প্রীতন্বিতা
মঙ্গলে মানুষের পূর্বপুরুষ
কোটি কোটি বছর আগে মঙ্গলে হয়তো জীবনের সূত্রপাত ঘটেছিল। মঙ্গল গ্রহের জলসম্পৃক্ত মৃত্তিকায় জীবনের আদি কোষগুলি যখন ডালপালা মেলছিল হঠাৎই একদিন কোন বিশাল উল্কাপিন্ডের সঙ্গে তার সংঘর্ষ ঘটল। বহু মাঙ্গলিক শিলা তাতে মহাকাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে গেল, কিছু এসে নামল পৃথিবীতে। যেসব শিলা পৃথিবীর মাটিতে পড়ল তাদের মধ্যে হয়তো যেভাবেই হোক কিছু আদিম জীবকোষ জীবন্ত থেকে গিয়েছিল এবং অনুকূল পরিবেশে বিস্তার লাভ করে কালক্রমে তারা এই গ্রহে গড়ে তুলল বর্তমান জীবন। এই তথ্য কিছুকাল আগেও গালগল্প বলে উড়িয়ে দিয়েছিলেন বিজ্ঞানীরা, কিন্তু সম্প্রতি এমন কিছু বিষয় জানা গেছে যে এই গল্পটাকে একেবারে কল্পনা বলে ভাবা যাচ্ছে না।
অস্ট্রেলিয়ার কুইন্সল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর মাইক্রোস্কপি অ্যান্ড মাইক্রোঅ্যানালাইসিস বিভাগের গবেষক ডক্টর ফিলিপ্পা ইউইন্স পশ্চিম অস্ট্রেলিয়ার সমুদ্রসৈকতে খননকার্য থেকে প্রাপ্ত সমুদ্রতলের কয়েক মাইল নিচের কিছু শিলা পরীক্ষা করে চাঞ্চল্যকর তথ্য জানতে পেরেছেন। লক্ষণীয় যে শিলাখণ্ডগুলি ভূত্বকের যে তলদেশ থেকে উদ্ধার করা হয়েছিল সেখানকার উষ্ণতা ১৫০ ডিগ্রি সেলসিয়াস এবং চাপ আবহমন্ডলের স্বাভাবিক চাপের তুলনায় ২ হাজার গুণ বেশি।

ইলেকট্রন মাইক্রোস্কোপের পরীক্ষায় ইউইন্স শিলাখণ্ডগুলির মধ্যে অকল্পনীয় ক্ষুদ্র ও ঘুমন্ত কিছু জীবকোষ খুঁজে পান যেগুলি আয়তনে মাত্র কুড়ি ন্যানোমিটার, যেখানে এক ন্যানোমিটার মানে এক মিটারের ১০০ কোটি ভাগের একভাগ। এসব ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র বস্তুগুলির নাম দেওয়া হয় ন্যানোবস্।
ইউইন্স দেখে অবাক হন যে ন্যানোবগুলিকে খাবার ও তাপ-চাপ প্রয়োগ করলে তাদের মধ্যে প্রাণের সাড়া পাওয়া যাচ্ছে। দুজন মাইক্রোবায়োলজিস্ট-এর সাহায্য নিয়ে গবেষক ভদ্রমহিলা আরও কতগুলি বিশেষ পরীক্ষা চালান। রাসায়নিক পরীক্ষায় দেখা যায় যে ন্যানোবগুলিতে রয়েছে প্রাণের প্রধান উপাদান ডিএনএ। এতদিন মনে করা হত যে কুড়ি ন্যানোমিটারের মত ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র কোন কোষে ডিএনএ থাকার জায়গা হতে পারে না। ভূপৃষ্ঠে প্রাপ্ত মঙ্গলের ন্যানোফসিল প্রাণের উপাদান হওয়ার ধারণাটা এই যুক্তিতেই বিজ্ঞানীরা অবাস্তব বলে আসছিলেন। ইউইন্সের গবেষণালব্ধ তথ্য বিজ্ঞানীদের সেই বিশ্বাসে জল ঢেলে দিল। তাহলে দেখা গেল যে অন্ধকার মহাকাশের অসম্ভব বৈপরীত্যে জীবনবিরুদ্ধ পরিবেশেও প্রাণের উপাদান বহনকারী জীবকোষ বেঁচে থাকতে পারে। অবশ্য এমন বিপরীত পরিবেশে বেঁচে থাকতে গেলে ন্যানোবের মতো ক্ষুদ্র হতে হবে না। প্রতিকূল চরমভাবাপন্ন পরিবেশে যেসব জীবনকণা বেঁচে থাকতে পারে তাদের বলা হয় এক্সট্রিমোফাইলস্, যেমন ব্যাকটেরিয়া। সম্প্রতি অন্য কিছু গবেষণায় দেখা গেছে যে এসব জীবনকণা পারমাণবিক চুল্লিতেও দিব্যি বেঁচে থাকে।
১৮৬৫ সালে সায়েন্স ফিকশনের জনক জুলে ভার্নের সাড়াজাগানো ক্লাসিক উপন্যাস ফ্রম দ্য আর্থ টু দা মুন প্রকাশিত হয়েছিল যেখানে ভার্নে তাঁর মহাকাশচারীদের পৃথিবী থেকে চাঁদে পাঠিয়েছিলেন একটা স্প্যেস ক্যাপসুলে ভরে আর সেই ক্যাপসুলটাকে একটা বিশালায়তন কামান থেকে গোলার মত নিক্ষেপ করা হয়েছিল। ব্যাপারটা যে অসম্ভব সেটা ভার্নে জানতেন। ক্যাপসুলটাকে কামান থেকে নিক্ষেপ করা হলে অভিকর্ষবিরোধী যে গতিবেগ হঠাৎ সৃষ্টি হবে তাতে উৎপন্ন হওয়া ভয়ংকর চাপে ক্যাপসুলের ভিতরে থাকা যে কোন প্রাণী এক লহোমায় পিষ্ট হয়ে মরে যেতে বাধ্য। জীবন্ত প্রাণী নিয়ে যে মহাকাশযান পৃথিবী থেকে মহাশূন্যে বেরিয়ে যেতে চাইবে তাকে মুক্তিবেগ অর্জন করতে হবে ধীরেসুস্থে নিয়মিত ছন্দে ক্রমাগত হারে।
উল্কাপিণ্ডের আঘাতে মঙ্গল গ্রহের গা থেকে নিক্ষিপ্ত শিলাখণ্ডগুলিতে জীবন্ত প্রাণকণা পৃথিবীতে এসে পড়ার ঘটনা যেন ভার্নের সেই কামানের গল্প।শিলাখন্ডগুলির এভাবে মহাকাশযান হয়ে পড়ার মধ্যে রয়েছে বেশ কয়েকটি বিষয় যা নিঃসন্দেহে প্রাণঘাতী। প্রথমত ভাবা যাক শক ওয়েভের কথা। প্রচন্ড আঘাতে উৎপন্ন হবে অকল্পনীয় উত্তাপ। প্রাণকণিকাগুলি সেসব সামলে যদিও বা বেঁচে যায় তো আছে অন্য ব্যাপার। কামানের গোলার ক্ষেত্রে যেমন দেখা গেছে, হঠাৎ যদি কোন বস্তুর মধ্যে প্রচন্ড গতিবেগ সৃষ্টি হয় তো অভিকর্ষবিরোধী যে চাপ তৈরি হবে তা সহ্য করা কোন জীবন্ত প্রাণীর ক্ষেত্রে অসম্ভব। পৃথিবীতে অধিকাংশ প্রাণবস্তুর ক্ষেত্রে দেখা যায় যে অভিকর্ষবিরোধী কয়েকশ’ গুণ গতিবেগই তাদের ধ্বংস হয়ে যাওয়ার পক্ষে যথেষ্ট। কিন্তু আশ্চর্যের কথা এই যে মঙ্গল থেকে শিলাখণ্ডবাহিত হয়ে যেসব প্রাণকণা পৃথিবীতে এসেছিল বলে মনে করা হচ্ছে তাদের অনেককেই দেখা গেছে অভিকর্ষবিরোধী দশ হাজার গুণ গতিবেগেও বেঁচে থাকতে সক্ষম। সম্প্রতি সুইডেনে এক পরীক্ষা থেকে দেখা গেছে যে এসব অতিক্ষুদ্র প্রাণকণাকে কামান থেকে নিক্ষেপ করা হলেও তারা হঠাৎ প্রাপ্ত প্রচন্ড গতিবেগের চাপ অগ্রাহ্য করে বেঁচে থাকে। জুলের ভার্নের তত্ত্বটা হয়তো ঠিকই ছিল।
মঙ্গল থেকে উল্কাপিণ্ড আঘাতজনিত কারণে নিক্ষিপ্ত শিলাখন্ডের যেসব সূর্যের চারদিকে ঘুরপাক খেতে শুরু করে তাদের অন্তত প্রতি ১৫ টির মধ্যে ১ টি এসে শেষপর্যন্ত পৃথিবীতে নামে। কেউ কেউ এ কাজটা করে কয়েক হাজার বছরে, কোথাও বা লেগে যায় লক্ষ লক্ষ বছর। এভাবে শিলাখণ্ডবাহিত হয়ে প্রাণকণা গুলির ভ্রমণপথ ছিল অসম্ভব বিপজ্জনক। কোটি কোটি মাইল মহাশূন্যের যাত্রাপথ চরম ঠান্ডা, রয়েছে কসমিক রে ও অতিবেগুনি রশ্মির একটানা প্রাণঘাতক আঘাত। মনে করা হয়, শিলাখণ্ডস্বরূপ মহাশূন্যযান এসব রশ্মির হাত থেকে জীবকণাগুলিকে কিছুটা হলেও প্রতিরক্ষা দিয়েছিল এবং মহাশূন্যের চরম ঠান্ডা প্রকারান্তরে বিরুদ্ধ পরিবেশে তাদের বাঁচিয়ে রাখার অনুকূলেই কাজ করেছিল।।
প্রাথমিক আঘাতে মঙ্গল গ্রহ থেকে উৎখাত হওয়ার বিপদের পর দীর্ঘ মহাকাশ পাড়ি দেওয়ার বিপদ, এই দুটি প্রতিকূলতাকে কাটাবার পরও থেকে যায় তৃতীয় আরেকটি বিপদ আর তা হল পৃথিবীতে ঢোকার সময় বায়ুমন্ডলের সঙ্গে সংঘর্ষ। প্রতি ঘন্টায় ২৫ হাজার মাইল গতিবেগে পৃথিবীর আকাশে আসার সঙ্গে সঙ্গে বায়ুমণ্ডলের সঙ্গে ঘর্ষণে উৎপন্ন উত্তাপে তাদের গা সাদা হয়ে যায় এবং অনেকগুলি মুহূর্তের মধ্যে ছাইয়ে পরিণত হয়। মাত্র অল্প কয়েকটি শেষপর্যন্ত পৃথিবীর মাটিতে নামতে পারে। এদের অভ্যন্তর উত্তাপের প্রচন্ডতা থেকে সুরক্ষিত যেহেতু এসব শিলাখণ্ডের বহিত্ত্বক খুব ভালো তাপ নিরোধক। আসলে মহাকাশ অতিক্রম করে আসার সময় যে অকল্পনীয় ঠান্ডার মধ্যে ছিল শিলাখণ্ডগুলি তাতেই তাদের অভ্যন্তরভাগ পৃথিবীতে ঢোকার সময়ও শূন্যের চেয়ে কম উষ্ণ থেকে যায় আর তাই বায়ুমণ্ডলের সঙ্গে ঘর্ষণে বাইরেটা উত্তাপে জ্বলে যেতে থাকলেও ভিতরটা ঠান্ডা থেকে যায় ও জীবকণাগুলিকে বাঁচিয়ে রাখে। পৃথিবীর মাটিতে নেমে জীবকণাগুলি খুঁজে পায় মঙ্গল গ্রহের অনুরূপ পরিবেশ এবং কোটি কোটি বছরে এখানে তারপর প্রাণের বিকাশ ঘটে।
প্রসঙ্গক্রমে অন্যরকম কিছু তত্ত্বের উল্লেখ করা যায়। পদার্থবিজ্ঞানী পল ডেভিস দা ফিফথ মিরাকেল বইতে পৃথিবীতে প্রাণের উৎপত্তি ও বিকাশ সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে বলেছেন যে অনাদি অতীত থেকে পৃথিবী ও মঙ্গলের মধ্যে জীবনের আদান-প্রদান ঘটে আসছে। তাঁর মতে পৃথিবী থেকেও কোন এক সময় প্রাণের বীজ গিয়েছিল মঙ্গলে আবার সেই বীজই মঙ্গল থেকে পৃথিবীতে এসে নোঙ্গর করেছিল। পল ডেভিস জানিয়েছেন যে ৪০০ কোটি বছর আগে পৃথিবীর তুলনায় মঙ্গলের পরিবেশ প্রাণের বিকাশের পক্ষে ছিল অনেক বেশি অনুকূল। তারপর প্রাণের বীজ আসে পৃথিবীতে এবং এখানকার পরিবেশ অনুকূল হয়ে ওঠে। পল ডেভিসও মনে করেন যে পৃথিবীর বর্তমান সভ্যতার বীজ আসলে মঙ্গল গ্রহ থেকেই এসেছিল সুদূর অতীতে। প্রতিভাস ম্যাগাজিন