বিদিশা বসু
গল্পের বইয়ের পাতা থেকে জঙ্গলের আনাচকানাচে — জিম করবেট ন্যাশনাল পার্ক
বন্যপ্রাণীদের বসবাসভূমি এবং চিড়িয়াখানায় পশুপাখির থাকার ধরনের মধ্যে পার্থক্যটা বুঝলে তবেই জঙ্গল ভ্রমণের স্বাদ অনুভব করা যায়। সে বনভূমি পশুদের নিজস্ব জগৎ, সেখানে আমরা মনুষ্যকূল বাইরে থেকে আসা অতিথি। তাই তাদের মেজাজ মর্জি অনুযায়ী তারা তাদের রাজত্বে ঘুরবে ফিরবে, সেসময়ে আমরা অতিথিরা সে রাস্তা যদি পার করি,তবে তাদের দেখা মিলতে পারে, আবার নাও মিলতে পারে…. এমনই জঙ্গলের নিয়মাবলি। এ তো চিড়িয়াখানা নয় যে, মুক্ত প্রাণকে বন্দী করে এনে আটকে রাখা,আর আমাদের আনন্দ দানের জন্য তাদের খাঁচার অন্য প্রান্ত থেকে দর্শন সুখ মেটানো।
যাই হোক… পশুদের দেখা মিলবে কি মিলবে না সে আশা না রেখেই শুধু মাত্র জঙ্গলের আদিমতার অনুভূতি উপভোগ করতে ২০২৪ সালের মে মাসের শেষে চারদিনের জন্য বেড়িয়ে পড়েছিলাম উত্তরাখণ্ডের প্রখ্যাত এবং ভারতবর্ষের সবচেয়ে প্রাচীন ন্যাশনাল পার্ক ” জিম করবেট ন্যাশনাল পার্ক “।১৯৩৬ সালে তৈরি এই পার্কে সবার্ধিক সংখ্যক বাঘ সংরক্ষিত আছে। দিল্লি থেকে প্রায় ৬-৭ ঘন্টার রাস্তা গাড়িতে গিয়ে আমরা প্রথম দিন উত্তরাখণ্ডের রামনগরের একটি সুন্দর সাজানো রিসোর্টে রাত্রিবাস করি। রামনগর থেকে প্রায় ১৫ কিমি দূরত্বে অবস্থিত আমাদের প্রথম গন্তব্য ” ঢিকালা জোন”।
ঢিকালা জোনে আমরা প্রথম দিন ” গইরাল ফরেস্ট রেস্ট হাউস ” এ ছিলাম। রাম গঙ্গা নদীর পাড়ে অবস্হিত জঙ্গলের মধ্যে এই পুরনো ব্রিটিশ আমলের থাকার জায়গায় রাতের অভিজ্ঞতা বেশ অনবদ্য। সারারাত ধরে পাহাড়ি নদীর কুলকুল আওয়াজ আর সাথে জঙ্গলের নিস্তব্ধতার মাঝে নানারকম পতঙ্গ এবং নাম না জানা জন্তুর ডাক এক আলাদা শিহরণ এনেছিলো। তবে এই রকম ছোট্ট ছোট্ট ৪-৫ টি বনদপ্তরের থাকার জায়গাগুলোতে কোন বিলাসিতার আশা করা অত্যন্ত বোকামো হবে। ইলেক্ট্রিসিটি এই সব অঞ্চলে নেই, সোলার ব্যবস্হার উপরে নির্ভরশীল এখানের বৈদ্যুতিক সিস্টেম। তাই রাত ৯ টার পরে ফ্যান চলে। সেই সাথে ভাত রুটি ডালের মত সাধারণ খাবার খেয়েই নিজেদের পেটপুজো সারতে হবে। অধিকাংশ জায়গায় নিরামিষ আহারই মিলবে। কোনরকম বাহুল্য আশা করলে এমন জঙ্গলের মধ্যে না থাকাই বাঞ্ছনীয়। তবে পুরনো আমলের বাড়ি হওয়ায় ঘর গুলো বহরে খুব প্রশস্ত এবং সুন্দর থাকার ব্যবস্হা।
তৃতীয় দিন আমরা ছিলাম, ” ঢিকালা ফরেস্ট রেস্ট হাউস ” এ। এই জায়গাটা সবচেয়ে পুরনো এবং এখানেই একমাত্র ইলেকট্রিক লাইন সহ বনদপ্তরের সব অফিস আছে। ৩২ টি নতুন পুরনো বাংলো সহ ঘর এবং খাবার সহ পানীয় জল এবং বাইরের ক্যান্টিনের সুব্যবস্হা আছে।
ঢিকালা জোনটি জিম করবেটের সবচেয়ে জনপ্রিয় এবং চাহিদা সম্পন্ন জোন। প্রধানত ফটোগ্রাফারদের প্রিয় জায়গা এটি। বছরের ২-৩ বার ভারতবর্ষ সহ পৃথিবীর নানা প্রান্তের ফটোগ্রাফাররা এখানে এসে ৩ রাত কাটিয়ে যান। নাওয়া খাওয়া বাদ দিয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা অপেক্ষা করে বাঘ সহ নানা পাখিদের একটা অসামান্য ছবি তুলতে ওঁনাদের আবেগ এবং উৎসাহ চোখের পড়ার মত। জিমমকরবেট ই এমন জঙ্গল, যার কোর এরিয়াতে টুরিস্টদের থাকা সহ ঘোরার বন্দোবস্ত আছে। তবে জীপ সাফারি করতে পারেন,যাঁরা ঐ ফরেস্ট রেস্ট হাউসগুলোতে রাত্রি বাস করবেন। বাকি বাইরের হোটেলে থাকা টুরিস্টদের জন্য ক্যান্টার সাফারি হয় ৫ ঘন্টা মত। কিন্তু ঐ ক্যান্টার বাসগুলো জঙ্গলের অনেক ভিতরের নদীর পাড় কিংবা গভীর বনভূমিতে যেতে পারে না। তারা বড় রাস্তা ধরেই ঘোরাঘুরি করে সারাদিন। কিন্তু জীপ সাফারি দিনের মধ্যে দুইবার হয়। সকাল ৫.৩০- ৯ টা এবং বিকেল ৩.৩০ থেকে ৭ টা পর্যন্ত। ফলে শিবালিক শৃঙ্গের পার্বত্য উপত্যকা সহ ঘন ঘাসের জঙ্গল কিংবা রামগঙ্গা নদীর পাথুরে জলের উপর থেকে ঘন্টার পর ঘন্টা ঘুরে জঙ্গলের আস্বাদন পাওয়া যায়। আমরা ঢিকালা জোনে দুইদিনে মোট চারবার সাফারি করেছি। এবার আসি পশুপাখিদের দর্শন সংক্রান্ত কিছু কথায়…
সম্বর সহ বার্কিং ডিয়ারের মত হরিণের যত্রতত্র ঘুরে বেড়ানো ওখানের খুব সাধারণ দৃশ্য। ময়ূর পাখনা মেলে রাস্তার মাঝে দাঁড়িয়ে সে ছবিও কয়েকবার চোখে পড়েছে। এছাড়া বুনো হাতিদের আাবাদভূমি এ জঙ্গল। তারাই এখানের রাজা, সে কথা নানা ভঙ্গিতে কত বার যে বুঝিয়েছে। কখনো নদীর পাড়ে দল বেঁধে ধূলো ওড়াচ্ছে,আবার ঘন ঘাসে বাচ্চাসহ ঘুরে বেড়াচ্ছে, কখনো বা বড় বুনো দাঁতাল হাতি একটা মোটা গাছের শিকড় সহ উপড়ে দিয়ে রাস্তায় ফেলে চলে যাচ্ছে, কিংবা বিশাল আকার শরীর নিয়ে সাফারির গাড়ির দিকে এমন ধেয়ে আসছে যে গাড়ি সব পালাতে পারলে বাঁচে।
এবার আসি সেই জঙ্গলের মহারাজার কথাতে… সবসময় তাদের দেখা মেলে না এ কথা জঙ্গলে প্রবেশের মুখেই ড্রাইভার দাদা ইরফান ভাই বলে দিয়েছিলেন। আমরাও আশা করি নি। কিন্তু মহারাজা যে আমাদের নিরাশ করবেন না,তা আমরা ভাবতেও পারি নি। চারটে সাফারিতে তিন তিনবার বাচ্চা সহ বাঘিনীর দর্শন… সে এক ঈশ্বর দর্শনের সমান। কয়েকটা উদাহরণ এমন…. ঘন ঘাসের জঙ্গল থেকে বাঘিনী মা ‘পারওয়ালি’ যার নাম,সে আমাদের সাফারি গাড়িগুলোর সামনে থেকে রাস্তা পেড়িয়ে অন্য দিকে গেলো।সেখানে এক পলাশ গাছে লেজ দুলিয়ে তার ছোট বাঘ ছানা খেলা করছে। তার একটু পরেই সে মা বাঘিনী মুখে করে এক হরিণ শাবককে শিকার করে সামনের নদীতে নিয়ে গেলো।তারপর হুঙ্কার ছাড়লো।দেখলাম,দুটো ছোট্ট বাচ্চা উল্টো দিক থেকে নদীর জল পেড়িয়ে মায়ের কাছে আসছে। হরিণ শাবকের এমন মৃত্যু খুব কষ্টদায়ক দৃশ্য হলেও মায়ের স্নেহ এবং সন্তানের প্রতি তার দায়িত্ব এ বাঘিনীর শিকার করার মধ্যে স্পষ্ট। প্রকৃতির নিয়ম তো এমনই!! মা নিজে না খেয়ে সন্তানদের ঐ খাবার ভাগ করে দিচ্ছে… এও তো এক মাতৃত্বের উদাহরণ।

বিকেলে আরেকজন বাঘমামাকে একই জায়গায় ডালপালার মধ্যে পা উঁচিয়ে বিশ্রাম রত অবস্হায় দেখলাম দুইবার মত।
আরেকবার সাফারিতে সকালে সে এক অনির্বচনীয় দৃশ্য, মা বাঘিনী শিকার ধরে ঘন ঘাসের মধ্যে রেখে এসেছে। তারপর সে নদীর জলে নেমে তার চারজন বাঘ শাবককে ডেকে নিয়ে সে রাস্তার অন্য প্রান্ত থেকে যাওয়ার চেষ্টা করছিলো। সমস্ত গাড়ি সহ ক্যামেরা তাক লাগিয়ে সবাই একদিকে অপেক্ষারত ছিল। কিন্তু বাঘিনী তার বাচ্চা সহ অন্য দিক থেকে যাওয়ায় ব গাড়ি তাদের পিছনে দৌড়াতে থাকে। বস্তুত সে এক বিরল দৃশ্য, কারণ চার চারটে বাচ্চা সহ মা বাঘের এই চলন,ফটোগ্রাফারদের কাছে এক অমূল্য সম্পদ। সেই মা বাঘ একে একে তার বাচ্চাদের ঐ গাড়ির মেলাসহ মানুষের ভীড় থেকে ঘন ঘাসের জঙ্গলের দিকে নিয়ে চললো। তারপর এ ঘাসের মাঝে তারা একে একে মিলে গেল। আমরাও এই অসামান্য দৃশ্য দেখে মন সম্পূর্ণ তৃপ্ত করে ঢিকালা জোনে দুইদিন কাটিয়ে প্রসন্ন চিত্তে অন্য গন্তব্যে রওনা দিয়েছিলাম।
আরেক বিষয় উল্লেখ্য — ঢিকালা জোনের কোথাও কোনরকম মোবাইল পরিসেবা কার্যকরী নয়। জঙ্গলের শান্তি এবং তার পরিবেশের সমতা বজায় রাখতেই আধুনিক কোনরকম পরিসেবা এখানে চালু নয়। ঢিকালা জোন বছরের ১৫ ই জুন থেকে ১৫ই নভেম্বর পর্যন্ত বন্ধ থাকে। আর এই ফরেস্ট রেস্ট হাউসগুলো তিনমাস আগে অনলাইনে বুক করতে হয় এবং সাফারিও অনলাইনে বুক হয়। বনদপ্তরের নির্দিষ্ট পরিমাণ সাফারি গাড়িই একদিনে প্রবেশ করতে পারে এবং সে সংখ্যা খুব সীমিত হওয়ায় এখানের বুকিং খুব দ্রুত শেষ হয়ে যায়।
এছাড়া জঙ্গলকে আবর্জনামুক্ত রাখতে বনদপ্তরের একটি পদক্ষেপও খুব প্রশংসনীয়। আমরা যখন জঙ্গলের সদর গেটে ভিতরে যাওয়ার অনুমতিপত্র পেলাম,তখন আমাদের হাতে একটা চটের বস্তার মত বড় ব্যাগ জিপসি গাড়িতে দেওয়া হলো। ড্রাইভার দাদা বললেন যে, যে তিনদিন আমরা এই ঢিকালা জোনে থাকবো,আমাদের ফেলে দেওয়া সামগ্রী আবর্জনা বক্সে না রেখে এই ব্যাগে পুড়ে রাখতে হবে। জঙ্গল থেকে বেড়োনোর সময়ে এই চটের ব্যাগটি গেটের বাইরে বড় এক ডাস্টবিনে ফেলে যেতে হবে। এর ফলে মানুষের ব্যবহৃত কোন প্ল্যাস্টিক বা খাবার প্যাকেট কিংবা কোন বাতিল জমা কিছু জঙ্গলের রাজত্বে থাকবে না। অতিথির মত এসে সঙ্গে করে নিজেদের বাতিল করা সামগ্রীও সাথে নিয়ে বেড়োতে হবে। তাহলে এ জঙ্গলও থাকবে কলুষমুক্ত।

চতুর্থ দিন,আমরা জিম করবেটের অন্য একটি জোনে ছিলাম,রামনগর থেকে ১১ কিমি দূরে ” ঢেলা জোন” এ। এটি অনেকটাই শহরের কাছাকাছি এবং সাধারণ টুরিস্টদের জন্য সারাবছর খোলা থাকে। আমরা ঢেলা জোনের ফরেস্ট রেস্ট হাউসে ছিলাম। এখানে মোবাইল টাওয়ারসহ বিদ্যুৎ সংযোগ সবই ব্যবস্হা আছে। সাফারির সময় সীমা এখানেও একই, তবে গাড়ি সংখ্যা অনেক কম এবং জঙ্গলের সীমানা অতি কম। এই ঢেলা জোনের সীমানা শেষে শুরু হয় আরেকটা জোন- ঝিরণা জোন। ঢিকালা জোনের অভূতপূর্ব অভিজ্ঞতার পরে শেষের দিনটা শুধু মাত্র জঙ্গলকে উপলব্ধি করতেই সাফারিতে বেড়িয়ে ছিলাম। কিন্তু সেখানেও এমন সৌভাগ্য হবে তা কল্পনার বাইরে ছিল। জঙ্গলের রাস্তা ধরে ৫ মিনিট যাওয়ার পরে নজরে এলো রাস্তার একটা ছোটো জলের কুয়োর মধ্যে বাঘ মশাই তার শরীর অর্ধেক ডুবিয়ে বসে বিশ্রাম নিচ্ছেন। প্রায় ২০ মিনিট মত আমরা তার বিশ্রামের নানা ভঙ্গিমা দেখার পরে তিনি সেই জলাধার থেকে আধা ভেজা অবস্থায় জঙ্গলের মধ্যে চলে গেলেন। পরের দিন সকালের সাফারিতেও সেই বাঘ মশাই আবারও রাস্তা পার করে একেবারে গাড়ির সামনে এসে উপস্থিত হোন। এ এক বিস্ময়কর ব্যাপার ছিল… এতবার বাঘের দেখা মিলবে তা কখনো আশাও করে যাই নি। কিন্তু এত কাছের থেকে নানারকম ভঙ্গিতে তার চলন গমন নজরে আসা,আমাদের জন্য জিম করবেট সফরনামাকে সার্থক করে।
চারদিনে মোট ছয়বার সাফারিতে পাঁচবার বাঘের দর্শন,সাথে নানারকম পশুর দিনলিপি চাক্ষুষ করা এবং নাম না জানা পাখিদের রূপের বাহার সহ তাদের গাছের কোটরে নানারকম বাসা তৈরি… এক অবাক পৃথিবীর সন্ধান দিয়েছে। শাল সহ নানা দামী গাছের নিজস্ব ভঙ্গিমায় বেড়ে ওঠা এবং গাছের গায়ে কীটপতঙ্গদের অবাধ বিচরণ সেও কিন্তু কম বিস্ময়কর নয়!!
ছোটবেলার জিম করবেট অবনিবাস এবং সেই জঙ্গলে কাটানো চার চারটে দিন মিলেমিশে এক হয়ে গেলো।
হিমাচলের এক শান্ত রাজমহলে দিনযাপনের কথা
সিমলা – মানালি ঘুরতে যাওয়ার ইচ্ছে প্রায় সবারই থাকে। প্রকৃতি দুহাত ভরে সাজিয়েছে হিমাচল প্রদেশের আনাচ কানাচ। সেই হিমাচলেই আছে সুসজ্জিত এক রাজকীয় ব্যবস্হাপনা। সিমলার বদলে যদি সেখানে দুটো দিন কাটানো যায়,তবে কিন্তু মন্দ হয় না!! সিমলার মত জনপ্রিয় শহরের কোলাহল থেকে একটু দূরে, পাইন দেবদারু মোড়া এক রাজপ্রাসাদে থাকার অভিজ্ঞতা কিন্তু অতুলনীয়।

চণ্ডিগড় থেকে ৩ ঘন্টা যাত্রা শুরু করে, সিমলা যাওয়ার পথে একটি রাস্তা বেঁকে যায় চেইল এর দিকে। সিমলা থেকে ৪৪ কিমি দূরে এই ” চেইল প্যালেস”। প্রায় ৭৫ একর জমি নিয়ে তৈরি পাতিয়ালার মহারাজার এই সাম্রাজ্য। সে সময়ে ব্রিটিশ দের গ্রীষ্ম কালীন রাজধানী ছিল সিমলা শহর। সুন্দর সাজানো গোছানো সিমলার স্থাপত্য জুড়ে ব্রিটিশ কলোনিয়াল সংস্কৃতির ছাপ স্পষ্ট। সেই সিমলা থেকে কিছুটা উপরে অবস্থিত চেইল নামক জায়গায় পাতিয়ালার মহারাজা ১৮৯১ সালে তাঁর রাজপ্রাসাদ তৈরি করেন। পরবর্তীতে সিমলা শহরে মহারাজা ভুপিন্দর সিংহের প্রবেশ নিষিদ্ধ করেন যখন ব্রিটিশ শাষক,তখন পাতিয়ালার মহারাজাও নিজের আত্মগরিমা বজায় রেখে সিমলা থেকে উচ্চ স্হানে অবস্হিত এই ছোট্ট জায়গা চেইল কে নিজের গ্রীষ্মকালীন রাজধানী হিসেবে বেছে নিয়ে রাজপ্রাসাদের আশপাশকে সুসজ্জিত করেন। পাহাড়ি দেওদর গাছে ঘেরা এই জায়গা থেকে সিমলা সহ আশপাশের স্হানও খুব সুন্দর দেখা যায়। স্বাধীনতার পরে ১৯৭২ সালে,হিমাচল প্রদেশের সরকার সরকারি ভাবে এই প্যালেসকে অধিগ্রহণ করেন এবং এখন বর্তমানে এটি হিমাচল প্রদেশ টুরিজম ডিপার্টমেন্টের একটি হেরিটেজ হোটেল।
এই বিশাল জায়গা ‘ চেইল প্যালেস ‘ হিসেবে পর্যটকদের কাছে পরিচিত। সিমলা থেকে ১-১.৫ ঘন্টা দূরত্বে অবস্হিত এই প্যালেস দেখতে সকাল ১০ টা থেকে ভীড় লেগে থাকে পর্যটকদের। গেটের বাইরে ১০০ টাকা প্রতি জন টিকিট ক্রয় করে দর্শনার্থীরা ঘুরে দেখতে পারেন এই রাজপ্রাসাদ এবং তার চারপাশের নানা জায়গা।
আমরা একটু অন্যভাবে এই জায়গা উপভোগ করলাম। সিমলা শহরে না থেকে হিমাচল টুরিজমের এই হেরিটেজ হোটেলে দুটো দিন থেকে অপার সৌন্দর্য উপভোগ করলাম। এখানে নানা রকম দামের রুম পাওয়া যায়।প্রধান যে রাজপ্রাসাদ আছে, সেই প্যালেসে মহারাজা, মহারাণীর স্যুট রুম সহ রাজকুমার, রাজকুমারীর রুম,উজির এবং দেওয়ানের রুম নামে সব ঘর আছে। এক এক রুমের এক রাতের খরচ এক একরকম। ৫৫০০ টাকা থেকে শুরু করে ১২০০০ টাকার রুমও এই প্যালেসের মেইন বিল্ডিংয়ে আছে। এছাড়া অ্যানেক্স বিল্ডিং এবং জঙ্গলের মধ্যে কটেজেও থাকার ব্যবস্হাপনা করা আছে।
আমরা প্যালেসের মেইন বিল্ডিংয়ে থাকার জন্য এক দারুণ অভিজ্ঞতা অর্জন করেছি। প্যালেসের নীচের তলায় সাধারণ দর্শকদের জন্য সকাল থেকে খোলা থাকে। সেখানেই হোটেলের রিসেপশন কাউন্টার এবং খাবার জায়গা। সেই ডাইনিং হলের পাশে বিলিয়ার্ড রুম সহ রাজাদের ব্যবহৃত নানা জিনিস দিয়ে সাজানো মিউজিয়াম। ঠান্ডা পানীয় দিয়ে উষ্ণ অভ্যর্থনা জানিয়ে ওখানের স্টাফরা আমাদের উপরের দোতলায় নিয়ে যান,যেখানে সাধারণ ভিজিটার্সদের প্রবেশ নিষিদ্ধ। শুধু মাত্র ঐ বিল্ডিংয়ে যাদের বুকিং থাকে,তারাই উপরের ঐ অপূর্ব সুন্দর ফ্লোরে যেতে পারেন। ঝাড়বাতি লন্ঠন দিয়ে সাজানো টানা বড় বারান্দার কোণে কোণে রাজকীয়তার ছোঁয়া। বিশাল বড় বড় ঘরের বাইরে রাজকুমার, রাজকুমারী, মহারাজ, মহারাণী লেখা আর দেওয়ালে দারুণ সব হাতে আঁকা ছবির বাহার।
দুপুরে খাবার জায়গায় ভীড় নজরে এলো। কাছাকাছি পাঞ্জাব হরিয়ানার মানুষজন ডে আউটিং হিসেবে এই জায়গাকে বেশ পছন্দ করেন,দেখে বোঝা যায়। সারাদিন ঘুরে ফিরে বিকেল বা সন্ধ্যায় ফিরে যাচ্ছিলেন অনেকে। সামনের মাঠ জুড়ে বসার জায়গা, বাচ্চাদের খেলার জায়গা,ছোট্ট ঝর্ণা আর ফুলের বাহার। এখানে ব্যাডমিন্টন এবং লন টেনিসের আলাদা কোর্ট আছে। সামনের মাঠে বড় বড় কোম্পানির মিটিং কিংবা বিয়ের অনুষ্ঠানের জন্যও ভাড়া দেওয়া হয়। তেমনই কোন অনুষ্ঠানের প্রস্তুতি চলছিল,তাই মাঠ জুড়ে প্যান্ডেল হওয়ার দরুণ প্যালেসের সামনের সৌন্দর্য একটু কম উপভোগ করলাম।

তবে প্রকৃতির নিস্তব্ধ রূপ এবং কোলাহল মুক্ত পরিবেশ এর আশেপাশের দৃশ্যকে ছবির মত সাজিয়ে রেখেছে। দুপুরে লাঞ্চ করে আমরা পায়ে হেঁটে প্রাসাদের চারপাশ ঘুরে দেখতে লাগলাম। ৩ কিমি দূরে একটি মন্দির আছে,সেটিও শান্ত সুন্দর। এছাড়া চিলড্রেন পার্ক,গাড়ি রাখার জায়গা সব সুন্দর আয়োজন আছে। আর আছে পাইন রডোডেনড্রন দেওদর গাছে ঘেরা ছোট ছোট গলির মত পথ। আর তার ফাঁকে ফাঁকে পাহাড়ের কোণে কটেজ। পাহাড়ি ডেইজি ফুলে মুড়ে আছে ফাঁকা জায়গা। এত রঙ বাহারি ফুল,নাম না জানা পাখি আর ফুল… এ জায়গাকে করেছে আলাদা। প্রকৃতির কোলে নিরিবিলিতে ঘুরে প্রাকৃতিক পাহাড়ি সৌন্দর্য উপভোগ করার যথাযোগ্য জায়গা চেইল।
রাতের পরিবেশ আবার সম্পূর্ণ আলাদা। এখানে সন্ধ্যা নামে অনেক পরে। ৭ টার সময়ে হালকা আলোর ছোঁয়ায় প্যালেসের পরিবেশ মায়াবি হয়ে যায়। সকাল থেকে নানা জায়গা থেকে আসা পর্যটকের ভীড় লেগে থাকে প্যালেসের সংগ্রহশালা দেখতে। সেই কলরবে মুখরিত প্যালেস ৭ টার পরে নির্ঝুম শান্ত হয়ে যায়। কয়েকজন ওখানে রাত্রি বাস করা আমাদের মত পর্যটক ছাড়া অন্য কারোর অস্তিত্ব থাকে না। আর মহলের দোতলা তো রাতে আরও নিঃশব্দ,নিজের পায়ের আওয়াজেও বিভ্রান্তি তৈরি হওয়ার জোগার। ওত বড় ফ্লোরে রাতে আমরা কয়েকজন ঘুরে,সামনের মাঠের অন্ধকার উপভোগ করার অভিজ্ঞতাও বেশ রোমহষর্ক।
এখান থেকে পরের দিন সকালে ব্রেকফাস্ট করে সিমলার আসেপাশ ঘুরে দেখে দুপুরে সিমলা মলের কোলাহল মুখরিত পরিবেশ বেশ ভালো লাগলো। সিমলা কালিবাড়িতে গিয়ে নিজস্ব সংস্কৃতির স্পর্শ বেশ উপভোগ্য। সিমলামলে পায়ে হেঁটে,বসে,সেখানের কালচারকে চাক্ষুষ করতে বেশ লাগে। সন্ধ্যা নামার পরে আবারও ফিরে এসেছিলাম সেই মায়াবি স্বপ্নপুরীতে। সন্ধ্যায় সেই নিস্তব্ধ ফাঁকা রাস্তা ধরে ফিরতে ফিরতে মনের মধ্যে শান্তি অনুভব হচ্ছিল।
প্রকৃতির মাঝে দুটো দিন শান্তিতে নিরিবিলিতে কাটানোর জন্য “চেইল প্যালেস” খুব ভালো একটা জায়গা। এখানে রাত্রিবাস করার জন্য হবে হিমাচল প্রদেশ টুরিজম থেকে রুম বুকিং করতে হবে। চন্ডীগড় থেকে প্রায় ১০৫ কিমি দূরে, পৌঁছাতে ৩.৫ ঘন্টা মত সময় লাগে এবং সিমলা শহর থেকে ৪৫ কিমি দূরে অবস্হিত এই প্যালেস একবার ঘুরে দেখে আসতেই পারেন… আশা করি নিরাশ হবেন না।
ভরা বর্ষায় জলপ্রপাতের মুখোমুখি… রাঁচি শহরে ঝটিকা সফর
ঝর্ণা! ঝর্ণা! সুন্দরী ঝর্ণা!
তরলিত চন্দ্রিকা! চন্দন-বর্ণা!
অঞ্চল সিঞ্চিত গৈরিকে স্বর্ণে,
গিরি-মল্লিকা দোলে কুন্তলে কর্ণে,
তনু ভরি’ যৌবন, তাপসী অপর্ণা!
ঝর্ণা!
— সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত
ঝর্ণার জল বৃষ্টিস্নাত হলে কেমন অপরূপ হয়, তার রূপদর্শন করতে হঠাৎ করে বেড়িয়ে পড়লাম ঝাড়খন্ডের রাজধানী শহর রাঁচির উদ্দেশ্যে। ছোটবেলা থেকে নানাজনের কাছে মজা করে শোনা কথা যে, তোকে রাঁচির পাগলাগারদে পাঠাতে হবে। কিংবা বর্তমান সময়ের তারকা ক্রিকেটার মহেন্দ্র সিং ধোনির বাসস্হান শহর হিসেবে রাঁচির নাম বেশ বিখ্যাত। তাই এই জায়গা দেখার সুপ্ত ইচ্ছেও মনের মধ্যে নিয়ে রাঁচির উদ্দেশ্যে রওয়া দিলাম বৃহস্পতিবার রাতের ট্রেনে।
হাওড়া থেকে রাত ৯.৩০ টায় কৃয়াযোগা এক্সপ্রেসে চেপে পরের দিন সকাল ৬ টা নাগাদ রাঁচি স্টেশনে পৌঁছালাম। ট্রেন ৩০ মিনিট মত লেট ছিল। স্টেশনে পা দিতেই চারপাশের দেওয়াল জুড়ে নানারকম দেশীয় চিত্রের নিদর্শন চোখে পড়লো। স্টেশনের বাইরে সেই ভোরবেলাতেও গাড়ির লাইন আর ব্যস্ততা নজরে এলো।
আমাদের হোটেল অগ্রিম বুকিং ছিল – ঝাড়খন্ড টুরিজম এর “হোটেল বিরসা বিহার” এ। স্টেশন থেকে একটা অটো করে ১.৫ কিমি দূরের সেই হোটেলে সহজেই পৌঁছে গেলাম। রাস্তায় যেতে যেতেই নজরে পড়লো… শহর জুড়ে দেওয়াল চিত্র যা ঐ রাজ্যের পরম্পরার বাহক। হোটেলের একটি স্যুট রুম বুক ছিল৷ আয়তনে প্রায় একটি এক কামরার ফ্ল্যাটের সমান এবং চারপাশ ভীষণ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। সকালবেলা ট্রেনের ক্লান্তি কাটিয়ে ঘন্টা দুয়েক বিশ্রাম নিয়ে প্রথম দিনের গন্তব্যে বেড়িয়ে পড়লাম।

প্রথম দিন – রাঁচি শহর থেকে প্রায় ৪০ কিমি দূরে অবস্হিত বিখ্যাত দশম ফলস্। নির্দিষ্ট জায়গায় গাড়িতে পৌঁছে এবার সিঁড়ি দিয়ে নীচে নামার পালা। হালকা বৃষ্টির মত পরিবেশে দূর থেকে জলের আওয়াজ আসছিল। বাঁধানো বেশ চওড়া সিঁড়ি বেয়ে কিছুটা নামার পরে পরে পাশাপাশি ভিউ পয়েন্টের জায়গায় বসার ব্যবস্হাপনা আছে। দূর থেকেই দশম জলপ্রপাতের ফেনিল জলকণা নজরে আসছিল। প্রায় ২৫০-৩০০ সিঁড়ি পেরিয়ে জলের কাছাকাছি আসা গেল। বড় বড় পাথর টুকরোর উপরে বসে ছবি তুলে,ঝর্নার জলে পা ডুবিয়ে বসে বেশ সময় কাটাচ্ছিল সবাই। আমরাও সামিল হয়েছিলাম সবার মত। তবে বৃষ্টির ছিটেফোঁটা গায়ে পড়তেই আবার সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে তৎপর হলাম। উপর থেকে বর্ষণস্নাত ঝর্ণার রূপ দেখে আরও মুগ্ধ হলাম।
এরপর বৃষ্টি মাথায় নিয়ে দশম ফলস্ এর কাছাকাছি সূর্য মন্দিরের উদ্দেশ্যে গেলাম। সাতটি বড় বড় ঘোড়ার মূর্তি দিয়ে তৈরি মন্দিরের চত্ত্বর নিরিবিলি সুন্দর। নীচে মন্দিরের স্বেচ্ছাসেবী সংস্হার তরফে স্হানীয় স্কুলের বাচ্চাদের মধ্যাহ্ন আহারের ব্যবস্হা আছে,দেখলাম।
এরপর আমাদের উদ্দেশ্য – বিখ্যাত পত্রাত্রু ভ্যালি। কিন্তু যাওয়ার সময়ে বৃষ্টির জন্য মাঝ পথে থেমে গেলাম,আর সেখানে দুপুরের খাবার খাবো বলে ঠিক হলো। খাবার জন্য যেখানে থামলাম,সেটাও বেশ বিখ্যাত জায়গা- মাহিন্দ্র সিংহ ধোনির ফার্ম হাউসের ঠিক পাশের রেস্টুরেন্ট। বৃষ্টির মধ্যে দুপুরের আহার শেষ করার পরে এক ঝলক ধোনির বাড়িতে উঁকিঝুঁকি দেওয়ার চেষ্টা করলাম। উঁচু পাঁচিলে ঘেরা লোহার লাল রঙের গেটের সামনে কয়েকজন দর্শনার্থীকে চোখে পড়লো, বাইক নিয়ে ধোনির নাম লেখা জার্সি পরে তারা এসেছেন এতটা পথ বাইকে, পশ্চিমবঙ্গ থেকেই,শুধু মাত্র এক ঝলক ক্রিকেটের আইকনকে দেখবে বলে। গেটের ফাঁক থেকে যতদূর দেখা গেল – প্রশস্ত পিচ রাস্তা পেরিয়ে প্রসাদসম এক বাড়ি আর তার উপরে উড়ছে বিশাল এক ভারতের পতাকার জয়ধ্বজা।
এরপর বিকেল হওয়ার আগে আগে আমরা পৌঁছে গেলাম পত্রাত্রু লেকে। রাঁচি থেকে ৩৩ কিমি দূরে অবস্হিত, এই যাত্রাপথ সম্পূর্ণ অন্য রকম। পাহাড়ি চড়াই উৎরাই পথ ধরে এগিয়ে চলছিলাম হালকা বৃষ্টির মধ্যে। একটু যাওয়ার পরেই পত্রাত্রু ভ্যালির প্রকৃত আকর্ষণ চোখে এলো। আঁকাবাঁকা পথ উপর থেকে সর্পিল হয়ে নীচে নেমেছে,সেই সাথে সবুজ গাছের শোভা চারদিকে। রাস্তার দুপাশে ২-৩ টে ভিউ পয়েন্ট থেকে জিক জ্যাক লাইনের ছবি তোলার ভিড় নজরে এলো। তারপর আমরা যখন পত্রাত্রু লেকে পৌঁছালাম টিকিট কেটে, নৌকা বিহারে যাওয়ার অনুরোধ নিয়ে মাঝিদের আনাগোনা শুরু হলো। একটা স্পিডবোটে চেপে লাইফ জ্যাকেট পরে লেকটা জলপথে প্রায় ২০ মিনিট মত ঘুরে দেখলাম। বেশ চওড়া, অনেকটা জায়গা নিয়ে এই লেক। এরপর লেক সংলগ্ন পার্কে কিছু সময় কাটিয়ে সন্ধ্যায় সারাদিনের ক্লান্তি নিয়ে হোটেলে ফিরে এলাম।
তবে বর্ষায় সবুজের সমারোহ যেমন চোখে পড়ার মত,তেমনই ঝর্ণার শোভা সুন্দর।

দ্বিতীয় দিন – সকালবেলা ১০ টার মধ্যে সকালের জল খাবার খেয়ে বেড়িয়ে পড়লাম রাঁচির অন্য বিখ্যাত জলপ্রপাত গুলো দেখতে। প্রথম লক্ষ্য ছিল – জোনহা ফলস্। রাঁচি-পুরুলিয়া হাইওয়ে রাস্তা ধরে প্রায় ৪৫ কিমি দূরের এই জলপ্রপাতে পৌঁছানোর রাস্তাটাও বেশ সুন্দর। ঘন জঙ্গলে ঘেরা গ্রামের মধ্যে দিয়ে যেতে হয়। গাড়ি থেকে নেমে রীতিমতো মানসিক প্রস্তুতি নিয়ে নামতে শুরু করলাম প্রায় ৭২২ সিঁড়ি নীচের এই মোহময়ী ঝর্ণার রূপদর্শন করতে। ৪৫ মিটার লম্বা এই ঝর্ণা ধাপে ধাপে নেমে এসেছে ৩-৪ টে ভাগে, প্রকৃতি প্রেমী এবং ফটোগ্রাফার মানুষদের পছন্দের জায়গা এটি। বেশ কিছু সময় কাটানোর পরে এবার উপরে ওঠার পালা। সে এক বিষম কষ্টের যাত্রা। এতগুলো সিঁড়ি উপরে ওঠতে প্রাণবায়ু যাওয়ার জোগাড়। হাঁফাতে হাঁফাতে অনেকটা সময় নিয়ে উপরে ওঠা গেল। তবে ঝর্ণার অপরূপ রূপ সেই কষ্টকে লাঘব করে।
এখানে পাতায় সাজিয়ে দেশী মুরগির ঝোল দিয়ে যে খাবার পরিবেশন করেন স্হানীয় দোকানীরা তা বেশ সুস্বাদু।
এরপর পরবর্তী লক্ষ্য – সীতা ফলস্। জোনহা থেকে ৫ কিমি দূরে এই ফলস,আকারে অনেকটা ছোট এবং সিঁড়ির ধাপ ১০০-১৫০ মত। তাই খুব বেশি কষ্ট হয় নি আসা যাওয়া করতে।
এরপরের গন্তব্য ঝাড়খণ্ডের বিখ্যাত হুন্ড্রু ফলস্। রাঁচি – পুরুলিয়া হাইওয়ে ধরেই সেখানে যাওয়া যায়। সুবর্ণরেখা নদীর জলপ্রপাত হিসেবে বিখ্যাত এই ফলস্ দেখতে প্রায় ৭৫০ চড়াই সিঁড়ি নামতে হবে। পূর্বের দুটো ফলস্ দেখার ক্লান্তি এবং শারীরিক সমস্যার কারণে ঐ সিঁড়ি ভাঙতে ভয় হচ্ছিল। কিন্তু তখনই ড্রাইভার মশাই অভয় দিলেন যে, উনি ফলস্ দেখাতে একটা স্হানীয় রাস্তায় নিয়ে যাবেন জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে। হাইড্রো ইলেকট্রিক্যাল পাওয়ার প্রজেক্টের পাশ থেকে নদী পেরিয়ে ঝর্ণার রূপ দর্শন করা যায়। পাওয়ার প্রজেক্টের সামনে গাড়ি দাঁড় করিয়ে আমরা তার পিছনের সিঁড়ি থেকে দূরের ঝর্ণাধারা দেখতে পেলাম। এরপর স্হানীয় দুজন দোকানী বললেন যে, পাথুরে নদীর উপরে বাঁশের সাঁকো পেরোতে ২০ টাকা দিলে আরও কিছুটা কাছ থেকে দেখতে পাওয়া যাবে। ওনাকে ৫০ টাকা দিতেই উনি আমাদের বাঁশের সাঁকো পার করে আরো কিছু পথ দেখিয়ে নিয়ে গেলেন। সে পথের দুপাশে বড় বড় পাথর বিছানো,পাশে আগাছা ভরা, আবার কোথাও বেশ বিপদসংকুল পিচ্ছিল বড় পাথর পেরিয়ে আমরা প্রায় ঝর্ণার কাছে এসে পৌঁছালাম। আসেপাশে কোন লোকের আনাগোনা ছিল না,তাই মন ভরে ছবি তুলে আবার সেই পথ ধরে সাবধানে ফিরে এলাম। ফেরার পথে একদল অল্পবয়সী স্হানীয় যুবকদের নদীর জলে আনন্দের সাথে স্নান করার মজা নিতে দেখলাম। প্রকৃতির একবারে কাছে এমন সুন্দর জলপ্রপাত, মন ভরিয়ে দিলো।

ফেরার পথে আমাদের জগন্নাথ মন্দির, টেগোর হিল, রক গার্ডেন দেখে ফিরে আসার কথা ছিল। কিন্তু মেয়ের শরীর ক্লান্ত হয়ে অসুস্থ বোধ করায় হোটেলে ফেরার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। ফেরার পথে অবশ্য ড্রাইভার দাদাকে বলেছিলাম,সেই গল্প বা কথায় শোনা বিখ্যাত পাগলাগারদ যা RINPAS নামে ওখানে পরিচিত,তা দেখিয়ে আনতে। ব্রিটিশদের নির্মিত সবচেয়ে পুরাতন মানসিক হাসপাতাল এটি।
সেই সাথে রাঁচি শহরের বড় বড় রাস্তা,প্রশাসনিক ভবন,রাজভবন, মুখ্যমন্ত্রীর আবাস… সব দেখে হোটেলে ফেরা হলো। তবে রাস্তায় কোন ট্রাফিক পুলিশ নজরে আসে নি,তাই গাড়িগুলোর নিয়ন্ত্রণ একটু বেলাগাম । রাস্তার দুপাশ জুড়ে স্হানীয় আদিবাসী সম্প্রদায়ের সোহরাই শিল্পকলার মাধ্যমে গ্রাম্য সংস্কৃতি, ময়ূর সহ বন্য প্রাণীদের নানারকম ভঙ্গি,স্হানীয় জীবনযাপন সহ নানারকম সাঁওতাল পটভূমি তুলে ধরা হয়েছে দেওয়ালে দেওয়ালে।
সেদিন রাতের ১০.১৫ তে রাঁচি স্টেশন থেকে কৃয়াযোগা এক্সপ্রেস ট্রেনে ফেরার টিকিট কাটা ছিল। তাই রাতের খাবার তাড়াতাড়ি খেয়ে আমরা ট্রেন ধরার উদ্দেশ্যে ৯.৩০ টার মধ্যে স্টেশনে পৌঁছে যাই। পরের দিন ভোর ৭ টার মধ্যে হাওড়া স্টেশনে চলে আসে।
এই দুই দিনের রাঁচি সফর ব্যস্ততার সাথে বেশ দারুণ উপভোগ করে কাটলো। তবে হাতে সময় থাকলে আরও ২-৩ দিন, নেতারহাট এবং বেতলা – এই দুটো জায়গাও একসাথে ঘুরে আসা যায়।
সরকারি ওয়েবসাইট থেকে হোটেল বুকিং করা যায়। ওখানে ২০০০ এবং ৩০০০ টাকার দু রকম রুম পাওয়া যায়। আমাদের দু দিন রাঁচির দর্শনীয় স্হান ঘুরতে গাড়ি ভাড়া প্রতিদিন ৩০০০-৩৫০০ টাকার মধ্যে পড়েছিল। স্হানীয় ডোকরার কাজের জিনিস বেশ বিখ্যাত। রাঁচি থেকে স্মারক হিসেবে কিনে আনা যায়।
ঝাড়খণ্ডের রাজধানী শহরে কাটানো এই দুটো দিন থেকে এইটুকু উপলব্ধি করলাম, বর্ষার সময়ে ঘুরে আসার জন্য আদর্শ জায়গা। কারণ জলপ্রপাত গুলো বৃষ্টিতে বেশ ভরভরন্ত, সেই সাথে চারপাশে সবুজের সমারোহ।
সামনের বর্ষাতে আপনারাও ঘুরে আসতে পারেন এই শহর থেকে।
দোলের ছুটিতে একদিনের জন্য মনের খোঁজে “মনচাষা”
দোলের ছুটিতে একদিনের জন্য মনের খোঁজে “মনচাষা”
গত বছর থেকে দোলের সময় বাড়িতে বা জন্মভিটেতে থাকতে মন চায় না। বাবা….. বড্ড ভালবাসতো রঙ মাখতে, ঐ দিন উঠোনে খালি গায়ে দাঁড়িয়ে প্রচ্ছন্ন সম্মতিতে বাচ্চা বুড়ো সবার হাত থেকে রঙ মেখে খুব খুশি মনে মিষ্টি চকলেট ভাগাভাগি করতো। তাঁর সেই স্মৃতি দোলের অনুভূতির সাথে মিশে,তাই গতবছর সে চলে যাওয়ার পরে পালিয়ে বেড়াই ঐ দিনটা চেনা গন্ডি থেকে অন্য কোথাও,দূরে অচেনার মাঝে।।
2024 সালে খুঁজতে খুঁজতে এক নতুন ঠিকানায় পৌঁছে গেলাম দোলের দিন সকালে… আমরা ৫ জন। সুন্দর সাজানো এক গ্রাম্য পরিবেশে নদীর পাড়ে “মনচাষা গ্রামীণ পর্যটন কেন্দ্র “। চারটি বাঁশের এবং চারটি মাটির তৈরি কটেজে রয়েছে সব রকম আধুনিক সুবিধার আয়োজন,কিন্তু সেই সাথে গ্রাম বাংলার আবেগ মেখানো।

পূর্ব মেদিনীপুরের এক ভিতরের গ্রাম পাউশিতে বাগদা নদীর ধারে এই অনন্য ভাবনার মিশেলে তৈরি ” মনচাষা ইকো ভিলেজ “। গেট পেরিয়ে দুপাশে বাঁধানো পুকুর, তার মাঝে গাছ গাছালি ঘেরা এক বাঁশের মাচানের খোলা বৈঠকখানায় এসে রাস্তার সব ধকল নিমেষে ঘুচলো। তারপর শুরু আতিথেয়তা, মহিলারাই এখানের সব দেখভাল করেন,সাথে অবশ্য ম্যানেজার মশাই ছেলেটি অমায়িক ব্যবহারের। মনে হলো যেন,কোন এক আত্মীয়ের গ্রামের বাড়িতে এসে বসলাম। খাটের দুপাশে বড় বড় পাখা দিয়ে সাজানো বিছানায় বসে দুপাশের হাওয়ায় চোখ বুজে আসছিল। সামনে সেই আমার ঠাকুমা যেমন চেয়ারে বসতো,আমাদের সেই পুরনো বাড়ির মত খোলা বারান্দায় রাখা চেয়ারগুলো আর টেবিলের সাজসজ্জা। সামনে অবশ্য ক্যারাম বোর্ড, লুডো, দাবার মত সব অবসর কাটানোর খেলার জিনিস মজুত। রান্নাঘর সহ সংলগ্ন ঘরগুলোর নামও বেশ মনকাড়া। ” তালা ভাঙার পাঠ”, “পাকশালা” এমন সব নামকরণ মাটি লেপা ঘরগুলোতে। আয়েশ করার জন্য ঐ বারান্দায় ছোট ছোট জলচৌকি, আবার দড়ির দোলনা রাখা,সাথে দেওয়াল জুড়ে গ্রাম বাংলার নানা ঐতিহ্য… ঝুড়ি,কুলো,খড়ের চাল, এর সাথে আবার বাচ্চাদের আঁকার জন্য একটা ক্যানভাসে সাদা আর্ট পেপার সহ রঙ পেনসিল।
আমাদের বসতে বলে এক দিদি লেবুর সরবত নিয়ে এলেন যখন, শরীর সহ মন জুড়ে বড় প্রশান্তি এলো।

এরপর ঐ দাওয়ার সামনের দুটো উঁচু মাচানের উপরে বাঁশের তৈরি ঘরে আমাদের একদিনের বসত ব্যবস্হা। চারপাশে ছোট্ট জলে পদ্মপুকুর, কিংবা ছোট্ট ছোট্ট ঘড়ের চালের নীচে দোলনা বা বসার মাচান করা। কতরকম ফলফুলের গাছ। এ সব ঘুরে ঘুরে আমাদের দেখার পালা চললো।একটা মাটির বাড়ির সামনে ঢেঁকি রাখাও ছিল। এরপর ঘরে গিয়ে বিশ্রাম নেওয়া…কিন্তু ঘরে গিয়ে তার আদল দেখে বেশ অবাক হলাম। কত্ত বড় বাঁশের ঘর। দুপাশে বড় বড় দুটো খাট, উঁচু সে ছাদ গম্বুজের মত, পরিষ্কার গামছা রাখা আমাদের জন্য, সাথে দুপাশের বিছানায় মশারীর ব্যবস্হা। ঘরের প্রতিটা কোণে যেমন যত্নের ছাপ,তেমনই ব্যালকনিতে বসার আলাদা রকম ব্যবস্হা। সব মিলিয়ে আমাদের ক্লান্তি কেটে গেল এমন কলুষমুক্ত নির্মল প্রাকৃতিক পরিবেশে এসে!! সবচেয়ে দেখার বিষয় হলো… ঘরের কোণে বা মাঝের বারান্দায় বসে থাকার জায়গায় “সহজ পাঠ” এর নানা ছোট্ট ছোট্ট উক্তি লেখা..
তারপর একটু সাজগোছ করে পুকুর পাড়ে গিয়ে আবির রঙে রাঙা হলাম আমরা। নির্জন পরিবেশে নিজেদের মধ্যে এই রঙ খেলা… এক অন্য অনুভব জাগালো। হঠাৎ দেখলাম গ্রাম থেকে একদল কিশোরী দল এসে আমাদের গালে রঙ ছুঁয়ে গেল। তারপর একজন অল্প বয়সী মহিলা এসে পায়ের জুতো খুলে আমাদের আবির রাঙা প্রণাম জানালেন,সাথে মিষ্টিমুখ করাতে চকলেট দিলেন। এমন আন্তরিকতায়,সত্যি মুগ্ধ হলাম… বাড়ির বাইরে এসেও এমন করে কেউ সেই পাড়ার রঙ খেলার আমেজ এনে দিতে পারে!!
এরপর দুপুরে স্নান সেরে দুপুরের ভোজের আয়োজন দেখে কেমন পেটে ইঁদুর দৌড়তে লাগলো। বলে রাখি,বাথরুমে গিজার সহ কমোডের সব ব্যবস্হা ছিল। তাই স্নানের কোন অসুবিধাও হয় নি।
কাঁসার থালায় সাজানো গয়না বড়ি সহ নানা রকম ভাজা শাক ডাল, সাথে দুই রকম মাছ, চাটনি, মিষ্টি, লাউ চিংড়ি, পাঁচমিশালি সবজি সহ প্রতিটা পদ ভীষণ উপাদেয় এবং ঘরোয়া। সেই সাথে ঐ দিদিদের আতিথ্য, বারে বারে খাবারের খোঁজ নেওয়া… বহুদিন পরে দুপুরের একসাথে এমন খোলা পরিবেশে বসে খাবার অভ্যাসকে উপভোগ্য করলো।
বিকেলের পরিবেশ কেমন মায়া জড়ানো,সামনে ছোট নদী, রোদ পড়ে যাচ্ছে… চারপাশে কোথাও যেন সেই সহজপাঠের গল্পগাঁথা সত্যি হয়ে উঠছে। সন্ধ্যায় চায়ের আসর, সাথে নানা বয়ামে রাখা ঝুড়ি ভাজা,চানাচুর, বিস্কুটের বাহার। সেদিন আমরা ছাড়াও আরও দুটো পরিবার ওখানে সন্ধ্যার আসরে এলো। বাচ্চা সহ বড়রা নানা রকম খেলায় মেতে উঠলো,মনেই হলো না যে এরা সদ্য পরিচিত,ঐ খোলা বারান্দা কখন যেন আমার ছোট্ট বেলায় দেখা বিকেলের উঠানের মত হয়ে গেলো,যেখানে বাবা কাকারা ক্যারাম খেলতো, মায়েদের সাথে আমরা লুডো, আবার দাদারা দাবা খেলতো। ঠিক এমন পারিবারিক পরিবেশে গল্প করার ফাঁকে ঐ দিদিরা সবাইকে চা এর সাথে তেলে ভাজা মেশানো মুড়ি মাখা দিলেন। সন্ধ্যার আসর জমে গেল এমন করেই জমজমাটি… তবে সেদিন বৃষ্টি শুরু হওয়ায় চারপাশে অন্যরকম আবহাওয়াও তৈরি হয়। এরপর রাতে আবারও রুটি অথবা ভাতের সাথে একই রকম সবজি ডাল সহ মাংসের ঝোল,সাথে রাবড়ি। ঘরোয়া এমন খাওয়া দাওয়া, সাথে কাঁসার থালা গ্লাসে পরিবেশন… আলাদা রকম এক ছোঁয়া এনেছে।

আবার ঘরে ঘরে ঐ দিদিরা রাতে গিয়ে মশারী টাঙিয়ে দিয়ে আমাদের আরও আপনজনের অনুভূতি জাগালেন।
আমাদের সঙ্গী আমার বান্ধবীর সেদিন খুব শরীর খারাপ ছিল। ওখানের দিদিরা অত্যন্ত যত্নের সাথে ওর দেখভাল করেন। গরম জলের ভাঁপের ব্যবস্হা সহ রাতে সরষের তেল হাতে পায়ে দেওয়া… সবটায় খুব আন্তরিকভাবে সাহায্য করেন ওরা।
পরের দিন সকালে চারপাশে নানা রকম পাখির ডাকে ঘুম ভাঙে। তারপর ঘুম চোখে সামনের নদীর দিকে তাকিয়ে চোখের আরাম এলো। এমন দৃশ্য তো আমাদের রোজের জীবনে ঘটে না!! তারপর সকালের চা বিস্কুট খেয়ে স্নান সেরে একেবারে ফিরে যাওয়ার প্রস্তুতি। সকালের জলখাবারে আবারও নতুনত্ব। ছোট্ট ছোট্ট বেতের ঝুড়িতে কলা রাখা, তারপর লুচি আর সাদা আলুর তরকারি। সেই সাথে কতরকমের আচারের আয়োজন। মিষ্টিও এলো বাহারি। জিভে লেগে থাকা এমন সুন্দর লুচি আলু চচ্চড়ি খেয়ে এবার বাড়ি ফেরার জন্য পা বাড়ালাম । আরেকবার চারদিক ঘুরে যখন গাড়ির দিকে যাচ্ছি,তখন ঐ দিদিরা কত আপনজনের মত বললেন যে, আবার আসবেন।। মনে হলো… একটাদিন আত্মীয় বাড়ি কাটিয়ে ফিরছি। ওনাদের আতিথেয়তায় আরও ভালো কাটলো এই একটা দিন।
কলকাতা থেকে প্রায় ১৫০ কিমি দূরে মনচাষাতে পৌঁছাতে প্রায় ৩ ঘন্টা সময় লাগে। ওখানে পৌঁছানোর ঠিকানা —–
কোলাঘাট ছাড়িয়ে নন্দকুমার হয়ে দীঘা যাওয়ার রাস্তায়, হেড়িয়া পেরিয়ে কালিনগর বাসস্টপ থেকে ডান দিকে গ্রামের রাস্তায় মনচাষা গ্রামীন পর্যটন কেন্দ্র।
থাকা সহ সমস্ত বেলার খাবার খরচ – তিনজনের ৯০০০ টাকা মত। এছাড়া গাড়ি নিয়ে গেলে ড্রাইভারের আলাদা থাকার ব্যবস্হা আছে।
এমন ঘরোয়া গ্রাম্য পরিবেশ তৈরি করে অপূর্ব থাকার ব্যবস্হাপনা করার ধারণা রুচিশীলতার পরিচয় বহন করে। এর জন Nilanjan Basu মহাশয়কে অনেক শুভকামনা রইলো