দীপান্বিতা 

মিলান কুন্দেরা

বুদ্ধিজীবীদের পৃথিবী যাদের পছন্দ তাদের জন্য মিলান কুন্দেরা সৃষ্টি করেছেন উজ্জ্বল সব হিউমার। তাঁর উপন্যাসগুলিতে রয়েছে বিসদৃশ্য উৎসবানুষ্ঠান, পাগলাটে বিজ্ঞানী, সুইমিং পুল ঘিরে থাকা উশৃংখল লোকজন, হতাশ কবিদের কাহিনী।  মানুষের অস্তিত্ব নিয়ে গবেষণার সঙ্গে তাঁর লেখায় মনোরমভাবে পরিবেশিত হয়েছে নানা অস্পষ্ট ধ্যান-ধারণা ও বিভ্রান্তি।  তাঁর মতে, পাঠককে ঔপন্যাসিক বোঝাবেন পৃথিবী একটা বড় প্রশ্ন। পৃথিবীতে সব যদি নিশ্চিত হয়ে যায় উপন্যাসের মৃত্যু ঘটবে।কুন্দেরা তাঁর চরিত্রগুলির বাহ্যিক চেহারার চেয়ে ভিতরের চেহারা নিয়ে বেশি মাথা ঘামিয়েছেন। তিনি বলেছেন যে পাঠকের কল্পনা স্বয়ংক্রিয়ভাবে লেখকের দৃষ্টিভঙ্গিতে সম্পূর্ণতা আনে। তাঁর ধারণায়, কারও চরিত্রের প্রয়োজনীয় বিষয় তাঁর বাহ্যিক চেহারা, এমনকি মানসিক গঠনও নয় বরং গুরুত্বপূর্ণ সেইসব বিষয় যা চরিত্রগুলিকে ভাঙাগড়া করে। নির্বাসন, অস্তিত্ব, ভালোবাসা-শিল্প-ভাবগম্ভীর সীমানা বহির্ভূত জীবন নিয়ে রচিত কুন্দেরার চরিত্রগুলিতে অস্পষ্টতা একটা ধরন এবং প্রায়ই দেখা যায় একাধিক মূল চরিত্র। একই উপন্যাসে দেখা যাবে কোন মূল চরিত্র কোথায় হারিয়ে গেল আর উপন্যাস এগিয়ে গেল অন্য এক চরিত্র নিয়ে।

কুন্দেরার জন্ম ১৯২৯ সালে চেকোস্লোভাকিয়ার এক শহরে মধ্যবিত্ত ও সুসংস্কৃতি সম্পন্ন পরিবারে। তাঁর বাবা লুটভিক কুন্দেরা ছিলেন সংগীত বিশারদ ও পিয়ানোশিল্পী। কুন্দেরা তাঁর কাছেই পিয়ানো বাজাতে শেখেন এবং পরে সংগীততত্ত্ব ও সংগীত রচনা নিয়ে পড়াশুনা করেন। তাঁর রচনায় সংগীত এক অপরিহার্য উপাদান হিসেবে উপস্থিত থেকেছে।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জার্মান সেনা চেকোস্লোভাকিয়া দখল করে নিলে কুন্দেরা মার্কস তত্ত্বে আকৃষ্ট হন এবং কমিউনিস্টদের দলে নাম লেখান যারা ১৯৪৮ সালে ক্ষমতায় আসে তাঁর দেশে। ১৯৫০ সালে কুন্দেরা ও অন্য লেখক জ্যান ট্রেফুলকাকে দলবিরোধী কাজকর্মের জন্য অবশ্য দল থেকে বহিষ্কার করা হয়েছিল। আসলে মার্কসীয় যে দর্শন কুন্দেরাকে আকৃষ্ট করেছিল সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রীয় শাসন তেমন ছিল না বাস্তবে। তাঁর প্রথম সাহিত্যসৃষ্টি ছিল দা ওনার্স অফ দ্য কিজ, কবিতা ও নাটকের প্রকাশ, সম্পূর্ণভাবে কমিউনিজমের প্রচারসর্বস্ব হলেও রাষ্ট্রগৃহীত শাসনতন্ত্রের পক্ষে কথা বলেনি। মানবতার লক্ষ্যে সমাজতন্ত্র মতবাদ নিয়ে তৈরি হয়েছিল প্রাগ স্প্রিং নামে এক স্বল্পস্থায়ী আন্দোলন যাতে কুন্দেরা যোগ দেন এবং সাহিত্যে রাষ্ট্রীয় হস্তক্ষেপ নিয়ে জোড় প্রতিবাদ জানাতে থাকেন।

প্রাগের চার্লস বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সাহিত্য ও নন্দনতত্ত্ব নিয়ে কুন্দেরা পরে পড়াশুনা করেন। কিছুদিন পর  প্রাগের  অ্যাকাডেমি অফ পারফরমিং আর্টস্ বিভাগে তিনি ফিল্ম ফ্যাকাল্টিতে গিয়ে চিত্র পরিচালনা ও সংলাপ রচনা শিক্ষা নেন। স্নাতক হওয়ার পর ফিল্ম ফ্যাকাল্টিতে তিনি বিশ্বসাহিত্যে লেকচারার হন। ষাটের দশকে তিনি ছোট গল্প লিখতে শুরু করেন যা লাফেবল লাভস্ গ্রন্থে সংকলিত হয়। তাঁর মতে এগুলি তাঁর পরিণত কাজের শুরু। অনেক গল্পেই দেখা যায় কোন এক নির্দোষ আড়ম্বরকে যারা তৈরি করে এবং যারা উপভোগ করে তাদের জন্য শেষপর্যন্ত ধ্বংস ডেকে আনে। এভাবে তিনি বোঝাতে চেয়েছেন চেক কমিউনিজমের প্রকৃত চেহারা যা উদ্যোক্তাদের হাতের বাইরে চলে গিয়েছিল। ১৯৫৬ সালে কুন্দেরা আবার কমিউনিস্ট পার্টিতে ঢোকার সুযোগ পেলেও ১৯৭০ সালে আরও একবার বহিষ্কৃত হন। সঙ্গে ছিলেন ভাক্ল্যাভ হ্যাভেল-এর মত অন্যান্য বিখ্যাত লেখক ও শিল্পীরা। তবুও কুন্দেরা চেক কমিউনিজমকে পুনর্গঠন-এর চেষ্টা করে যেতে থাকেন। শেষপর্যন্ত ১৯৭৫ সালে তাঁকে সংস্কারের স্বপ্ন বিসর্জন দিয়ে ফ্রান্সে পালিয়ে যেতে হয়। ১৯৮১ সালে তিনি ফ্রান্সের নাগরিকত্ব লাভ করেন।

১৯৬৮ সালে চেকোস্লোভাকিয়ার ওপর রাশিয়া আধিপত্য বিস্তার করলে প্রাগ স্প্রিং আন্দোলনের ধ্বংস ঘটে। ১৯৬৭ সালে পার্টি থেকে বহিষ্কারের স্মৃতি নিয়ে কুন্দেরা দা জোক উপন্যাস লেখেন যেখানে এক তরুণ তার বান্ধবীকে বিরক্তিকর এক চিঠি লেখার জন্য রাজনৈতিক হেনস্থার শিকার হয়েছিল। রাশিয়ান কমিউনিস্টরা চেকোস্লোভাকিয়ায় এসে যাদের প্রথমেই অপছন্দ করে তাদের একজন কুন্দেরা। ফিল্ম ফ্যাকাল্টির পড়ানোর কাজ থেকে তাঁকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। তাঁর লেখা বইপত্র সমস্ত লাইব্রেরি ও বুকস্টোর থেকে শাসকরা সরিয়ে নিয়ে যায় এবং কোন নতুন বই প্রকাশের ওপর নিষেধাজ্ঞা বসে। তবুও কুন্দেরা লিখতে থাকেন এবং তাঁর উপন্যাস লাইফ ইজ এলজহয়ার এবং দ্যা ফেয়ারওয়েল পার্টি দেশের বাইরে প্রকাশিত হয়।

কমিউনিস্টদের কাছে ব্লাকলিস্টেড হয়ে কুন্দেরা ফ্রান্সে গিয়ে ১৯৭৯ সালে প্রকাশ করেন তাঁর বিখ্যাত আত্ম উপাখ্যানধর্মী লেখা দা বুক অফ লাফটার এন্ড ফর গেটিং যেখানে তিনি জানান সেসব চেক নাগরিকদের কথা যারা কমিউনিজম আগ্রাসনকে নানা উপায়ে বিরোধিতা করছে। ১৯৮৪ সালে প্রকাশ পায় তাঁর সর্বোত্তম বিখ্যাত উপন্যাস দা আনবিয়ারেবল লাইটনেস অফ বিয়িং যার চলচ্চিত্রায়ন ঘটান মার্কিন পরিচালক ফিলিপ কাউফম্যান। ব্যক্তির অনির্দিষ্ট ভাগ্য উপন্যাসের মূল বিষয়, যেখানে দেখানো হয়েছে, কোন একজন যেভাবে বেঁচে আছে হয়তো সেভাবে না-ও বাঁচতে পারত। পৌনঃপুনিকতা, পরীক্ষা-নিরীক্ষা এবং ভুল-শুদ্ধ নির্বাচনের কোন সম্ভাবনাই নেই।

নিজস্ব রাজনৈতিক বিশ্বাস থাকা সত্ত্বেও কুন্দেরা জোর দিয়ে সবসময় বলে এসেছেন যে উপন্যাস সম্পূর্ণভাবে শিল্পকর্ম হওয়া উচিত, কখনোই তা রাজনৈতিক মতাদর্শ প্রচারের মাধ্যম নয়। পরবর্তী সময়ে কুন্দেরা নিজেও তাঁর উপন্যাস থেকে রাজনীতি বর্জন করতে থাকেন, পরিবর্তে মুখ্য হয়ে ওঠে বৃহত্তর দার্শনিক ধ্যান-ধারণা। ১৯৯০ সাল থেকে তিনি ফরাসি ভাষায় লিখতে শুরু করেন। কুন্দেরার মতে, ইউরোপের চারজন বড় ঔপন্যাসিক হলেন ফ্রাঞ্জ কাফকা, হারম্যান ব্রখ, রবার্ট মুসিল এবং উইটোল্ড গমব্রউকজ্।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *