দীপান্বিতা

জাঁ মারি গুস্তাভ লা ক্লেজিও

চিরায়ত মহাকাব্যিক সাহিত্যের জগতে একটি অবিস্মরণীয় অধ্যায়ের সূচনা করেছিলেন গ্রিসের অন্ধ মহাকবি হোমার। তাঁর সৃষ্ট ইলিয়াড এবং ওডিসি মহাকাব্য দুটিতে এক বিশাল প্রেক্ষাপটে দেখানো হয়েছে অপহৃতা সম্রাজ্ঞী হেলেনকে ঘিরে স্পার্টা আর ট্রয় রাষ্ট্রদুটির মেনেলাউস, আগামেমনন, একিলেস, হেক্টর, প্যারিস, ওডিসিয়ুস প্রমুখ মহারথীদের মরণপণ মহারণ। আবার এই ওডিসিয়ুসকেই হোমার চিত্রায়িত করেছেন সাত সমুদ্র তের নদীতে দুঃসাহসিক অভিযাত্রী হিসেবে। আসলে তিনি ইথাকার রাজা ইউলিসিস। এই হোমারীয় কাব্য ও সাহিত্য প্রতিভাই পরিলক্ষিত হয়েছে ২০০৮ সালে নোবেল সাহিত্য পুরস্কার বিজয়ী ফরাসি সাহিত্যিক জাঁ মারি গুস্তাভ লা ক্লেজিও-র কালজয়ী উপন্যাসগুলিতে। 

ক্লেজিও-র জন্মের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে ব্রিটিশ যুক্তরাজ্য, যে দেশের অ্যাংলো-স্যাক্সন রাজতন্ত্রকে ১০৬৬ সালে হেস্টিংস-এর যুদ্ধে পর্যুদস্ত করেছিল ফরাসি নৃপতি ডিউক উইলিয়াম অফ নর্ম্যান্ডির সেনাবাহিনী। ক্লেজিও-র পরবর্তী কর্মভূমি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। তবে তাঁর রচনাতে তিনি বিখ্যাত ফরাসি লেখক মলেয়ার, আলবেয়ার কামু , দিদেরো, ভিক্টর হুগোর মত জীবনদর্শনকে ততটা বেশি গুরুত্ব না দিয়ে চিত্রায়িত করেছেন আফ্রিকা, এশিয়া ও উপনিবেশিক তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলিতে অবহেলিত, উপেক্ষিত সংস্কৃতি এবং বহুধাবিভক্ত জনজীবনকে। হোমারের মত বিশ্বের বিভিন্ন সংস্কৃতিকে সম্যকভাবে উপলব্ধি করার ক্ষমতা রাখেন তিনি। শুধু নব্যবিজ্ঞানের যুক্তিবাদকেই নয়, সভ্যতার আনাচে-কানাচে এখনো বিষধর ভুজঙ্গের মত ফণা তুলে দাঁড়ানো মধ্যযুগীয় কুসংস্কার, নির্লজ্জ বর্বরতা, পাশবিকতা আর পুরুষতান্ত্রিক সমাজের স্বৈরাচারকে নির্ভীকভাবে চিত্রায়িত করেছেন গুস্তাভ ক্লেজিও। এজন্য ইউরোপীয় সাহিত্যিক সমাজে কঠোর সমালোচনা হয়েছে তাঁর, তবুও বিশ্ব মানবতাকে সাম্যমূলক সাহিত্যে প্রতিভাত করার জন্য বারংবার এগিয়ে এসেছেন তিনি। 

গুস্তাভ ক্লেজিও-র বাবা মরিশাসজাত একজন ব্রিটিশ চিকিৎসক। ছেলেবেলার অনেকটা সময়ই তাঁর কেটেছে আফ্রিকা মহাদেশে। এর ফলে কঙ্গো-জাম্বেসি-নীল নদের আশেপাশে গহন অরণ্যে কালাহারি ও নুবিয়া এবং সাহারা মরুস্থলীতে বেড়ে ওঠা ও কষ্টদায়ক জীবনযাত্রায় অভ্যস্ত বহু কৃষ্ণাঙ্গ আদিম জনগোষ্ঠীর মধ্যে সযত্নে লালিত নানা অদ্ভুত কুসংস্কার ও ধর্মনৈতিক প্রথা স্থান পেয়েছে তাঁর গ্রন্থগুলিতে। উষাকালের মানবিক সংস্কৃতিকে জানতে তিনি সত্তরের দশকে পানামাতে বেশ কয়েকটি বছর কাটান একটি আমেরিন্ডিয়ান উপজাতির লোকজনের সঙ্গে। একসময় নিউ মেক্সিকোর আলবুকার্কে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে বেশিরভাগ সময়েই স্পেনীয় ভাষাভাষী ছাত্র-ছাত্রীদের বিশ্বসাহিত্য পড়াতেন। তবুও সারা পৃথিবীতে ঘুরেও নিজেকে পুরোদস্তুর ফরাসি বলেই মনে করেন তিনি। ফরাসি ভাষা যেন বইছে তাঁর রক্তে। 

১৯৮০ সালে প্রকাশিত হয়েছিল গুস্তাভ ক্লেজিও-র সবচেয়ে জনপ্রিয় উপন্যাস ডেজার্ট বা মরুভূমি। ইউরোপে আগত বিদেশীরা ওই মহাদেশে যে কুসংস্কার, অবহেলা আর হীন মানসিকতাকে প্রত্যক্ষ করে থাকেন সেগুলি নিয়েই এই বিতর্কিত উপন্যাস। এই বইতে আফ্রিকার সাহারা অঞ্চলে একসময়ে গড়ে ওঠা আর ফরাসি ও উপনিবেশিকদের হাতে বিধ্বস্ত হওয়া তুয়ারেগ উপজাতীয় সভ্যতার ওপর বিশেষ আলোকপাত করা হয়েছে। সুইডেনের জাতীয় সাহিত্য একাডেমির পক্ষ থেকে স্থায়ী সম্পাদক হোরেস এংদাহল জানিয়েছিলেন যে ১০ মিলিয়ন সুইডিশ ক্রোনার অর্থমূল্যের নোবেল সাহিত্য পুরস্কার দেওয়া হয়েছে ক্লেজিও-র কাব্যিক দুঃসাহসিকতা, বিমূর্ত ও আত্মিক মানসিকতা এবং অন্ত্যজ সভ্যতার মধ্যে লুক্কায়িত প্রাণচাঞ্চল্যকে প্রদর্শনের জন্য। তাঁর রচিত ১৯৯১ সালে প্রকাশিত উপন্যাস ওনিৎসা-তে চিত্রায়িত হয়েছেন খুব ছোটবেলাতেই তাঁকে ছেড়ে যাওয়া এবং গুইয়ানা ও নাইজেরিয়াতে চিকিৎসকের পেশা গ্রহণ করা তাঁর বাবা। ফরাসি স্কুল থেকে উত্তীর্ণ হয়ে ক্লেজিও উচ্চশিক্ষা লাভ করেন ইংল্যান্ডের ব্রিস্টল ও লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ে। প্রথমে তিনি ভেবেছিলেন, ইংরেজি ভাষায় লেখালেখি করবেন। তারপর ঔপনিবেশিকদের ভাষা বলে সেই পরিকল্পনাকে ত্যাগ করেন। নতুন ধরনের রচনাশৈলী আর আঞ্চলিক উপভাষার শব্দ মিশ্রণে ১৯৬৩ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর প্রথম উপন্যাস লা প্রাসে ভার্বাল বা দ্যা ট্র্যান্সক্রিপ্ট। ক্লেজিও-র সাহিত্যদর্শনে বারংবার প্রতিধ্বনিত হয়েছে ইংরেজ রোমান্টিক কবি জন কিট্স্, স্কটল্যান্ড-এর ঔপন্যাসিক রবার্ট লুইস স্টিভেনশন, আয়ারল্যান্ডের ঔপন্যাসিক জেমস জয়েস, মার্কিন লেখক আরনেস্ট হেমিংওয়ে ও জে ডি স্যালিঙ্গার-এর প্রভাব। এঁরা প্রত্যেকেই ক্লেজিও-র মতই নির্বাসনে ও নির্জনে থেকে তাঁদের সাহিত্যসৃষ্টি করেছেন। 

বিশ্বায়ন ও নগরকেন্দ্রিক সভ্যতাকে নিয়ে তিনি খুব একটা তৃপ্ত নন। বর্তমান আধুনিকতার শ্বাসরোধকারী আবহাওয়া থেকে অতীত ও নির্মল সংস্কৃতিকেই বেশি পছন্দ করেন ক্লেজিও। তাই নিউইয়র্ক, প্যারিস, লন্ডন, ওয়াশিংটন, ব্রাসেলস-এর ফ্যাশনদুরস্ত নব্য প্রজন্মকে এড়িয়ে তাঁর লেখনীতে সরব হয়ে ওঠে কালাহারি মরুভূমির খৈশান বুশম্যান উপজাতি ও বলিভিয়ার রেড ইন্ডিয়ান কৃষকরা।

প্রতিভাস ম্যাগাজিন | Prativas Magazine

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *