প্রীতন্বিতা

স্পিৎজার দূরবীন ও নক্ষত্রের জন্ম 

আকাশে উজ্জ্বল হয়ে থাকা লক্ষ লক্ষ তারার জন্ম কিভাবে হয়েছিল তা সঠিকভাবে এখনোও জানতে পারেননি বিশ্বের তাবোত মহাকাশ বিজ্ঞানীরা। পাশাপাশি ঘুরতে থাকা দুটি ছোট তারা বা প্রোটোস্টার যুক্ত হয়ে মাধ্যাকর্ষণ শক্তি, মহজাগতিক ধূলিকণা, হাইড্রোজেন ও হিলিয়াম গ্যাসের মধ্যে বিক্রিয়ার ফলে যে অনেক তারার উৎপত্তি ঘটিয়েছে সেটা আমরা জানতে পেরেছি কৃত্রিম উপগ্রহ থেকে নেওয়া আলোকচিত্রের মাধ্যমেই। তবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসা বলেছে একটি নতুন কথা। নাসার বিশেষ মহাকাশ পর্যবেক্ষণ সংস্থা স্পিৎজার-এর পাঠানো স্যাটেলাইট ছবি থেকে জানা গেছে যে মহাকাশে থাকা বিভিন্ন বড় আকারের তারার মাধ্যাকর্ষণ জনিত টানে অর্থাৎ তৃতীয় শক্তির প্রভাবে মহাকাশে ঘুরতে থাকা বিভিন্ন গ্রহের টুকরো, গ্যাসের পিণ্ড, ধূলিকণা মিলেও সৃষ্টি হচ্ছে নতুন তারার। 

নাসার এই স্পিৎজার মহাকাশ দূরবীনটিকে চালায় দীর্ঘ আলোর তরঙ্গ বা ইনফ্রারেড আলোযুক্ত আলোক বর্ণালী বা স্পেকট্রাম। ছোট দৈর্ঘ্যের আলোক তরঙ্গ খুব তাড়াতাড়ি বিচ্ছুরিত হওয়ার জন্য সেই আলোতে কোন দূরের জিনিসকে ভালো দেখা যায় না, কিন্তু ইনফ্রা রেড বা লাল উজানী আলোক রশ্মির তরঙ্গ দৈর্ঘ্যের মাধ্যমে দূরের জিনিস, যেমন নক্ষত্রদের আরোও ভালোভাবে দেখা যায়। তবে এই ইনফ্রা রেড বায়ুমন্ডলে শোষিত হওয়ার জন্য এই ধরনের রশ্মি চালিত টেলিস্কোপকে বায়ুমণ্ডলের বাইরে পৃথিবীর চারপাশে কক্ষপথে ঘুরতে থাকা মহাকাশ গবেষণা কেন্দ্রে বসানো হয়েছে। এই শতাব্দীর প্রথম দশক অব্দি কাজ করেছিল স্পিৎজার দূরবীন, কেননা এই যন্ত্রটিতে শক্তি যোগানো তরল হিলিয়ামের যোগান এরপর ফুরিয়ে যায়। ইনফ্রারেড রশ্মি থেকে যেহেতু উষ্ণতা তৈরি হয় তাই এই স্পিৎজার দূরবীনটিকে পরম শূন্য তাপমাত্রাতে -২৭৩° সেলসিয়াস শীতল রেখেছিলেন মহাকাশ বিজ্ঞানীরা। যাতে এই তাপমাত্রা না বাড়তে পারে সেজন্য পৃথিবীর চারদিকের কক্ষপথে না রেখে স্পিৎজারকে সূর্যের চারদিকের কক্ষপথে, যাকে বলা হয় হেলিওসেন্ট্রিক অরবিট, সেখানে রাখা হয়েছিল। এর ফলে পৃথিবীপৃষ্ঠ থেকে প্রতিফলিত সৌরতাপ আর পৌঁছতে পারেনি ওই দূরবীনের কাছে। এই দূরবীনটির নামকরণ করা হয়েছিল প্লাজমা পদার্থবিদ্যা ও আন্তর্গ্রহ জ্যোতিঃপদার্থবিদ্যাতে পথিকৃৎ বিজ্ঞানী ডক্টর লাইমেন স্ট্রং স্পিৎজারের নামে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রিন্সটন প্লাজমা ফিজিক্স ল্যাবরেটরির প্রতিষ্ঠাতা তিনি সর্বপ্রথম গত শতাব্দীর চল্লিশের দশকে প্রস্তাব দিয়েছিলেন পৃথিবীর কক্ষপথে মহাকাশ দূরবীন স্থাপনের জন্য।

এই দূরবীন থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী আমরা জানতে পেরেছি যে মহাশূন্যে বেশ কয়েক হাজার আলোকবর্ষ ধরে ছড়িয়ে থাকা মহাজাগতিক ধূলিকণার মেঘ, অর্থাৎ নেবুলা বা নীহারিকা থেকেও জন্ম নিতে পারে নক্ষত্ররা। যদি কোন বড় তারা ওই ধূলিকণার পাশ দিয়ে যায় তাহলে সেই জ্যোতিষ্ক থেকে ধূলিকণাগুলোর মধ্যে আছড়ে পড়ে মাধ্যাকর্ষণ শক্তি তরঙ্গের আঘাত। তখন ঠিক মার্বেল বলের মতো ধূলিকণাগুলো আরোও জোরে ঘুরতে থাকে। বহু লক্ষ বা কোটি বছর ধরে চলে এই ঘূর্ণন। তারপর সেই ধূলিকণাগুলো মাধ্যাকর্ষণ বলের জন্য একত্রিত হয়ে তৈরি করে নক্ষত্র। বাইসাইকেলের টায়ারের পাম্প করা গ্যাসের আয়তন যেমন প্রবল চাপে কমে যায় তেমনি মাধ্যাকর্ষণের চাপেও ওই ধূলিকণা আর গ্যাসের আয়তন কমে যেতে থাকে। ওই চাপ যত বাড়ে নেবুলার মধ্যে থাকা গ্যাসের উষ্ণতাও বেড়ে চলে প্রায় দশ লক্ষ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মত। হাইড্রোজেন বোমাতে যেভাবে শক্তি উৎপন্ন হয় সেভাবে ওই নেবুলার মধ্যে হাইড্রোজেন অণুগুলির পরস্পর সংঘর্ষে তৈরি হয় হিলিয়াম অণু। যখন নেবুলার মধ্যে থাকা সমস্ত হাইড্রোজেন অণু ব্যবহৃত হয়ে হিলিয়াম তৈরি হয় তখনই অসহনীয়ভাবে উত্তপ্ত হয়ে বিস্ফোরণ ঘটে নক্ষত্রগুলির এবং এই দশাকে বলে সুপারনোভা। এই দশাতে নেবুলার ওপর প্রযুক্ত মাধ্যাকর্ষণ শক্তির দিক পাল্টে যায়। হিলিয়াম অণুগুলি পরস্পর সংযুক্ত হয়ে উচ্চ আণবিক ভরযুক্ত মৌল গঠন করে। 

স্পিৎজার দূরবীন থেকে পাঠানো উপগ্রহ ছবির মাধ্যমে মহাকাশ বিজ্ঞানীরা জানতে পেরেছেন যে যখন কোন তারার শরীর আশপাশের মহাজাগতিক বস্তু গ্রহণ করতে করতে সূর্যের থেকে আট গুণ বড় হয়ে যায় তখন সেই দানবিক নক্ষত্র থেকে অতিবেগুনি রশ্মি বিচ্ছুরিত হতে থাকে। এর ফলে ওই নক্ষত্রটিকে ঘিরে রাখা গ্যাসীয় পুঞ্জস্থিত হাইড্রোজেন পরমাণুর মধ্যে থেকে ইলেকট্রন কণিকাগুলি সরে যেতে থাকে শক্তি বিকিরণের মাধ্যমে। তাতে ধনাত্মক ও আহিত হাইড্রোজেন পরমাণুতে পরিপূর্ণ হয়ে যায় ওই গ্যাসীয় পুঞ্জ। ওই আহিত গ্যাস বা প্লাজমা তখন উত্তপ্ত হয়ে দানব তারার সীমানা ছাড়িয়ে ছড়িয়ে পড়ে অপেক্ষাকৃত ঠান্ডা এলাকাতে, ঝাঁটার মতো সমস্ত মহাজাগতিক ধূলিকণা ও গ্যাসকে ঝাঁট দিয়ে একসঙ্গে নিয়ে যায় ওই গ্যাস। ওই বর্ধিত গ্যাসীয় বলয়গুলোই তখন বিভিন্ন ঘনত্বের গ্যাসপিন্ডে পরিণত হয়ে তৈরি হয় দ্বিতীয় প্রজন্মের তারা বা সেকেন্ড জেনারেশন স্টার। এই তথ্য থেকে বুঝতে পারা যায় যে বৃহদাকার তারাগুলি থেকে যেসব গ্যাসীয় পিণ্ড বেরিয়ে আসে তার জন্য মহাশূন্যে অনেক শূন্যস্থান বা কসমিক ভ্যাক্যুয়ামও তৈরি হয়। ছায়াপথ বা মিল্কি ওয়ে গ্যালাক্সির দক্ষিণ দিকে এবং সেন্টরাস নক্ষত্রমন্ডলীর মধ্যে অবস্থিত পৃথিবী থেকে প্রায় সতেরো হাজার দুশ আলোকবর্ষ দূরের একটি অঞ্চলে এই প্রক্রিয়ায় বেশ কিছু তারাও গড়ে উঠেছে। ওই তারাগুলির স্যাটেলাইট ছবি, যাকে বৈজ্ঞানিক ভাষাতে বাবল বলা হয়, তুলে নিয়েছে স্পিৎজার দূরবীনটি। পৃথিবী থেকে প্রায় ছ হাজার পাঁচশ আলোকবর্ষ দূরের ডব্লিউ ফাইভ অঞ্চলের কিছু উপগ্রহ চিত্র তুলেছিল দূরবীনটি। তাতে দেখা গেছে যে ক্যাসিওপিয়া নক্ষত্রমন্ডলীর অন্তর্গত এই এলাকাটিতেও এই রকমভাবে বেশ কিছু নক্ষত্রের জন্ম হয়েছে। এইসব দৈত্যাকার নক্ষত্রের চারপাশে উজ্জ্বল আলোর বলয়ের মতো অবস্থিত রয়েছে দ্বিতীয় প্রজন্মের তারকারা। প্রতিভাস ম্যাগাজিন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *