দীপান্বিতা
অ্যালবার্ট কামু
বিশ্ব সাহিত্যে যে ক’জন মহান ব্যক্তি নিজের চেয়েও সর্বসাধারণের মঙ্গল আর মানবতার কথা বেশি ভেবেছেন কামু তাঁদের মধ্যে একজন। মানুষের জন্য এত ভাবতেন বলেই জীবদ্দশায় অসম্ভব প্রিয় ছিলেন সবার কাছে। চিন্তাজগতে আলোড়ন তোলা নানা তত্ত্ব তিনি তাঁর উপন্যাস, নাটক, প্রবন্ধ ইত্যাদিতে জানিয়ে গেছেন। দুর্ভাগ্যক্রমে ১৯৬০ সালে মাত্র ৪৭ বছর বয়সে তিনি পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছিলেন। তাঁর মৃত্যু হয়েছিল অভিশপ্ত এক মোটর গাড়ি দুর্ঘটনায়।

মজার কথা এই যে মৃত্যুকে কেন্দ্র করেই কামু তাঁর বিশ্ববিখ্যাত অসম্ভবের তত্ত্ব নির্মাণ করেছিলেন। পৃথিবী জুড়ে চলছে তখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। ১৯৪০ সাল নাগাদ কামু চলে আসেন প্যারিসে।তাঁর সঙ্গে বন্ধুত্ব হয় সার্ত্রে ও সিমোন দ্য বুয়েবার-এর। এই পরিবেশেই কামু তাঁর নতুন দর্শন নির্মাণ করেন যা এক্সিস্টেনশিয়ালিজম-এর একটি শাখা এবং পরে সার্ত্রে এর নামকরণ করেন অ্যাবসার্ডিজম। এই মতবাদে জীবনের সমস্ত কিছুকেই অর্থহীন বলে মনে করা হয়, কারণ মৃত্যু আসলে কী মানুষের তা বোঝার কোন ক্ষমতাই নেই। এই বিচ্ছিন্নতাবাদ-এর ধারণাকে ভিত্তি করেই তিনি লিখেছিলেন দা স্ট্রেঞ্জার উপন্যাস। প্রায় একই সময়ে প্রকাশিত দা মিথ অফ সিসিফাস এবং দুটি নাটক ক্রস পারপাস ও ক্যালিগুলা-তেও তিনি পরিপূর্ণ অবিশ্বাস বা নিহিলিজমকে তুলে ধরেছিলেন। মৃত্যুভয় ও দারিদ্র্যের দুঃসহ অভিজ্ঞতা কামুর অন্য সব বিখ্যাত রচনারও বিষয়বস্তু হয়ে উঠেছিল। উদাহরণ হিসেবে নাপশিয়ালস, সামার এবং সংকলিত প্রবন্ধ গ্রন্থ দা রং সাইড অ্যান্ড দ্য রাইট সাইড-এর উল্লেখ করা যায়। খুবই দরিদ্র পরিবারে তাঁর জন্ম হয়েছিল বলেই দারিদ্র্যের বাস্তব জ্বালাটা তিনি জানতেন। পঞ্চাশের দশকের শুরুতে তিনি যখন সাংবাদিক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন তখনও তাঁর লেখা আর্টিকেল গুলির বিষয়বস্তু ছিল দারিদ্র্যপীড়িত আরবদের জীবন।
কামুর মধ্যে প্রবল ছিল অন্তর্দ্বন্দ্ব। অসম্ভবের মতবাদে নৈতিকতা থাকা না-থাকা সমান কামু এটা মানতে পারতেন না। জীবনকে অর্থহীন ভাবলেও জীবনের নৈতিক দিকগুলি অস্বীকার করা সম্ভব ছিল না তাঁর পক্ষে। নিজের জীবন ও বিশ্বযুদ্ধে বিপর্যস্ত ফ্রান্সের অভিজ্ঞতাগুলি তাঁকে নৈতিক দায়দায়িত্ব সম্পর্কে উদাসীন থাকতে দিত না। এসব বিষয় নিয়েই তিনি লিখেছিলেন লেটার্স টু আ জার্মান ফ্রেইন্ড । পরবর্তী সময়ে কামু নিজের দেখানো অসম্ভবের তত্ত্বে নিজেই বিরক্ত হয়ে পড়েন ও নৈতিক দায়-দায়িত্বভিত্তিক মানবতাকে প্রবলভাবে প্রতিষ্ঠা দেওয়ার পন্থা খুঁজতে শুরু করেন। রূপকধর্মী উপন্যাস দা প্লেগ এই প্রচেষ্টারই ফলশ্রুতি যেখানে মহামারী প্লেগ-এর বিরুদ্ধে মানুষের বেঁচে থাকার লড়াই দেখানো হয়েছে যা প্রকৃতপক্ষে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের বিরুদ্ধে মানুষের সংগ্রামের বিবরণ। অশুভ যুদ্ধ মানুষ বর্জন করতে পারবে কিনা উপন্যাসে কাম স্পষ্ট সে সম্পর্কে কিছু জানাননি, সমস্ত কাহিনী জুড়ে তিনি কেবল মানুষের মর্যাদাবোধ আর মানবতার জয়গান শুনিয়ে গেছেন। একসময় তিনি একটি জার্নালের সম্পাদনাও করেছিলেন আর সেখানেও রাজনীতি যে কঠোরভাবে নৈতিকতা নির্ভর হওয়া উচিত এটাই ছিল তাঁর সম্পাদকীয় গুলির বক্তব্য।
সমসাময়িক দিকপাল দার্শনিক জাঁ পল সার্ত্রের সঙ্গে কামুর মতবিরোধ আর কলহে জড়িয়ে গিয়েছিলেন। কামু একইসঙ্গে খ্রিস্টধর্মের ঈশ্বরবাদ ও মার্কসের রাজনৈতিক ইউটোপিয়াকে প্রবলভাবে আক্রমণ করেছিলেন। হিংসা বর্জন ও মানবতার প্রতিষ্ঠাই ছিল তাঁর কাছে সর্বপ্রধান বিষয়। আধুনিক অনৈতিকতাকে ভিত্তি করে কামু তারপর লেখেন দা ফল উপন্যাস।
১৯১৩ সালে ফরাসি অধিকৃত উত্তর আফ্রিকার আলজেরিয়াতে তাঁর জন্ম। বাবা লুসিয়েন অগস্তে কামু প্রথম বিশ্বযুদ্ধে লড়াই করতে গিয়ে যখন মারা যান কামুর বয়স তখন মাত্র এক বছর। তাঁর মায়ের নাম ক্যাথেরিন হেলেন সিনটেস। কামু মাকে অসম্ভব ভালোবাসতেন। মা এক মুহূর্ত চোখের আড়াল হলে তিনি কেঁদে ভাসাতেন, এ কথা নিজেই কামু বলেছিলেন একসময়। পড়াশোনা করেছিলেন বেশ নিষ্ঠার সঙ্গে। আলজিয়ার্স বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় খেলাধুলা আর থিয়েটার তাঁর প্রিয় হয়ে ওঠে। ফুটবল, সাঁতার এবং বক্সিং ছিল তাঁর অসম্ভব প্রিয়।যক্ষারোগে আক্রান্ত হওয়ার জন্য অকালে তাঁকে পড়াশোনা শেষ করতে হয়েছিল। এই রোগ তাঁকে সারা জীবন ভুগিয়েছিল।
১৯৫৭ সালে মানবতার পূজারী অ্যালবার্ট কামু তাঁর অনবদ্য সাহিত্যকর্মের জন্য নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন।
প্রতিভাস ম্যাগাজিন | Prativas Magazine
