প্রীতন্বিতা

ব্রহ্মাণ্ডের প্রথম বস্তু

কোটি কোটি গ্যালাক্সি, তারা, গ্রহ উপগ্রহ, ধুমকেতু, পালসার, কোয়াসার, ব্ল্যাক হোল, নীহারিকা, রক্তদানব, ডার্ক ম্যাটার ইত্যাদি জানা-অজানা বহু জাতীয় বস্তু মিলে গড়ে তুলেছে এই বিশ্বজগত যার পুরোপুরি হদিশ আজও বুঝে ওঠা সম্ভব হয়নি। রাতের আকাশে এই জগত আমাদের কাছে প্রকাশ পায়। এই জগত এলো কোত্থেকে, নাকি চিরকালই এর অস্তিত্ব বজায় ছিল একইভাবে? বিজ্ঞানীরা এর উত্তর খোঁজার চেষ্টা করছেন দীর্ঘদিন ধরে। এখন পর্যন্ত বিশ্বসৃষ্টির সবচেয়ে যুক্তিগ্রাহ্য তত্ত্ব হল বিগ ব্যাং থিওরি। 

কল্পনাতীত এই মহা বিস্ফোরণ বিশ্ব জগতের সমস্ত বস্তুকণা এবং তাদের থাকার জায়গা স্পেস বা মহাশূন্য এমনকি সময়েরও জন্ম দিয়েছিল। কিন্তু বিস্ফোরণের পর পরই আজ যেমন চোখের সামনে দেখছি তেমন জগত তৈরি হয়ে যায়নি। বিজ্ঞানীদের ধারণা অনুযায়ী বিগ ব্যাং এর পর অন্তত কুড়ি কোটি কোটি বছর মহা ব্রহ্মাণ্ড ডুবেছিল সুগভীর অন্ধকারে। শূন্য এবং সময় তখন সৃষ্টি হয়ে গিয়েছিল, কিন্তু বর্তমানের এই সব তারা বা গ্যালাক্সির কোন অস্তিত্ব ছিল না। এদের আবির্ভাব আরো অনেক পরের ঘটনা। 

বিজ্ঞানীদের মনে অনেকদিন ধরেই কৌতূহল ছিল প্রথম কোন্ বস্তু জন্ম নিয়েছিল অনন্ত মহাশূন্যে। উত্তরটা খুঁজে পাওয়া মোটেই সহজ কাজ নয় কারণ, প্রায় চোদ্দশ কোটি বছর বয়সি এই ব্রহ্মাণ্ডে প্রথম জন্ম নেওয়া বস্তুটি অন্তত হাজার কোটি বছরের পুরনো হতে বাধ্য। সে এখনো মহাকাশে বেঁচে থাকতে পারেনা। স্বাভাবিক কালের নিয়মে অনেকদিন আগেই তার মৃত্যু অনিবার্য। তাহলে তাকে কিভাবে আর খুঁজে পাওয়া যাবে? বিজ্ঞানীরা যুক্তি দেখালেন, বাস্তবে বস্তুটির উপস্থিতি হারিয়ে গেল সে যে মহাকাশে ছিল তার নিশানা এখনো থেকে যেতে বাধ্য। সেই নিশানা হলো বস্তুটি নির্গত আলোকরশ্মি, যা কোটি কোটি বছর পর এখনো মহাশূন্যে পরিভ্রমণরত। সেই আলো খুঁজে পেলেই বস্তুটি সম্পর্কে জানা যাবে। 

কিন্তু এখানেও সমস্যা আছে। তারকা আর গ্যালাক্সি জগতের প্রবল আলোর ভিড়ে অতএত বছরের প্রাচীন অনুজ্জ্বল আলো কিভাবে খুঁজে পাওয়া সম্ভব? দিনের বেলা যেমন সূর্যের প্রখর আলোয় আকাশে তারাদের আলো চাপা পড়ে যায় তেমন ঘটনা তো এখানেও সত্যি। বিজ্ঞানীরা এই সমস্যারও একটা সরল সমাধান খুঁজে বার করলেন। সূর্যের আলো সরে গেলে যেমন তারাদের আলো স্পষ্ট হয়ে ওঠে তেমন কৌশল এখানেও অনুসরণ করা যেতে পারে। 

বিজ্ঞানীরা প্রথমে স্পিৎজার স্পেস টেলিস্কোপ এর সাহায্যে গ্যালাক্সি আর তারা ভরা আকাশের প্রচুর ছবি তুললেন। তারপর সেসব ছবি থেকে সুপরিচিত ও কাছাকাছি গ্যালাক্সি ও তাদের আলো সরিয়ে দিলেন। পড়ে থাকল যেসব ছবি মনে করা হচ্ছে যে সেগুলি ব্রহ্মাণ্ডের আদিম বস্তু। তাদের দূরত্ব প্রায় ১৩০০ কোটি আলোকবর্ষ। 

বহু বহু কোটি বছর আগে হারিয়ে যাওয়া বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের এই আদিম তারকাদের আলো এখনো বর্তমান ছিল বলে তাদের অস্তিত্ব এভাবে আবিষ্কার করা সম্ভব হয়েছে যা থেকে জানা যাবে সূচনায় মহাবিশ্ব কেমন ছিল দেখতে। 

খুঁজে পাওয়া এই আদিম আলো খুবই অনুজ্জ্বল। এদের আলো এত অনজ্জ্বল হওয়ার কারণ এই যে তারা রয়েছে অনেক অনেক দূরে, মহাবিশ্বের একেবারে শেষ প্রান্তে। 

বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের প্রথম শিশুটিকে খুঁজে পাওয়ার পর বিজ্ঞানীদের মধ্যে সাড়া পড়ে গেল। টেলিস্কোপের তোলা মহাকাশের ছবি থেকে গ্যালাক্সি ও তারাদের আলো বাদ দেওয়ার পর ব্যাকগ্রাউন্ডে পড়ে থাকা আলোকিত অঞ্চলকে মহাশূন্যের প্রথম বস্তু বলে মেনে নিয়েছেন প্রায় সবাই। বিজ্ঞানীদের কথায়, আদি মহা ব্রহ্মাণ্ড এক অর্থে ছিল ভীষণ উত্তপ্ত আর তার কারণ হলো তখন তা যে সব বস্তু দিয়ে পরিপূর্ণ ছিল সেগুলি এখনকার তুলনায় অনেক বেশি প্রচন্ড তার সঙ্গে ও উন্মত্ত ভাবে আলোক বিচ্ছুরণ ঘটাতো। 

প্রশ্ন হল, মহা ব্রহ্মাণ্ডের এই প্রথম বস্তুগুলি কী হতে পারে। গবেষকরা এর পরিষ্কার কোন জবাব দিতে পারেননি। দুটি সম্ভাবনা সত্যি বলে তাঁরা মনে করেন। এক হতে পারে তারা ছিল অতিকায় তারকা, আয়তনে আমাদের সূর্যের তুলনায় কয়েকশো গুণ বড়। অথবা প্রথম ওই বস্তুগুলির পক্ষে বিশালায়তন ব্ল্যাক হোল হওয়াও বিচিত্র নয়। যাই হোক না কেন, এদের ছবি থেকে কিভাবে ব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টি হয়েছিল সেই জিজ্ঞাসার উত্তর পাওয়ার পর আরেকটু কাছাকাছি হতে পারা যায়। 

বিজ্ঞানের সর্বাধুনিক হিসেব অনুযায়ী আজ থেকে 1370 কোটি বছর আগে বিগ ব্যাং ঘটনার পর স্পেস, টাইম ও ম্যাটার সৃষ্টি হয়েছিল। ওই ঘটনার 100 কোটি বছরের মধ্যে জন্ম নিয়েছিল ওই আদিম তারকা। তার জন্মের মধ্য দিয়েই অবসান ঘটেছিল বিগ ব্যাং পরবর্তী ব্রহ্মাণ্ডের অন্ধকার যুগ। অথবা সেই আদিম সৃষ্টি অতিকায় ব্ল্যাক হোল হতে পারে যা সমস্ত গ্যাস ও ধূলিকণা গিলে খেয়ে উগরে দিচ্ছিল অকল্পনীয় শক্তি। যদি ব্ল্যাক হোল না হয়ে সেগুলি তারা হয়তো সেই তারকা কুঞ্জ হতে পারে প্রথম মিনি গ্যালাক্সি। এইসব মিনি গ্যালাক্সি গুলি একসঙ্গে মিলিয়েই হয়তো আমাদের ছায়াপথ বা মিল্কি ওয়ে সৃষ্টি হয়েছিল। প্রতিভাস ম্যাগাজিন | Prativas Magazine

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *