প্রীতন্বিতা

দুগ্ধধবল সমুদ্র

দুধ সাগরের কথা আমরা শুনেছি রূপকথায়। আমাদের পুরাণ উপকথায় ও দুধ সাগরের উল্লেখ আছে। ব্যাপারটি যে একেবারেই কল্পকথা এমন নয়। শতাব্দীর পর শতাব্দি ধরে সমুদ্রগামী বহু জাহাজের অনেক নাবিক দাবি করে এসেছে যে তারা দুগ্ধ সমুদ্র প্রত্যক্ষ করেছে। সপ্তদশ শতাব্দী থেকে এই অবিশ্বাস্য কাহিনীর সূত্রপাত। পরবর্তী ৪০০ বছরের যা আরও পল্লবিত হয়েছে। সমুদ্রযাত্রী নাবিকদের এই দুধ সাগরের গল্প সামুদ্রিক উপকথা বলেই ভাবতে অভ্যস্ত ছিলেন বিজ্ঞানীরা যা হতে পারে দৃষ্টি বিভ্রমের ফল। 

জুলেভার্নের ক্লাসিক সাইন্স ফিকশন টোয়েন্টি থাউজেন্ডস লিগস আন্ডার দ্য সি যেখানে নাবিকরা দুগ্ধ সমুদ্র যাত্রার কথা আলোচনা করেছে। ১৯৯৫ সালে এস এস লিমা নামে এক ব্রিটিশ বাণিজ্য জাহাজ ভারত মহাসাগরের উত্তর পশ্চিমাংশ ধরে পাড়ি দিচ্ছিল। যেটা ছিল পঁচিশে জানুয়ারির রাত। জাহাজটির সোমালিয়া উপকূল থেকে 280 কিলোমিটার দূর এগিয়ে যাওয়ার সময় দুধ সাদা সমুদ্রে পড়ে গেল। জাহাজের লগবুকের রেকর্ড থেকে জানা যায় যে অন্ধকার রাতে চারপাশের সমুদ্র জল হঠাৎ কোন জাদু মন্ত্রে দিগন্ত ব্যাপী বরফ ক্ষেত্রের মত সাদা হয়ে উঠল, অথবা মনে হচ্ছিল সমস্ত দিক ঘিরে রেখেছে তুষার ধবল মেঘমালা। 

উল্লেখযোগ্য যে এমন ঘটনা ভারত মহাসাগরগামী নাবিকদের বর্ণনাতেই পাওয়া গেছে। সমুদ্র জল সমস্ত দিকে অপার্থিব শুভ্র আলোক বন্যায় ভেসে যায় দিগন্ত পর্যন্ত, মনে হয় সমুদ্রের জল বুঝি দুধ। এই ঘটনা কয়েক ঘণ্টা থেকে কয়েক দিন পর্যন্ত স্থায়ী হতে পারে। 

বিজ্ঞানীরা ব্যাপারটা নিয়ে গবেষণা চালাচ্ছিলেন দীর্ঘদিন। শেষ পর্যন্ত এর একটি সম্ভাব্য উত্তর খুঁজে পাওয়া গেছে। তার জন্য উপগ্রহ চিত্র ও তথ্যের ওপর নির্ভর করতে হয়েছে। ১৯৯২ সাল থেকে দুধ সমুদ্র সম্পর্কে নাবিকদের সমস্ত বর্ণনা উপগ্রহের সংগৃহীত তথ্যের সঙ্গে মিলিয়ে দেখতে থাকেন বিজ্ঞানীরা। শেষ পর্যন্ত উপগ্রহের তোলা ছবি থেকে তারা এসএস লিমা বাণিজ্য তড়িটির যাত্রাপথ আবিষ্কার করতে সমর্থ হন। জাহাজটি দুধ সাদা সমুদ্র সম্পর্কে রিপোর্ট নথিবদ্ধ করার ত্রিশ মিনিট পরের সংশ্লিষ্ট অঞ্চলের উপগ্রহ চিত্র খুঁজে পাওয়া যায়। সমুদ্রের ব্যাপক অঞ্চল জুড়ে দেখা যায় আলোক বিচ্ছুরণ। উদ্ভাসিত সমুদ্র জল আয়তনে ছিল অন্তত ১৫ হাজার বর্গকিলোমিটার এবং অন্তত তিন রাত স্থায়ী হয়েছিল। বিজ্ঞানীদের একজন বলেছিলেন যে এটা ছিল মেরুদন্ড হিম করে দেওয়া মুহূর্ত যা কারো জীবনে খুবই দুর্লভ। 

বিজ্ঞানীদের মতে দুধ সমুদ্র আসলে একদল বিশেষ ব্যাকটেরিয়ার উৎপাদিত ঠান্ডা আলোয় তৈরি, যেমন রাতে জোনাকি পোকা আলো জ্বালিয়ে সংকেত পাঠায়। এই বিরল দৃশ্য হতে পারে ব্যাকটেরিয়া দের তরফ থেকে মাছেদের আকর্ষণ করার এক প্রচেষ্টা যাতে মাছেরা কাছাকাছি এলে তাদের দেহে বাসস্থান খুঁজে নেওয়া যায়। 

এই বিশেষ ব্যাকটেরিয়াদের বলা হয় বায়োলুমিনেসেন্ট। এরা ব্যাকটেরিয়াম ভাইব্রিয়োহারভেয়ি। যারা কলেরা রোগ সৃষ্টি করে তাদের জাত ভাই। বায়োলুমিনেসেন্স মানে হল কোন জীবন্ত কোষের আলোক উৎপাদন ক্ষমতা। এই প্রক্রিয়ায় এক রাসায়নিক বিক্রিয়া একটি ইলেকট্রন কে এমন ভাবে উৎক্ষেপ করে যাতে সেটি লাফিয়ে উঁচুস্তরে চলে যায়। এরপর ইলেকট্রন শক্তি হারিয়ে আবার নিচুস্তলটিতে গিয়ে পড়ে এবং অতিরিক্ত শক্তিকে আলোক-কণা হিসেবে বিচ্ছুরিত করে। অন্য আলো উৎপাদনের ক্ষেত্রে যেমন তাপ উৎপন্ন হয় এখানে তেমন ঘটে না, একটু শক্তিও তাপ উৎপাদনে নষ্ট হয় না। এজন্যই বাওলুমিনেসেন্স আসলে ঠান্ডা আলো। সামুদ্রিক জীবন ওনারা যে বায়োনুমিনেসন্স আলো তৈরি করে তার বর্ণ সাধারণত নীল। কিন্তু দুধ সমুদ্রে এই আলোর সাদা মনে হয় মানব চক্ষুর বড় কোষ গুলির বিশেষ ধর্মের জন্য। 

উপযুক্ত পরিবেশে ভাইব্রিয়হারভেয়ি ব্যাকটেরিয়ারা নিজে থেকেই একটানা আলো উৎপাদন করে যেতে পারে। এর জন্য একটি বিশেষ শর্ত হলো এই যে ব্যাকটেরিয়াদের খুবই উঁচু মাত্রায় জড়ো হতে হবে। কত পরিমাণ ব্যাকটেরিয়া দরকার দুধ সমুদ্র তৈরির জন্য? হাওয়াই দ্বীপের যতটা আয়তন ততটা স্থান জুড়ে যে পরিমাণ ব্যাকটেরিয়া থাকতে পারে ঠিক সেই সংখ্যক। অংকের হিসেবে চল্লিশ বিলিয়ন ট্রিলিয়ন। পৃথিবীর পৃষ্ঠতলকে যদি চার ইঞ্চি পুরু বালির স্তরে মুড়ে দেওয়া হয় তাহলে সেখানে বালি কণার সংখ্যা যা হবে ঠিক তত সংখ্যক ব্যাকটেরিয়া দরকার দুধ সমুদ্র তৈরির জন্য।

প্রতিভাস ম্যাগাজিন | Prativas Magazine

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *