দীপান্বিতা
নাগিব মাহফুজ
তাঁকে বলা হয় ইজিপ্টের বালজাক, যিনি আরব দুনিয়ার প্রথম লেখক হিসেবে নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন ১৯৮৮ সালে। শেষ বয়সে প্রায় অন্ধ হয়ে গিয়েছিলেন, তবুও তিনি লিখে যেতেন। মুসলিম মৌলবাদীদের চক্ষুশূল মাহফুজ অনেক লেখক ও বুদ্ধিজীবীদের মত জীবদ্দশায় হিট লিস্টে ছিলেন। তাঁর অপরাধ অনেক। ইরানের ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ রুহল্লা খোমেইনি যখন সলমন রুশদিকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছিলেন তখন তিনি রুশদির পক্ষে কথা বলেছিলেন। অবশ্য পরে রুশদির লেখা স্যাটানিক ভারসেস পড়ে তাঁর মনে হয়েছিল, ইসলাম ধর্মের কাছে সেটি এক অপমান। ১৯৭৮ সালে প্রেসিডেন্ট আনোয়ার সাদাত ইসরাইলের সঙ্গে যে ক্যাম্প ডেভিড শান্তি চুক্তি করেছিলেন মাহফুজ তা সমর্থন করেন। এসব কারণেই মধ্যপ্রাচ্যের বহু দেশে তাঁর বই বর্জন করা হয়েছিল। তাঁর লেখা দ্যা চিলড্রেন অফ জেবেলাউই বইটি লেবানন ছাড়া সমগ্র দুনিয়ায় নিষিদ্ধ হয়েছিল। ১৯৯৪ সালে বাড়ির কাছে মাহফুজকে কিচেন নাইস দিয়ে হত্যার চেষ্টা করা হয়। গলায় বেশ আঘাত পান তিনি। ইজিপ্টের দুই ইসলামিক সন্ত্রাসবাদীকে এই অপরাধে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছিল।
কায়রো শহরের গামালিয়াতে জন্ম নাগিব মাহফুজের। প্রথমে তাঁর পরিবার থাকত আল জামালিয়া অঞ্চলে। পরে সেখান থেকে শহরতলীর আল আব্বাসিয়া অঞ্চলে তাঁরা চলে যান। লেখকের বহু লেখায় পটভূমিকা হয়ে এসেছে অঞ্চল দুটি। তাঁর বাবা ছিলেন সরকারি চাকুরে। মাহফুজ তাঁকে বলতেন প্রাচীনপন্থী। পরে তিনি নিজেও বাবার মতই সরকারি চাকুরে হয়েছিলেন। ছোটবেলায় মাহফুজ প্রচুর বই পড়তেন। তাঁর মা তাঁকে প্রায়ই জাদুঘরে নিয়ে যেতেন। মাহফুজের অনেক বইতে ইজিপ্টের ইতিহাস পরবর্তী সময়ে তাই মুখ্য হয়ে উঠেছিল।

১৯১৯ সালে ইজিপ্টের বিদ্রোহ তাঁর মধ্যে গভীর প্রভাব ফেলেছিল। তখন তাঁর ৯ বছর বয়স। ঘরের জানালা দিয়ে হামেশাই দেখতেন ইংরেজ সৈন্যরা নারী-পুরুষ নির্বিশেষে বিক্ষোভকারীদের গুলি করে মারছে। ওইসব দৃশ্য দেখে বাচ্চা বয়সে তিনি বেশ ভয় পেতেন।
কায়রো বিশ্ববিদ্যালয়ে মাহফুজ দর্শন নিয়ে পড়াশোনা করতেন। এক বছর এম এ পড়ার পর পেশাদার লেখক হবেন বলে সিদ্ধান্ত নিলেন। সাংবাদিক হিসেবে আল রিসালা সংবাদপত্রে কাজ নিয়ে লিখতে লাগলেন আল হিলাল ও আল আহরাম কাগজে।
মাহফুজ ৪০টি উপন্যাস ছাড়াও প্রচুর ছোট গল্প, অনেক নাটক ও ৩০টি স্ক্রিনপ্লে লিখেছিলেন। প্রথম দিকে তিনি লিখতেন আর্টিকেল ও ছোট গল্প। বিভিন্ন ম্যাগাজিনে এমন আশিটি লেখা ছাপা হয়েছিল। প্রাচীন ইজিপ্টের ওপর লেখা জেমস বাইকির একটি বই তিনি অনুবাদ করেছিলেন। ওই অনুবাদ তাঁর প্রথম প্রকাশিত বই। তাঁর প্রথম গল্প সংগ্রহ প্রকাশ পায় ১৯৩৮ সালে। পরের বছর সরকারি চাকরি নিয়ে ৩৫ বছর সেখানে কাটান। প্রায় ১৫ বছর সরকারি আমলা হিসেবে কাজ করেন ইসলামিক অ্যাফেয়ার্স মন্ত্রকে। পরে রাষ্ট্রীয় চলচ্চিত্র বিভাগ ছাড়াও সংস্কৃতি মন্ত্রকে তিনি চাকরি করেছিলেন। বিয়ের পর পারিবারিক আবাস আল-আব্বাসিয়া ছেড়ে তিনি এক নতুন অ্যাপার্টমেন্টে চলে আসেন যেখান থেকে নীল নদের শোভা দেখা যেত।
ঐতিহাসিক উপন্যাস আবাথ আল আকদার, রাদুবিস এবং কিফা টিবাহ ছোট্টবেলার বাসস্থান আল-জামালিয়াকে কেন্দ্র করে লেখা। স্যার ওয়াল্টার স্কটের আদর্শে অনুপ্রাণিত মাহফুজ ইতিহাস নিয়ে ৩০ টি ধারাবাহিক উপন্যাস লিখবেন ঠিক করেছিলেন। তবে ওই তিনটি উপন্যাস লিখেই তাঁর উৎসাহ নিভে গিয়েছিল। সমসাময়িক দুনিয়ার সাধারণ মানুষ এবং তাদের সামাজিক ও মানসিক গতিপ্রকৃতি তাঁর আগ্রহ সৃষ্টি করেছিল।
পঞ্চাশের দশকে মাহফুজ সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য কাজ করেছেন পনেরশো পাতার দ্য কায়রো ট্রিলজি প্রকাশ করে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ থেকে পঞ্চাশের দশক, রাজা ফারুকের সিংহাসনচ্যুত হওয়া পর্যন্ত কায়রোর ঘটনাবলী নিয়ে বহুবর্ণ চরিত্র সমন্বয়ে এই উপন্যাসত্রয়ী যা মাহফুজকে বালজাক, ডিকেন্স, তলস্তয় ও গল্সওয়ার্দির সমমর্যাদা সম্পন্ন করে তুলেছে।
এটা আশ্চর্যের বিষয় যে তাঁকে নোবেল প্রাইজ দেওয়া হয় যে কাজের জন্য তা অন্তত তিন দশক আগে প্রকাশিত হয়েছিল। মাহফুজ ইজিপ্টের বাইরে প্রায় যানইনি কোনদিন। তাঁর হয়ে নোবেল পুরস্কার নেওয়ার জন্য তিনি তাঁর মেয়েদের পাঠিয়েছিলেন।
শেষ বয়সে মাহফুজ প্রায় অন্ধ হয়ে গিয়েছিলেন। তবুও তিনি লিখে যেতেন যদিও কলম ধরতে বেশ কষ্ট হত। কফি হাউসে নিয়মিত বন্ধুদের সঙ্গে মেলামেশা ছাড়তে হয়েছিল তাঁকে। কায়রো শহরে তাঁর মৃত্যু হয় ২০০৬ সালে।