তাপস কুমার দে
শরীর কি পাখি ডাকা ঘরে ফেরা অন্ধকার
সেতারে জড়ানো স্তব্ধ জলের জ্যোৎস্নায় ফিরবে বাতাসের রুহ!
মিশে যাবে পথ, পথিক, অসংখ্য জোনাক শৈশব
আয়ুর উত্তাপে সহজাত স্রোত
রচিবে কিরণ উল্লাসে ঋতু ভরা মাতাল গান
ইতিহাস এঁটে দেয়া প্রবঞ্চনা মুছে যেতে থাকে ভালো মন্দ সবকিছু।
কাগজের ভাজে ইহকাল পরকালের আঁটোসাঁটো দেহ
হয়তো কখনোই ছিলোনা অন্ধকার বেরিয়ে আসা বুলেটের তাড়া
পরিনত নিয়তির সমীকরণ সূচিত যখন।
অজ্ঞতার বোঝা উন্মোচিত প্রার্থনায় ঝুলতে থাকে
পাপপুষ্ট চুম্বননাশক কবিতা।
ভাঁজ মুড়তে মুড়তে পৃষ্টাজুড়ে মোটা হয়ে গেছে আকাশ।
আমৃত্যু পেটঝোলা। শরীরটা অন্ধজনের হাতি দেখার কাহিনী।
ফিরে আসবে কি প্রপাতে হারিয়ে যাওয়া দৈববাণী, দৈবশরীর।
যার গভীরে নিজেকে সঁপে দিতে পারি!
লেখাটি শেষ হতেই ফেবুতে পোস্ট দিলো মুক্তি। আর পোস্ট দেওয়ার মধ্য দিয়ে নেমে আসে তার যত স্বস্তি, শান্তি, সুখ যেন মনের আকাশে উড়ে গেল একঝাঁক পাখি। এবার টেবিল থেকে উঠে বড়ো এককাপ কাঁচাপাতা চা বানিয়ে চুমুক দিচ্ছে আর পায়চারি করছে। তখন করনাকালিন সময়, বাসা থেকে বেরুনো অসম্ভব প্রায়। সারা দিনরাত লেখালেখি আর পড়াশোনাতেই কেটে যায় বিশেষ করে ফেবুতে ভালো সময় কাটে। মুক্তি ডাক্তারি পড়ে, শেষবর্ষের শিক্ষার্থী। ফেবুতে পোস্ট দেওয়ার জন্য প্রতিদিন লেখা তৈরি করা আর তার মন্তব্যের উত্তর দেওয়া মুক্তির কাছে এখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সময়টা উপভোগও করছে। তবে সব মন্তব্য যে পজিটিভ তা কিন্তু নয়, দু’একটা নেগেটিভ মন্তব্য পেয়ে থাকে কিন্তু সেগুলো নিয়ে তেমন উচ্চবাচ্য করেনা কারণ সে বাংলা সাহিত্য সম্পর্কে তেমন কিছু জানে না। পড়াশোনা বলতে দু’চারটে গল্প, উপন্যাস আর কবিতার বই পড়েছে যা সকলেই যৌবনে পা রেখে পড়ে থাকে, একজন বাঙালি হিসেবে। তাই তার লেখা সাহিত্যের কোন শাখায় পড়ে সে তা নিজেও জানে না। নেগেটিভ মন্তব্য নিরবে নিভৃতে শয্য করে বা এড়িয়ে যায়। আজকের লেখাটিতে প্রচুর মন্তব্য এসেছে, এর মধ্যে একটি মন্তব্য চোখে পড়ার মতো। লেখালেখিতে নিজেকে উজাড় করে দেওয়ার মতো উৎসাহব্যঞ্জক। মুক্তির বড়ো ভালো লেগেছে। মন্তব্যটি পাঠিয়েছেন সিরাজুল ইসলাম। মুক্তি তাড়াতাড়ি ওনার প্রফাইলটি বের করে দেখে নিলো। সরকারি চাকুরে , লেখালেখি করেন। চাকরির সুত্রে এখানে সেখানে বদলী হয়ে থাকেন। বিবাহিত ।
মুক্তি আবার মন্তব্যটি মনপ্রাণ দিয়ে পড়তে থাকে —
প্রিয় মুক্তি /
আপনার লেখা, “বাতাসের রুহ ” পড়ললাম। অনবদ্য লেখা। সেখানে অজস্র প্রশ্ন ছুঁড়ে রেখেছেন পাঠক বোদ্ধাগনের কাছে।
সত্যি তো, “শরীর কি পাখির ডাকে ঘরেফেরা অন্ধকার!”
জীবন কি? আসলেই কি আমরা জানি, জীবন কি?
Life is nothing, but a walking shadow!
জীবন আসলেই চলমান ছায়া মাত্র। আমরা মিছে মায়ার মোহে সবাই ছুটছি দিনরাত্রি, অহোরাত্র। অন্তত পথের দিশারী সে কোন নক্ষত্র আলোয় ছুটে চলা, কে জানে তা!
অন্তবিহীন অনন্তকাল বসন্তদিন বেঁচে আছি কোন স্বার্থের মোহমায়ায় পড়ে।
উত্তর খোঁজার ব্যর্থ অপপ্রয়াসে আমি সন্ধ্যার নিবিড় অন্ধকারে কোন লঞ্চঘাটের নির্জন আঁধারে খুঁজতে চেষ্টা করি কখনোসখনো। সন্ধ্যার মায়াতে নদীর দু’পাড়ে জ্বলে ওঠে তখন অজস্র নিয়নবাতি কিম্বা হ্যালোজেন। আমি তন্ময় হয়ে দেখি শত সহস্র আলোর উর্মিমালা। কোনটা জ্বলছে আপন বিভা ছড়িয়ে। কোনটা নিভে যাচ্ছে হুটহাট দপ করেই।
এও যেন জীবনের ওঠানামা, চিরন্তন সত্য।
অসংখ্য সুর ভেসে আসে ঘুঁঘরো উচঙ্গের। জীবনবোধের এক মহাসমীকরণ মহড়ায় ব্যস্ত।
হয়তো আপনার কথাই সঠিক, ফিরে আসে না আর জলপ্রপাতে হারিয়ে যাওয়া দৈববাণী, দৈবশরীর। যার গভীরে সঁপে দিতে পারবো নিজেকে।
শতকোটি আলোকবর্ষ দূরে সরে যেতে হবে দিন দিন প্রতিদিন।
“জিন্দেগী কি তালাশও মে হাম মউৎও কো কীৎনে পাস আ গ্যয়া।”
জীবনের সুলুক সন্ধান করতেই আমরা আমাদের অস্তিত্ব হারিয়ে ফেলছি।
ভালো থাকবেন সবসময়ই বিশ্বাস করি বন্ধু।
সিরাজুল ইসলাম।
(কবি ও গল্পকার)
ফেবুতে ব্যক্তিগত সম্পর্কের বাইরে সকলেই সকলকে বন্ধু বলে সম্বোধন করে থাকে। কিন্তু মুক্তি যেন বন্ধু শব্দটির যথাযথ উষ্ণতা অনুভব করলো। জানালায় গিয়ে দাঁড়ালো। দূরে তাকালো যেখানে সম্পর্কের সব শুত একহয়ে মিশে গেছে সবুজে। ভেতরটা আবেগে ফুঁসে ওঠা অশ্রুজলে ভিজে গেল, মনে হলো সিরাজুল ইসলাম তার কতোদিনের চেনা আপন একজন মানুষ। পাশে পেলে আকাশটাকে ছোঁয়া যেতো। লেখা যেত জীবনের গল্প। শূন্যতা র থেকে পূর্ণতার দিকে ধাবিত হতো সময়। দর্শন সেখানে ক্রমাগত ভাবে ঋতুর রূপান্তর ঘটায়। জানি কল্পনা সৌন্দর্যের চলমান প্রকৃতির রূপ আর তাতে মোহিত হয়ে মুক্তি ফোন করলো সিরাজুল ইসলামকে।
— হ্যালো আমি মুক্তি বলছি
— ম্যসেঞ্জারে ফোন করেছেন নামটি দেখতে পাচ্ছি।
— কেমন আছেন আপনি?
— একা মানুষ যেভাবে থাকা যায় তেমনই আছি।
— একা কেনো? বৌমনি কোথায়?
— সরে গেছে অভিমানকে সাথী করে।
— কারণ?
— বড়লোকের আদুরে রাজকন্যা।
আমার গরীবত্ব মেনে নিয়ে চলতে পারেনি বলে একদিন মেয়েকে সাথে নিয়ে চলে গেছে বাবা-র কাছে।
বাদ দিন সেসব। আপনার কথা বলেন।
— আমাকে আপনি করে না বলে তুমি করে বললে খুশি হবো
— দেখো যারা লেখালেখি করে তাদের শরীরের বয়স
বাড়লেও মনের বয়স বাড়ে না। পরে তুমিই অতিষ্ঠ হয়ে যাবে না তো? জানি তুমি ভালো লেখো। মেধাবী, এসবের তোয়াক্কা করবেনা। বাড়িতে কে কে আছেন?
— মা, দুই বোন
— বাবা কোথায়?
— আমাদের ছেড়ে না ফেরার দেশে চলে গেছেন।
— দুঃখিত, অজান্তে কষ্ট দিয়ে ফেল্লাম।
— কোনো ব্যপার নয়। আপনি ভীষণ মনখোলা মানুষ।
— মনখোলা মানুষ হয়ে কি লাভ! সেই তো হাত পুড়িয়ে রান্না করতে হয়।
— তবে কি আমি এসে রান্না করে দেবো।
সৌজন্যের খাতিরে মুক্তি কথাটা বল্লেও মনেমনে চাইছিল নিজ হাতে রান্না করে খাওয়াতে। মায়া হচ্ছিল। সত্যিই তো এবয়সে একা থাক না জানি কতো কষ্টের।
— আমার কি আর সে সৌভাগ্য হবে?
— মনথেকে চাইলে হতেও পারে।
— সত্যিই তুমি খুব ভালো তাই এভাবে বলতে পারলে।
প্রথম আলাপেই দুজনে মনের দিক থেকে বড়ো কাছাকাছি চলে এসেছে। ঘনিষ্টতাও বেড়েছে। এরপর প্রতিদিন ঘন্টার পর ঘন্টা ফোনালাপ নিয়েই দু’জনে ব্যস্তথাকে। করোনার স্থবিরতায় তাদের কিছুই যেন যায় আসছেনা। সিরাজুল ইসলাম মুক্তিকে নিয়ে কবিতা,গল্প লিখছে, কোন অপশন পেলে গিফট পাঠিয়ে দিচ্ছে কুরিয়ারের মাধ্যমে। কদিনেই প্রেমিকের মতো আচরণ যেন তার বয়সকে আঠারো-উনিশে নামিয়ে এনেছে। ঐ ফোনই যেন তার একাকিত্ম দূর করে দিয়েছে
এইতো কদিন আগেও নিজেকে বড়ো নিঃসঙ্গ মনে হতো। কিছু ভালো লাগতো না। খেতেও ইচ্ছে করতো না তাই ঠিকমতো খেতামও না কেমন যেন খিদে মরে গিয়েছিল। দিনগুলো অদ্ভুত রকমের মলিন, ধুসর ছিল। মাঝে মাঝেই গান শুনতাম বিশেষ করে রবীন্দ্রসংগীত আর মেলা মন খারাপ লাগলে মা-বাবার কথা মনে পড়তো, হারিয়ে যাওয়া বোনের কথা মনে পড়তো। ম্মৃতিসিক্ত সেই সব আঁকাবাঁকা দিনগুলো আমাকে যেন বলতো, কাঁদিস না এইতো আমরা আছি তোর পাশে। আমার রুমের সামনে কিছু অনাবাদি জমি ছিলো সেখানকার বনজঙ্গল পরিষ্কার করে জমিটাকে আবাদি করে গড়ে তুলি। নানারকম সবজি, ফুলের গাছ লাগিয়েছি। যাতে একাকিত্বটা ভুলে থাকতে পারি। নিজেকে ব্যস্ত রাখতে পারি। ঠিকমতো গাছগুলোর পরিচর্যা করতাম না। তবু কিছু সবজি হয়েছে, আশপাশের মানুষেরা নিয়ে খেয়েছে। না টাকার বিনিময়ে নয়। চাইলেই দিয়ে দিতাম। আসলে নিজেকে উজাড় করে দেওয়ার মধ্যে অন্যরকম আনন্দ আছে তাই শুধু বিলিয়েই যাই। বড়ো ভালো লাগে বিলিয়ে দিতে। যেমন তোমাকে দিয়েছি, অবশ্য তোমাকে দিয়ে লাভ হয়েছে বউ পেয়েছি । আমি বদলে গেলাম। কথাগুলি মুক্তিকে সিরাজুল ইসলাম ফোনে বলছিল।
— সাথে সাথে মুক্তি বলে উঠলো বুড়োর শখ কতো! আমি তোমার বউ হতে যাবো কেনো! তোমার বউ জানলে জেলের ভাত খাওয়াবে দু’জন কে-ই।
— যদি বউই না হবে তবে আদর করলে কেনো? বয়স কালে তোমার সাথে দেখা হলে অবশ্যই তোমাকে বিয়ে করতাম। আর তুমি রাজি থাকলে প্রথম বৌয়ের কাছে অনুমতি নিয়ে বিয়ে করবো। তোমাকে না পাওয়ার আফসোস আমার বাকি জীবন কূরেকূরে খাবে। আপাতত তুমি আমার কলিজা হয়ে থাকো। এখন থেকে কলিজা বলেই ডাকবো তোমায়। আর তোমার মাকে বলে রেখো করনার পর তোমার জামাই আসছে।
কথাগুলো মুক্তির কাছে স্বপ্নের মতো মনে হলো। লজ্জায় লাল হয়ে উঠলো। ফোনটা কেটে দিলো। পদ্মা, মেঘনা, যমুনা যেন এক হয়ে গেলো। বান ডাকলো। জোয়ারে ভেসে গেলো সমতলের সকল কূল, বাগবাগিচা। সমুদ্র ডাকছে আর ডাকছে। গর্জে উঠলো আকাশ। বৃষ্টি হচ্ছে। চারিদিকে মেঘ, মুক্তি দৌড় দিয়ে ছাদে গিয়ে উঠলো। হাত তুলে, লাফিয়ে, নেচে অনেকক্ষণ ধরে ভিজলো অঝরধারার বৃষ্টিজলে।
এসবের মধ্যেই সরকার করোনার বিধিনিষেধ তুলে দিলো। সকলের মতো মুক্তিও কলেজের হোস্টেলে চলে গেলো। যাওয়ার সময় কি কি নিয়েছে, নির্দিষ্ট পরিমানের টাকাপয়সা নিয়ে যেতে পারছে কি না খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে এসব শুনে নিলো সিরাজুল ইসলাম। যেন নিজের বউ। আরো বললো, কলিজা ওখানে যেয়ে নিয়মিত ফোন করো আর একটু আদর করে দাও! চুমুর একটি আওয়াজ শুনতে পেলো তারপর লাইনটি কেটে গেল। পরের দিন থেকে ক্লাসশুরু হলো। ডাক্তারির শেষবর্ষের ক্লাস বলে কথা সারাদিন ক্লাস আর প্র্যাক্টিস মিলে একদম ক্লান্ত। সিরাজুল ইসলামকে একবারও ফোন দিতে পারছে না বরং সিরাজুল ইসলাম ফোন দিলে কেটে দিচ্ছে। এভাবে কয়েকটি দিন কাটানোর পর শুক্রবার সকালে মুক্তি ফোন দিলে সিরাজুল ইসলাম ফোন কেটে দেয়। কয়েক বার দেওয়ার পর অভিমান ভেঙ্গে ফোন ধরে। কলিজা বলে কয়েক বার ডাকার পরও তেমন উত্তেজনা খুঁজে পায়না মুক্তির ভেতর সিরাজুল ইসলামও একটু আনমনা হয়ে পড়ে। ভাবে, ওর তো ভবিষ্যত আছে বাবাটা নেই, ছোটো দু’টি বোন আছে, সারাবছরের ইনকাম বলতে জমির ফসল আর বাবার রেখে যাওয়া দুটি দোকানের ভাড়া। না, ওকে ডাক্তার হতেই হবে। ওকে, আর বিরক্ত করবো না। ওপাশ থেকে মুক্তি কথা বলেই যাচ্ছে কিন্তু সিরাজুল ইসলাম কিছুই কানে নিলো না তবে এটুকু শুনতে পেলো মা বলেছে সামনে আমার বিয়ে দিয়ে দেবে। সিরাজুল ইসলাম আকাশ পাতাল ভাবে।আঁধার দেখে ভরদুপুরে। যেন ঝড়ের গায়ে উড়িয়ে দিয়েছে স্বপ্ন। ক্লান্তি মুখর সকল পদ্যগুলো নিবিড় হয়ে দাঁড়ায় শূন্য ঘরে। হয়তো নীল ফুলের সমাহার সম্ভাষণ জানাবে। তবুও এ-ই ফোনটি সিরাজুল ইসলামের নিঃসঙ্গতার সঙ্গী। কলিজার নিঃশ্বাস, উষ্ণতা, আবেগ সব, সবকিছুই জীবন্ত হয়ে ছুঁয়ে যেত সিরাজুল ইসলামের জীবনে যেন ফোনেই তার সংসার। সে জানতো এই অসমপ্রেম হতে পারে না। তাকে ধরে রাখার কোন অধিকার তার নেই। তবু ভালোবাসা শ্বাশ্বত আর নিস্কাম প্রেম সত্যি বিরল। সারা রাত কলিজাকে নিয়ে লেখা বিভন্ন কবিতা, গল্প এবং দুজনের বিভিন্ন ম্যসেজ পড়তে পড়তে বাতাসের রুহু লেখাটি সামনে এলো—-
শরীর কি পাখি ডাকা ঘরেফেরা অন্ধকার
সেতার জড়ানো স্তব্ধ জলের জ্যোৎস্নায় ফিরবে বাতাসের রুহু!
সিরাজুল ইসলাম ভাবলো সত্যিই সে আমার কাছে বাতাসের রুহু। তারপর কলিজাকে ব্লক করে দেয় সমস্ত স্মৃতি মুছে ফেলে যদি ওর বিয়ের পর এ-সব নিয়ে অশান্তি হয়। কিছু অশ্রু ঝরলেও সিরাজুল ইসলাম ফোনটাকে কলিজা ভেবে তুলে রাখে আজীবনের জন্য।