নীলাদ্রি পাল

বঙ্গদেশে দুর্গাপুজো প্রথম কবে শুরু হয়েছিল সেবিষয়ে সঠিকভাবে কিছু জানা যায় না। তবে মার্কণ্ডেয় পুরাণ বা চণ্ডী পুরাণ মতে বলিপুরের (বর্তমানে বীরভূম জেলার বোলপুর শান্তিনিকেতন) রাজা সুরথ প্রথম মহিষাসুরমর্দিনী রূপে দেবী দুর্গার প্রথম পুজো করেন। সপরিবার দুর্গা পূজার প্রথম উল্লেখ পাওয়া যায় ১৪৮০ খ্রিস্টাব্দে রাজসাহী জেলার তাহিরপুরের রাজা কংস নারায়ণের পুজোয়। কলকাতায় ১৬১০ খ্রিস্টাব্দে প্রথম সপরিবার, সবাহন দুর্গা পূজার প্রচলন করেন কলকাতার জমিদার রায় লক্ষ্মীকান্ত গঙ্গোপাধ্যায় মজুমদার চৌধুরী বড়িশাতে আটচালা মন্দির স্থাপন করে। ব্রিটিশ শাসনকালে অনেক ব্যবসায়ী ও জমিদার পরিবার নিজ নিজ বাসগৃহে দুর্গা পূজা শুরু করেন। বিশিষ্ট বাড়ির এই পুজো গুলিই বনেদি বাড়ির পুজো হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। 

বাংলার আনাচে কানাচে অবস্থিত বনেদি বাড়ির দুর্গাপুজো নিয়ে আলোচনা শুরু করেছি গত সংখ্যা থেকে। এইবারে আলোচনা করব হাওড়া জেলার শিবপুর ও আন্দুলের বনেদি বাড়ির দুর্গাপুজো গুলিকে নিয়ে। 

 # শিবপুরের রায়চৌধুরী বাড়ির দুর্গাপুজো #

শিবপুর অঞ্চলের প্রাচীনতম ও জাঁকজমকপূর্ণ বনেদি বাড়ির দুর্গাপুজো হল রায়চৌধুরী পরিবারের পুজো। প্রায় সাড়ে তিনশো বছরের পুরনো এই পুজো। বাস্তব আর কিংবদন্তীর মিশেলে এই বাড়ির পুজোর পত্তন ঘিরে রয়েছে একটি দারুন গল্প। 

জমিদার রাজা রামব্রহ্ম রায়চৌধুরীর এক কন্যা

সন্তান ছিল। বাড়ির সামনের পুকুরে জমিদারের মেয়েটি রোজ পদ্মাবতী নামের একজন সাধারণ মেয়ের সাথে খেলা করত। এই পুকুরটি বালিপুকুর নামে পরিচিত ছিল, যা আজও রয়েছে। খেলার শেষে মেয়ে দু’জন সেই পুকুরে স্নান করত। জমিদার রামব্রহ্ম একদিন পদ্মাবতীর সাথে দেখা করতে চেয়ে মেয়েকে দিয়ে তার কাছে খবর পাঠান। কিন্তু পদ্মাবতী দেখা করতে অস্বীকৃত হয়ে বলে সে যদি মনে করে জমিদারের সাথে দেখা করার প্রয়োজন আছে তবে সে নিজেই জমিদারের কাছে পৌঁছে যাবে। এইকথা শুনে রামব্রহ্ম অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হয়ে পেয়াদা পাঠান পদ্মাবতীকে ধরে আনার জন্য। পেয়াদারা বালি পুকুরে গিয়ে তন্নতন্ন করে খুঁজেও পদ্মাবতীর দেখা পায় না। পুকুরধারে শুধু পায়ের ছাপ ছাড়া আর কারোরই দেখা নেই। অনেক চেষ্টা করেও পদ্মাবতীর দেখা পাওয়া যায় না। 

সেই রাতেই রামব্রহ্ম স্বপ্নে পদ্মাবতীকে দেখেন। স্বপ্নে পদ্মাবতী বলে সে দেবী দুর্গা। জমিদার কন্যার খেলার সাথী হিসেবে রোজ দুপুরে বালি পুকুরে তার সাথে খেলা করে। তাঁর পূজো যেন রায়চৌধুরী বাড়িতে শুরু করা হয়। এই স্বপ্ন দেখার পর জমিদার রামব্রহ্ম তাঁর বাড়িতে দুর্গাপুজো শুরু করেন। ১৬৮৫ খ্রিস্টাব্দ (১০৯২ বঙ্গাব্দ) থেকে শুরু করে আজও রায়চৌধুরী পরিবারে দুর্গাপুজো হয়ে আসছে। এই বাড়ির গৃহদেবী হলেন ব্যাতাইচণ্ডী। 

দুর্গাপুজো শুরু হয়েছিল বাঁশের তৈরি আটচালা দুর্গামণ্ডপে। সেই কারণে রায়চৌধুরী বাড়ির এই পুজো ‘সাঁজের আটচালা’ নামে পরিচিত। তিন চালা ডাকের সাজের দেবী মূর্তি এই পুজোর বিশেষত্ব। দেবীর বোধন শুরু হয় দুর্গাষষ্ঠীর তেরো দিন আগে কৃষ্ণা নবমী তিথি থেকে। 

বেলুড়মঠের পুজো রীতি বৃহন্নন্দীকেশ্বর মত অনুসরণ করে পুজো হয় এই রায়চৌধুরী বাড়িতে। মেটে প্রতিমা সম্পন্ন হওয়ার পরে এলাকার ব্রাহ্মণদের আমন্ত্রণ করা হয় দেবী প্রতিমা দর্শন করে প্রতিমা তৈরিতে কোনো খুঁত আছে কিনা পরীক্ষা করে দেখার জন্য। দেবী মূর্তি নিখুঁত হওয়ার ছাড়পত্র পাওয়ার পরে শুরু হয় চূড়ান্ত পর্বের মূর্তি গড়ার কাজ। 

এই পুজোয় মূর্তির সামনে কোনো ঘট রাখা হয় না। সেই ঘট রাখা হয় বেল গাছের গোড়ায়। এই বেলগাছটি রয়েছে আটচালা সংলগ্ন একটি ঘরে, যার ছাঁদ ফুঁড়ে উঠে গিয়েছে গাছটি। দুর্গাদালানে দেবী মূর্তির পাশাপাশি বেলঘরে প্রতিষ্ঠিত ওই ঘটেও পুজো করা হয় দুর্গাপুজোর দিনগুলিতে। 

বলি প্রথা এখনও চালু আছে এই রায়চৌধুরী বাড়িতে। সপ্তমীর দিন একটি এবং অষ্টমী ও নবমীতে দু’টি করে পাঁঠা বলি দেওয়া হয়। নানানরকম মিষ্টান্ন, ঘরে তৈরি নারকেল নাড়ু ও বিভিন্ন রকমের ফল দেওয়া হয় ভোগে। নবমীর দিন হোমযজ্ঞ সম্পন্ন হলে হাঁড়িকাঠ উঠিয়ে পংক্তিভোজের আয়োজন করা হয়। দশমীর দিন দেবী দুর্গার মূর্তি বিসর্জনের পরে তাঁর মাথার মুকুট গৃহদেবী ব্যাতাইচণ্ডীর মাথায় পরানো এই বাড়ির পুজোর অন্যতম বৈশিষ্ট্য। 

 # আন্দুলের দত্তচৌধুরী পরিবারের দুর্গাপুজো #

আন্দুলের প্রাচীনতম বনেদি বাড়ির পুজোগুলির মধ্যে অন্যতম হল দত্তচৌধুরী পরিবারের দুর্গাপুজো।এই পরিবারের পূর্বপুরুষ দেবদাস (তেকড়ি) দত্ত ২৫২ বিঘা জমির ওপর একটি প্রাসাদ নির্মাণ করেন ও জমিদারির পত্তন করেন চতুর্দশ শতকের শেষ ভাগে। দক্ষিণ রাঢ়ীয় সমাজের বালির দত্ত কুলের দ্বাদশ পুরুষ ছিলেন তেকড়ি দত্ত। মুজঃফরপুর পরগনার অধীনে ছিল আন্দুল সেই সময়ে। তেকড়ি দত্তের প্রভাব প্রতিপত্তি বিচার করে সেই সময়ের স্বাধীন বাংলার সুলতান সেই পরগনার রাজস্ব সংগ্রহকারীর পদে নিযুক্ত করে চতুরঙ্গ প্রদান করেন। সেই চতুরঙ্গ থেকে চৌধুরী শব্দের উৎপত্তি। আন্দুলে এইভাবে দত্তচৌধুরী পরিবারের উত্থান ঘটে। এই চৌধুরীরাই ছিল আন্দুলের আদি রাজা, যে কথা স্বীকার করেছেন স্বয়ং আন্দুলাধিপতি রাজা রাজনারায়ণ রায়। 

রামশরণ দত্ত তাঁর সময়কাল ১৫৪৮-১৬০৬ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে ১৫৬৮ খ্রিস্টাব্দে শুরু করেন দত্তচৌধুরী পরিবারের দুর্গাপুজো। তিনি ছিলেন মুজঃফরপুর পরগনার ‘বড় কুমার’। প্রাসাদের কাছে একটি খড়ের আটচালাতে মহিষাসুরমর্দিনী দেবী দুর্গার পুজো শুরু হয় ঘোড়ার আকৃতি সিংহে সওয়ার হয়ে। সেই সময় বলি প্রথা ছিল। এই বাড়ির দেবী দুর্গার নাম রাজরাজেশ্বরী ঠাকুরাণী। কুলদেবতা রাজরাজেশ্বর নারায়ণের ভগিনী রূপে পূজিত দেবী দুর্গার এইরকম নামকরণ করা হয়েছে দত্তচৌধুরী বাড়িতে। 

পরবর্তীকালে রামশরণের ষষ্ঠ ও কনিষ্ঠ পুত্র কাশীশ্বর দত্তচৌধুরী ১৬২৪ খ্রিস্টাব্দে আন্দুলে তাঁদের পেতৃক জমিদারি পুনরুদ্ধার করেন তৎকালীন মুঘল সম্রাট শাহজাহানের সহযোগিতায়। দাদাদের সঙ্গে নিয়ে কাশীশ্বর একটি নতুন প্রাসাদ নির্মাণ করেন এবং একটি পাকা দুর্গাদালানও নির্মাণ করেন। এরপর থেকে নতুন দুর্গাদালানে শুরু হয় দুর্গাপুজো। দালানের পাশেই রয়েছে কাশীশ্বরাদি নামে চারটি শিবমন্দির। ১৯২৯ খ্রিস্টাব্দে সেই দুর্গাদালানটি ভেঙে পড়ে। পরের বছর সেই জায়গাতেই পাঁচ খিলান ও দুই দালানের একটি নতুন দুর্গাদালান নির্মাণ করা হয়। নবনির্মিত এই দুর্গাদালানেই এখনো দুর্গাপুজো হয়ে আসছে। ঘোড়া রূপে নয়, সিংহের সাধারণ রূপেই এখন দেবী দুর্গার পুজো হয় বৃহন্নন্দীকেশ্বর পুরাণ ও গুপ্তপ্রেস মতানুসারে। 

দেবী দুর্গার বোধন শুরু হয় কৃষ্ণা নবমী তিথিতে আর পুজো শেষ হয় দুর্গা নবমীতে। পুজোর ঠিক তেরো দিন আগে শুরু হয় দেবী চণ্ডীর কল্পারম্ভ ও ঘট স্থাপন। দেবীপক্ষে বাড়ির অবিবাহিতা মেয়েদেরও হাতে শাঁখা পরতে হয়। থাকে না শুধু নোয়া। ভোগে ফল ও বিভিন্ন রকমের মিষ্টির সাথে দেওয়া হয় জিভেগজা। সপ্তমী ও অষ্টমীতে দেওয়া হয় খিচুড়ি ভোগ, নবমীতে পোলাও। পুরনো রীতি মেনে এখনো বাড়ির সদস্যদের মধ্যে প্রসাদ বিতরণের সময় “বাবা, রামশরণের কড়াই ধর” বলার চল আছে। পাঠাবলির চল অনেক বছর আগেই বন্ধ হয়ে গেছে। আগে যখন পাঠাবলি হত, সেই বলির পাঠা খাওয়া পরিবারের সদস্যদের নিষিদ্ধ ছিল। নবমীর দিন এখন আখ, চালকুমড়ো বলি ও চালের পিটুলি দিয়ে মানুষের আকৃতি তৈরি করে শত্রু বলি হয়। কুমারী পুজোতে হয় ব্রাহ্মণ ও অব্রাহ্মণ মেয়ের কুমারী পুজো। ধুনো পোড়ানো, হোম নবমীর দিনই হয়ে থাকে। পুজোর কাজ করে টোলেরা। 

৪৫৭ বছর আগে জমিদার রামশরণ দত্তচৌধুরী সকল প্রজাকে নিয়ে যে দুর্গোৎসব শুরু করেছিলেন, তারই পদাঙ্ক অনুসরণ করে দশমীর সন্ধেয় বাড়ির বৌয়েরা দেবী দুর্গাকে বরণ করে কনকাঞ্জলি দেওয়ার পরে পাড়ার বৌয়েরাও দেবী দুর্গাকে বরণ করেন। বিসর্জনের সময় শোভাযাত্রার সাথে আন্দুল সংলগ্ন জোড়হাট গ্রামের রাজবংশী সম্প্রদায়ের লোকেরা তাদের কাঁধে করে দেবীমূর্তি নিয়ে যায় আন্দুলের দুলে পাড়ায়। দুলেরা ছিল দত্তচৌধুরীদের পালকি বাহক। এই শোভাযাত্রায় দত্তচৌধুরী বাড়ির মেয়ে বৌয়েদের অংশগ্রহণ করার নিয়ম নেই। দুলে পাড়ায় গিয়ে দুলে বৌয়েদের আরেক প্রস্থ বরণের পরে আবার শোভাযাত্রা করে দেবী মূর্তি ফিরিয়ে আনা হয় দত্তচৌধুরীদের পাড়ায়। সরস্বতী নদীর তীরে পরিবারের নিজস্ব ঘাটে আগে প্রতিমা বিসর্জন হত। এখন পরিবারের দালানের কাছে নিজস্ব দেবোত্তর পুকুরে প্রতিমা বিসর্জন দেওয়া হয়। রায়বাহাদুর মাধবচন্দ্র দত্তচৌধুরী এই পুকুরটি খনন করেছিলেন। 

জমিদারির কিছুই আর অবশিষ্ট নেই এখন দত্তচৌধুরীদের। কর্মসূত্রে বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে পড়েছে দত্তচৌধুরী পরিবারের সদস্যরা। আন্দুলে দত্তচৌধুরীদের এখন মাত্র দু’ঘরের বাস। বনবিহারি দত্তচৌধুরী (বুনো চৌধুরী) এবং কিষাণচাঁদ চৌধুরীর পরিবার। দুর্গাপুজো এদের সকলকে একসূত্রে বেঁধে রেখেছে। কলকাতার হাটখোলার দত্ত পরিবার এই চৌধুরীদের এক উল্লেখযোগ্য শাখা। পুজোর সময় বৃহৎ এই বংশের মানুষদের দেখা মেলে আন্দুলের চৌধুরী বাড়িতে। 

প্রতিভাস ম্যাগাজিন | Prativas Magazine

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *