বিদ্যাসাগর তখন সামাজিক আচারগুলির সংস্কারের জন্য চেষ্টা করছিলেন। একদিন তার বারাসাতবাসী বন্ধু কালীকৃষ্ণ তাঁর জন্য কিছু আমের আচার তৈরি করে পাঠান। পরে দেখা হলে বিদ্যাসাগর বন্ধুকে আমের আচারের খুব সুখ্যাতি করেন। কালীকৃষ্ণ হেসে বলেন, ‘তাহলে বিদ্যাসাগর, তুমিও স্বীকার করো, এদেশের সব আচার কু-আচার নয়, কেমন?’

.

.

দাদাঠাকুরের উপাধি কেন পন্ডিত হলো জানতে চাইলে তিনি তার ব্যাখ্যা এভাবে দিলেন, ‘আমার উপাধি পন্ডিত কী করে? কেন হবেনা? কোন জিনিস যখন খণ্ড খন্ড করা হয় তখন তাকে বলা হয় খন্ডিত। ঠিক সেই রকম আমি যেখানে যাই সব কাজ পন্ড হয়ে যায়—- তাই আমি পন্ডিত।’

.

.

এক বন্ধু রবীন্দ্রনাথকে নিজের বাড়িতে নিমন্ত্রণ করেছেন। কবিগুরু এলে পর ভদ্রলোক তাঁর আপ্যায়নে খুব ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। একটি সুদৃশ্য চেয়ার এগিয়ে দিলেন বসার জন্য। চেয়ারটি দেখে কবি গম্ভীর ভাবে জিজ্ঞেস করলেন, ‘চেয়ারটি সজীব নয় তো?’ প্রশ্ন শুনে ভদ্রলোক অবাক। চেয়ার আবার সজীব হয় কিভাবে? চেয়ার তো নিষ্প্রাণ জড় পদার্থ। উনি ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলেন। তাই দেখে রবীন্দ্রনাথ হাসতে হাসতে বললেন, ‘তোমার ভাবনার কিছু নেই। আমি বলছি চেয়ারটি স-জীব অর্থাৎ ওতে ছারপোকা নেই তো?’

.

.

সন্ধ্যের পর হেঁটে হাওড়ার কাঠের পুল পার হওয়ার সময় এক পকেটমারের খপ্পরে পড়লেন শরৎচন্দ্র। লোকটা তার পকেট থেকে চেনশুদ্ধ ঘড়িটা তুলে নিতে হাত বাড়িয়েছে আর শরৎচন্দ্রও খপ করে হাতটা ধরে ফেললেন। অপ্রস্তুত পকেটমার সঙ্গে সঙ্গে জিজ্ঞেস করে, ‘স্যার, কটা বেজেছে?’ শরৎচন্দ্র তৎক্ষণাৎ জবাব দেন, ‘ভাগ্যিস বারোটা বাজেনি।’

.

.

কবিগুরুর সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন এক ভদ্রলোক। তিনি শুনেছিলেন ইদানিং কবি কানে একটু কম শুনছেন। সাক্ষাতের সময় রবীন্দ্রনাথ ভদ্রলোককে নাম জিজ্ঞেস করতেই তিনি সজোরে চিৎকার করে বলেন, ‘কানাই’। রবীন্দ্রনাথ মৃদু হেসে বলেন, ‘সানাই হলেই তো ভালো হতো!’

.

.

দাদাঠাকুরের আসল পরিচয় দিয়ে মহামোহপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রীমশাই লিখেছিলেন, ‘বিদূষকের এডিটর, প্রুফ রিডার, কম্পোজিটর, ডেসপ্যাচার—- তিনি কেবল সাবস্ক্রাইবার নন। সেকালে ভাঁড়ের কথা শুনেছিলুম তিনি সেই ভাঁড়। তিনি খুব তেজস্বী ব্রাহ্মণ, বেশ মিষ্টি করে সকলকে হক কথা শুনিয়ে দেন।’

.

.

শরৎচন্দ্র তখন খ্যাতির মধ্যগগনে। এসময় দ্বিতীয় এক শরৎচন্দ্রের আবির্ভাব হয়। ইনি ছিলেন গল্পলহরী মাসিক পত্রের সম্পাদক। বেশ কয়েকটি উপন্যাসও উনি রচনা করেন। এঁর কারণে আসল শরৎচন্দ্রের সুনাম কিছুটা ক্ষুন্ন হয়। এ সময় একদিন এক বাল্যবন্ধুর সঙ্গে দেখা শরৎচন্দ্রের। বন্ধু তো তার মুখের দিকে হাঁ করে চেয়ে রইলেন।শরৎচন্দ্র তাই দেখে বললেন, ‘কিহে, চিনতে পারছ না, আমি শরৎ।’ বন্ধু রসিকতা করে বললেন, ‘আজকাল সাহিত্যের বাজারে দুজন শরৎচন্দ্রের আবির্ভাব ঘটেছে, তুমি কোনজন?’ শরৎচন্দ্র রসিকতা করে জবাব দিলেন, ‘চরিত্রহীন।’

.

.

নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু একবার মঞ্চে বক্তৃতা দিচ্ছিলেন। বক্তৃতা চলাকালীন সুভাষচন্দ্রের বিরোধী পক্ষের একজন শ্রোতা হঠাৎ তাঁকে লক্ষ্য করে এক পাটি জুতো ছোড়ে। সুভাষচন্দ্র বক্তৃতা থামিয়ে শ্রোতাদের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘আপনি দয়া করে অপরপাটি জুতোটাও ছুড়ে দিন। না হলে, এক পাটি জুতো আপনি পড়তে পারবেন না, আমারও এটা কোন কাজে লাগবে না।’ সভায় হাসির রোল পড়ে গেল।

.

.

পটলডাঙার পথ দিয়ে একদিন বিদ্যাসাগর যাচ্ছিলেন। পথ চলতেন তিনি খুব দ্রুত পায়ে। তো সেদিনও হনহন করে চলতে গিয়ে এক ভদ্রমহিলার গায়ে তার চটি জুতোর ধুলো লেগে গেল। বিদ্যাসাগরের বেশভূষা দেখে ভদ্রমহিলা চোখ পাকিয়ে বলে উঠলেন, ‘আ মরণ, উড়ের তেজ দেখো!’

.

.

একদিন এক নিমন্ত্রণের আসরে গেছেন বিদ্যাসাগর আর বঙ্কিমচন্দ্র। দুজনের মধ্যেই বেশ হৃদ্যতা ছিল। বিদ্যাসাগরের বেশভূষা বরাবরের মতো, পায়ে সেই পরিচিত চটি জুতো। তাই দেখে বঙ্কিমচন্দ্র পরিহাস করে বললেন, ‘আপনার চটির ডগা যে বেঁকে উপরে উঠে যাচ্ছে!’ বিদ্যাসাগর দমবার পাত্র নন। তিনি বঙ্কিমচন্দ্রের কথা শেষ হতে না হতেই জবাব দিলেন, ‘হ্যাঁ, চট্টোপাধ্যায় পুরনো হলে বঙ্কিম হয়।’ চট্টোপাধ্যায় বলতে বিদ্যাসাগর এখানে চটি জোড়াকেই বুঝিয়েছিলেন।

.

.

রবীন্দ্রনাথ পিঠে খেতে ভালোবাসতেন বলে এক ভদ্রমহিলা তাঁর জন্য পিঠে তৈরি করে পাঠিয়ে দিলেন। কিছুদিন পর গুরুদেবের সঙ্গে দেখা হতে তিনি পিঠে কেমন হয়েছিল জানতে চান। রবীন্দ্রনাথ মৃদু হেসে বললেন, ‘শুনবে, নেহাৎ যখন শুনতে চাও বলি। লোহা কঠিন, পাথর কঠিন আর কঠিন ইষ্টক, তার অধিক কঠিন কন্যে তোমার হাতের পিষ্টক।’

.

.

ভূদেব মুখোপাধ্যায় ছিলেন বিদ্যালয় পরিদর্শক। একবার একটি গ্রামের স্কুল পরিদর্শন করতে গিয়ে ক্লাসে ঢুকে একটি ছেলের নাম জিজ্ঞেস করলেন। ছেলেটি নাম বলল, ‘ত্রপণ দ্রাস।’ ভূদেববাবু তখন বিদ্যালয়ের শিক্ষককে জিজ্ঞেস করলেন, ‘ছেলেটি কোন ক্লাসে পড়ে ?’ শিক্ষক উত্তর দিলেন, ‘দ্রিতীয় শ্রেণীতে।’ ভূদেববাবু বললেন, ‘ব্রেশ ব্রেশ।’

.

.

শরৎচন্দ্র রেঙ্গুন থেকে ফিরে এলেন দাড়ি নিয়ে, সেই দাড়ি আর কাটেন না। হঠাৎই একদিন আবার সব দাড়ি কেটে ফেললেন। তাঁর এই দাড়ি কাটার কারণটা তিনি বলেছিলেন সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়কে। লম্বা দাড়ি নিয়ে একদিন ট্রেনে কোথাও যাওয়ার সময় তার ঠিক পাশে বসেছিলেন এক মুসলমান ভদ্রলোক। তো তিনি শরৎচন্দ্রকে তাঁর মত মুসলমান ভেবে খুব খাতির করে এক খিলি পান বাড়িয়ে ধরে বললেন, ‘ভাই সাহেব, এই নিন, পান খান।’ এই ঘটনার পরেই শরৎচন্দ্র দাড়ি কেটে ফেলেন।

.

.

সাহিত্যিক শিবরাম চক্রবর্তী কলেজ স্ট্রিটের দিলখুসা কেবিনে প্রায়ই চা-টা খেতে যেতেন। একবার চায়ের কাপ মুখে তুলেই তিনি বেয়ারাকে হাঁক পাড়লেন। বেয়ারা এসে সামনে দাঁড়াতেই তিনি বললেন, ‘এটা যদি চা হয় তবে আমাকে কফি দাও।  আর এটা যদি কফি হয় তাহলে আমাকে চা দাও।’

.

.

বার্নার্ড শ’ যখন খ্যাতির শীর্ষে, তখনই তাঁকে নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়। কিন্তু শ’ সে পুরস্কার গ্রহণ করেননি। রসিকতা করে বলেছিলেন, ‘আমি এবছর কোন বই লিখিনি—- সেই স্বস্তিতেই নোবেল কমিটি আমাকে পুরস্কৃত করেছে।’

.

.

বিশ্ব বিখ্যাত বৈজ্ঞানিক আইনস্টাইনের বাড়িতে গেছে এক সাংবাদিক। ঘুরে ঘুরে সব দেখেশুনে সে আইনস্টাইনকে প্রশ্ন করল, ‘আপনার গবেষণাগার আর যন্ত্রপাতি কোথায় ?’ আইনস্টাইন নিজের মাথাটি দেখিয়ে বললেন, ‘এটাই আমার গবেষণাগার।’ আর হাতের পেন্সিল দেখিয়ে বললেন, ‘এই হল আমার যন্ত্রপাতি।’

.

.

বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন। তাঁর এজলাসে একবার একটি মামলা ওঠে। জনৈক ব্যক্তি অন্য একজনের সম্পর্কে অভিযোগ জানিয়ে বলে যে তার স্ত্রীর ওপর দ্বিতীয় ব্যক্তি দৃষ্টিনিক্ষেপ করেছে। বঙ্কিমচন্দ্র জিজ্ঞেস করলেন, ‘সাক্ষী আছে ?’ প্রথম ব্যক্তি বলল, ‘হুজুর, আমার স্ত্রী-ই সাক্ষী। সে-ই দেখেছে।’ বঙ্কিমচন্দ্র মৃদু হেসে বললেন, ‘তাহলে দেখা যাচ্ছে যে তোমার স্ত্রীরও পরপুরুষের ওপর কটাক্ষপাত করা অভ্যেস আছে। নতুবা তিনি কেমন করে জানলেন যে এই ব্যক্তি তার প্রতি দৃষ্টি নিক্ষেপ করেছে ?’

.

.

অক্ষয় সরকার তখন ঢাকায় থাকেন। একদিন তিনি মেঘনাথবধ নাটক দেখতে গেছেন। সঙ্গে আছেন তাঁর বাবা গঙ্গাচরণ। মেঘনাথ বধ হওয়ার পর প্রমীলা সহমরণে যাওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছেন। রাবণ বক্তৃতা দিয়ে চলে গেছেন। মঞ্চে আর কোন জনপ্রাণী নেই। প্রমীলা বেচারা নিজেই নিজের চিতা ফুঁ দিয়ে জ্বালাতে লাগলেন। এই দৃশ্য দেখে অক্ষয় সরকার যথেষ্ট বিরক্তির সঙ্গে বলে উঠলেন, ‘এদের কি কেউ নেই নাকি ? ভৃত্য, পরিচারকেরা সব গেল কোথায়?’ তাঁর বাবা গঙ্গাচরণ তাই শুনে বললেন, ‘রাম কি আর কিছু বাকি রেখেছে ? পুরো রাক্ষসপুরী শূন্য করে দিয়েছে।’ 

.

.

কোন এক বন্ধুর দ্বিতীয় পক্ষের বিয়েতে গিয়েছিলেন রজনীকান্ত সেন। বিয়ের পর ফেরার পথে নববধূর প্রবল জ্বর হয়েছিল। বন্ধুটি থার্মোমিটারে জ্বর পরীক্ষা করে দেখলেন, তারপর রজনীকান্তকে এসে জানালেন, ‘জ্বর ১০৩ হয়েছে।’ রজনীকান্ত হেসে বললেন, ‘আগেও এক সতীন, এখনও ১০৩।’

.

.

এক ভোজের আসরে গেছেন নজরুল। পরিবেশন চলছে, প্রায় শেষের দিকে। এমন সময় একজন পরিবেশনকারী লুচির ঝুড়িটা হাতে নিয়ে নজরুলের কাছে এসে বললেন, ‘আর লুচি দেবো ?’ শুনে নজরুল বললেন, ‘না, আর লুচি লাগবেনা।  আমি বেলুচিস্তানের লোক।’

.

.

সাহিত্যিক দামোদর মুখুজ্জে সম্পর্কে ছিলেন বঙ্কিমচন্দ্রের বেয়াই। শাস্তি নামে একটি উপন্যাস লিখে তিনি বঙ্কিমচন্দ্রকে উপহার দিয়েছিলেন। উপহার পেয়ে বঙ্কিমচন্দ্র উত্তরে দামোদর মুখুজ্জের উদ্দেশ্যে লিখলেন, ‘প্রিয়তমেষু শাস্তিপ্রাপ্ত হইলাম। ইহলোকে পাইলাম, পরলোকেও ভরসা করি দামোদর বঞ্চিত করিবেন না।’ 

.

.

দামোদর মুখুজ্জে বঙ্কিমচন্দ্রের কয়েকটি উপন্যাসের উপসংহার লিখেছিলেন। সেইসব উপসংহার বিশেষ সুবিধের হয়নি। বঙ্কিমচন্দ্রও পছন্দ করেননি। তাই তিনি দামোদরকে ঠাট্টা করে বলেছিলেন, ‘আপনি আমার উপন্যাসের উপসংহার লিখে আমাকে সংহার করেছেন।’ 

.

.

একদিন বাদশাহ আকবর বীরবলকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘আমি বড় না ঈশ্বর বড় ?’ বীরবল বললেন, ‘আপনিই বড়।’ বাদশাহ বললেন, ‘কিসে ?’ বীরবল উত্তর দিলেন, ‘আপনি ইচ্ছে করলে যে কোন প্রজাকে রাজ্য থেকে বার করে দিতে পারেন। কিন্তু ঈশ্বর কোন প্রজাকে তার নিজ রাজ্য থেকে বার করে দিতে পারেন না।’ উত্তর শুনে আকবর হাসতে লাগলেন।

.

.

রসরাজ অমৃতলাল বসুর সঙ্গে দেখা করার জন্য এক ভদ্রলোক থিয়েটারে গিয়ে তাঁর ঠিকানা চান। কোন অভিনেতা তাঁকে  ঠিকানা দেন, এক নং মৈত্র লেন। ভদ্রলোক অনেক খোঁজাখুঁজি করে শেষপর্যন্ত বাড়ির হদিশ পান। অমৃতলালের সঙ্গে দেখা হতে তিনি বললেন, ‘ঠিকানা খুঁজতে খুঁজতে বড় হয়রান হয়েছি। মৈত্র লেন আর খুঁজে পাই না। এ যে দেখছি রায়চন্দ্র মৈত্র লেন, তা-ও ১ বাই ২ নম্বর।’ অমৃতলাল জানতে চান, ‘কে আপনাকে ঠিকানা দিয়েছে?’ ভদ্রলোক বললেন, ‘থিয়েটারের কোন এক অভিনেতা হবে।’ অমৃতলাল মন্তব্য করেন, ‘ঠিকই হয়েছে। জানেন তো, অভিনেতারা অর্ধেক মুখস্থ করেন আর অর্ধেক থাকে প্রম্পটারের হাতে।’

.

.

বিদ্যাসাগর ছাত্রদের শারীরিক শাস্তি অপছন্দ করতেন। সংস্কৃত কলেজের অধ্যক্ষ থাকার সময় তিনি প্রায়ই ক্লাসে ক্লাসে টহল দিয়ে বেড়াতেন। একদিন একজন অধ্যাপকের ডেস্কের ওপর একগাছা বেত রয়েছে দেখে কারণ জিজ্ঞেস করলে অধ্যাপক বললেন, ‘ম্যাপ দেখানোর সুবিধের জন্য এনেছি।’ বিদ্যাসাগর হেসে বললেন, ‘রথ দেখা আর কলা বেচা দুই-ই হবে। ম্যাপ দেখানো হয় আর ছেলেদের পিঠে দু-এক ঘা বসানো হয়, কী বলেন ?’ অধ্যাপক ঘাড় হেঁট করে রইলেন।

.

.

একবার এক কুঁচ তেলের কোম্পানি কয়েক শিশি তেল উপহার দিয়ে রবীন্দ্রনাথকে একটা প্রশংসাপত্র লিখে দিতে বলে। রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, ‘এদের কুঁচ তেল ব্যবহার করিয়া যৎপরোনাস্তি আনন্দ পাইয়াছি। আমার মস্তকের দুইস্থানে দুইটি টাক ছিল। এখন দুইয়ে মিলিয়া একটা টাকে পরিণত হইয়াছে। এদের তৈলের গুণ অসাধারণ।’ 

.

.

শিবরাম চক্রবর্তী একদিন শুধু একটা গেঞ্জি গায়ে বাজারে এসেছেন। একজন পরিচিত লোক তাঁকে এরকম অবস্থায় দেখে অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘আরে একি শিবরামবাবু, আপনি এই অবস্থায় ?’ শিবরাম বললেন, ‘ঘুম ভেঙে দেখি জামাকাপড় সব চুরি হয়ে গেছে।’ পরিচিত ভদ্রলোকটি জিজ্ঞেস করলেন, ‘তাহলে আপনার কি আর কোন জামাকাপড় নেই ?’ শিবরাম বললেন, ‘আছে ভাই, কিন্তু সে তো লন্ড্রিতে আর লন্ড্রির রশিদও সেই চুরি হওয়া জামার পকেটেই থেকে গিয়েছে।’

.

.

একবার সরোজিনী নাইডু ডাক্তার বিধানচন্দ্র রায়কে বলেছিলেন, ‘বিধান, তোমার বয়স তো প্রায় ষাট হল। এখনও হাসতে গেলে তোমার গালে টোল পরে কেন ?’ বিধানচন্দ্রের জবাব, ‘সরোজিনী, তুমিতো ষাট পেরিয়ে গেছ। এখনও তোমার ওদিকে নজর কেন ?’ 

.

.

মধুসূদন কিছুদিন কলকাতা হাইকোর্টে ব্যারিস্টার হিসেবে কাজ করেছিলেন। হাইকোর্টে যেতেন তিনি ঘোড়ার গাড়িতে চেপে। একদিন ঘোড়ার গাড়িতে ওঠার সময় পা পিছলে পড়ে বেশ আঘাত পান। আঘাত এত বেশি ছিল যে তাঁকে কিছুদিন বাড়িতে শয্যাশায়ী হয়ে থাকতে হয়। খবর পেয়ে সিউড়ির জমিদার দক্ষিণারঞ্জন মুখোপাধ্যায় তাঁকে দেখতে যান। কী হয়েছে জানতে চাইলে মধুসূদন মৃদু হেসে জানালেন, ‘ভগ্ন-ঊরু ! কুরুক্ষেত্র রণে !’

.

.

একবার এক অভিনেতা আবেগতাড়িত কন্ঠে শিবরাম চক্রবর্তীকে বলেছিলেন যে
সিরাজদৌল্লা নাটকটিকে বাঙালির জাতীয় নাটক হিসেবে ঘোষণা করা উচিত। উত্তরে শিবরাম বলেছিলেন, ‘ভাই, জাতীয় নাটক কিনা জানিনা, তবে ওটা নাটকজাতীয় সন্দেহ নেই।’

.

.

কর্মজীবনে রজনীকান্ত সেন ওকালতি করতেন। একদিন কোর্টে চেম্বারে বসে অন্যান্য উকিলবাবুদের কাছে তিনি এক রাখালের গল্প বলেছিলেন। রাখাল পথ দিয়ে যাচ্ছিল, সঙ্গে ছিল তার বলদ জোড়া। একটি বলদ মোটা, অন্যটি খুব রোগা। রাখালের পিছনে এক উকিলবাবু আসছিলেন। তিনি রাখালকে ডেকে জানতে চাইলেন, একটা গরু এত মোটা আর অন্যটা এত রোগা কেন। রাখাল কি খেতে দেয় না ? রাখাল নিরীহ গলায় জানাল, ‘বাবু মোটাটা হচ্ছে উকিল আর রোগাটা তার মক্কেল।’

.

.

কোন এক পঁচিশে বৈশাখ রবীন্দ্রনাথের বাড়িতে অনুরাগী ভক্তরা এলেন কবিকে শ্রদ্ধা জানাতে। এঁদের মধ্যে সুকুমার রায়ও ছিলেন। কবি সবার জলযোগের জন্য ফল ও মিষ্টির ব্যবস্থা করলেন। সুকুমার রায় ফল খেলেন না, শুধু মিষ্টি খেলেন। কবি তাঁকে বললেন, ‘দেখো সুকুমার, শুনেছিলাম তুমি গীতা পাঠ করছ। তা তোমার গীতা পাঠ সার্থক হয়েছে।’ শুনে সুকুমার রায় তো বটেই, অন্যরাও বেশ অবাক হলেন। একজন জিজ্ঞেস করলেন, ‘কিরকম গুরুদেব?’ কবি হেসে বললেন, ‘তা না হলে এমন মা ফলেষু কদাচন ও শিখলো কোথা থেকে ?’

.

.

বৃক্ষরোপণ উৎসব চলছে শান্তিনিকেতনে। আচার্য ক্ষিতিমোহন সেন বৃক্ষরোপণ করতে যাবেন আর হঠাৎ প্রবল বৃষ্টি নামল। প্রায় সবাই বৃষ্টিতে ভেজার ভয়ে ছুটে পালাল সামনের ঘেরা বারান্দায়। ক্ষিতিমোহন তাঁর সঙ্গে ভিজতে থাকা সঙ্গীকে বললেন, ‘ওরা সব ভিজিওয়ানা গ্রামের লোক।’ সঙ্গী ভদ্রলোক বললেন, ‘আর আমরা হলাম জলপাইগুড়ির লোক।’

.

.

গান্ধীজি এসেছেন শান্তিনিকেতনে। রবীন্দ্রনাথ বেগুন ভাজা দিয়ে ফুলকো লুচি খেতে ভালোবাসতেন। তাঁর পাতে লুচি দেখে গান্ধিজি আঁতকে উঠে বললেন, ‘এসব খান নাকি আপনি ? এ যে সাক্ষাৎ বিষ।’ রবীন্দ্রনাথ হেসে বললেন, ‘বিষ ঠিকই। তবে তার প্রতিক্রিয়া খুবই ধীর। ষাট বছর ধরে এ বিষ খাচ্ছি।’

.

.

নীলদর্পণের নাট্যকার দীনবন্ধু মিত্র সধবার একাদশী নামে একটি অসাধারণ প্রহসন লিখেছেন। ওই নাটকের নায়ক নিমচাঁদ উচ্চশিক্ষিত। ইংরেজি সাহিত্যের ও সাহেবি আদব-কায়দার ভক্ত। মদ খেয়ে যখন-তখন মাতলামি করে। ওই নাটক পড়ে মধুসূদনের কয়েকজন বন্ধু দীনবন্ধুর কাছে ছুটে এসে অভিযোগ করেন, ‘আপনি নিম চাঁদের মধ্য দিয়ে মধুকে এইভাবে ব্যঙ্গ করেছেন। এটা কি উচিত কাজ হল ?’

.

.

কবি নবীনচন্দ্র সেনের এক পিতৃবন্ধুর বন্ধুর ধারণা ছিল যে তাঁর মত বাংলা বুঝি আর কেউ জানে না। নবীনচন্দ্রের সঙ্গে দেখা হলেই তিনি প্রশ্নর পর প্রশ্ন করে তাঁকে জ্বালাতন করেন। একদিন তিনি নবীনচন্দ্রকে প্রশ্ন করলেন, ‘বলতো সন্ধি কাকে বলে। না পারলে কানমলা দেব।’ নবীনচন্দ্র উত্তর দিলেন, ‘যা করের সঙ্গে কর্ণের সংযোগ ঘটায় তার নাম সন্ধি।’

.

.

শান্তিনিকেতনের অধ্যাপক পন্ডিত ক্ষিতিমোহন সেন একদিন এক সভায় বক্তৃতা দিচ্ছিলেন। হঠাৎ লক্ষ করলেন দু’-একজন ভদ্রলোক ও ভদ্রমহিলা আলস্যে হাই তুলছেন। সেনমশাই হঠাৎ বক্তৃতা থামিয়ে বললেন, ‘হিজ হাইনেস হার হাইনেস সকলে এসে গেছেন দেখছি। এবার আমার বক্তৃতা থামানো উচিত।’ 

.

.

মংপুতে থাকার সময় রবীন্দ্রনাথ মধুর ওপর একটি কবিতা লিখে প্রবাসীতে পাঠান। কবিতা ছাপা হওয়ার পর এক অজানা ভক্ত এক বোতল মধু পাঠান। রবীন্দ্রনাথ সেটা মৈত্রেয়ীদেবীকে দেখিয়ে বললেন, ‘দেখছ তো, মধুর বিষয়ে কবিতা লেখার পর কেবল মধু আসছে।’ ওই কথা শুনে একজন বলে উঠলেন, ‘এর চেয়ে আপনি যদি চাল-ডাল-তেলের ওপর কবিতা লিখতেন তবে চাল-ডাল ঘরে আসত। সংসারের খরচ কিছুটা বাঁচত।’

.

.

হরপ্রসাদ শাস্ত্রী লেখাপড়ার কাজে ব্যস্ত থাকলে তাঁর গৃহিণী প্রায়ই এসে সাংসারিক কথাবার্তা শুরু করতেন।শেষে একদিন গৃহিণী ওইভাবে কথা শুরু করতেই তিনি যাত্রাভিনয়ের ঢঙে হাত নেড়ে বললেন, “লিখিতে পড়িতে দিলে কই? বিবা’বধি নিরবধি জানিনা আর তোমা বই।” শাস্ত্রীমশাই ছিলেন খাদ্যরসিক। গৃহিণী আবার বিশেষ রান্নাবান্না করতেন না। এই নিয়ে একদিন অনুযোগ করলে গৃহিণীও যাত্রা অভিনয়ের মত হাত নেড়ে বললেন, “রাঁধিতে বারিতে শিখিতে দিলে কই ? বিবা’বধি নিরবধি জানিনা আর আঁতুড় বই।”

.

.

রজনীকান্ত তখন ক্যান্সার রোগে মরণাপন্ন। এসময় একদিন লাহামশাই স্বরচিত “আরাম” বইখানি তাঁকে উপহার দিলেন। রজনীকান্ত বইটি হাতে নিয়ে পরিহাস করে বললেন, “আমার এই ব্যারামে আরাম দিলেন বেশ।”

.

.

দীনবন্ধু মিত্র একবার বঙ্কিমচন্দ্রকে লোক মারফৎ একজোড়া কাপড়ের জুতো পাঠিয়ে সঙ্গে চিরকুটে লিখে দেন, “কেমন জুতো!” বঙ্কিমচন্দ্রও সেই একই লোককে একটি চিরকুট লিখে জবাব পাঠিয়ে দেন, “তোমার মুখের মতো!”

সংগৃহীত 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *