধ ঘাট রোডের উপরে। অটো ঐ মোড় পর্যন্ত যেতে রাজি হলো না,কারণ মাঝপথে রাস্তার কাজ চলছে। তাই বেনারসের বিখ্যাত রিক্সায় চেপে আমরা চললাম হোটেলে। দশাশ্বমেধ ঘাট যাওয়ার রাস্তার মুখে পুলিশের ব্যারিকেড। ওখান থেকে পায়ে হাঁটা রাস্তা৷ আমাদের বুকিং করা হোটেলে পৌঁছে চেক ইন করার পরে ওখানের ম্যানেজারের সাথে কথা বলে ঠিক হলো যে,সবাই স্নান সেরে পুজো দিতে চলে যাবো। সেদিন এত মানুষের ভীড় হওয়ার জন্য লাইন প্রায় ঘাটের রাস্তায়। আমরা সকাল ১১ টায় মন্দিরের চার নং গেটে পৌঁছালাম। সেখানে সুগম যাত্রার টিকিট কেটে লাইনে দাঁড়ালাম। মন্দিরের নিয়ম সম্পূর্ণ বদলে গেছে। নানারকম গেট সহ বিশ্বনাথ মন্দিরের ব্যবস্হাপনা অন্যরকম। মোবাইল বা অন্য কোন সামগ্রী নিয়ে প্রবেশ নিষেধ। পুজোর জিনিস নিয়ে প্রায় ৩ ঘন্টা লাইনে দাঁড়িয়ে মায়ের ইচ্ছা পূরণ হলো। কাশীতে বাবা বিশ্বনাথ দর্শন সহ পুজো দেওয়ার উদ্দেশ্যে এই যাত্রা ছিল। মায়ের সেই মনস্কামনা পূরণ করে আমাদের মনেও শান্তি হলো। মন্দিরের ভিতরের পরিবেশ এখন শৃঙ্খলাবদ্ধ এবং পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। পানীয় জল সহ শৌচালয় বিশ্রামাগার সব ব্যবস্হাই বেশ আধুনিক মানের। পূজার লাইনে দাঁড়িয়ে চারপাশের দর্শনার্থীদের নানা কলরবের মধ্যে থেকে এটা অনুভূতি হলো যে, ভারতবর্ষের নানা প্রান্তের মানুষ এক জায়গায় এসেছে। সামনে ছিল ওড়িয়া কয়েকজন, পাশের লাইনের এক দল দক্ষিণ ভারতীয়, পিছনে হিমাচলী টুপি পড়া এক পরিবার,আবার কিছু দূরে গুজরাটি এক অল্পবয়সী তরুণের দল। এমন নানা রাজ্যের মানুষের সমাগম ছিল। পুজোর পরিবর্তে এই বিচিত্র দেশের নানা রকম আদবকায়দা ভাষার মানুষদের দেখেই দারুণ লাগলো। তবে পুজো দিয়ে ফেরার পথের অভিজ্ঞতা মোটেই ভালো নয়৷ ঐ সংকীর্ণ রাস্তায় হাজার হাজার মানুষ পুজো দিতে আসছে কিংবা ফিরে যাচ্ছে। তার মাঝে স্হানীয় মানুষ বাইক সাইকেল নিয়ে ঐ জনস্রোতের মাঝে যাতায়াত করছে। ফলে একপ্রকার বিশৃঙ্খলা তৈরি হয় রাস্তা জুড়ে। কোন বয়স্ক মানুষ বা শিশু সেই ধাক্কাধাক্কিতে পড়ে গেলে পদপৃষ্ঠ হওয়ার সম্ভাবনা থেকে যায়। অতি সাবধানে মা কে সামলে নিয়ে আমরা প্রায় ৩০-৪০ মিনিট ঐ বদ্ধ রাস্তায় যুদ্ধ করে হোটেলে দুপুর ৩.৩০ টে নাগাদ ফিরে আসি,যেখানে হোটেল থেকে মন্দিরের গেটের দূরত্ব ১০ মিনিট মত। এই ভীড়ের একটা বড় কারণ… কুম্ভ মেলা। অধিকাংশ মানুষ মেলা ঘুরে কাশীধামে পূজা দিতে এসেছে। ফলে এই বিপুল মানুষের সমাগম। এরপর তাড়াতাড়ি দুপুরের আহার করেই বেড়িয়ে পড়লাম বেনারসের সন্ধ্যারতি দেখার উদ্দেশ্যে। বিকেল ৪.৩০ টের মধ্যেই ঘাটের দুপাশে ভীড় উপচে পড়ছে। সামনের দিকে বসার জায়গায় লোকজন বহু আগে থেকে এসে জায়গা নিয়েছে। নদীর সামনের দিকের নৌকা বা লঞ্চগুলোতেও লোকজন নজরে এলো। আমরা একটা বড় লঞ্চের উপরের ডেকে টিকিট কেটে প্রায় সামনের সারিতে বসার জায়গা নিলাম৷ প্রায় এক ঘন্টা অপেক্ষার পরে আরতির প্রস্তুতি চাক্ষুষ করলাম। সেই সাথে কাতারে কাতারে মানুষের ঢল নেমেছে ঘাটে, নদীর পাড়ে, নৌকাগুলোতে। ঘাটে আসার রাস্তা,সিঁড়ি জুড়ে মানুষ জায়গা নিয়েছে এই বিখ্যাত সন্ধ্যারতির সাক্ষী থাকার জন্য। সেই সাথে আছে প্রচুর বিদেশী মানুষের আনাগোনা। কত অবলীলায় তারা আমাদের এ দেশের পোষাক পরম্পরাকে রপ্ত করে এই পরিবেশকে উপভোগ করছে। গঙ্গা আরতি করে ছয়জন নবীন পুরোহিত এক তাল ছন্দে নানা আঙ্গিকে আধ ঘন্টার উপর সময় ধরে সন্ধ্যারতি করেন। তাদের মধ্যে যে মেলবন্ধন, তা খুব নজর কাড়ে। পঞ্চ প্রদীপ,ধুনো,শঙ্খনিনাদ, নানারকম আচার সহযোগে যে পরিবেশ রচিত হয় তা সত্যি প্রশংসনীয়। বেনারসের সন্ধ্যারতি অন্যান্য জায়গার তুলনায় স্বতন্ত্র এবং নিজছন্দে তালে পরিবেশে অনন্য হওয়ার কারণে তা সারা বিশ্বেও প্রখ্যাত। কিন্তু এই সময় বিপুল জনজোয়ারের কারণে শান্ত মনে এই পরিবেশকে উপভোগ করা অতোটাও যায় নি। তবে এত মানুষ এক জায়গায় বসে আরতি দেখছে চুপচাপ, সেটাও অন্য অনুভূতি। আরতি শেষে লঞ্চ করে রাতের বেনারসের নানা ঘাটের দৃশ্য দেখতে দেখতে সময় কেটে গেল বেশ। প্রতিটা ঘাটের আলাদা ইতিহাস, সে গল্প অনেকেরই জানা৷ তাই সে কথা আর বললাম না৷ সারাদিন বেনারসে পুজো,আরতি দেখে ক্লান্ত শরীরে হোটেলে ফিরলেও মনে প্রশান্তি ছিল যে… মা কে যে উদ্দেশ্যে এখানে নিয়ে আসা সেটা পূরণ করতে পেরেছি। ফেরার পথে বেনারসের বাসনপত্র, নানা পুজাসামগ্রীর দোকানে ঘুরে কিছু কেনাকাটা করে ফিরলাম।
এছাড়া বেনারসের চাট এর দোকান খুব বিখ্যাত, সেখানে মানুষের ভীড় নজরে এলো। এছাড়া পানের দোকান এবং বেনারসী শাড়ির দোকানেও লোকের আনাগোনা অনেক। দশাশ্বমেধ ঘাটের রাস্তায় এমন নানা ছোট বড় দোকান.. এছাড়া রথযাত্রা মোড়ে পুরনো বেনারসী শাড়ি সহ অনেক দোকান রয়েছে। পরের দিন JDS নামক বেনারসী শাড়ির সবচেয়ে পুরনো শাড়িমহল থেকে একটা শাড়িও কিনে এনেছি। আমার কাছে এটাও বেনারস ভ্রমণের এক নতুন অভিজ্ঞতা, এত বিপুল আয়োজন এবং শাড়ি সম্ভার খুব কমই আমি দেখেছি। ফিরে আসার দিন সকালে অবশ্য অসি ঘাট সহ বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয় ঘুরে দেখেছি। বেনারসের অলিগলি জুড়ে নানা কথকতা,নানা গল্প… এত কম সময়ে সে সব কিছু দেখা সম্ভব হয় নি৷ পরে আরেকবার বেনারসের নিজস্ব সৌন্দর্য উপভোগ করবো বলে যেতে হবে।
আমরা পরের দিন অর্থাৎ ২৪শে জানুয়ারি ভোর বেলা রওনা দিয়েছিলাম প্রয়াগে। মহাকুম্ভ মেলার বিশালত্ব নিজ চোখে দেখাটাই ছিল আমাদের কুম্ভমেলায় যাওয়ার উদ্দেশ্য। আমরা কোনোরূপ স্নান বা পুণ্য অর্জন করার স্বার্থে কুম্ভ দর্শনে যাই নি। ভারতবর্ষের সবচেয়ে বড় মেলার এত কাছে এসে তা না দেখে যেতে মন চাইলো না,তাই বেনারস থেকে ২.৫ ঘন্টা দূরের প্রয়াগের উদ্দেশ্যে রওনা হলাম ভোর ছয়টায়। তারপরের অভিজ্ঞতা পরবর্তী সময়ে বলবো।
একবেলা মহাকুম্ভ মেলাতে
বেনারসে পৌঁছে প্রথম দিনই কাশী বিশ্বনাথ মন্দিরে পুজো দেওয়া সহ সন্ধ্যারতি দেখা… সবটাই সম্পূর্ণ করা হয়েছিলো। এর সাথে সাথে আমার মায়ের ইচ্ছা পূরণ হলো,যা এবারের সফরের মূল উদ্দেশ্য। তাই হোটেলে কথা বলে ঠিক হলো,পরের দিন অর্থাৎ ২৪শে জানুয়ারী প্রয়াগরাজে যাওয়া হবে… মহাকুম্ভে। ড্রাইভার বললেন যত সকালে বেড়োনো যাবে তত সুবিধা, নাহলে জ্যামে আটকে পৌঁছাতে দেরি হবে৷ সে মত আমরা ভোর ৬ টায় স্নান সেরে বেরিয়ে পড়েছিলাম বেনারস থেকে। হোটেল থেকে সকালের জল খাবার গুছিয়ে দিয়েছিলো,যাতে পথে যেতে যেতেই আমরা খেয়ে নিই,রাস্তায় কোথাও থামতে না হয়। বেনারস থেকে প্রয়াগের দূরত্ব ১২৫ কিমি মত, মোটামুটি ২.৫ ঘন্টা পথ খুব সুগম যাওয়ার পরে প্রয়াগে প্রবেশের মুখে পুলিশের ব্যারিকেড দেওয়ার জন্য সোজা যাওয়ার রাস্তা বন্ধ। তারপর ড্রাইভার দাদা বামদিকের একটা রাস্তা ধরলেন যা কোন স্হানীয় জনপদ মধ্যে দিয়ে যায়। কিন্তু সেই রাস্তার মুখে মুখে ছোট বড় গাড়ির জটলা, ফলে আমরা আটকে যেতে লাগলাম। এরপর সেই ছোট বাধা সব কাটিয়ে প্রয়াগের মুখে যখন গাড়ি ঢুকলো চারপাশে মানুষের ঢল নজরে এলো। সে এক অন্য দৃশ্য। রাস্তার পাশে বড় বড় সব বাস দাঁড়ানো। বাসের জানলায় শাড়ি গামছা বা নিত্য ব্যবহার্য জিনিসপত্র ঝোলানো দেখে মনে হলো,দূর দূর প্রান্ত থেকে মানুষ এই বাসে চেপে এসেছে, আপাতত কয়েকদিনের সংসার এখানেই। তারপর দলে দলে বাচ্চা বড় সব ধরনের মানুষ ঝোলা ব্যাগ বাক্স কাঁধে মাথায় হাতে নিয়ে চলেছে কুম্ভ মেলার দিকে৷ সেখান থেকে হয়ত মেলার দূরত্ব ১২-১৪ কিমি। কিন্তু মানুষের উৎসাহে কোন খামতি নেই। তারা চলেছে কোন এক অজানা আকর্ষণে। প্রয়াগে প্রবেশের মুখে শাস্ত্রী ব্রিজের উপরে যখন গাড়ি উঠলো,সে এক অদ্ভুত দৃশ্য নজরে এলো। নদীর দুপাড় জুড়ে শুধু মেলার তাঁবু আর তা্ঁবু। যতদূর চোখ যাচ্ছে নানারকমের প্যান্ডেলের আকারের তাঁবু কিংবা গম্বুজের মত দেখতে মাথা উঁচু করে আছে থাকার নানা আস্তানা। নদীতে চড়া পড়েছে, তার সাদা বালির উপরে মানুষের আনাগোনা, এত বিশাল আকার আয়োজন আমি এ জন্মে কখনো দেখি নি। সেই সাথে নজরে এলো নদী পারাপারের জন্য পর সমান্তরালভাবে অনেক ব্রিজ আর তার উপরে পিলপিল করে মানুষ হেঁটে যাচ্ছে। আমরা দূর থেকে ব্রিজের উপরের এ দৃশ্য দেখছিলাম.. তাই মনে হচ্ছিলো কেউ যেন কোন এক তাঁবু খাটানো নতুন নগরী স্হাপন করেছে এ জায়গায়। এবার শুরু হলো কুম্ভ মেলায় ঢোকার আসল সমস্যা… চরম জ্যাম। শহরে ঢুকে পর পর এত এত জায়গায় গাড়ি আটকে গেল যে, ২.৫ ঘন্টার রাস্তা ৫ ঘন্টার উপরে লাগলো। এই জ্যামে আটকে রাস্তার দুপাশে নজরে এলো..দেশের নানা প্রান্ত থেকে জড়ো হওয়া মানুষের ঢল। বয়স্কদের সঙ্গে নিয়ে চলেছে ছেলে মেয়ের দল,আবার অসুস্হ বাচ্চাকে কোলে নিয়ে হাঁটছে বাবা মা,কোথাও আবার নানা রকম বসনধারী সন্ন্যাসী দল চলেছে নামগান করতে করতে। কিছু লোক বাইকে করে আসছে,তাদের সাথে নতুন যুগের রুকস্যাক ব্যাগ,যোগা ম্যাট, স্লিপিং ব্যাগ।আবার দেহাতি মানুষের দল সাথে নিয়ে চলেছে তার জরাজীর্ণ কম্বল বালিশ চাদর নিয়ে। অধিকাংশ মানুষের হাতে জল নেওয়ার ডিব্বা। কেউ কেউ তো খালি পায়ে পথ চলছে নির্দ্বিধায়।বোট ঘাটের উদ্দেশ্যে আমাদের গাড়ি এগিয়ে চলছিলো। সে পথে যাওয়ার পাশে যে অস্হায়ী ব্রিজ তাতে শুধু মানুষ পায়ে হেঁটে চলেছে। কেউ মাঝপথে দাঁড়িয়ে রয়েছে, বিশ্রাম নিচ্ছে,কেউ বা স্নান সেরে বাড়ির পথে ফিরছে তাদের পিঠে বোঝা,হাতে বড় বড় ড্রামে গঙ্গাজল। আমরা অবশেষে যমুনা ঘাটের কাছে যখন পৌঁছালাম দূর থেকে ত্রিবেণী সঙ্গমস্হলে ভীড় উপচে পড়ার দৃশ্য চোখে পড়লো। ওখান থেকে বোটে করে ত্রিবেণীতে নিয়ে যায়,সেখানে স্নানের ব্যবস্হা আছে।গঙ্গাজল ভরে ওখান থেকে লোকজন স্নান সেরে ফিরছে। তবে আমরা যখন গেলাম,শুনলাম এখন নৌকা পারাপার বন্ধ। ও দিকে মানুষের ভীড় বেশি। তাই প্রশাসন থেকে আপাতত নৌকা যাওয়া বন্ধ রেখেছে। সঙ্গম থেকে নৌকাগুলো ফিরে আসার পরে পুলিশ ওদিক থেকে সিগনাল দিলে তবে আবার নতুন করে নৌকা ত্রিবেণীতে যাবে। কিন্তু ওখানে উপস্হিত মাঝিরা কেউ কোন নির্দিষ্ট সময় জানাতে পারলো না যে কখন আবার নৌকা চলাচল শুরু হবে। সময়টা ১ ঘন্টাও হতে পারে আবার ২ ঘন্টাও,কোন নিশ্চিত করে বলা যায় না। এর মাঝে পুলিশ কিছু লোককে স্পেশাল বোটে এদিকে পাঠালো,পরে জানলাম যে তারা বিশেষ পাস নিয়ে এসেছে, কেউ প্রশাসন বা পুলিশের আত্মীয় কিংবা সাংবাদিক। কিন্তু আমাদের মত সাধারণ মানুষ ঐ নদীর পাড়ে বসে অপেক্ষা করতে লাগলো কখন আবার নৌকা নিয়ে যাবে সেই পুণ্য স্নান করার জায়গায়। এবার আমরা উপলব্ধি করলাম যে,এখানে দাঁড়িয়ে থাকলে আমাদের দিনের মধ্যে পুরো সময়টাই চলে যাবে। আমাদের তারপর আবার বেনারসে ফিরেও যেতে হবে। আর আমাদের মহাকুম্ভে আসার উদ্দেশ্য তো এই পুণ্যস্নান নয়,আমরা এসেছে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় মানুষের মেলা দেখতে।মেলার মধ্যে ঢুকে পায়ে হেঁটে তার চারপাশকে চাক্ষুষ না করলে এখানে আসাটা ব্যর্থ। এইদিকটা মেলার অন্যপ্রান্ত,এখান থেকে নৌকা করে ত্রিবেণী সঙ্গমে গিয়ে স্নান করে ফিরে আসতে হয়,কিন্তু মেলা প্রাঙ্গনে ঢুকতে গেলে ঐ অস্হায়ী ব্রিজ গুলোতে উঠে যেতে হবে,যা অত্যন্ত কষ্টসাধ্য,বিশেষ করে মায়ের পক্ষে তা অসম্ভব। অগত্যা ড্রাইভার দাদাকে অনুরোধ করা হলো যে,এমন কোথাও গাড়ি দাঁড় করাতে যেখান থেকে পায়ে হেঁটে মেলার একটা দিক দেখা সম্ভব। সে কথা শুনে ড্রাইভার দাদা একটু অবাক এবং মনোক্ষুণ্ণ হলেন যে,এরা কেমন লোক, পুণ্য স্নানের এমন ভালো ব্যবস্হা ফেলে রেখে এরা মেলা ঘুরবে শুধু। মানুষ ঘন্টার পর ঘন্টা শুধু অপেক্ষা করে ওখানে যেতে,আর আমরা সেখানে দাঁড়াতে চাইলাম না৷ তবু উনি যাত্রীদের কথানুযায়ী রাস্তার কিছুটা আগে গিয়ে মিন্টো পার্কের সামনে গাড়ি দাঁড় করিয়ে দিলেন। সেখান থেকে আমাদের কুম্ভ মেলায় পায়ে হেঁটে দেখার শুরু।
এবার আসি এবারের কুম্ভ মেলা প্রসঙ্গে। এতকাল পর্যন্ত কুম্ভমেলার বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে অবগত ছিলাম না। কিন্তু কোথাও ঘুরতে গেলে সে সম্পর্কে স্বল্প হলেও জানতে হয়। সাধারণত প্রতি ১২ বছরে চার জায়গায় ঘুরে ঘুরে কুম্ভ মেলা হয়। এর মধ্যে প্রতি ১২ বছরে একবার পূর্ণ কুম্ভমেলা হয়। সাধারণত হরিদ্বার এবং এলাহাবাদ ( বর্তমানে প্রয়াগরাজ) এই পূর্ণ কুম্ভ হয় ১২ বছর অন্তর অন্তর। কথিত আছে যে, হিন্দু পৌরাণিক গাঁথা অনুযায়ী সমুদ্র মন্হনের সময়ে দেবতা এবং অসুরের অমৃত নিয়ে লড়াইয়ে যখন অমৃত ঘড়া উত্থিত হচ্ছিল তখন কয়েক ফোঁটা অমৃত এই স্হানেও পড়ে। তার ফলে নির্দিষ্ট তিথি বা সময়ে এই জলে স্নান করলে পুণ্য লাভ হয়৷ হিন্দু পুরাণের এই বিশ্বাসের উপরে আস্হা রেখে প্রতি কুম্ভমেলায় লাভ লাভ লোক এক জায়গায় হয়ে অমৃত স্নান করে। এই স্নানের মূল লক্ষ্য হলো… মোক্ষ লাভ করা। এর মধ্যে প্রয়াগের সাগর সঙ্গম যা তিনটি নদী গঙ্গা যমুনা এবং সরস্বতীর মিলনস্হল সেই ত্রিবেণী সঙ্গমে ডুব দেওয়াকে হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা অতি পুণ্য হিসেবে গণ্য করে। এবারের কুম্ভ মেলা ১২ বারের পরে ১২ বছরের তফাতে ১৪৪ বছর পরে সংঘটিত হচ্ছে যা নাকি বিশেষ বৈশিষ্ট্যপূর্ণ,একে তাই মহাকুম্ভ নাম দেওয়া হয়। লোকের মধ্যে বিশ্বাস যে,এ জন্মে এই বিশেষ সন্ধিক্ষণ আর কখনও আসবে না। তাই সারাবিশ্বে এই মেলাকে নিয়ে এক আলোড়ন পড়েছে। বিশ্বের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় সমাগম, এত বড় মেলা ভারতবর্ষে আর কোথাও হয় না। প্রায় ৪০০০ হেক্টর বিস্তৃত নদীর দুপাড় জুড়ে এ মেলা বসেছে। পুরো মেলাকে ২৫ টি সেক্টরে ভাগ করা এবং ৩০ টি অস্হায়ী পল্টন ব্রিজের ব্যবস্হা আছে। এত বড় মেলা একবেলা তো নয়ই একদিনেও ঘুরে ঘুরে দেখা সম্ভব নয়। আর সবচেয়ে বড় বিষয় হলো… কুম্ভমেলা দেখার এক এবং একমাত্র উপায়, পায়ে হাঁটা। এই সব সেক্টর গুলো থেকে কয়েক কিলোমিটার হেঁটে সঙ্গমে এসে স্নান করতে হয়,তাই এত এত মানুষ হেঁটে হেঁটে চলেছেন পুণ্য স্নানের উদ্দেশ্যে। সারাবিশ্বের সবচেয়ে বড় এই ধর্মীয় মেলার আয়োজন করা হয়েছে ৪৫ দিন ব্যাপী,যেখানে আন্দাজ প্রায় ৩০-৪০ কোটি মানুষের সমাগম হবে। ছয়দিনের শাহীস্নান সহ ১৩ই জানুয়ারি থেকে ২৬শে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত এই মহাকুম্ভ মেলার আয়োজন।
আমরা যে পথ দিয়ে হাঁটা শুরু করেছিলাম সেটা ছিল সেক্টর ৩-৪, সেখানেই সঙ্গম যাওয়ার রাস্তা। মানুষের মাঝে নিজেরাও মিশে গেলাম হাঁটতে হাঁটতে। এ এক বিচিত্র মেলা। এত এত সব বড় বড় এক একটা স্টল। আমাদের স্কুল বিল্ডিং সহ মাঠ নিয়ে যতটা জায়গা তত জায়গা জুড়ে বিভিন্ন সরকারি দপ্তরের অস্হায়ী অফিস। রেলের কাউন্টার খোলা.. সেখানের ডিজিটাল স্ক্রিনে কখন কোন ট্রেন কোন প্লাটফর্মে তার সংবাদ। ভোটার তালিকা সংশোধন সহ ভারতীয় ডাক বিভাগ, বিএস এন এল এর সহায়তা কেন্দ্র। এছাড়া পুলিশ, জেলা প্রশাসন, আর্মি সহ নানা রকম সরকারি পরিসেবার অস্হায়ী আস্তানা অনেক অনেক জায়গা জুড়ে। এছাড়া বায়ো টয়লেট,পানীয় জলের পরিসেবা কিছুটা পথের অন্তর অন্তর। আমরা হনুমান মন্দির যাওয়ার রাস্তা ধরে এগোতে লাগলাম ভারতের নানা রাজ্যের মানুষের সাথে পায়ে হেঁটে। কিন্তু মা এতটা পথ হেঁটে আর চলতে পারছিলো না,সেই সাথে মানুষের ভীড়ে ক্লান্ত হয়ে পড়ে। কিছুদূর যাওয়ার পরে নজরে আসে বিভিন্ন রকমের ব্যাঙ্কের অস্হায়ী কাউন্টার খুলেছে,যেখানে ATM সহ সব রকমের পরিসেবা দেওয়ার ব্যবস্হা আছে। কোন ছোট ব্রাঞ্চ যেমন হয়,ঠিক সেরকম কাঠামো নির্মিত। দেবাংশু মানে আমার স্বামী স্টেট ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়ায় কর্মরত।সেই পরিচয় দিয়ে ওখানের ব্যাংক কর্মীদের সাথে কথা বলে মা কে ওখানে বসানোর ব্যবস্হা করা হলো। ওঁনারা খুব আন্তরিকতার সাথে মাকে ওখানে বসিয়ে রাখলো। আমরা তিনজন এবার চললাম সঙ্গমের উদ্দেশ্যে।
যত সামনে এগোচ্ছি,তত উপলব্ধি হচ্ছে আমাদের দেশের বিচিত্রতা। নানা ভাষাভাষী, নানা পোশাকের মানুষ এগিয়ে চলেছে। রাস্তার দুপাশে নানা রকম বড় বড় স্টল। খাবারের ফুড জোন পরপর। অনেকটা শপিং মলগুলোতে যেমন পর পর নানা রকম খাবারের স্টল থাকে,টাকা দিয়ে কিনে সামনে খাবার টেবিলে রেখে তেমনই ব্যবস্হা। জামা কাপড়ের আলাদা একটা বড় জায়গা জুড়ে মেলা বসেছে, যেখানে দেশের নানা প্রান্তের পোশাকের সম্ভার। কিছুদূর যাওয়ার পরে নজরে এলো সঙ্গম আর ৫০০ মিটার দূরে। চারপাশ থেকে মানুষ এক জায়গায় যাচ্ছে। এর মধ্যে প্রচুর বিদেশী পর্যটককে নজরে এলো,কেউ আমাদের দেশীয় পোষাকে সেজে কপালে তিলক কেটে ঘুরছে,কেউ বা ক্যামেরা বন্দী করছে নানা মুহূর্ত। সঙ্গম ঘাটে যাওয়ার আগে নন্দী ঘাটের আরেক প্রান্ত থেকে অসংখ্য মানুষ এ দিকে আসছে।কোথাও সবাই পর পর একে অপরের হাত ধরে লাইন দিয়ে চলেছে,কারোর গলায় আই কার্ড ঝোলানো,আবার এক জায়গায় নজরে এলো ছেলের ব্যাগের সাথে গামছার একপ্রান্ত,আরেক প্রান্ত মায়ের হাতে বাঁধা। তবে আমরা কোন শাহী স্নান বা কোন পুণ্য তিথিতে যাই বলে সেই ভয়ংকর ভীড় বা ঠেলাঠেলির সম্মুখীন হই নি। উল্টে অনেকটা প্রশস্ত জায়গা জুড়ে যাওয়ার ব্যবস্হা ছিল।কিন্তু রাস্তার মাঝখান দিয়ে পুলিশের গাড়ি কিংবা জলবাহী গাড়ির আনাগোনার দরুন কিছুটা অব্যবস্হা হচ্ছিল। আবার একদল পুলিশ বাহিনী ঘোড়সওয়ার হয়ে পুরো মেলা চত্ত্বর টহল দিচ্ছিলো। কোথাও রাস্তার মাঝে ফল, ফুল বা কোন অন্য দোকানের ভ্যান গাড়ি দাঁড়াতে দেখলে তাদের কোণায় নিয়ে রাস্তা ফাঁকা করার নির্দেশ দিচ্ছিলো। এর সাথে চলছিলো মাইকে নানা রকম সর্তকতামূলক বার্তা এবং কেউ কোথাও পরিবার থেকে নিখোঁজ হলে তার অনুসন্ধান সংক্রান্ত খোঁজ খবর। সঙ্গম দ্বারের মুখে এসে দুপাশে আখড়া নজরে এলো,কাছে গিয়ে সেখানে বসে থাকা সন্ন্যাসীদের দেখতে গেলে পুলিশ এসে সরিয়ে দেয়,কারণ এটা নাকি restricted area!! অগত্যা তাদের কারোর আর দেখা মিললো না, মনে হলো সাধু বাবারা এখন অনেক বেশি ভি,আই,পি… তাদের বক্তব্য বা চিন্তাভাবনা সাধারণের জন্য নয়,তাহলে কিসের সাধনা বা মোক্ষলাভ যা অন্য মানুষের মধ্যে না ভাগ করা যায়!! আমরা স্বামী বিবেকানন্দকে আদর্শ হিসেবে ভাবি, ওখানে গিয়ে বুঝলাম তিনি কেন বিশ্ববরেণ্য, নমস্য।

যাই হোক, সঙ্গম ঘাটের কাছে গিয়ে দেখলাম স্নান সেরে জামা বদলের অস্হায়ী অনেক ব্যবস্হা। সেখানে নারী পুরুষ নির্বিশেষে জলে ডুব দেওয়া এবং জল থেকে উঠে পোশাক বদলের প্রস্তুতিতে ব্যস্ত। জলের কাছে গিয়ে আমরা দাঁড়ালাম,পাশ থেকে বাচ্চা বুড়ো মহিলারা সব ডুব দিচ্ছে, জলে নেমে এক একজনের এক একরকমের প্রার্থনা করার ধরণ। কেউ মন্ত্র উচ্চারণ করছে,কেউ পূর্ব পুরুষকে তর্পণ, কেউ বা আগামীর জন্য নানা ইচ্ছার কথা বলছে। এর মাঝে কিন্তু প্রায় সবাই নানা ভঙ্গিতে মোবাইলে ভিডিও, রিলস্ বা লাইভ করতে ব্যস্ত।ওখানে এক ছোট বাচ্চা মেয়ে ফুল প্রদীপ বিক্রি করছিলো জলে ভাসানোর জন্য, তার থেকে একটা সেট কিনে আমার মেয়ে হাঁটু জলে নেমে তা ভাসিয়ে দিলো। তারপর আমরাও সেখান থেকে ফিরে এলাম বিনা জলে নেমে। দূরে নৌকা করে ত্রিবেণী সঙ্গমের স্নানের জায়গাটা দেখলাম,সেখানে নৌকার লাইন আর মানুষের জলের মধ্যে ভীড়। সঙ্গম ঘাট থেকে ফেরার পথে এক সাংবাদিক আমাদের কাছে আসেন,জিজ্ঞেস করেন কোথা থেকে এসেছি এবং কেন কিসের উদ্দেশ্যে এখানে। যখন শুনলেন যে,আমরা কোন পুণ্যস্নান করতে বা কোন মানসিকপুজো বা ইচ্ছে পূরণ করতে আসি নি,উনি বেশ হতাশ হলেন। শুধুমাত্র সর্ববৃহৎ মেলা এবং মেলার পরিবেশ দর্শন করাই আমাদের যাত্রার উদ্দেশ্য… এ কথা শুনে উনি ধন্যবাদ জ্ঞাপন করে অন্য পুণ্যার্থীর কাছে গেলেন। ফেরার পথে মেয়ের বায়না বাকিদের মত কপালে নাকি ট্যাটু বানাবে। ওখানে চন্দন তিলক পড়ানোর জন্য পরপর লোক বসে আছে,টাকার বিনিময়ে তারা নানা রকমের তিলক কেটে দিচ্ছেন। এছাড়া রুদ্রাক্ষ, নানা রকম ধর্মীয় মালা,জল ভরার পাত্র,ফুল মোমবাতি এসব বিক্রির অসংখ্য লাইন দিয়ে নীচে বসার জায়গা। আবার গরুকে খাবার খাইয়ে পুণ্য অর্জন করতে গরু সহ চাল খাবার নিয়ে বসেছে কেউ। এছাড়া পাশের আখড়াগুলোতে খাবার ও জল বিনা খরচায় বিলি করা হচ্ছে। এই সব নানা রকম দৃশ্য দেখতে দেখতে আমরা আবার ফিরে যেতে লাগলাম। প্রায় ৩ -৪কিমি রাস্তা পায়ে হেঁটে সঙ্গম ঘাটে পৌঁছে ছিলাম।সেই এক রাস্তাই আবার হেঁটে ফিরতে হবে ভেবে এবার বেশ কষ্ট হতে লাগলো। মা কে প্রায় ২ ঘন্টা বসিয়ে রাখার পরে সাথে নিয়ে কিছু খাবার খেয়ে গাড়ি পার্কিং এর জায়গায় ফিরতে লাগলাম। কিছুটা যাওয়ার পরে নজরে এলো, ঠেলা গাড়িগুলো যাত্রী বহন করছে,৫০ টাকা জন প্রতি। সেটা করে প্রায় ১.৫ কিমি রাস্তা এলাম। তারপরেও কিছুটা হেঁটে আমাদের গাড়িতে উঠলাম। ফেরার পথেও প্রয়াগ শহর থেকে বেড়োতে অনেক সময় লাগলো জ্যামে আটকে। তখনও কাতারে কাতারে মানুষের দল চলেছে সেই অমৃত কুম্ভের সন্ধানে। ব্রিজে ওঠার পরে আবার সেই বিস্ময়কর দৃশ্য চোখে পড়লো। তখন সন্ধ্যা নামবে প্রায়,তাই তাঁবুগুলোতে আলোর সারি। দূর থেকে ব্রিজের দুপাশে শুধু তাঁবু নগরী,যার কোন শেষ নেই। তার মাঝে মাঝে মানুষ কিলবিল করছে,গাড়ি চলছে।
কুম্ভমেলা ঘুরে বেনারস শহরে ঢুকতে প্রায় রাত ৯ টার বেশি হয়ে গেলো। কিন্তু মনের মধ্যে এক অপার বিস্ময় নিয়ে ফিরে এলাম। এমনও বড় মানুষের মেলা বসতে পারে!! আমরা তো মেলার ২৫ ভাগের এক ভাগ দেখলাম। সেই সব বাবাজিদের আখড়া,নানা অনুষ্ঠান, তাঁবু আস্তানা কোনোটাই দেখি নি।সেগুলো অন্য সেক্টরে।
কিন্তু যতটুকু দেখলাম তা এত দীর্ঘ জায়গা জুড়ে, তা অবাক করা ছাড়া কিছু নয়। তবে মেলা প্রাঙ্গনে কোথাও প্লাস্টিকের ব্যবহার নিষিদ্ধ। এছাড়া পরিচ্ছন্নতা যথেষ্ট ভালো। নাহলে এত বিপুল সংখ্যক মানুষ আসছে,সেখানে নোংরা আবর্জনা পড়ে থাকার সম্ভাবনা অনেক। কিন্তু এত সংখ্যক পরিষ্কার করার লোক,ঝাড়ুদার ছিল যে সেই আন্দাজে কোনো অপরিষ্কার পরিবেশ ছিল না। তবে আমি যেহেতু একটা জায়গায় ঘুরেছি এবং বিশেষ দিনে যাই নি, তাই আমার ব্যক্তিগত উপলব্ধি একরকম হয়েছে। তবে হা, পুলিশের মধ্যে ট্রাফিক সিস্টেম একেবারেই শৃঙ্খলা পরায়ণ নয়৷ এছাড়া কোন বিশিষ্ট লোকজন এলেই এরা পায়ে হাঁটা রাস্তায় মানুষের ঢলের মধ্যে সেই গাড়িগুলোকে প্রবেশ করাতে ব্যস্ত থাকছে,তার ফলে মানুষ যে এক ছন্দে যাচ্ছিলো সেই ছন্দ ভঙ্গ হওয়ার কারণে বিশৃঙ্খলা তৈরি হতে বাধ্য। কুম্ভ মেলা সম্পর্কে আমরা আগেও জানি যে,কুম্ভ অন্য সাধারণ মেলার মত নয়। এখানে সাবধানতা অবলম্বন করা দরকার।এখানে এসে হারিয়ে যাওয়ার ইতিহাস প্রসিদ্ধ। আর এবারের কুম্ভ তো মহাকুম্ভ,যা নিয়ে দেশ বিদেশের মানুষের মধ্যেও আগ্রহের শেষ নেই। শারীরিক সমস্যা থাকলে এখানে না যাওয়াই শ্রেয়। পুণ্য অর্জনের খাতিরে প্রাণটাই চলে যাক তা তো কাম্য নয়৷ তেমন হলে বয়স্ক অসুস্থ মানুষকে কোথাও বসিয়ে সক্ষম রা ঘুরে আসতে পারেন। এ মেলায় গেলে অতি প্রয়োজনীয় হলো… পায়ে হেঁটে যাওয়া। আমরা আসা যাওয়া মিলিয়ে প্রায় ৮-৯ কিমি হেঁটেছিলাম। তবে যেটুকু দেখেছি তা এ জন্মে ভুলবো না। এক টুকরো ভারতবর্ষকে এক জায়গায় হতে দেখলাম। মানুষের ধর্মবিশ্বাসকে চাক্ষুষ করলাম। এতটা অঞ্চল জুড়ে কয়েককোটি জন সমাগম ৪৫ দিন ধরে আয়োজন করা হয়েছে,তা নিজ চোখে দেখে এলাম। সর্বোপরি, ভারতের বৈচিত্র্যতা একজায়গায় হতে দেখলাম। প্রতিভাস ম্যাগাজিন
সমাপ্ত
কিন্নর – কৈলাসের পথে
প্রথম পর্ব
প্রথম দিন – সারাহান
হিমাচল প্রদেশের প্রায় অনেক জায়গা দেখা হলেও কিন্নরের সৌন্দর্য দেখার সুযোগ হয় নি।তাই কিন্নর কৈলাসের দিকে যাওয়ার ইচ্ছে থাকলেও সময় হাতে কম থাকায় কিছুতেই যথাযোগ্য প্ল্যান করা যাচ্ছিলো না। ব্যাংকারের সাথে সংসার করার জ্বালা অনেক, আপাত দৃষ্টিতে ক্যালেন্ডারে ছুটি অনেক দেখালেও ব্যাঙ্কে চাকুরীজীবিদের ছুটি নেওয়া বড্ড মুসকিল। আমরা এত ঘুরে বেড়াই,কিন্তু তার পিছনে ছুটির হিসেব নিকেষ নিয়ে কতটা মাথা ঘামাতে হয় তা শুধু নিজেরাই জানি। আমার চাকরির ক্ষেত্রে এই সমস্যা কম,কিন্তু সংসারের অন্য মানুষটার কাজের প্রতি কর্তব্যকে সম্মান জানাতে আমরা প্রায় প্রতিবারই পুজোর সময়ে বেড়িয়ে পড়ি। এরজন্য আমাদের নিজভূমির সবচেয়ে বড় উৎসবের আনন্দকে ফেলে রেখে বেড়োতেই হয়। যাই হোক,এবারে অনেক ভেবে ঠিক করা হলো যে, ষষ্ঠীর দিন অফিস করে তারপর রাতের ফ্লাইট ধরে দিল্লি যাওয়া হবে। পরের চার দিন ছুটি এবং মাঝে দুটোদিন মাত্র নিজস্ব ছুটি নিয়ে লক্ষ্মীপুজোর দিন আবার ফিরে এলে টানা সাতদিনে এই ট্রিপ করা সম্ভব হবে। এর জন্য আমাদের কিছুটা হলেও শারীরিক কষ্ট সহ্য করে অনেকটা পথ পাড়ি দিতে হবে,তবু কিন্নরের স্বপ্ন পূরণ সম্ভব।
ষষ্ঠীর দিন রাতে দিল্লি এয়ারপোর্ট থেকে সোজা নিউ দিল্লি স্টেশনের পাশের এক হোটেলে রাত প্রায় ১২ টায় এলাম। পরের দিন ভোর ৫.৫০ এর বন্দে ভারত এক্সপ্রেসে করে চন্ডীগড়ে নামলাম সকাল ৮.৪০ এ। সেখান থেকেই আমাদের প্রথম দিনের দীর্ঘ পথ যাত্রা। আমরা সপ্তমীর দিন যত রাস্তা এসেছি,তার জন্য শারীরিকভাবে সুস্থ থাকা এবং পাহাড়ি পথে শরীরে যে সমস্যা থাকে তা থেকে মুক্ত হওয়াটা জরুরি। নাহলে চন্ডীগড় থেকে সারাহান পর্যন্ত দীর্ঘ পাহাড়ি প্রায় ২৭৫ কিমি পথ প্রায় ১০ ঘন্টায় যাওয়াটা অত্যন্ত কঠিন। আমাদের ড্রাইভার দাদা বিচক্ষণ এবং শান্ত প্রকৃতির হওয়ায় সকাল ৯ টায় যাত্রা শুরু করে সন্ধ্যা প্রায় ৬.৩০ টায় পৌঁছে দিলেন আমাদের প্রথম কিন্নরের গন্তব্য… সারাহান।

এই যাত্রাপথেই আরেক লোভনীয় জিনিস নজরে এলো… কিন্নরী আপেল বাগান এবং সারা রাস্তা জুড়ে আপেল বোঝাই গাড়ির আনাগোনা। সন্ধ্যায় যখন আমরা সারাহানে আমাদের থাকার জায়গায় পৌঁছালাম,পথের সব ক্লান্তি দূর হলো হোটেলটির নিজস্ব লোকেশনের জন্য। আমরা হিমাচল টুরিজম এর ‘হোটেল শ্রীখন্ড’ এ ছিলাম। এই দীর্ঘ পথ অধিকাংশ যাত্রীরা একবারে আসেন না। একটা দিন সিমলাতে থেকে পরের দিন সারাহানে থাকাটাই ঠিকঠাক।
সারাহান বিখ্যাত ভীমকালি মন্দির এর জন্য। এটি সতীর ৫১ টি পীঠস্থানের মধ্যে একটি। আমাদের হোটেল থেকে হাঁটাপথে ২ মিনিট এই মন্দির। হোটেলের কটেজের ঘরটি সাবেকি ও বহরে এত বড় এবং সুন্দর যে রাস্তার ধকল মিটে গেলো রাতে আরামের ঘুম দিয়ে। রাতে মন্দির থেকে পুজোর ঘন্টার আওয়াজ এবং সকালের আরতির ধ্বনি মনকে প্রশান্তি দিলো। সেদিন ছিল অষ্টমী শেষে নবমী পুজোর দিন। সকাল সকাল স্নান সেরে সেদিন মন্দিরে পুজোও দিয়েছিলাম। তবে এ মন্দিরের বৈশিষ্ট্য আমাদের এখানকার মন্দিরের মত নয়। তিব্বতি প্যাগোডার আদলে তৈরি এ মন্দির বৌদ্ধ এবং হিন্দু সংস্কৃতির বৈশিষ্ট্য বহন করছে। রুপায় মোড়া গেট সহ ছোট্ট কাঠের সিঁড়ি দিয়ে উপরে মন্দিরের গর্ভগৃহের গঠন আলাদা রকমের। মন্দিরে পুজো দিয়ে আসেপাশে ঘুরে হোটেলে এসে আবার সব গুছিয়ে বেড়িয়ে পড়েছিলাম পরের গন্তব্যের উদ্দেশ্যে।
ভীমকালি মন্দিরের ভেতরে মোবাইল ক্যামেরা নিষিদ্ধ এবং মাথা ঢেকে সবাইকে প্রবেশ করতে হয়।
মন্দির সহ সারাহানের হোটেল থেকে শ্রীখণ্ড মহাদেব শৃঙ্গ দেখা পাওয়া যায়।
দ্বিতীয় দিন –সারাহান থেকে সাংলার পথে…
সারাহান থেকে প্রায় ৮৫ কিমি দূরে কিন্নরের পুরনো এই জনপদ… সাংলা ভ্যালি অথবা যাকে বাসপা ভ্যালিও বলা হয়। বাসপা নদীর সৌন্দর্য এবং কৈলাস পর্বতের উল্টোদিকের বরফাবৃত শোভা এই ভ্যালিকে আরও মনোরম করে তুলেছে। সারাহান থেকে সাংলা যাওয়ার পথে পাহাড়ের নানা রকম ভঙ্গিমা নজর কেড়েছে। সাংলা ভ্যালি ঢোকার মুখেই বিখ্যাত কামরু ফোর্ট যাওয়ার রাস্তা এবং ছোট্ট সাংলা বাজার জুড়ে কিন্নরী আপেল বোঝাই দোকান,স্টোর রুম আর আপেল রপ্তানির নানা কার্যকলাপ চোখে পড়লো।

আমাদের থাকার জায়গাটি সাংলা ভ্যালি থেকে একটু দূরে প্রায় ২ কিমি,ছিটকুলের দিকে। দুপুর বাড়ার সাথে সাথে মনে দ্বিধা বাড়ছিলো যে,কোন দূরে নিরিবিলিতে কি পরিবেশে গিয়ে উপস্হিত হবো এই নির্জন জায়গায়। পথ সংকীর্ণ হওয়ায় এবং রাস্তায় বড় মিলিটারি গাড়ি আটকে থাকায় পৌঁছাতে দেরি হচ্ছিল, সাথে সাথে উদ্বেগও বাড়ছিল।
পাহাড়ি চড়াই রাস্তা ধরে নীচে নেমে যখন ” sattva pine resort,sangla” তে পৌঁছালাম সব মনের দ্বিধাদ্বন্দ্ব একনিমিষে দূর হলো। নদীর আওয়াজ এবং সামনে বরফ ঢাকা পাহাড়ের শোভার মাঝে বৌদ্ধিক সাজে সজ্জিত এই ১০ টি কটেজ নিয়ে তৈরি রিসোর্টটি নিজেই একটা দর্শনীয় স্থান। সেই সাথে ওখানের কর্মীদের আতিথেয়তা মনে জায়গা করে নিলো। পথের ক্লান্তি দূর করতে ওদের স্হানীয় ভেষজ চা শরীরকে আরাম দিলো। তারপর লাঞ্চের সাধারণ খাবারের পরিবেশন ছিল অনন্য… কাঁসার বাসন, পিতলের ঘড়ার জল, সাথে নিজস্ব বাগানের পালং শাকের পালংপনীর বড্ড মুখরোচক। খাবার দাবারের পরে আমরা কাছেই নদীর পাড়ে ছোট্ট ব্রিজের দিকে এগোতে লাগলাম।
স্হানীয় বাসপেরি গ্রাম,যা এই সাংলা ভ্যালির একটা আলাদা বৈশিষ্ট্য তা এই রিসোর্টের কাছেই। আমরা বিকেলের হালকা রোদে সেই গ্রামের দিকে যাওয়ার পথে বাসপা নদীর তীরে গিয়ে উপস্থিত হয়েছিলাম। কোন বাইরের ভীড়ভাট্টা ছাড়া স্হানীয় মানুষদের কাজ থেকে ফিরে আসার দৃশ্য মনে আলাদা অনুভূতি আনলো। এই ট্রিপে সব জায়গাই সুন্দর, কিন্তু এই সাংলার রিসোর্টটি অবস্থানগতভাবে ইউনিক হওয়ায় এর সৌন্দর্যের স্বাদ সবার চেয়ে আলাদা। ছোট্ট সাঁকো পেরিয়ে গ্রামের দিকে যাওয়ার মুখে একটি মন্দির। আর তার ফাঁক দিয়ে সূর্য ডোবার আলো ঝকঝক করছে। তবে গ্রামে যাওয়ার পথটা একটু চড়াই এবং কিছুটা দূরে থাকায় বিকেলে আর যাওয়া হলো না। শারীরিক সমস্যার কারণে আমি পরের দিন সকালেও যাই নি,কিন্তু বাবা মেয়ে প্রায় ১.৫ ঘন্টা ছোট্ট ট্রেকিং করে বাসপেরি ভিলেজ ঘুরে এসেছিলো। গ্রামের প্রতিটা বাড়ি সম্পন্ন এবং সব বাড়ির সামনে আপেল বাগান। সেখানে বাইরে থেকে ব্যবসায়ীরা এসেছেন এবং আপেল পেড়ে গাড়ি করে বাইরে নিয়ে যাওয়ার প্রস্তুতি চলছিলো। ওদের দেখে স্হানীয়রা বেশ কিছু আপেল উপহার হিসেবে খেতে দেয় এবং গাছের তলা থেকেও তিতির কয়েকটা আপেল কুড়িয়ে আনে। এই আপেলের স্বাদ সম্পূর্ণ ভিন্ন। এত রসালো মিষ্টি যেন অমৃতসম। আমাদের এখানে সাধারণত এমন আপেল পাওয়া যায় না।মন ভরে আপেল বাগানে আপেলের ঝাঁক দেখে এবং বাসপা নদীর তীরে বসে সূর্যাস্ত দেখে সাংলা ভ্যালির অপরূপ শোভা ভীষণ রকমভাবে উপভোগ করেছিলাম।
এর সাথে রাতে রিসোর্টে বনফায়ারের ব্যবস্হা এবং ঘরোয়া ভেজ সুপ বাইরের প্রায় ৫-৬° উষ্ণতাকেও গ্রহণযোগ্য করে দিয়েছিলো। রাতে ডিনারে স্হানীয় হিমাচলী কড়াই চিকেন সহ স্হানীয় খাবারের ব্যবস্হা থাকায় হিমাচলী খাবারের স্বাদও নেওয়া হয়। রাতে ঠান্ডা ভীষণ ছিল,কিন্তু কটেজের ঘরে সবরকম আরামদায়ক ব্যবস্হা থাকায় কোন অসুবিধা হয় নি।সাংলাতে বাসপা নদীর তীর সহ আপেল বাগানে ঘোরার অভিজ্ঞতা অসাধারণ ছিল। প্রতিভাস ম্যাগাজিন