প্রীতন্বিতা
বিজ্ঞানে জালিয়াতি
ইতিহাসে জালিয়াতির অনেক দুঃসাহসিক খবর কিছু না কিছু সবারই পড়া আছে। খবরের কাগজেও হামেশাই নানারকম জালিয়াতির কথা জানা যায়। অর্থনৈতিক দুনিয়ার বড় বড় জালিয়াতির রোমহর্ষক বিবরণ রীতিমত পিলে চমকে দেয়। জালিয়াতি ঘটেনা এমন কোন ক্ষেত্র বুঝি অনুপস্থিত। বিজ্ঞানের জগতেও রয়েছে আলোড়ন তোলা নানান জালিয়াতির কান্ড।
বিজ্ঞানীরা তাঁদের কাজকর্ম করেন যেসব তথ্যকে ভিত্তি করে অনেক সময়ই দেখা যায় অভীষ্ট বিষয়ে প্রমাণ করতে তাঁরা সেসব তথ্যের বিকৃতি কিছু হলেও ঘটিয়ে থাকেন। পিল্টডাউন মানুষ নিয়ে জালিয়াতি তেমনই একটি সাড়াজাগানো ঘটনা। বিংশ শতাব্দীর প্রথমদিকে মানুষ ও বনমানুষের মধ্যে যে মিসিং লিংক তা খুঁজে বার করার চেষ্টা চলছিল যখন এই জালিয়াতি ঘটে সেই সময়ে। ভূবিজ্ঞানী চার্লস ডসন ও তাঁর বন্ধু আর্থার স্মিথ ঘোষণা করেন যে দক্ষিণ ইংল্যান্ডের পিল্টডাউন অঞ্চলে তাঁরা একটি মাথার খুলি খুঁজে পেয়েছেন যা হতে পারে সেই মিসিং লিংক। প্রায় তিন দশক ধরে এই ধাপ্পা সবাই সত্যি বলে ভেবে এসেছে। পরে উন্নততর পরীক্ষায় প্রমাণিত হয় যে খুলিটি আসলে কৃত্রিমভাবে তৈরি যার কিছু অংশ খুবই সাম্প্রতিক কালের।
নামজাদা বিজ্ঞানীদের বিরুদ্ধেও তথ্য বিকৃতির অভিযোগ রয়েছে। টলিমি সম্পর্কে বলা হয় যে তিনি বৎসরের দৈর্ঘ্য ঠিক প্রমাণ করতে রাশিতথ্যের বিকৃতি ঘটিয়েছিলেন। গ্যালিলেও নাকি বাস্তবে অনেক পরীক্ষা না করে রাশিতথ্যের অদলবদল ঘটিয়ে কিছু বিষয় প্রমাণ করেছিলেন। এমনকি স্বয়ং আইজাক নিউটন নাকি তাঁর কিছু কাজকর্মে স্বেচ্ছাকৃতভাবে অসত্য তথ্যের আশ্রয় নিয়েছিলেন। বংশগতির জনক গ্রেগর মেন্ডেলের কাজেও দেখা গেছে তিনি রাশিতথ্যের কিছু বিকৃতি অন্তত ঘটিয়েছিলেন।
বিজ্ঞানের ইতিহাসে আরেকটি আলোড়ন তোলা ধাপ্পার অভিযোগ রয়েছে মানুষের প্রথম চন্দ্র অভিযান সম্পর্কে। আর্মস্ট্রংরা চাঁদে পা দিয়ে যেসব ছবি তুলে এনেছেন সেসব বিচার করে অনেকেই জানিয়েছেন যে ছবিগুলি মোটেই চাঁদে তোলা হয়নি, তোলা হয়েছে পৃথিবীর মাটিতে, হয়ত বা কোন স্টুডিওতে।
বৈজ্ঞানিক ধাপ্পাবাজির এক অনন্য নজির তৈরি হয়েছিল ২০০৫ সালে যার ধাক্কা গোটা বিজ্ঞানীমহলের গালে চুনকালি মাখিয়ে দিয়েছে। এই জালিয়াতি দেখা গেছে চিকিৎসাবিজ্ঞানে। দক্ষিণ কোরিয়ার বিশিষ্ট বিজ্ঞানী হোয়াং উ-সুক এই নক্কারজনক কান্ডের নায়ক। আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন এই বিজ্ঞানীর পরিচিতি জীবদেহে ক্লোনিংয়ের জন্য। ক্লোনিং থেকে স্লুপি নামে একটি কুকুর সৃষ্টি করে তিনি পৃথিবীজুড়ে আলোড়ন তুলেছিলেন। তারপর তিনি দাবি করেন যে ক্লোন করে প্রথম মানব শিশুর ভ্রূণ তৈরি করতে পেরেছেন। প্রকাশিত গবেষণাপত্রে ঘোষণা করেন যে অন্তত ত্রিশটি মানব ভ্রূণ তিনি ক্লোন করেছেন। ওই একই লেখায় তিনি দাবি করেন যে দেহস্থ কোষগুলির অনেকগুলিকে ক্লোন করাও সম্ভব হয়েছে। সংবাদমাধ্যম তাঁর দাবি অনুযায়ী জানিয়েছিল যে তিনি ও তাঁর সঙ্গীরা মিলে সোম্যাটিক সেল নিউক্লিয়ার ট্রান্সফার নামে এক অভিনব ক্লোনিং পদ্ধতি বাস্তবায়িত করতে পেরেছেন। এই সাফল্য চিকিৎসা বিজ্ঞানে এক বিরাট অবদান সৃষ্টি করতে যাচ্ছিল যার কল্যাণে পার্কিনসন ডিজিজ, ডায়াবেটিস ও অ্যালঝেইমারকে নির্মূল করা সম্ভব হত। হোয়াং-এর নাম উঠে এসেছিল সম্ভাব্য নোবেল বিজয়ীর তালিকায়। তারপরে হঠাৎ সবকিছুর সলিল সমাধি। জানা গেল যে হোয়াং ও তাঁর সঙ্গীরা মানব কোষ ক্লোনিং করার ব্যাপারটায় প্রায় পুরোপুরি জালিয়াতির আশ্রয় নিয়েছেন। মানব ভ্রূণ সৃষ্টি করার ব্যাপারটা আসলে সযত্নে সাজানো এক ধাপ্পা। সিউল জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণাগারে কর্মরতা দুজন মহিলা সহকারী তাঁর পরীক্ষায় গোপনে তাঁদের ডিম্বাণু দিয়েছিলেন। হোয়াং প্রথমে বলেছিলেন যে সমস্ত ব্যাপারটা তাঁর অজ্ঞাতে ঘটেছে। পরে উপর্যুপরি জেরায় প্রমাণিত হয়েছে যে জালিয়াতির সমস্ত কীর্তি তাঁর নির্দেশেই হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশেষ অনুসন্ধান কমিটি হোয়াং-এর শাস্তি নির্ধারণের জন্য নানা খোঁজখবর করে জানতে পেরেছেন যে ক্লোনিং সংক্রান্ত তাঁর সমস্ত দাবি সন্দেহজনক, এমনকি স্নুপি নামের ক্লোন কুকুরটিও হয়তো এক ধাপ্পা। অথচ আশ্চর্যের কথা এটাই যে বৃটেনের বিশ্ববিখ্যাত নেচার জার্নালে হোয়াং-এর মিথ্যে গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়েছিল। অভিজ্ঞ সম্পাদকমন্ডলীর জ্ঞানীগুণী ব্যক্তিদের কেউই কিছু বুঝতে পারেননি। বিজ্ঞান পত্রিকা সায়েন্সও হোয়াং-এর রচনা প্রকাশ করেছিল কোনরকম সন্দেহ না করেই।
বিজ্ঞানের জগতে এমনই সব আলোড়ন তোলা জালিয়াতি অতীতে যেমন ঘটেছে বর্তমানেও ঘটছে। আজকে যে বৈজ্ঞানিক সত্য বা তথ্য অপরিহার্য বলে মনে হচ্ছে ভবিষ্যতে হয়তো দেখা যাবে তার ভিত্তি পুরোপুরি সাজানো তথ্যরাশি। খ্যাতি ও অর্থের মোহ সব মানুষকেই নেশাগ্রস্থ করে। বিজ্ঞানীরাও তা থেকে মুক্ত হতে পারেন না।