দীপান্বিতা

 আইজ্যাক আসিমভ

জুলে ভার্নের হাত ধরে সাহিত্যের যে বিশেষ ধারা সায়েন্স ফিকশন নামে বিকশিত হয়েছিল তাকে বর্তমান উচ্চতায় প্রতিষ্ঠিত করার ব্যাপারে যাঁদের ভূমিকা অনস্বীকার্য তাঁদের মধ্যে অন্যতম সেরা আইজ্যাক আসিমভ। বিগত শতাব্দীর প্রথমদিকে রাশিয়ায় তাঁর জন্ম এক গোঁড়া রাশিয়ান ইহুদি পরিবারে। তাঁর তিন বছর বয়সের সময় পরিবারটি পাকাপাকিভাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে চলে আসে। এই কারণে আইজ্যাক আসিমভের কোনদিনই রাশিয়ান ভাষা শেখা হয়নি।

তাঁর আসল জন্ম তারিখটি জানা যায় না। সমসাময়িক তিন মহারথী সায়েন্স ফিকশন লেখকদের মধ্যে তিনি একজন, অন্য দুজন হলেন রবার্ট এ হাইনলিন ও আর্থার সি ক্লার্ক। আসিমভ বিখ্যাত তাঁর ফাউন্ডেশন সিরিজের জন্য। প্রায় সমান বিখ্যাত তাঁর গ্যালাকটিক এম্পায়ার সিরিজ এবং রোবট সিরিজ। তাঁর লেখা নাইট ফল গল্পটিকে আমেরিকার সায়েন্স ফিকশন লেখক সমাজ সর্বকালের সেরা সায়েন্স ফিকশন গল্পের মর্যাদা দিয়েছিলেন। সারা জীবনে তিনি লিখেছেন ও সম্পাদনা করেছেন পাঁচশ টিরও বেশি বই, আর আছে তাঁর লেখা অন্তত ন’ হাজার চিঠি। তিনি মনে করতেন যে জীবনে যত লোকের সঙ্গে দেখা হয়েছে তাঁদের মধ্যে একমাত্র মার্ভিন মিনস্কি ও কার্ল সাগান তাঁর চেয়ে বেশি বুদ্ধিমান। 

নিউইয়র্কের ব্রুকলিনে তাঁদের ছিল একটি ক্যান্ডি স্টোরস্। পরিরেরর সবাই সেখানে কাজ করত। পাঁচ বছর বয়সে নিজের চেষ্টায় পড়তে শিখে গিয়েছিলেন তিনি। নিউইয়র্কের ব্রুকলিন শহরেই তাঁর প্রাথমিক শিক্ষা। তারপর কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গ্র্যাজুয়েট হয়ে বায়োকেমিস্ট্রিতে পিএইচডি করেন। মাঝখানে কিছুদিন মার্কিন সামরিক বাহিনীতে তাঁকে কাজ করতে হয়েছিল। তখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়। পরে কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি বায়োকেমিস্ট্রি বিভাগে প্রফেসর পদে নিযুক্ত হয়েছিলেন।

প্রথম স্ত্রী গারট্রুড ব্লুগারম্যান-এর সঙ্গে বিবাহবিচ্ছেদ হওয়ার পরপরই আসিমভ বিয়ে করেন জেনেট জেপসনকে। গারট্রুডের সঙ্গে ৩১ বছরের দাম্পত্য জীবনে ডেভিড ও রবিন জোয়ান নামে দুই ছেলেমেয়ের জন্ম হয়েছিল। 

নিজে বিজ্ঞান নিয়ে লিখলে কী হবে, আকাশে ওড়ায় তাঁর ছিল ভয়। সারা জীবনে মাত্র দুবার তিনি বিমান ভ্রমণ করেছিলেন। খুব একটা দূরেও বিশেষ বেড়াতে যেতেন না। অনুরাগীদের চিঠিপত্রের জবাব দিতে তাঁর কোন আলস্য ছিল না। অটোগ্রাফ দিতেও ভালোবাসতেন। শারীরিক সক্ষমতা খানিকটা কম ছিল তাঁর। সাইকেল চালানো বা সাঁতার শেখেননি কখনো। নিরুপায় হয়ে গাড়ি চালাতে শিখেছিলেন।

তিনি ছিলেন মানবদরদী ও যুক্তিবাদী। কারো ধর্মবিশ্বাসে তিনি আঘাত করতেন না। তবে কুসংস্কার ও অপবিজ্ঞানের বিরুদ্ধে তিনি সোচ্চার ছিলেন। আসিমভ অমর হয়ে থাকবেন রোবট বিজ্ঞান বা রোবটিক্সের তিনটি মূল সূত্র আবিষ্কার এবং ফাউন্ডেশন সিরিজ তৈরি করার জন্য। ইংরেজি অভিধানে তাঁর তৈরি পজিট্রনিক, সাইকো হিস্ট্রি, রোবটিক্স শব্দগুলি পাকাপাকিভাবে স্থান করে নিয়েছে।

জনপ্রিয় টেলিভিশন শো স্টার ট্রেক দা নেক্সট জেনারেশন নির্মাণ করেছিলেন জিন রডেনবেরি। এই সমস্ত বিজ্ঞান নির্ভর কাহিনীতে ছিল সব অ্যান্ড্রয়েডরা যারা পজিট্রনিক মস্তিষ্কের অধিকারী। এই পজিট্রনিক ব্রেন আসিমভের উদ্ভাবিত কল্পিত প্রযুক্তি। স্টার ট্রেকের সাফল্যের পিছনে আসিমভের অবদান অনেকটাই। এই টিভি শো চলার সময় থেকেই জিন আর আসিমভ একে অন্যের বন্ধু হয়ে ওঠেন। 

পজিটট্রনিক রোবোটদের গল্প নিয়েই আসিমভের বিখ্যাত সংকলন আই রোবট .এই সংকলনের আশ্চর্য গল্প বাইসেন্টেনিয়াল ম্যান নিয়ে নির্মিত চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছিলেন রবিন উইলিয়ামস। ২০০৪ সালে তৈরি হয় আই রোবট সিনেমা যাতে মুখ্য ভূমিকায় ছিলেন উইল স্মিথ। অবশ্য আই রোবট সিনেমার গল্প অন্যের লেখা, নামটি কেবল আসিমভের কাছ থেকে ধার করা। মূল গল্পগুলির অনুপ্রেরণায় আই রোবট নামে বিকল্প চিত্রনাট্য তৈরি করেছিলেন প্রখ্যাত সায়েন্স ফিকশন লেখক হারল্যান এলিসন।

প্রাক্তন বিটল ও রক দল উইংস-এর প্রধান পল ম্যাক্ কার্টনি একসময় আসিমভের কাছে এসে এমন এক সিনেমা তৈরির ইচ্ছে প্রকাশ করেছিলেন যেখানে দেখা যাবে কোন এক রক ব্যান্ডের সদস্যরা ভিনগ্রহীদের প্রভাবে প্রভাবিত। আসিমভ এই বিষয়টিকে নিয়ে চমকপ্রদ এক গল্প লিখে দেন, যদিও পল শেষ পর্যন্ত সিনেমাটি তৈরি করেননি।

বিজ্ঞানের প্রায় সমস্ত বিভাগে গল্প-উপন্যাস ছাড়াও অন্য ধরনের বহু লেখা লিখেছেন আসিমভ .ইতিহাসেও ছিল তাঁর আকর্ষণ। অন্তত ১৪টি জনপ্রিয় ইতিহাসের বই লিখে গেছেন তিনি। এসব বইয়ের মধ্যে গ্রিক ও রোমান ছাড়াও রয়েছে ইজিপ্টের ইতিহাস। দু’ ভলিউম-এ বাইবেল নিয়ে লিখে গেছেন অনবদ্য গাইড বই। সাহিত্যেও ছিল তাঁর উৎসাহ। শেক্সপিয়ারের রচনাবলী এবং প্যারাডাইস লস্ট-এর ওপর রয়েছে তাঁর বই। এছাড়া তিনি ছিলেন রহস্য কাহিনীর বড় মাপের লেখক। জীবনের শেষ সময়ে লিখেছিলেন অসংখ্য লিমেরিক। আর আছে তাঁর লেখা দু’ ভলিউম আত্মজীবনী।

প্রায় ৫৮ বছর বয়সে তিনি প্রথম হৃদরোগে আক্রান্ত হন। তার ছ’বছর পর হয় তাঁর বাইপাস সার্জারি। ৭২ বছর বয়সে ১৯৯২ সালের নিউইয়র্ক শহরে মারা যান তিনি। সাময়িকভাবে মৃত্যুর কারণ ছিল হৃদরোগ ও কিডনি সংক্রান্ত জটিলতা। মৃত্যুর ১০ বছর পর আসিমভের আত্মজীবনী ইটস বিন আ গুড লাইফ-এর এক নতুন সংস্করণ প্রকাশ করেন তাঁর দ্বিতীয় স্ত্রী জেনেট। সেখানে জেনেটের এক সংযোজন থেকে জানা যায় যে বাইপাস সার্জারির সময় আসিমভের শরীরে এইডস ভাইরাসের সংক্রমণ ঘটে এবং সেটাই পরে মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়ায়। শরীরে এইডস সংক্রমণের কথা জানার পর আসিমভ তা প্রকাশ করে দিতে চেয়েছিলেন। অনেক বলেকয়ে তাঁকে নিরস্ত করেছিলেন তাঁর চিকিৎসকরা। প্রতিভাস ম্যাগাজিন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *