প্রীতন্বিতা
পিল্টডাউন ম্যান
মানুষের পূর্বপুরুষ নিয়ে একটা রহস্য আছে। কিভাবে পৃথিবীতে মানুষের আবির্ভাব ঘটল তার সদুত্তর পাওয়া যায়নি এখন পর্যন্ত। অনেকেই মনে করেন যে মানুষের বর্তমান প্রজাতি নেমে এসেছে বানর সদৃশ্য বনমানুষদের থেকে। কিন্তু মানুষ যে বনমানুষের বংশধর তার কোন জোরদার প্রমাণ পাওয়া যায়নি। আবার ডারউইনের বিবর্তনবাদের তত্ত্ব অনুযায়ী মানতেই হয় যে মানুষের বর্তমান ধারাটি অন্য কোন না কোন প্রজাতি থেকে বিকাশ লাভ করেছে, হঠাৎ মানব প্রজাতি শূন্য থেকে উদয় হতে পারে না। বনমানুষ থেকে মানুষের বর্তমান প্রজাতিটির উদ্ভব ঘটার সম্ভাবনা প্রবল। কিন্তু মানুষ আর বনমানুষের মধ্যে যোগসূত্র হিসেবে একদল প্রাণীর অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া উচিত ছিল যা থেকে বলা যেত যে বনমানুষের একটি দল নিজেদের বিশেষ বিবর্তন ঘটিয়ে এভাবে পরে মানুষ প্রজাতির উদ্ভব ঘটালো। খুঁজে না পাওয়া এই যোগসূত্রকেই বলা হয় মিসিং লিঙ্ক।
১৯১২ খ্রিস্টাব্দে বিজ্ঞানী মহলে হঠাৎ এক আলোড়ন সৃষ্টি হয়ে গিয়েছিল। জানা গেল যে নৃতত্ববিদরা আবিষ্কার করেছেন পিল্টডাউন ম্যানের ফসিল এবং এরাই হলো সেই মিসিং লিঙ্ক। এই নিয়ে প্রায় ৪০ বছর ধরে অন্তত পাঁচশো রচনা প্রকাশিত হলো বিভিন্ন জার্নালে। তারপর একদিন প্রমাণ পাওয়া গেল যে পুরো ব্যাপারটাই ধাপ্পাবাজি। কিছু বিজ্ঞানী নামযশ ও অর্থের মোহে ভেবেচিন্তে এই ধাপ্পা তৈরি করেছিলেন। এই ধাপ্পাবাজি এমনই মোক্ষম ছিল যে পৃথিবীর সমস্ত মানুষ, তার মধ্যে বড় বড় বিজ্ঞানীিরাও রয়েছেন, সবাই ৪০ বছর ধরে বোকা বনে থেকেছিলেন।

যারা পিল্টডাউন ম্যানের ফসিল বানিয়েছিলেন তাঁদের দক্ষতাও প্রশংসনীয়, যদিও কাজটা মারাত্মক অপরাধ। মানুষের দুটি খুলি, ওরাংওটানের চোয়াল, হাতির পেষক দন্ত, হিপোপটেমাসের সাধারণ দাঁত ও শিম্পাঞ্জির শ্বদন্ত নিয়ে তৈরি হয়েছিল এই নকল ফসিল। পরে বিশেষ পরীক্ষায় জানা গিয়েছিল যে মানুষের খুলিগুলি ৬২০ বছরের প্রাচীন। অসম্ভব মোটা এসব খুলি হতে পারে পাটাগোনিয়া অঞ্চলের ওনা ইন্ডিয়ান উপজাতির। ওরাংওটাানের খুলি হয়তো সারাওয়াক থেকে আমদানি করা প্রায় ৫০০ বছরের পুরনো। হাতির দাঁতগুলি জোগাড় করা হয়েছিল তিউনিসিয়া থেকে। হিপোপটেমাসের সাধারণ দাঁতগুলি সম্ভবত মালটা বা সিসিলি থেকে আনা। শিম্পাঞ্জির দাঁতগুলি প্লেইস্টোসিন যুগের কোন এক সংগ্রহ। বেশ উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে এইসব প্রাণীর ওইসব বিশেষ দেহাবশেষ ইংল্যান্ডের কাছাকাছি পিল্টডাউন অঞ্চলে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রাখা হলো যাতে পরে কেউ তাদের খুঁজে পায় এবং বনমানুষ থেকে মানুষের বিবর্তন ঘটার মিসিং লিঙ্ক আবিষ্কার করতে পারে। খুলিগুলিকে অ্যাসিড দিয়ে এমন ক্ষতবিক্ষত করা হয়েছিল যাতে তাদের অনেক পুরনো মনে হয়। ফসিল-এর অন্য উপাদানগুলিকে একই উদ্দেশ্যে আয়রন সালফেট সল্যুশন দিয়ে ছোপছাপ ধরা বানিয়ে দেওয়া হয়েছিল। দাঁতগুলিকে বাদামী রঙে রাঙিয়ে বাবল গাম দিয়ে ছাপ ধরানো হয়। এভাবেই নানা কায়দাকানুন করে সতর্কতার সঙ্গে এই ধাপ্পাবাজি সাজানো হয়েছিল যাতে সবটাই বিশ্বাসযোগ্য হয়ে ওঠে।
কে বা কারা এই বিদঘুটে মজা তৈরি করেছিলেন এই প্রশ্নের উত্তরটাও বিশেষ স্পষ্ট নয়। মনে করা হয় যে ব্রিটিশ মিউজিয়ামের ভূতত্ত্ববিদ ও জীবাশ্ম সংগ্রাহক এবং নৃতত্ববিদ চার্লস ডসন এই আজব কীর্তির মূল মাথা। কিন্তু প্রমাণ পাওয়া যায়নি। সন্দেহভাজন ব্যক্তিদের তালিকায় আরো অনেকেই আছেন।
পুরো বিজ্ঞানীমহলকে এভাবে বোকা বানিয়ে দেওয়ার ঘটনা খুব কমই আছে। এই ধাপ্পা হয়তো চিরস্থায়ী হত না, কোন না কোন দিন ধরা পড়তো অবশ্যই। তবে যতদিন ধাপ্পা টিকে থাকতো সেই মিথ্যে ভিত্তির ওপর ভর দিয়ে গড়ে উঠতো বিজ্ঞানের এক অলীক জগত। আসলে সে সময় বিজ্ঞান ততটা উন্নত না হওয়ার জন্যও ধাপ্পাটা বুঝতে এত সময় লেগেছিল। ১৯৪৯ সালে ব্যাপারটা প্রথম সন্দেহের চোখে দেখা হয় যখন আবিষ্কৃত দেহাবশেষগুলির সময়কাল নির্ধারণে ফ্লোরিন পরীক্ষার কথা ভাবা হয়। এ ধরনের পরীক্ষার ব্যবস্থা আগে ছিল না। কিন্তু এটাও ঠিক কথা যে বিজ্ঞানীরা একটু সতর্ক হলে পিল্টডাউন ম্যান আবিষ্কারের সঙ্গে সঙ্গেই বুঝতে পারতেন যে এর সাধারণ দাঁতগুলি পুরনো বোঝাবার জন্য ফাইল দিয়ে ঘষাঘষি করা হয়েছিল। প্রতিভাস ম্যাগাজিন | Prativas Magazine
