দীপান্বিতা

আন্দ্রে জিদ 

এক বিতর্কিত চরিত্র। বিশ্বমানের সাহিত্য সৃষ্টি করে পুরস্কার পেলেও তাঁর মৃত্যুকালে তিনি পৃথিবীর মাত্র দু’জন সাহিত্যিকের মধ্যে একজন ছিলেন যাঁর সমস্ত সাহিত্যকর্ম রোমান ক্যাথলিক ধর্মাশ্রয়ীদের পাঠ নিষিদ্ধ বলে নির্ধারিত হয়েছিল। অথচ তাঁর জীবনের সূচনা ঘটেছিল ধর্মকে আশ্রয় করেই। তাঁর প্রায় সমস্ত সাহিত্যকর্মেই তিনি নিজেকে অনুসন্ধানের চেষ্টা করেছেন। ব্যক্তিগত জীবনের প্রতিফলন ঘটেছে সব লেখায়। সঙ্গে অবশ্যই চারপাশের জগৎটাকেও তুলে এনেছেন। তিনি আন্দ্রে জিদ।

১৮৬৯ খ্রিস্টাব্দে তাঁর জন্ম প্যারিস শহরে। প্যারিস বিশ্ববিদ্যালয়ে বাবা ছিলেন আইনের অধ্যাপক। জিদের এগারো বছর বয়সের সময় তাঁর বাবা মারা যান। তাতে অবশ্য আর্থিক কোন কষ্টে তাঁকে পড়তে হয়নি জীবনে। তাঁর মা ছিলেন বিত্তশালী পরিবারের মেয়ে। অনেক ধনসম্পত্তি ছিল তাঁর। ছেলে সম্পর্কে মায়ের ছিল অস্বাভাবিক ভাবনাচিন্তা। ছেলের স্বাস্থ্য খারাপ ভেবে তিনি তাঁকে স্কুল থেকে ছাড়িয়ে আনেন। লেখাপড়া শেখার জন্য গৃহশিক্ষক ঠিক করে দেন। প্রোটেস্ট্যান্ট ধর্মের আবহে তিনি বড় হতে থাকেন। ছোটবেলা থেকেই বাইবেল মুখস্থ করা ছিল তাঁর অবশ্য কর্তব্য। 

কুড়ি বছর বয়সে জিদের প্রয়োজনীয় পড়াশোনা শেষ হয়। টাকাপয়সার কোন চিন্তা ছিল না। জিদ সিদ্ধান্ত নেন, জীবন কাটাবেন সাহিত্যসৃষ্টি আর ভ্রমণ করে। বছর দুয়েক পর প্রকাশ পায় আত্মবিশ্লেষণমূলক তাঁর প্রথম রচনা দা নোটবুকস অফ আন্দ্রে ওয়াল্টার। প্যারিস শহরের বুদ্ধিজীবীদের ঘরোয়া আসরেও তিনি যাতায়াত শুরু করেন। এই যাতায়াত থেকেই তাঁর উত্তর আফ্রিকা সফরের সূচনা শুরু হয়। সঙ্গে ছিলেন এক তরুণ চিত্রকর পল অ্যালবার্ট লরেন্স। এই চিত্রকরকে জড়িয়ে জিদ সম্পর্কে অনেক কুৎসা শোনা গিয়েছিল।

আন্দ্রে জিদের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে রয়েছে যে কেলেঙ্কারির ইতিহাস তা হল সমকামিতা। দ্বিতীয়বার উত্তর আফ্রিকা সফরের সময় তাঁর সঙ্গে দেখা হয় ইংরেজ সাহিত্যিক অস্কার ওয়াইল্ডের। এই সাক্ষাৎকারের প্রভাব জিদের জীবনে ও কাজে বেশ গভীরভাবে পড়েছিল। ওয়াইল্ড সম্পর্কেও রয়েছে সমকামিতার কুৎসা। দা ফ্রুটস অফ দা আর্থ উপন্যাসে জিদ এই সফরের নিষিদ্ধ বিষয়গুলি লিখে গেছেন। 

জিদ তাঁর জীবনের বাস্তবতার সঙ্গে ধর্মীয় নৈতিকতাকে কিছুতেই মেলাতে পারছিলেন না। ছোটবেলাতেই ভাব হয়েছিল তুতো বোন ম্যাদেলিন রনদিউ-এর সঙ্গে, ২৫ বছর বয়সে জিদ তাঁকে বিয়ে করেন। বিয়েটা যে একটা ভন্ডামি জিদ দা ইমমোরালিস্ট এবং স্টেট ইজ দা গেট উপন্যাস দুটিতে খোলাখুলি জানিয়েছেন। এসব সত্বেও তাঁদের দাম্পত্যজীবন ৪২ বছর স্থায়ী হয়েছিল যা একদিক থেকে একটা রেকর্ড। 

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় জিদ প্যারিসে রেড ক্রস সংস্থার হয়ে কাজ করেন। এখানেই তাঁর সঙ্গে পরিচয় হয় মার্ক অ্যালেগ্রেট নামে এক ব্যক্তির। জিদ তাঁর সঙ্গে ভালোবাসা ও নিষিদ্ধ সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েন। তাঁর স্ত্রী ম্যাদেলিন স্বামীর এসব কীর্তির কথা শুনে এমন খেপে যান যে জিদ তাঁকে যত চিঠি লিখেছিলেন সব পুড়িয়ে ফেলেন। জিদ তাতে খুব দুঃখ পান। উত্তরে তিনি সমকামিতাকে প্রতিষ্ঠা করতে লেখেন করিডন এবং আত্মজীবনী ইফ আই ডাই। বই দুটিতে সবকিছু এত খোলাখুলি তিনি লিখেছিলেন যে পরিচিত বন্ধু ও বিদগ্ধজনেরা তাঁকে সম্পূর্ণ বর্জন করেন। পরবর্তী সময়ে জিদ মার্কসবাদের খুব ভক্ত হয়ে ওঠেন এবং কমিউনিজমের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করতে থাকেন। তার কারণটা অবশ্য বেশ মজার। যেহেতু রাশিয়াতে লেনিন ঘোষণা করেন যে সমকামিতা অপরাধ নয় তাই জিদের এত কমিউনিজমপ্রীতি। অবশ্য কয়েক বছর পর খুব উৎসাহ নিয়ে রাশিয়া সফরে গিয়ে তাঁর মোহভঙ্গ ঘটেছিল। 

১৯৪৭ সালে তাঁকে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়েছিল। তাঁর মৃত্যু হয় ১৯৫১ খ্রিস্টাব্দে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *