শিশির আজম

Rome, Open City (1945)

কোন কোন কবিতা বারবার পড়া যায়, কোন কোন সিনেমা বারবার দেখা যায়। সংগীত, নৃত্য, চিত্রকলা, ভাস্কর্য, স্থাপত্যকলা অর্থাৎ সবগুলো শিল্পমাধ্যমের ক্ষেত্রেই হয় তো এরকমটা হয়ে থাকে। রেনেসাঁপর্বে মাইকেলাঞ্জেলোর হাতে যে সুবিশাল পাথরটা ডেভিডের প্রাণ ধারণ করে ভাস্কর্যরূপে আমাদের সামনে দাঁড়িয়েছিল সে কি মারা গেছে? না। আজও সে সমান জীবন্ত। অজন্তা-ইলোরা-খাজুরাহের মন্দিরগাত্রের নগ্ন নারী-পুরুষের সুষম শারীরিক গঠন আর তাদের বিচিত্র ভঙ্গী আজও আমাদের সমানভাবে বিস্মিত করে। সেই সময়, সেই সময়ের আগুন আমাদেরকে নতুনভাবে স্পর্শ করে। Rome, Open City (১৯৪৫) দেখার পর এরকম অনুভূতিতে আক্রান্ত হওয়া স্বাভাবিক। ক্রিটিকরা এটাকে War-drama film হিসেবে বিবেচনা করেন। কি আশ্চর্য, কতোবার দেখেছি এই সিনেমা, এখানে আমি war পাইনি। drama তো পাইইনি। আর ডকুমেন্টারির সব আলামতই এর ভিতর বিরাজমান। হ্যা, সেনা আছে, অস্থায়ী সেনা ক্যাম্প আছে, নির্যাতন শিবির আছে, নির্জন রাস্তায় টহল জিপ আছে, বাড়ি বাড়ি ঢুকে সন্দেহভাজন লোকজনকে তুলে নিয়ে যাওয়া বা ফাঁকা রাস্তায় ঠান্ডা মাথায় গুলি করে মারা, সবই আছে। কিন্তু এই ফিল্মকে হলিউডের মারমার কাটকাট সিনেমার সঙ্গে একদমই মেলানো যাবে না। এখানে প্রযুক্তি আর অস্ত্রের ঝনঝনানি নেই। ল্যাতিন আমেরিকা বা বলিউডের সিনেমার সঙ্গেও মিল নেই। আরেকটা ব্যাপার, এর ক্লোজ শটগুলো যেন ফ্রিদা কালোর আতংকিত ব্যথাদীর্ণ তুলিতে আঁকা একেকটা প্রতিকৃতি। মিড শটগুলো ফ্যাসিবাদের ভয়ংকর থাবার নিচে সাধারণ জনগণের প্রতি মুহূর্তে বেঁচে থাকবার আপ্রাণ চেষ্টা। আবার লং শটগুলোতে দেখা যায় তথাকথিত ওপেন সিটি রোম কীরকম থমকে আছে, থমথমে নিঃশব্দ রাস্তা, পথচলতি মানুষের আতংকিত চোখ, ফিসফাস। 

মার্কিনি সিনেমার সঙ্গে বরাবরই ইউরোপীয় সিনেমা একটা দূরত্ব রেখে চলেছে। মুনাফা অর্জনকে মাথায় রেখেও শুরুতে মার্কিনি সিনেমায় শিল্প (art)কে সর্বাগ্রে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। তারপর মার্কিনি সিনেমা হলিউডের খপ্পরে পড়ে যাওয়ার পর শিল্প (art) শিল্প (industry)-র কাছে পরাভূত হলো। আর ইন্ডাস্ট্রি মানেই পুঁজির হাঙরের হা। এই হাঙর শিল্প-ভাষা-রুচি-সংস্কৃতি-ঐতিহ্য কোন কিছু গিলতেই দ্বিধা করে না। তার দরকার মুনাফা। এই চক্র থেকে ইউরোপ বরাবর নিজেকে অনেকটা রক্ষা করে আসতে পেরেছে, এখন অব্দি, অনেকটা। সিনেমায় নিওরিয়ালিজমের সূত্রপাত যে মাস্টার ফিল্মমেকারদের হাত ধরে তার ভিতর রবার্তো রোসেলিনি একজন। অন্যদের ভিতর রয়েছেন সত্যজিৎ রায়, আকিরা কুরোসাওয়া, ভিত্তরিও ডি সিকা, পিয়্যের পাওলো পাসোলিনিসহ আরও কেউ কেউ। তবে এই ফিল্মমেকারদের ভাবনা-অভিজ্ঞতা-পরিপ্রেক্ষিতে ভিন্নতা তো ছিল। তাদের কাজের ধরণও আলাদা। যা হোক ‘রোম, ওপেন সিটি’র মানবিক দিকটাই দর্শককে টাচ্ করবে বেশি, যদিও এর রাজনৈতিক দিকটাকে উপেক্ষা করবার জো নেই। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে মিত্রশক্তির কাছে ইতালির হারের ক্ষত তো ছিলই। সেটা ছিল প্রথম পরাজয়। দ্বিতীয়বার আবার পরাজিত হতে হয় ফ্যাসিবাদের দোসর জার্মানির কাছে। এই ইতিহাস অনেকেই সামনে আনতে চান না। কিন্তু রোসেলিনি ভোলেননি, আমাদেরকে ভুলতে দেননি। এই ক্ষত উনি ক্যামেরায় ধরে রেখেছেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তীতে ইতালি যে পরাজয়ের গ্লানি বয়ে বেড়াচ্ছিল, তার ওপর মড়ার পর খাড়ার ঘা জার্মানির অবরোধ–এই প্রেক্ষাপটে রোসেলিনির ফিল্মত্রয়ীর প্রথমটি হলো ‘রোম, ওপেন সিটি’। দ্বিতীয়টি ‘পাইসা’ (১৯৪৬), তৃতীয়টি ‘জার্মানি, ইয়ার জিরো’ (১৯৪৮)। উল্লেখ্য, ১৯৪৩ সালের ১৪ আগস্ট রোমকে ‘উম্মুক্ত শহর’ হিসেবে ঘোষণা করা হয়। সাধারণ মানুষের সঙ্গে  যুদ্ধবাজ শাসকদের কি ভয়ানক প্রতারণা! সেই তেতাল্লিশ সালেই রোসেলিনি এই সিনেমার কাজ শুরু করেন। নামকরণ করেণ ‘রোম, ওপেন সিটি। ফ্যাসিবাদ নামক ভয়ানক দানবের বিরুদ্ধে উনি ক্যামেরাকে দাঁড় করিয়েছেন। সত্যিকার ফিল্মমেকারের ক্যামেরা এরকমই হয়। এই সিনেমায় স্ক্রিপ্টে উনাকে সহযোগিতা করেছেন বিশ্বসিনেমার আরেক দিকপাল ফেদেরিকো ফেলিনি। যদিও ফেলিনির কাজের প্রভাব এই সিনেমায় তেমন নেই। ‘রোম, ওপেন সিটি’র ভেতরকার যে স্পিরিট তা ঋত্বিক ঘটককে হয় তো মনে করিয়ে দেবে, বা সত্যজিৎ বা মৃণাল সেনকে। রোসেলিনি প্রচলিত অর্থে ধার্মীক ছিলেন না কিন্তু খ্রিস্টীয় আধ্যাত্মবাদে এক ধরণের শ্রদ্ধা ছিল তার। সেই সঙ্গে বিশ্বযুদ্ধ পৃথিবীর সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্রগুলোর ভিতরকার নগ্ন খেয়োখেয়ি আর সাধারণ মানুষের অসহনীয় ভোগান্তি তাকে তাকে বিমুঢ় করে তুলেছিল। বলা যায় তারকোভস্কির মনোজগতের সঙ্গে এর সামঞ্জস্য রয়েছে। রাষ্ট্র এবং সহকর্মী বন্ধুদের সঙ্গে বিরোধও এই জায়গায়। এটা যেন নিয়তি। ঋত্বিককে এই নিয়তি ভোগ করতে হয়েছিল। সেসময় ইতালি আর জার্মানি দুটো দেশের ঘাড়েই চেপে বসে ছিল ফ্যাসিবাদ। এরা পুরো পৃথিবীটাকেই অপমান করছিল, বিপর্যস্ত করে তুলছিল। শেষে এক রাক্ষস আরেক রাক্ষসের ঘাড় কামড়ে ধরে। এ এক মারাত্মক পরিণতি!  আমরা জানি, ইতালিয়ানরা কম পয়সায় সিনেমা করতে ওস্তাদ। আর সহজভাবে যেটা সাধারণ মানুষের চোখে সহনীয় তেমনভাবে ক্যামেরা ধরতে ওরা পছন্দ করে। ফরাসি আর জার্মানরা এক্ষেত্রে একটু খাপছাড়া। ওরা ঋদ্ধ দর্শককে আগ্রহী করতে, নাড়া দিতে বা খ্যাপাতে পছন্দ করে। গঁদার বা ক্রুফোর কথা তো বলাই যায়। ফরাসিদের ভেতর জঁ রেনোয়াকে রোসেলিনির অনেকটা কাছের মনে হবে। কেন? অনেক প্রস্ন আর হতাশার পরও এদের ক্যামেরা জ্বলে ওঠে মানবিকতার আলোয়। একজন সাধারণ দর্শক হিসেবে ‘রোম, ওপেন সিটি’র আঁচ এভাবেই আমি পেয়েছি আমার অনুভূতিতে। প্রতিভাস ম্যাগাজিন

আন্দ্রেই রুবলভ (১৯৬৬)

‘আন্দ্রেই রুবলভ’ দেখতে গিয়ে বারবার মনে হয়েছে আমি কবিতা পড়ছি। তারকোভস্কির সিনেমা তো আসলে কবিতাই। ‘ইভান’স চাইল্ডহুড’-এর পর ‘আন্দ্রেই রুবলভ’ তারকোভস্কির দ্বিতীয় ফিচার ফিল্ম। ‘ইভান’স চাইল্ডহুড’ মুক্তি পায় ১৯৬২ সালে আর ‘আন্দ্রেই রুবলভ ১৯৬৬ সালে। প্রথম মুভিতেই কবিতা ছিল। আর দ্বিতীয় মুভি সুবিশাল সময় পরিসরের ‘আন্দ্রেই রুবলভ’ তো ১০ লাইনের ছোট্ট একটা কবিতা যার অনুরণন দর্শকের চেতনায় সর্বগ্রাসী। তারকোভস্কিকে বলা হয় ‘সিনেমার কবি’। আবার কেউ কেউ বলেন ‘সিনেমার বুদ্ধ’। হ্যা, আমরা জানি, তারকোভস্কির পিতা ইউক্রেন বংশোদ্ভূত আর্সেনি তারকোভস্কি ছিলেন রাশিয়ার একজন জনপ্রিয় কবি। এই কবি পিতার প্রভাব তারকোভস্কিকে জীবনভর আচ্ছন্ন করে রেখেছিল। এই পারস্পর্য থেকেই হয়তো রাশিয়ায় ১৫ শতকের আইকন পেইন্টার ও কবি আন্দ্রেই রুবলেভকে নিয়ে তারকোভস্কি নির্মাণ করেন ‘আন্দ্রেই রুবলভ’। তারকোভস্কির সেই আইকনিক দীর্ঘ দীর্ঘ শটের সমষ্টি এই সিনেমা যা চিত্রশিল্পী রুবলভের দুর্বিনীত সময়ের দাসত্বের মধ্যে লড়াই আর আধ্যাত্মিকতার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ বলা যায়। রুবলভের ছিল শিশুর নিষ্কলুষ দৃষ্টি অথচ তার সামনে ঘটে চলছিল একের পর এক পাশবিক হিংস্রতা ও নারকীয় ভয়াবহতা। রুবলভ চেয়েছিলেন শুভচেতনা দিয়ে মানবিক পৃথিবী গড়তে। এর জন্য পঙ্কিল ও ব্যধিগ্রস্ত পৃথিবীকে পরিবর্তন করা দরকার। একাজে মানুষের ভিতর সহমর্মীতার উন্মেষ দরকার। এই আকুতিই রুবলভকে তাড়িয়ে বেড়িয়েছে। তাড়িত হয়েছেন তারকোভস্কি। এই সিনেমায় প্রথমেই আমরা গরম বায়ুচালিত একটি বেলুন ওড়ানোর কশরত দেখি। ইয়েফিম নামে একজন বেলুনের নিচের দড়িকে বর্ম হিসেবে ব্যাহার করে উড়তে চেয়েছিল। কিন্ত তা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয় কিছু অজ্ঞ মানুষের নিষ্ঠুরতায়। এখানে আমরা দেখি একটি বিষন্ন ঘোড়ার গড়াগড়ি। ঘোড়া প্রতীক তারকোভস্কির সিনেমায় আমরা বারবার দেখি। কিন্তু তা বাকুড়ার ঘোড়া বা ফিদা হুসেনের ঘোড়া থেকে অবশ্যই পৃথক। যদিও ট্র্যাডিশনের দিক থেকে রুশ আর ভারতের ঘোড়ায় মিল আছে। জয়নুলের চিত্রে যেমন কাক, দালির চিত্রে ঘড়ি বা পিঁপড়ে, তেমনি তারকোভস্কির ক্যামেরায় ঘোড়া। ঘোড়া মারাত্মক সব ইমেজ নিয়ে ওর সিনেমায় হাজির থাকে। বলে রাখা ভাল, ‘আন্দ্রেই রুবলভ’র অনেকগুলো ভার্সন বাজারে আছে। এটা হয়েছে রাষ্ট্র কর্তৃক শিল্পীর স্বাধিনতায় পরিপূর্ণ শ্রদ্ধাবোধ না থাকার কারণে। একটানা সতেরো বছর তারকোকস্কিকে সিনেমার বাইরেও থাকতে হয়েছে। সশরীরে উনি ইউরোপকে কাজের ক্ষেত্র করেছেন জীবনের শেষ দিকে। যদিও ওর ডায়েরিতে আমরা উল্লেখ পাই, ওটা ছিল রাজনৈতিক উৎপাত থেকে মুক্তি পেতে উত্তপ্ত কড়াইতে ঝাঁপিয়ে পড়বার মতো অবস্থা অনেকটা। আমরা জানি তারকোভস্কি একাধারে ফিল্মমেকার, লেখক, ফিল্ম এডিটর ও ফিল্ম থিওরিস্ট। অনেক সিনেমাবোদ্ধার মতে আইজেনস্টাইনের পর তারকোভস্কিই রাশিয়ার সবচে বিখ্যাত ফিল্মমেকার। যা হোক, তারকোভস্কির অন্যান্য সিনেমার মতো এই সিনেমায়ও যে এতো এতো লং শট  আর মন্থর গতির স্বতস্ফূর্ত সিনেমাটোগ্রাফির ব্যবহার তা কি কেবলই কবি পিতা আর ধ্রুপদী চিত্রশিল্পী আন্দ্রেই রুবলভের আধ্যাত্মকতা থেকে প্রাপ্ত? আর লং শটের তাৎপর্যপূর্ণ ব্যবহার? আর অপ্রচলিত প্লট কাঠামোয় ক্যামেরার মন্থর চলন? এটার কারণ সম্ভবত সময়ের অনুভূতিতে দর্শকের মনোনিবেশ নিবদ্ধ করা। সাধারণত আমরা দেখি, পরবর্তীতে কী ঘটবে এই উত্তেজনায় দর্শক আবদ্ধ থাকে। তারকোভস্কির অভীষ্ট লক্ষ্য আলাদা। উনি চান বর্তমান সময়ের অনুভূতিতে স্ফূরিত হয়ে দর্শক কালের অচলায়তন ভাংতে অনুপ্রাণিত হবেন। দর্শক ঐ সময়ের ল্যান্ডস্কেপ বা পোর্ট্রেটের কালহীন অনুভূতিতে জারিত হবেন। এমন কি শূন্য ফ্রেমও হয়ে উঠবে অপ্রচলিত ও নিজস্বতায় তাৎপর্যপূণ। আমরা জানি, তারকোভস্কি অল্প সময়ের জন্য মিউজিক স্কুলে পড়েছেন,  ড্রইংয়ে হাত পাকিয়েছেন, গোপনে কবিতাও লিখেছেন। কবিতার প্রতি এই আগ্রহই তারকোভস্কিকে দিয়ে ক্যামেরার মাধ্যমে লিখিয়ে নিয়েছে ‘ইভান’স চাইল্ডহুড’, ‘আন্দ্রেই রুবলভ’, ‘মিরর’, বা ‘স্টকার’র মতো একটার পর একটা কবিতা। অবশ্য ওর ফিল্মের সংখ্যা হাতেগোনা। ৭ টি ফিচার ফিল্ম, ১ টি প্রামাণ্যচিত্র। সবগুলোই কবিতা। হ্যা, ছোট্ট একটা কবিতা এইমাত্র আমি পড়ে শেষ করলাম, ২২৫ মিনিট সময়পর্বের। কবিতার নাম ‘আন্দ্রেই রুবলভ’। প্রতিভাস ম্যাগাজিন

The Seventh Seal (1957)

বায়োলোজিক্যাল স্ট্র্যাকচার ছাড়াও মানুষ এমন এক সত্তা যার খোঁজে কবি, লেখক, শিল্পী, সাহিত্যিক, দার্শনিক, বিজ্ঞানী সবাই হন্যে হয়েছেন। গ্রিক দার্শনিক বলছেন, Know Thyself আর কিয়ারোস্তামির এক চরিত্র (Test of Cherry) নিজের মৃত্যুর সঙ্গে বোঝাপড়া করতে স্বস্তিমতো একটা জায়গা খুঁজে বেড়াচ্ছেন তেহরানের রাস্তায় রাস্তায়। বরাবর আমরা দেখেছি, কবি-শিল্পীরা মৃত্যুকে হয় মহিমান্বিত করছেন অথরা তাকে উপস্থাপন করছেন বিভৎসরূপে। কিন্তু মৃত্যু তো মৃত্যুই আর মানুষ শেষ অব্দি মানুষ। যা হোক ইঙ্গমার বার্গম্যানের The Seventh Seal মৃত্যু বিষয়ক কোন প্রতিবেদন আমাদের দেয় না। সাহসী মানুষেরা জীবনকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে নেয়। গল্প-উপন্যাসেও এমনটা আমরা দেখি। মার্কসীয় সমাজতান্ত্রিক বাস্তবতা তো এটাকে সমর্থন করেই, নারীবাদেও ওটাকে বড় পরিসরে আমরা দেখতে পাই। বার্গম্যানের এই চরিত্র কিন্তু জীবনকে না, মৃত্যুকে চ্যালেঞ্জ করে বসে। এটা আমাদের ভাবনার বৈচিত্রময় পরিসরে পূর্বে কখনও জায়গা পায়নি। জীবদ্দশায় বার্গম্যান নির্মাণ করেছেন ৪৯ টি চলচিত্র যার মধ্যে ৪৫ টি ফিচার ফিল্ম আর ৪ টি ডকুমেন্টারি। এই বিপুল সৃষ্টির ফ্রেমিং ও লেন্সিংয়ে নিজেকে কখনও তিনি অস্বস্তিতে পড়তে দেননি। তার দার্শনিক সত্তাকে নিজের মতো তিনি চলতে দিয়েছেন, গভীর জটিল সত্যের সঙ্গে অসততা করেননি। বলে নেওয়া ভাল, বাবা ধর্মজাজক হওয়ায় ছোটবেরা থেকেই ধর্মীয় আবহে বড় হয়েছেন বার্গম্যান। তাই ধর্ম ও ঈশ্বরের প্রভাব তার চলচিত্রে লক্ষ্ণণীয়ভাবে অনুভব করা যায়। বার্গম্যান অবশ্য সামগ্রিকভাবে তার কাজকে আত্মজৈবনিক বলেই মনে করেছেন। অর্থাৎ নিজেকে দেখা আর নিজের ইতি-নেতির ব্যাপারে নিজে বিচারকের আসন নেওয়া, এটা পরবর্তীতে ভর করেছিল তারকোভস্কি, কুরোসাওয়া বা কিয়ারোস্তামির কাজেও। বার্গম্যানের এই প্রভাবকে এরা অকুন্ঠচিত্তে স্বীকারও করেছেন। এদের এই খ্রীস্টীয় নৈতিকতা অবশ্য ঋত্বিক ঘটকের কাছে আদৌ ভাল লাগেনি। কেন ভাল লাগেনি সেই আলোচনায় গেলে যে আদর্শিক ও দার্শনিক পরিসরে সিনেমার এই মহাপরিচালকদের বিচরণ সেখানে অনেক দ্বন্দ্বসংঘাতে আমাদের জড়িয়ে পড়তে হবে। আমরা সেদিকে যাব না। তাহলে কি আমরা The Seventh Seal দেখার সময় খ্রিস্টিয়ো নৈতিকতায় নিজেদেরকে জারিত করে নেবো? না, এর দরকার হবে না। ভাটিক্যানের সিসটিন চ্যাপেলের নিচে দাঁড়িয়ে খ্রিস্টিয়ো নৈতিকতায় আমাদেরকে দীক্ষা নিতে হয় না। মাইকেলাঞ্জেলোর ‘ডেভিড’ বা লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চির ‘দ্য লাস্ট সাপার’-এর সামনে কোন শিল্পগ্রাহী নিজেকে ঈশ্বরের ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র সেবক মনে করেন না। শিল্পই বরং ঈশ্বরকে সৃষ্টি করে। সে ঈশ্বর অবশ্য মানুষের ভিতরই বাস করে। আসলে বার্গম্যান কি জীবন বা মৃত্যুকেন্দ্রিক কোন দার্শনিক পরিক্রমায় নেমেছেন? না। মৃত্যদূত যখন সমুদ্রতীরে লোকটার সামনে এসে দাঁড়ায় লোকটার ভিতর দ্বিধা বা ভীতি আমরা দেখতে পাইনি। বরং সে যেন মৃত্যুদূতকে বিভ্রান্তিতে ফেলে দিতে চায়। সে চায় মৃত্যুর আগে মৃত্যুদূত তার সঙ্গে দাবা খেলায় বসুক। সে জানে মৃত্যুদূত দাবাখেলা পছন্দ করে। তার সামর্থ্য থাকলে সে তাকে হারিয়ে দিক। এরপর সিনেমাটা যেভাবে এগোয় তাতে মানবসত্তার যে অজ্ঞেয় ল্যান্ডস্কেপ সেখানে আমরা প্রবেশ করি। আমাদের প্রচলিত যে জীবনবাস্তবতা  সেটা থেকে আমরা নিজেদেরকে আলাদাভাবে উপলব্ধি করি। এটাকে বলা যেতে পারে নিজের দিকে ফিরে তাকানো। নিজেকে দেখা। নিজের সঙ্গে বোঝাপড়া। এখন আপনারা বলতে পারেন এই কাজটা কে করেননি? এই খোঁজা বা বোঝাপড়া শ্রীচৈতন্য তার ভক্তিবাদে চারিয়ে দিয়েছেন। যদিও তা একসময যুক্তিহীনতার অকৃতিতে পানসে হয়ে গেছে তা। ভারতবর্ষে চার্বাকরা এই বোঝাপড়ার ক্ষেত্রটাকে অনেক বড় করতে পেরেছেন, স্থবির সমাজবাস্তবতায় ঢেউ তুলেছেন, আঘাত করেছেন। রেনেসাঁশিল্পীরা যে দেবতাদের দিক থেকে মানুষের দিকে ফিরতে পারলেন এটাও তো নিজের সঙ্গে কথাবার্তা বলতে পারার কারণেই। রদাঁ যে ‘নরকের দরজা’ (১৮৮০-১৯১৭) আমাদের সামনে উম্মোচন করলেন সেখানে কি কেবলই অপরাধীদেরকে আমরা পাই? না, জগতের সব মানুষকেই আমরা দেখি। এমন কি সেখানে আমিও আছি। পূর্বে এমনটা দেখা যায়নি। সেভেন্থ সিলে বার্গম্যান এভাবে জীবন যাপনের বিভিন্ন প্রক্ষিতে নিজেকে দেখতে চেয়েছেন। প্রতি মুহূর্তে নিজের সঙ্গে চলেছে তার বোঝাপড়া। এই বোঝাপড়া যে সব সময় ব্যাক্তির জন্য সুখকর-স্বস্তিকর-আরামদায়ক হবে এমনটাও তো না! ফ্রিদা কালো যেভাবে The Two Fridas আত্মপ্রতিকৃতিতে নিজের মুখোমুখি হয়েছেন, ব্যাপারটা তো একই। গ্রেকোরোমান ভাস্কর্যে ও স্থাপত্যকর্মে  মহত্ম আছে, জিজ্ঞাসা নেই। শিল্পীরা যে এতো এতো প্রতিকৃতি এঁকেছেন, এগুলো কেন? আর জিয়াকোমেত্তির কঙ্কালসার ফিগার? এসব হলো নিজের সঙ্গে কথা বলতে পারা, আপন সত্তার মুখোমুখি দাঁড়াবার সাহস বা আকাঙ্ক্ষা। শিল্পীরা বরাবরই এটা করে এসেছেন। এঁকেছেন আত্মপ্রতিকৃতি। এমন কি এদের স্টিল লাইফগুলোতেও আপন আপন সত্তার অনুরণন-সংশ্লেষণ-বীজারণ। তারপর ধরো হোকুসাই (১৭৬০-১৮৪৯) যে মাউন্ট ফুজিকে ছত্রিশটি কোণ (Thirty Six Views of Mount Fuji / 1830-1832) থেকে দেখেছেন, সেটা কী? এই দেখার ভিতর কি জাপানি মনন নেই? নেই দ্রোহ, বিষাদ, হতাশা, পরাজয়? The Seventh Seal সিনেমায় এই আত্মজিজ্ঞাসা শুরু থেকে শেষ অব্দি জারি রয়েছে। আসলে এখানে বার্গম্যান জীবন বা মৃত্যুকে নিয়ে কাহিনী রচনা করেননি। একই মানুষের দুটি সত্তা। এদেরকে মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেওয়া মানে মারাত্মক পরিস্থিতির সম্মুখিন হওয়া। হ্যা, বার্গম্যানের সবগুলো সিনেমাতেই পাওয়া যায় এক ধরণের সুইডিশ নির্জনতা ও সান্ত্রিতিকতা। এর কেন্দ্রে আছে মানুষ। মানুষের ভিতরকার দ্বন্দ্ব-আহ্বান বরাবর ছুঁতে চেয়েছেন বার্গম্যান। আর এটা সেই কোথায়? Wild Strawberries (1957), The Virgin Spring (1960), Through a Glass Darkly (1961), Winter Light (1963), The Silence (1963), Persona (1966) সহ সবগুলো সিনেমায়ই আমরা দেখি বার্গম্যানের চরিত্ররা ওদের নিজস্ব দ্বন্দ্ব নিয়ে ভিন্ন ভিন্ন প্রেক্ষিতে উপস্থিত হয়। বার্গম্যানের ক্যামেরা আমাদেরকে দেখায় মানবিক অনুভূতির দ্বন্দ্ব-বিকাশ-বিচ্যূরণ। আর উনি যেহেতু মূলত নাটকের মানুষ (নিজের ব্যাপারে ওনার মূল্যায়ন এমনই। উনি বলতেন যে সিনেমা ওনার স্ত্রী আর নাটক ওনার প্রেমিকা।) তাই  ব্যাক্তির ভেতরকার দ্বন্দ্ব-সংঘাতের প্রতি উনার মনযোগী হওয়াটা বেশ স্বাভাবিক। দাবা খেলাটা কেবল উছলত। বলা যায়, মৃত্যুদূতের সামনে বার্গম্যান স্বাভাবিক একজন মানুষকেই উপস্থাপন করেছেন। মানুষের বেঁচে থাকা, সংগ্রাম, প্রেম, স্নেহমমতা, অপরাধপ্রবণতা সবকিছুই একজন মৃত্যুদূতের সামনে উঠে আসে। সবকিছুর সঙ্গেই সে নিজেকে মিলিয়ে দেখতে পারে। হ্যা, মৃত্যুদূত আর মৃত্যুপথযাত্রী লোক কি আলাদা না একই ব্যাক্তি,  দর্শকের মনে এই প্রশ্নও তো আসতে পারে এক সময়। এই খেলাটাই বার্গম্যান খেলেছেন তার দর্শকের সঙ্গে। এটাই তার নিজস্ব খেলা, নিজের সঙ্গে, একই সঙ্গে দর্শককে নিয়েও। তার খেলার ভিতর ফেলিনির নাটকীয়তা নেই, মৃণাল সেনের মার্কসীয় দ্বন্দ্ব নেই। তারকোভস্কির কাব্যময়তার স্ফূরণ কিছুটা আছে অবশ্যই, এটা না মেনে উপায় নেই। আর আছে সাদা-কালোয় ফরাসি ইম্প্রেশনিস্টদের মতো বস্তুকে দেখার, অনুভব করবার আলাদা চোখ। এটা আমরা ‘ওয়াইল্ড স্ট্রবেরি’তে দেখি, ‘পারছোনা’তেও দেখি। তবে এভাবে দেখতে গিয়ে বস্তুর সামগ্রিক সার্বভৌম অস্তিত্বকে বার্গম্যান কখনো অস্বীকার করেননি। বরং পিকাসো, ব্র্যাক বা আইনস্টাইনের সঙ্গে বার্গম্যান নিজেকে একাত্ম করতে পেরেছেন, বস্তুকে বিভিন্ন দিক থেকে দেখতে পারার আলাদা চোখ নিয়েও। বার্গম্যানের সঙ্গে নরকের একটার পর একটা দরজা আমরা পার হই, সেজানের রেখা ও রঙের ঋজুতায়। কোথাও তুলি টলে যাবার আশঙ্কা নেই। শেষ অব্দি বার্গম্যান তার ‘দ্য সেভেন্থ সিল’-য়ে এই রিদম ও ঋজুতা ধরে রাখতে কোন খামতি রাখেননি, সিনেমা প্রেমিদের জন্য এটা বাড়তি পাওয়া। বলার অপেক্ষা রাখে না, বার্গম্যানের কাছে এই প্রত্যাশা খুব স্বাভাবিক।

প্রতিভাস ম্যাগাজিন | Prativas Magazine

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *