দীপান্বিতা
উমবার্তো একো
পৃথিবীর সমস্ত চিন্তাশীল ব্যক্তিদের জন্য লেখেন উমবার্তো একো। তাঁর উপন্যাস পড়েন পৃথিবীর চিন্তাবিদরা। কোনান ডয়েল, আগাথা ক্রিস্টি যেমন রহস্যে ভরা সাহিত্য সৃষ্টি করেছেন, তেমনি উমবার্তো একোও রহস্য উপন্যাস লেখেন। পার্থক্য এই যে, একোর রহস্য উপন্যাস সবার জন্য নয়। এসব রহস্য বুঝতে পারেন বাঘা বাঘা চিন্তাবিদরা। নাম করা যায় তাঁর সেরা সৃষ্টি নেম অফ দা রোজ-এর, যা আসলে একটি চিন্তাশীল রহস্য উপন্যাস। ১৯৮৮ সালে প্রকাশিত ফুকোজ পেন্ডুলাম এমনই আরেকটি রহস্য উপন্যাস যাকে বলা হয় থিংকিং পারসন্স দা ভিঞ্চি কোড।

উমবার্তো একো একজন সাহিত্যিক, এটুকু বললে তাঁর সম্পর্কে কিছুই বলা হয় না। তাঁর একটা বড় পরিচয় হল, তিনি উত্তর-আধুনিক যুগের এক সেরা দার্শনিক। এটুকু বলাও যথেষ্ট নয়। তাঁর নামের পাশে পরিচিতি হিসেবে লেখা যায় মিডিয়াভ্যালিস্ট, সেমি ওটিশিয়ান, সাহিত্য সমালোচক। প্রত্যেকটি ক্ষেত্রেই তিনি প্রায় অপ্রতিদ্বন্দ্বী। পাশাপাশি একো একজন প্রাবন্ধিক, শিশু সাহিত্যিক ও উচ্চমানের অ্যাকাডেমিক টেক্সট রচয়িতা।
১৯৩২ সালের ৫ই জানুয়ারি উত্তর ইটালির পিডমন্ট অঞ্চলের আলে সন্দ্রিয়া শহরে তাঁর জন্ম। বাবা গিউলিও ছিলেন একজন অ্যাকাউন্ট। পরে সরকারের ডাকে তাঁকে যুদ্ধে যেতে হয়েছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় মা জিওভান্নার সঙ্গে একো পাহাড় অঞ্চলে এক ছোট্ট গ্রামে বসবাস শুরু করেন। তাঁর বাবারা ছিলেন তেরো জন ভাইবোন। বাবা চেয়েছিলেন ছেলে হোক উকিল। কিন্তু একো তুরিন বিশ্ববিদ্যালয়ে মধ্যযুগীয় দর্শনশাস্ত্র ও সাহিত্য পড়তে ভর্তি হন এবং দর্শনশাস্ত্রেই থিসিস লেখেন। একসময় আস্থা হারিয়ে তিনি ক্যাথলিক ধর্ম বর্জন করেন।
পরে রাষ্ট্রীয় সম্প্রচার দপ্তরের রেডিও টেলিভিশনি ইতালিয়ানাতে তিনি সাংস্কৃতিক সম্পাদক পদে নিযুক্ত হন এবং তুরিন বিশ্ববিদ্যালয়ে লেকচার দেওয়ার কাজ পান। একদল চিত্রকর, সঙ্গীতজ্ঞ ও লেখক মিলে যে সম্মেলন গড়ে তুলেছিলেন একো তার এক সক্রিয় সদস্য ছিলেন। তাঁর লেখা প্রভাবিত হয়েছিল এখান থেকে। এক জার্মান শিক্ষিকা রিনাতে র্যামজির সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয় ১৯৬২ সালে। দুটি ছেলেমেয়ে তাঁদের। দুটি বাড়ি ছিল একোর। মিলান শহরের অ্যাপার্টমেন্টে রয়েছে ত্রিশ হাজার বইয়ের একটি লাইব্রেরি। রিমিনি অঞ্চলের কাছে রয়েছে তাঁর অবসরযাপনের অন্য একটি বাড়ি। সেখানে আছে কুড়ি হাজার বইয়ের আরোও একটি লাইব্রেরি।
মধ্যযুগীয় নন্দনতত্ত্ব ও দর্শনের অপ্রতিদ্বন্দী পন্ডিত একো আধুনিক ভাষাতত্ত্ব নিয়েও অসাধারণ গবেষণা করেছেন। তাঁর এই সুচিন্তিত গবেষণা প্রকাশিত হয়েছে ওপেরা অ্যাপেরটা বা ওপেন ওয়ার্ক বইতে। একোর আরেক অবিস্মরণীয় কাজ নৃতত্ববিষয়ক গবেষণা এবং দেশ-বিদেশের চিন্তামমনস্ক ব্যক্তিদের নিয়ে বহুজাতিক সম্মেলন গড়ে তোলা। প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের মধ্যে সাংস্কৃতিক আদান-প্রদানের সেতুবন্ধন ঘটানোর প্রধান উদ্যোগী তিনি। আবার তিনিই আন্তর্জাতিক যোগাযোগ রক্ষাকারী ভাষা এসপেরেনতো নিয়ে যাঁরা উৎসাহী তাঁদের এক মূল প্রবক্তা।
সারা পৃথিবীতে বহু মানুষ তাঁর সাহিত্যকর্মের আগ্রহী পাঠক। উপন্যাসগুলি বহু ভাষায় অনূদিত এবং এগুলির বিক্রিও বেশ ভালো। তাঁর উপন্যাসগুলিতে প্রায়ই ঐতিহাসিক চরিত্র ও সমসাময়িক ভাষা উপস্থাপিত হয়। প্লট পরিকল্পনায় রয়েছে আশ্চর্য মুন্সিয়ানা। এসব কিছুর অনবদ্য সম্মেলন ঘটেছে তাঁর বহু আলোচিত ও সম্ভবত প্রধান সৃষ্টিকর্ম দা নেম অফ দা রোজ উপন্যাসে। চতুর্দশ শতকের এক মঠে সংঘটিত এক ঐতিহাসিক রহস্য এর উপজীব্য। মঠে একের পর এক খুন ঘটে যাচ্ছিল যাতে অন্তর্নিহিত ছিল এক গুরুত্বপূর্ণ ধর্মীয় বিতর্ক। আধুনিক আর্থ-রাজনীতিক ভাষ্যে মধ্যযুগের ধর্মীয় মতবিরোধের উপস্থাপন বইটিকে অনন্য করে তুলেছে। পরে এই বইয়ের কাহিনী নিয়ে সিনেমা তৈরি হয় যাতে অভিনয় করেছিলেন শন কোনেরি, এফ মুরে আব্রাহাম ও ক্রিশ্চিয়ান স্লেটার। উপন্যাসে ও ছবিতে রয়েছে অন্ধ এক সন্ন্যাসী গ্রন্থাগারিকের একটি চরিত্র। এটি দক্ষিণ আমেরিকার বিখ্যাত ঔপন্যাসিক হোরহে লুই বোরহেসের আদলে করা যাঁর ছিল বইয়ের ওপর অসম্ভব অনুরাগ। শেষ জীবনে তিনিও অন্ধ হয়ে গিয়েছিলেন।
একোর দ্বিতীয় উপন্যাস ফুকোজ পেন্ডুলাম। এই বইটিও বেশ ভালো বিক্রি হয়েছিল। উপন্যাসের প্লট পরিকল্পনা অভিনব। এক ছোট প্রকাশনী সংস্থায় কাজ করে তিন সম্পাদক। বেশিরভাগ সময়ই তাদের বেকার বসে থাকতে হয়। বেশি কাজকর্ম না থাকায় নিজেদের মধ্যে পরামর্শ করে নিছক মজা পাওয়ার জন্য তারা এক অদ্ভুত ষড়যন্ত্রের তত্ত্ব বার করল। প্রথমদিকে ব্যাপারটা খেলা হলেও পরে বিপজ্জনক হয়ে গেল। বাইরের লোকরা এই খেলায় সামিল হয়ে বিশ্বাস করতে লাগল যে ওই তিন মূল হোতা কোন গুপ্ত রত্নভান্ডারের সন্ধান পেয়ে গেছে।
দা আইল্যান্ড অফ দ্যা ডে বিফোর একোর তৃতীয় উপন্যাস। এখানে আছে রেনেসাঁ যুগের এক ব্যক্তির গল্প যে এক বর্জিত জাহাজ থেকে দেখছে একটি দ্বীপ। তার বিশ্বাস, দীপটি আন্তর্জাতিক সময় রেখার বাইরে এবং সে সেখানে সাঁতরে যেতে না পেরে জাহাজে আটকে থেকে ভাবছে তার অ্যাডভেঞ্চারপূর্ণ বিগত দিনগুলির কথা যা তাকে বর্তমান সংকটে ফেলেছে।
২০০০ সালে প্রকাশিত হয় বৌদোলিনো নামে একোর চতুর্থ উপন্যাস। বৌদোলিনো একজন নাইট যে চতুর্থ ক্রুসেড-এর সময় বাইজেন্টাইনের জনৈক ঐতিহাসিকের প্রাণ রক্ষা করেছিল। এবার বৌদোলিনো তার আত্মকাহিনী বলছে। কিন্তু মুশকিল হল এই যে বৌদোলিনো আগাগোড়া মিথ্যেবাদী। তার বলা গল্পগুলির কী কী অংশ ঐতিহাসিক ও পাঠকরা গ্রহণ করবে বা বর্জন করবে এ এক আশ্চর্য ধাঁধা।
পঞ্চম উপন্যাস দা মিস্টেরিয়াস ফ্লেম অফ কুইন লোয়ানাতে একো পুরাদ্রব্য বিশেষজ্ঞ এক প্রবীণ বই বিক্রেতার গল্প বলেছেন যে সদ্য কোমা থেকে জেগে উঠে তার অতীত মনে করার কথাই কেবল ভাবতে পারছে।
সাহিত্যের সমস্ত ধারার সঙ্গে যোগসূত্র স্থাপন করার প্রক্রিয়াসমৃদ্ধ একোর সৃষ্টিকর্ম। তাঁর উপন্যাসে থাকে বহু ভাষার ব্যবহার, ইতিহাস ও সাহিত্য বিষয়ক নানা চিত্তাকর্ষক প্রসঙ্গ। যেমন তাঁর দা নেম অফ দা রোজ উপন্যাসের চরিত্র উইলিয়াম অফ বাসকারভিল একজন যুক্তিবাদী ইংরেজ সন্ন্যাসী ও ডিটেকটিভ। এই চরিত্র একই সঙ্গে শার্লক হোমস ও উইলিয়াম অফ ওকহ্যাম চরিত্র দুটির মেলবন্ধন ঘটিয়েছে। আবার এখানেই দেখা যাবে সাহিত্যিক হোরহে লুই বোরহেসের প্রতিভূকে। একো জানিয়েছেন, আধুনিক সময়ের যে দুজন সাহিত্যিক তাঁর কাজকে বেশি প্রভাবিত করেছেন তাঁদের একজন বোরহেস এবং অন্যজন জেমস্ জয়েস। প্রতিভাস ম্যাগাজিন