শিশির আজম

Rome, Open City (1945)

কোন কোন কবিতা বারবার পড়া যায়, কোন কোন সিনেমা বারবার দেখা যায়। সংগীত, নৃত্য, চিত্রকলা, ভাস্কর্য, স্থাপত্যকলা অর্থাৎ সবগুলো শিল্পমাধ্যমের ক্ষেত্রেই হয় তো এরকমটা হয়ে থাকে। রেনেসাঁপর্বে মাইকেলাঞ্জেলোর হাতে যে সুবিশাল পাথরটা ডেভিডের প্রাণ ধারণ করে ভাস্কর্যরূপে আমাদের সামনে দাঁড়িয়েছিল সে কি মারা গেছে? না। আজও সে সমান জীবন্ত। অজন্তা-ইলোরা-খাজুরাহের মন্দিরগাত্রের নগ্ন নারী-পুরুষের সুষম শারীরিক গঠন আর তাদের বিচিত্র ভঙ্গী আজও আমাদের সমানভাবে বিস্মিত করে। সেই সময়, সেই সময়ের আগুন আমাদেরকে নতুনভাবে স্পর্শ করে। Rome, Open City (১৯৪৫) দেখার পর এরকম অনুভূতিতে আক্রান্ত হওয়া স্বাভাবিক। ক্রিটিকরা এটাকে War-drama film হিসেবে বিবেচনা করেন। কি আশ্চর্য, কতোবার দেখেছি এই সিনেমা, এখানে আমি war পাইনি। drama তো পাইইনি। আর ডকুমেন্টারির সব আলামতই এর ভিতর বিরাজমান। হ্যা, সেনা আছে, অস্থায়ী সেনা ক্যাম্প আছে, নির্যাতন শিবির আছে, নির্জন রাস্তায় টহল জিপ আছে, বাড়ি বাড়ি ঢুকে সন্দেহভাজন লোকজনকে তুলে নিয়ে যাওয়া বা ফাঁকা রাস্তায় ঠান্ডা মাথায় গুলি করে মারা, সবই আছে। কিন্তু এই ফিল্মকে হলিউডের মারমার কাটকাট সিনেমার সঙ্গে একদমই মেলানো যাবে না। এখানে প্রযুক্তি আর অস্ত্রের ঝনঝনানি নেই। ল্যাতিন আমেরিকা বা বলিউডের সিনেমার সঙ্গেও মিল নেই। আরেকটা ব্যাপার, এর ক্লোজ শটগুলো যেন ফ্রিদা কালোর আতংকিত ব্যথাদীর্ণ তুলিতে আঁকা একেকটা প্রতিকৃতি। মিড শটগুলো ফ্যাসিবাদের ভয়ংকর থাবার নিচে সাধারণ জনগণের প্রতি মুহূর্তে বেঁচে থাকবার আপ্রাণ চেষ্টা। আবার লং শটগুলোতে দেখা যায় তথাকথিত ওপেন সিটি রোম কীরকম থমকে আছে, থমথমে নিঃশব্দ রাস্তা, পথচলতি মানুষের আতংকিত চোখ, ফিসফাস। 

মার্কিনি সিনেমার সঙ্গে বরাবরই ইউরোপীয় সিনেমা একটা দূরত্ব রেখে চলেছে। মুনাফা অর্জনকে মাথায় রেখেও শুরুতে মার্কিনি সিনেমায় শিল্প (art)কে সর্বাগ্রে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। তারপর মার্কিনি সিনেমা হলিউডের খপ্পরে পড়ে যাওয়ার পর শিল্প (art) শিল্প (industry)-র কাছে পরাভূত হলো। আর ইন্ডাস্ট্রি মানেই পুঁজির হাঙরের হা। এই হাঙর শিল্প-ভাষা-রুচি-সংস্কৃতি-ঐতিহ্য কোন কিছু গিলতেই দ্বিধা করে না। তার দরকার মুনাফা। এই চক্র থেকে ইউরোপ বরাবর নিজেকে অনেকটা রক্ষা করে আসতে পেরেছে, এখন অব্দি, অনেকটা। সিনেমায় নিওরিয়ালিজমের সূত্রপাত যে মাস্টার ফিল্মমেকারদের হাত ধরে তার ভিতর রবার্তো রোসেলিনি একজন। অন্যদের ভিতর রয়েছেন সত্যজিৎ রায়, আকিরা কুরোসাওয়া, ভিত্তরিও ডি সিকা, পিয়্যের পাওলো পাসোলিনিসহ আরও কেউ কেউ। তবে এই ফিল্মমেকারদের ভাবনা-অভিজ্ঞতা-পরিপ্রেক্ষিতে ভিন্নতা তো ছিল। তাদের কাজের ধরণও আলাদা। যা হোক ‘রোম, ওপেন সিটি’র মানবিক দিকটাই দর্শককে টাচ্ করবে বেশি, যদিও এর রাজনৈতিক দিকটাকে উপেক্ষা করবার জো নেই। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে মিত্রশক্তির কাছে ইতালির হারের ক্ষত তো ছিলই। সেটা ছিল প্রথম পরাজয়। দ্বিতীয়বার আবার পরাজিত হতে হয় ফ্যাসিবাদের দোসর জার্মানির কাছে। এই ইতিহাস অনেকেই সামনে আনতে চান না। কিন্তু রোসেলিনি ভোলেননি, আমাদেরকে ভুলতে দেননি। এই ক্ষত উনি ক্যামেরায় ধরে রেখেছেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তীতে ইতালি যে পরাজয়ের গ্লানি বয়ে বেড়াচ্ছিল, তার ওপর মড়ার পর খাড়ার ঘা জার্মানির অবরোধ–এই প্রেক্ষাপটে রোসেলিনির ফিল্মত্রয়ীর প্রথমটি হলো ‘রোম, ওপেন সিটি’। দ্বিতীয়টি ‘পাইসা’ (১৯৪৬), তৃতীয়টি ‘জার্মানি, ইয়ার জিরো’ (১৯৪৮)। উল্লেখ্য, ১৯৪৩ সালের ১৪ আগস্ট রোমকে ‘উম্মুক্ত শহর’ হিসেবে ঘোষণা করা হয়। সাধারণ মানুষের সঙ্গে  যুদ্ধবাজ শাসকদের কি ভয়ানক প্রতারণা! সেই তেতাল্লিশ সালেই রোসেলিনি এই সিনেমার কাজ শুরু করেন। নামকরণ করেণ ‘রোম, ওপেন সিটি। ফ্যাসিবাদ নামক ভয়ানক দানবের বিরুদ্ধে উনি ক্যামেরাকে দাঁড় করিয়েছেন। সত্যিকার ফিল্মমেকারের ক্যামেরা এরকমই হয়। এই সিনেমায় স্ক্রিপ্টে উনাকে সহযোগিতা করেছেন বিশ্বসিনেমার আরেক দিকপাল ফেদেরিকো ফেলিনি। যদিও ফেলিনির কাজের প্রভাব এই সিনেমায় তেমন নেই। ‘রোম, ওপেন সিটি’র ভেতরকার যে স্পিরিট তা ঋত্বিক ঘটককে হয় তো মনে করিয়ে দেবে, বা সত্যজিৎ বা মৃণাল সেনকে। রোসেলিনি প্রচলিত অর্থে ধার্মীক ছিলেন না কিন্তু খ্রিস্টীয় আধ্যাত্মবাদে এক ধরণের শ্রদ্ধা ছিল তার। সেই সঙ্গে বিশ্বযুদ্ধ পৃথিবীর সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্রগুলোর ভিতরকার নগ্ন খেয়োখেয়ি আর সাধারণ মানুষের অসহনীয় ভোগান্তি তাকে তাকে বিমুঢ় করে তুলেছিল। বলা যায় তারকোভস্কির মনোজগতের সঙ্গে এর সামঞ্জস্য রয়েছে। রাষ্ট্র এবং সহকর্মী বন্ধুদের সঙ্গে বিরোধও এই জায়গায়। এটা যেন নিয়তি। ঋত্বিককে এই নিয়তি ভোগ করতে হয়েছিল। সেসময় ইতালি আর জার্মানি দুটো দেশের ঘাড়েই চেপে বসে ছিল ফ্যাসিবাদ। এরা পুরো পৃথিবীটাকেই অপমান করছিল, বিপর্যস্ত করে তুলছিল। শেষে এক রাক্ষস আরেক রাক্ষসের ঘাড় কামড়ে ধরে। এ এক মারাত্মক পরিণতি!  আমরা জানি, ইতালিয়ানরা কম পয়সায় সিনেমা করতে ওস্তাদ। আর সহজভাবে যেটা সাধারণ মানুষের চোখে সহনীয় তেমনভাবে ক্যামেরা ধরতে ওরা পছন্দ করে। ফরাসি আর জার্মানরা এক্ষেত্রে একটু খাপছাড়া। ওরা ঋদ্ধ দর্শককে আগ্রহী করতে, নাড়া দিতে বা খ্যাপাতে পছন্দ করে। গঁদার বা ক্রুফোর কথা তো বলাই যায়। ফরাসিদের ভেতর জঁ রেনোয়াকে রোসেলিনির অনেকটা কাছের মনে হবে। কেন? অনেক প্রস্ন আর হতাশার পরও এদের ক্যামেরা জ্বলে ওঠে মানবিকতার আলোয়। একজন সাধারণ দর্শক হিসেবে ‘রোম, ওপেন সিটি’র আঁচ এভাবেই আমি পেয়েছি আমার অনুভূতিতে। প্রতিভাস ম্যাগাজিন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *