দীপান্বিতা 

ভার্গাস লোসা

বিশ্ববন্দিত ঔপন্যাসিক। দক্ষিণ আমেরিকার পেরুতে তাঁর জন্ম ১৯৩৬ সালে। ম্যাজিক রিয়ালিজম সাহিত্যের অন্যতম প্রাণপুরুষ। জন্মের কিছুদিন পরই তাঁর বাবা ও মায়ের মধ্যে বিচ্ছেদ ঘটে যায়। তাঁকে নিয়ে তাঁর মা চলে যান বলিভিয়াতে নিজের বাবার কাছে যেখানে ভদ্রলোক পেরুর দূতাবাসে কর্মরত ছিলেন। দাদুর সঙ্গে বেশ স্বাচ্ছন্দের মধ্যেই থাকতেন তিনি ও তাঁর মা। আট বছর ছিলেন তিনি এই পরিবেশে। দিনরাত কেবল অ্যাডভেঞ্চারের গল্প পড়তেন। গল্পগুলি যেখানে শেষ হত লোসা তা পছন্দ করতেন না। তিনি তাই প্রত্যেকটি গল্পের শেষে আরও অতিরিক্ত অধ্যায় নিজে বানিয়ে নিতেন।

শিগগিরই বাবা আর মায়ের বিরোধ মিটে যায়। লোসার বয়স তখন দশ। তাঁরা আবার পেরুতে চলে আসেন। খুব কবিতা লিখতে শুরু করেন তিনি। বাবার সঙ্গে এই নিয়ে অশান্তি। কবিতা মোটেই পছন্দ করতেন না ভদ্রলোক। ছেলের মতিগতি দেখে তিনি বেশ ভয় পেতেন। ছেলে না শেষে লেখক হয়ে যায় এই আশঙ্কা থেকে মুক্তি পেতে তিনি ছেলেকে লিওনাসিও প্রাদো মিলিটারি স্কুলে ভর্তি করে দেন। সৈনিক স্কুলের কঠোর নিয়ম-কানুনের মধ্যে পড়লে নিশ্চয় ছেলের সাহিত্যপ্রীতি ঘুচে যাবে। ব্যাপারটাকে লোসার মনে হয়েছিল এক নিষ্ঠুরতা। সৈনিক স্কুলের পরিবেশ তাঁর একেবারেই পছন্দ হয়নি। এই বিরুদ্ধ পরিবেশ তাঁর মধ্যে এক বিপরীত প্রভাব ফেলেছিল। গোপনে তাঁর সাহিত্যপ্রীতি বজায় রাখতে তিনি বদ্ধপরিকর হয়ে ওঠেন। লিখতে থাকেন প্রাণমন দিয়ে এবং প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হন যে এভাবেই প্রচলিত সমাজ ব্যবস্থার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ জানাবেন।

১৯৬২ সালে তাঁর বয়স যখন ২৬ তখন তাঁর প্রথম উপন্যাস দা টাইম অফ দ্য হিরো প্রকাশিত হয়। এই বইতে মিলিটারিদের খুব কঠোর ভাষায় নিন্দা করেছিলেন তিনি। বেশ কয়েকটি সাহিত্য পুরস্কার পায় এই উপন্যাস। সবাই এর উচ্চ প্রশংসা করে কিন্তু লিওনাসিও প্রাদো মিলিটারি স্কুলের কর্তৃপক্ষ উপন্যাসটি পড়ে প্রচন্ড খেপে যায়। তাদের হুকুমে এই বইয়ের কয়েক হাজার কপি জনসমক্ষে পোড়ানো হয়। 

উপন্যাসটির প্রধান আলোচ্য বিষয় ছিল সেই সব ব্যক্তিবর্গ এবং বিধিনিষেধ যা পেরুর লেখকদের প্রায়ই এড়িয়ে যাওয়া ছাড়া উপায় থাকে না। উপন্যাসের চরিত্রগুলি ফ্যান্টাসিতে মুড়ে দিয়ে ভার্গাস লোসা এক অনবদ্য আবহাওয়া সৃষ্টি করেছেন। বাস্তব জীবন ও কল্পনা পরস্পর সংবদ্ধ হয়ে কিভাবে এক বিশেষ বাস্তবতার উৎপত্তি ঘটায় যা ওই দুটি উপাদানের কোন একটিকে বাদ দিয়ে থাকতে পারে না, এই ব্যাপারটাকে অনুসন্ধান করাই আসলে লোসার লেখালেখির অন্যতম মূল আকর্ষণ।

আর এখানেই রচনাশৈলীতে ম্যাজিক রিয়ালিজমকে আশ্রয় করা অনিবার্য হয়ে ওঠে। ল্যাটিন আমেরিকান সাহিত্যে হোরহে লুইস বোর্জেস এই বিশেষ ধারার উদ্ভাবক, দার্শনিক রহস্যসমূহ আবিষ্কারের উপায় হিসেবে তাঁর গল্পগুলিতে ফ্যান্টাসির আশ্রয় নিয়েছিলেন তিনি। তাঁর উত্তরসূরি সাহিত্যিকদের রচনায় এই প্রকরণ সমৃদ্ধ হয়ে উদ্ভব ঘটায় ম্যাজিক রিয়ালিজমের। এই বাস্তবতা দেখায় যে পৃথিবী ও মানব সমাজের স্বাভাবিক বাইরের চেহারাটার ভিতরে গোপন রয়েছে অন্য এক বাস্তবতা যা আমরা কেউ খালি চোখে দেখতে পাই না। ভার্গাস লোসা ছাড়াও এই বিশেষ সাহিত্যরীতির স্থপতিকার হিসেবে গাবরিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ, কার্লোস ফুয়েন্টেস ও অ্যালজো কার্পেন্টিয়ের সারা বিশ্বে পরিচিত। 

১৯৬৭ সালে লোসার সঙ্গে মার্কেজের দেখা হয় ক্যারাকাস শহরে। তাঁরা দুজনে একসঙ্গে কাহিনী রচনার শিল্পকলা নিয়ে সর্বসাধারণের সঙ্গে ধারাবাহিক আলোচনায় যোগ দেন। সমাজে উপন্যাসের লক্ষ্য কী এই বিষয়ে ভারগাস লোসার ধারণা এ সময় বেশ পরিণত হয়ে ওঠে। তাঁর ধারণায় উপন্যাস হলো লেখকদের লড়াই করার একটি মাধ্যম এবং এর সাহায্যে লেখকরা মানবিক বাস্তবতায় পরিবর্তন আনার চেষ্টা করেন। উপন্যাস একই সঙ্গে কোন ব্যক্তির অতীত সময়কে বাঁচিয়ে রাখে এবং ব্যক্তি সত্ত্বাকে অশুভ প্রভাব মুক্ত করে।

সত্তরের দশকে লোসা ভীষণভাবে রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। ১৯৮১ সালে তিনি লেখেন দা ওয়ার অফ দা এন্ড অফ দ্য ওয়ার্ল্ড যে লেখায় ল্যাটিন আমেরিকার ইতিহাসে রাজনৈতিক গোঁড়ামির প্রবল নিন্দে করা হয়। কাহিনীর পটভূমিকায় থাকে উনবিংশ শতাব্দীর ব্রাজিল, এখানে ইতিহাসে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলির সঙ্গে কল্পনার মিশ্রণ ঘটিয়ে চরিত্রগুলির মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ করা হয়। লোসা দেখিয়েছেন যে ইতিহাসও আসলে এক কল্পকাহিনী এবং এ-সম্পর্কে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি ভবিষ্যৎ পাল্টে দিতে পারে।

নব্বইয়ের দশকের শুরুতে ভার্গাস লোসা তাঁর রাজনৈতিক মতাদর্শকে কেবল লেখার জগতে সীমাবদ্ধ না রেখে বাস্তবে প্রয়োগ করতে চান। পেরুর রাষ্ট্রপতি হওয়ার নির্বাচনে তিনি আলবার্টো ফুজিমোরি-র সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নামেন। তিনি হেরে যান আর ফুজিমোরি পেরুতে কায়েম করেন স্বৈরাচারী ও দুর্নীতিপরায়ণ এক শাসনতন্ত্রের।

ভার্গাস লোসা কিন্তু লেখা থামাননি কোন অবস্থাতেই। ২০০২ সালে প্রকাশিত হয়েছে দা ফিস্ট অব দ্য গোট উপন্যাস যেখানে ইতিহাস ও কল্পনার সঙ্গে রাজনৈতিক অন্তর্দৃষ্টি মিশিয়ে ভার্গাস লোসা এক স্বৈরাচারী একনায়কের শাসন বিশ্লেষণ করেছেন। এছাড়া আন্ট জুলিয়া অ্যান্ড দা স্ক্রিপ্টরাইটার এবং আ ফিস ইন দ্য ওয়াটার হল ভারগাস লোসার অন্য দুটি বিখ্যাত রচনা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *