সৌমিতা রায় চৌধুরী

শিবকে দেবাদিদেব মহাদেব বলা হয়। আর এই দেবাদিদেবের আরাধনাকে কেন্দ্র করে বহু প্রাচীনকাল থেকে বিভিন্ন উৎসব, লোকগান প্রচলিত আছে। শিবের আরেক নাম গম্ভীর। আর এই গম্ভীর থেকেই এসেছে ‘গম্ভীরা’ উৎসব। 

উপরোক্ত পংক্তি গুলিতে প্রধান চরিত্র শিবকে একটি প্রাকৃতিক সমস্যার (অনাবৃষ্টির) কথা জানানো হয়েছে। গম্ভীরা গানে প্রধান চরিত্রের কাছে একটি সমস্যাকে আখ্যানের আকারে তুলে ধরা হয়। প্রধান চরিত্র শিব সেই সমস্যাকে সমাধানের সাধ্যমত চেষ্টা করেন। এটাই ‘গম্ভীরা’ লোকগানের মূল বৈশিষ্ট্য। এমন একটি গান হলো

        শিব তোমার লীলাখেলা করো অবসান, 

        বুঝি বাঁচে না আর জান। 

        অনাবৃষ্টি কইরা সৃষ্টি

        মাটি করলো নষ্ট হে……… 

মালদহ জেলা ও বাংলাদেশে চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা আধুনিক গম্ভীরা গানের আতুরঘর। দলবদ্ধভাবে ঢোল, তবলা, মন্দিরা সহযোগে গম্ভীরা নৃত্যগীতির পরিবেশনার রীতি প্রচলিত আছে। অঞ্চলভেদে বৈশাখ, জ্যৈষ্ঠ, শ্রাবণ মাসে শিব মূর্তি স্থাপন করে গম্ভীরা নৃত্যগীতী পরিবেশন করা হয়। প্রাচীনকালে এটি সূর্যের উৎসব ছিল বলে অনেকে মনে করেন। 

মালদহে নিম্ন বর্ণের হিন্দু, কোচ, রাজবংশী, পোলিয়া জনজাতি চৈত্র মাসের শেষ চারদিনে এক বিশেষ উৎসবে অংশগ্রহণ করেন। প্রথম দিন ‘ঘট ভরা’ অনুষ্ঠানে মন্ডপে ঘট স্থাপন করে শিব বন্দনার সূচনা পর্ব শুরু হয়। দ্বিতীয় দিনে ‘ছোট তামাসা’ উপলক্ষ্যে শিব পার্বতীর পূজা হয় এবং ঢোল-বাদ্য সহযোগে নৃত্যানুষ্ঠানের ব্যবস্থা থাকে। তৃতীয় দিনে ‘বড় তামাসা’ অনুষ্ঠানে দিনের বেলায় সঙের দল পথ পরিক্রমা করে এবং রাতের বেলায় মুখোশ পরে উদ্যম নৃত্যের মাধ্যমে গম্ভীরার বিশেষ রূপ প্রকাশ পায়। চতুর্থ দিনে ‘আহারা’ উৎসবে শিবের সাথে নীলের পুজো হয় এবং গম্ভীরা গান গাওয়া হয়। এই দিন বিকেলবেলায় সঙ বেরোয়। এই সময় গম্ভীরা লোকনাট্য পরিবেশন করা হয়। 

শিবরূপী অভিনেতাকে মঞ্চে ডেকে অন্যান্য অভিনেতারা সামাজিক বিভিন্ন সমস্যার কথা জানান। সমাধানের পথও বের করা হয় এই মঞ্চেই। এমন একটি গান হলো

        আম লিচু কাঁসা নকসী কাঁথা লাক্ষার

        জেলা চাঁপাইনবাবগঞ্জ

        সেথায় আছে পদ্মা মহানন্দা পূণর্ভবা

        চমচম আলকাপ আর গম্ভীরার মঞ্চ

        সিল্কের শাড়ির দরকার হলে

        পাবে নানা সেথায় গেলে — নানা হে।। 

প্রায় দেড় হাজার বছর পূর্বে তৎকালীন বাংলার রাজধানী গৌড়ে (বর্তমানে মালদহ) গম্ভীরার উদ্ভব। তখন থেকেই আদ্যের গম্ভীরা প্রচলিত লোকসংগীত। বছরে একদিন (চৈত্রের শেষে বা বৈশাখের শুরুতে) শিবকে উদ্দেশ্য করে সারা বছরের সুখ-দুঃখের বর্ণনা দেওয়া হত বা বর্ষ পর্যালোচনা করা হত। এইজন্য এই সময়কাল শিব পূজা বা শিবের গাজন নামেও পরিচিত ছিল। 

মালদহের গম্ভীরার বিশেষত্ব হলো মুখোশের ব্যবহার। নিম ও ডুমুর গাছের অংশ বিশেষ দিয়ে মুখোশ তৈরি করা হয়। কখনো কখনো মুখোশ তৈরি করতে মাটিরও ব্যবহার হয়। গম্ভীরা নৃত্যে নরসিংহের মুখোশ সব থেকে জনপ্রিয়। এছাড়াও চামুণ্ডা, উগ্রচণ্ডা, লক্ষ্মী-সরস্বতী ইত্যাদি মুখোশ ব্যবহৃত হয়। 

গম্ভীরা প্রকৃতপক্ষে দুই ধরনের। দেবদেবীদের সম্বোধন করে মানুষের দুঃখ বেদনার আখ্যান গাওয়া হত। এই রীতিটি প্রাচীনকাল থেকে চলে আসছে। পরবর্তীকালে বর্ণনা মূলক গম্ভীরাতে আর্থ সামাজিক এবং রাজনৈতিক বিষয়বস্তুও উঠে আসে। 

বিশ শতকের শুরুতে গম্ভীরায় বিশেষ পরিবর্তন দেখা যায়। শিব হয়ে ওঠেন বৃটিশ সরকারের প্রতিনিধি। মানুষরূপী একজন শিবকে বৃটিশ সরকারের অত্যাচার, অনাচার ও দুর্নীতির সমালোচনা করে আর্থ সামাজিক এবং রাজনৈতিক পরিস্থিতির কথা জানিয়ে গম্ভীরা শুরু হয়। 

        মজুতদার আর চোরা কারবার

        দেশের মহা ক্যান্সার

        দিনের পর দিন দেশকে তারা

        কইরা দিছে ছারখার — নানা হে  ……. 

পালা গম্ভীরার জনক শেখ সফিউর রহমান (সুফি মাস্টার) তাঁর সময়কালে (১৮৯০-১৯৮০) গম্ভীরা গানের আমূল সংস্কার করেন এবং পালা গম্ভীরার সূচনা করেন। তিনি পালাগান নিমাই সন্ন্যাস, রাধার মনোরঞ্জন ইত্যাদি পালাগান রচনা করেন। তিনি কিশোরীমোহন চৌধুরী বা কিশোরী পণ্ডিতের গম্ভীরা দলে যোগদান করেন। পরে নিজেই গম্ভীরা দল গঠন করেন। বৃটিশ শাসিত ভারতে তিনি প্রচুর বৃটিশ বিরোধী গান রচনা করেন। তাঁর রচিত

        সাহেব ধরি ও লাঙ্গল কলার গাছ হে

        নাচাইছে বেশ ভালুক নাচ হে

তাঁর অমর সৃষ্টি। বৃটিশ সরকার তাঁর রচিত গম্ভীরা গান নিষিদ্ধ করেন এবং তাঁর মাথার মূল্য এক হাজার টাকা ধার্য করে। ১৯১৮ সালে পাবনায় অনুষ্ঠিত বঙ্গীয় সাহিত্য সম্মেলনে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ তাঁকে স্বর্ণ পদক প্রদান করেন। দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন এবং নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর কাছ থেকেও তিনি শুভেচ্ছা পেয়েছিলেন। 

গম্ভীরা গানের উৎপত্তি মালদহ জেলার হিন্দু সমাজে হলেও বঙ্গভঙ্গের কারণে অনেকেই পূর্ববঙ্গের রাজশাহী জেলার চাঁপাইনবাবগঞ্জে চলে আসেন। সুফি মাস্টার সহ মহসিন মোক্তার, কালু মোক্তার, ওয়াজেদ আলী, লুৎফর হক প্রমুখ গম্ভীরা গানের পৃষ্ঠপোষকেরা নবাবগঞ্জে বসতি গড়ে তোলেন। এইসময় থেকেই গম্ভীরা গানের পৃষ্ঠপোষক হয় মুসলিম সমাজ। গান পরিবেশনার ক্ষেত্রেও বৈচিত্র্য আসে। শিবের পরিবর্তে নানা-নাতির প্রচলন মুখ্য ভূমিকা পালন করে। নানা-নাতির মধুর সম্পর্কে রঙ্গরস, কৌতুক, ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ, তিরস্কার, পুরস্কারের মাধ্যমে বিভিন্ন বিষয়ের চর্চা সম্ভব। বিভিন্ন সংলাপের মাধ্যমে গদ্য ও পদ্যময় কথোপকথন চলে ধূসর দাড়িওয়ালা নানা এবং ছেঁড়া গেঞ্জি ও কোমরে গামছা পরিহিত নাতির মধ্যে। যন্ত্রানুষঙ্গে থাকে ঢোল, মন্দিরা, হারমোনিয়াম ও দোতারা। 

অতীতে গম্ভীরা গান হত একতাল, ত্রিতাল, দাদরা ও কাহারবা মাপকাঠিতে। বর্তমানে বিভিন্ন সুর-তালের মিশেলে বিভিন্ন সুর-তাল-ছন্দে গম্ভীরা গান এগিয়ে চলে। 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *