সৌমিতা রায় চৌধুরী

বিয়ের গান

“লীলা বালী লীলা বালী

     ভর যুবতী সই গো

  কি দিয়া সাজাইমু তোরে?”

     এমন একটি গানের কলি ভেসে আসছে আর আপনি বিবাহের নিমন্ত্রিত অতিথি উপহারের প্যাকেট সাজিয়ে নিজেকে প্রস্তুত করছেন ওই অনুষ্ঠানে যাওয়ার জন্য। বলুন তো, এইরকম একটা সময় মনের মধ্যে একটা খুশি খুশি ভাব হয় কিনা? বিবাহ অনুষ্ঠানের এক আলাদাই মাত্রা আছে। 

     প্রচলিত প্রবাদ হলো, ‘জন্ম-মৃত্যু-বিয়ে তিন বিধাতা নিয়ে’। বিবাহ প্রতিটি মানুষের জীবনের নতুন এক অধ্যায়। নতুন সংসার গঠনের আশায় আপন মনের মাধুরী মিশায়ে পুরুষ-নারী (বর-কনে) সারা জীবনের জন্য পরস্পরের প্রতি দায়িত্ববোধ ও ভালোবাসায় একত্রে জীবন শুরু করে। দুটি পৃথক পরিবারের মধ্যে আত্মীয়তার বন্ধন তৈরি হয় বিবাহ নামক প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে। দুই পরিবারই নিজ নিজ পরিবারের মৌলিকত্ব প্রচারের পাশাপাশি পাশে থাকার দায়িত্ববোধ বহন করে। 

     আইনি বিবাহ অতি আধুনিক সভ্য সমাজের বিষয়। কিন্তু বৈবাহিক সম্পর্কের বন্ধন সুপ্রাচীনকাল থেকে পরিবারতন্ত্রকে সুশৃঙ্খলভাবে সমাজ গঠনে সাহায্য করেছে। জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে বৈবাহিক প্রথার ক্ষেত্রে কিছু আচার-বিচার, নিয়ম-নিষ্ঠা থাকে। 

     হিন্দু বিবাহের আচারগুলিকে দুটি ভাগে ভাগ করা যায়। লৌকিক এবং বৈদিক। লৌকিক আচারগুলি অঞ্চল ভেদে আলাদা আলাদা। কিন্তু বৈদিক আচারগুলি মূলত একইরকম। রামায়ণের শিক্ষায় হিন্দু বিবাহে দৃঢ় সংস্কারের বৈশিষ্ট্য থাকে। সেখানে ছড়ার গানে শিব-দুর্গার সঙ্গে রাম-সীতার উপস্থিতিও লক্ষ্য করা যায়। শাস্ত্র নির্দেশিত ক্ষৌরকর্ম পালনের পরে পয়ার ছন্দে পাঁচালির সুরে যে গান গাওয়া হত, তা অনেকটা এমন —

“শুনুন শুনুন মহাশয় করি নিবেদন

  রাম-সীতার বিবাহ কথা করুন শ্রবণ

  প্রজাপতি নির্বন্ধ কহেন সর্ব লোকে

  কন্যাদান মহাফল সর্বশাস্ত্রে লেখে।”

     হিন্দু বাসি বিয়ের আসরে কন্যার সখী দলের আসরেও থাকত শ্রীরামের মহিমা। যেমন —

“শ্রীরামচন্দ্রের বাসি বিয়া মিথিলায় 

  দেখিতে রামের বিয়া

  স্বর্গপুরের বাসী যারা

  গোপনে থেইকে চায়।”

     একসময় হিন্দু সমাজে বহুল প্রচলিত এই মৌখিক ছড়াগুলি কালের গহ্বরে ক্রমশ হারিয়ে গেছে। বাংলাদেশের রাজশাহী জেলায় প্রচলিত হলুদ কোটার ছড়া যেমন —

 “শোনে হরিণের ডাক

  ওই না হলদি কুটতে ক’নার মা। 

  শোনে বাঘের ডাক

  দৌড় দিয়ে যায় ক’নার মা।”

     আবার বাড়ির বয়ঃজ্যেষ্ঠ মহিলারা গান গেয়ে বর-কনের প্রতি স্নেহ প্রকাশ করতেন। এমনই একটি গান হলো —

“এলাম সই তোদের বাড়ি মালা দিতে

  মালা দিতে লো সজনী বর দেখিতে

  আমি রসেরও মালিনী

  রসের খেলা কতই জানি।”

     বিবাহকে ইসলাম ধর্মে অত্যন্ত পূণ্য কর্ম বলে মনে করা হয়। হাদিসে বলা হয়েছে, যখন কোনো বান্দা বিবাহ করে, সে তার ধর্মের অর্ধেক ইমান পূর্ণ করে। মুসলিম সমাজে মনে করা হয়, বিয়ের কাপড় বেহেস্ত পর্যন্ত যায়। মুসলিম সমাজে বিয়ের গানের বহুল প্রচলন আছে। এই গান শুরু হয় আল্লাহর বর্ণনা দিয়ে। গ্রামীণ মুসলিম বিবাহ রীতিতে সাতজন এয়ো স্ত্রী ঢেঁকির তালে মঙ্গল গীত গায়। একে ‘ঢেঁকি-মুঙ্গলা’ বলে। যেমন —

“চোখ মুজি মুজি চোখে ছাই

  ঢেঁকি মুঙ্গলানো দেখে যাই

  গাল ভ’রে পান পাই

  মাথা ভ’রে তেল পাই।”

     কনের অতি সাধারণ কিছু সাচ্ছন্দ ও বর-কনেকে নিয়ে নানান ঠাট্টা তামাসা করে এই ধরণের গীত গাওয়া হয়। 

     বাংলার খ্রিস্টান বিবাহ বাসরে কিছুদিন আগে পর্যন্ত ল্যাটিন ভাষায় বিবাহের শপথ কবিতা ‘নবদো’ পাঠ করতে হত পাত্রকে। কিছু না বুঝে ল্যাটিন ভাষার কাব্য পাঠে নানান অসুবিধার কারণে বাঙালি খ্রিস্টান বিবাহে এই প্রথা বিলুপ্ত হয়েছে। 

     বৌদ্ধ সমাজেও বিয়ের প্রচুর ছড়া ও গান প্রচলিত ছিল। যেমন, বাপের বাড়ি থেকে বিদায় লগ্নে কন্যা গায় —

“ঢোল বাজে আর মাইক বাজে

  আঁর পরাণে ক্যান গররের

  ক্যান গরি আঁই যাইয়ম পরের ঘর।”

     নেপালী সমাজে প্রীতিভোজের সময় ছড়া কেটে বাকযুদ্ধ হয়। কলাপাতার মতো নেপালীদের ভোজনপত্র হলো নাঙলো পাতা। সেই নিয়ে গান হলো —

“নাঙলো জত্রো পাত, 

  কসরী খানছৌ জন্তী।”

     অর্থাৎ কোদাল চালানো খসখসে হাতে বরযাত্রীরা নাঙলো পাতায় কীভাবে খাবে? 

     সাঁওতাল এবং কুড়মি সমাজ প্রকৃতি নির্ভর। সাঁওতাল পরগণায় তিতি নামের পাখিটি জোড়ায় জোড়ায় থাকে। তাদের নিয়ে বরের আশীর্বাদ অনুষ্ঠানে গান উঠে আসে সাঁওতাল বিবাহে। যেমন —

“আরুরে বিহুরে সেহে’লে তিতি দ”

      অর্থাৎ তিতি পাখির মতো হোক নবদম্পতির নবজীবন। কুড়মি সম্প্রদায়ের বিবাহে প্রকৃতি প্রাধান্য পায়। এই সম্প্রদায়ের বিবাহ বিষয়ক প্রবাদটি হলো —

 “ঘর আর বর

  মাঘ ফাল্গুনে কর।”

     কুড়মি কন্যা যখন বাবা মায়ের কাছ থেকে বিদায় নেয় তখন পাত্রপক্ষ এমন একটি গান গায় —

“তর বিটিকে লিয়ে যাচ্ছি বাইজ-বাজনা করে

  থাক লো কইন্যার মা শুধা ঘরটি লয়ে।”

     উত্তরবঙ্গীয় হাজংদের বিয়েতে ‘গীদাল’দের আমন্ত্রণ জানানো হয়। বিয়ের প্রতিটি অনুষ্ঠানকে এরা গীতময় করে তোলে। মেচ সম্প্রদায়ের বিয়েতেও সংগীত এবং নৃত্যানুষ্ঠান প্রধান বৈশিষ্ট্য। কনেপক্ষ বিয়ের আসরে আগত বরের পথ অবরোধ করে গেয়ে ওঠে —

“ফাসা-গহবলি-লাইলুলাই”

     অর্থাৎ গভীর বনের হে নববর, তোমার বিয়ের হাড়িয়া (মদ) নিয়ে এসো। উত্তরবঙ্গীয় ধিমাল জনজাতির বিবাহে বরযাত্রীকে আটকানো হয় এবং গানের প্রশ্নবাণে বরকে বলা হয় —

“রেমকা বেজান কেলাকো মাপিঙ্গেরে…”

     অর্থাৎ আমাদের সুন্দর মেয়েটাকে তোমায় দেবো না। এর পর মদ ও চুরুট বিনিময়ের পরে বরকে বিবাহ বাসরে নিয়ে যাওয়া হয়। 

     কোড়া জনজাতির বিবাহের গান ‘আড়দি দুরাং’ নামে পরিচিত। ‘আড়দি দুরাং’ শব্দের অর্থ বিয়ের গান। লোধা সমাজে কুলবধূর দল জলাশয় থেকে জল ভরে মঙ্গলঘট নিয়ে ফেরার পথে কোকিল পাখির উদ্দেশ্যে গান ধরে। 

“কুইলি, কুইলি, ওগো কুইলি, 

  এ পথে না করিও বাসা গো। 

  এখনি আসিবে বর যাতরি, 

  ভাঙ্গিবে কুইলির বাসা গো।”

     শবর সমাজে গায়ে হলুদের নাম ‘গাঁইডা হুড়িৎ’। হলুদ মেখে স্নান করে আসা ছেলেটি বা মেয়েটিকে তাদের বৌদি আকন্দ ফুলের মালা পড়িয়ে দেন। তখনই সমবেত কণ্ঠে গান শুরু হয় —

“ফুলের মালা পরিস না রে

  যাবেক জাতের কুল।”

     হিন্দি বলয়ে বিবাহ আসরে মেহেদী সংগীত আচারগুলি বর্তমানে প্রায় সব সম্প্রদায়ের বিবাহেই স্থান দখল করেছে। 

     সিনেমা সিরিয়ালে বিবাহের দৃশ্য টি আর পি বাড়ানোর জন্য নির্মাতাদের কাছে যেমন প্রয়োজনীয়, দর্শকদের কাছে তেমনি জনপ্রিয়। 

     বর্তমান সমাজ ব্যবস্থায় যদিও বিবাহ বিচ্ছেদের খতিয়ান অসংখ্য। তবু বিবাহকে ঘিরে মানুষের মনে উৎসাহ ও উদ্দীপনা যুগ যুগ ধরে বিশেষ বার্তা বহন করে চলেছে। দেশ-কাল-সময় নির্বিশেষে বিবাহ অনুষ্ঠান উৎসবের চেহারা নেয়। নৃত্য এবং গীত তার অপরিহার্য অঙ্গ। 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *