নীলাদ্রি পাল
জনশ্রুতি ও বাস্তবতার মিশেলে
ডায়মন্ড হারবারের চিংড়িখালি দূর্গ
পিকনিক স্পট ও সপ্তাহ শেষের ভ্রমণে বাঙালি বিশেষ করে কলকাতাবাসীর অন্যতম প্রিয় জায়গা হল দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার ডায়মন্ড হারবার। বর্ষার মরসুমে বাঙালিকে হাতছানি দেয় সেখানকার ইলিশ মাছ।
ডায়মন্ড হারবার অঞ্চলটি এক সময় ছিল সুন্দরবনের অন্তর্গত। আগে নাম ছিল হাজীপুর। ১৬০৮ খ্রিস্টাব্দে মুঘল সেনাপতি রাজা মানসিংহ তাঁর গুরু পুত্র সাবর্ণ বংশীয় লক্ষ্মীকান্ত গঙ্গোপাধ্যায়কে হালিশহর থেকে ডায়মন্ড হারবার পর্যন্ত আটটি বিস্তীর্ণ অঞ্চলের জায়গীর দেন মুঘল সম্রাট জাহাঙ্গীরের স্বাক্ষর ও সনদ বলে এবং রায় ও চৌধুরী উপাধিতে ভূষিত করেন।
ইংরেজ আমলে সুন্দরবনে কিছু নতুন বন্দর নির্মাণ করার পরিকল্পনা করা হয়, যার মধ্যে ডায়মন্ড হারবার ছিল অন্যতম। ডায়মন্ড হারবারের পিকনিক স্পটের সামনে রয়েছে একটি ভাঙা দূর্গ। দূর্গটির কয়েকটা ভাঙা দেয়াল বর্তমানে অবশিষ্ট রয়েছে। বাকি সব অংশ নদীর ভাঙনের ফলে নদীগর্ভে বিলীন। দূর্গটির বিশাল আয়তনের প্রমাণ পাওয়া যায় নদীর তীরে বহুদূর পর্যন্ত ছড়িয়ে থাকা ভাঙা কেল্লার ইঁটের ছোট ছোট টুকরোর বিস্তার দেখলে।

জনশ্রুতি অনুযায়ী লুঠের সামগ্রী রাখার জন্য সপ্তদশ শতকে পর্তুগিজ জলদস্যুরা এই দূর্গটি তৈরি করে। ব্রিটিশরা পরবর্তীকালে সারিয়ে নিয়ে এটি ব্যবহার করে। নদীর পাড় ভাঙনের ফলে এই দূর্গটি পরিত্যক্ত হয়। কিছু মানুষ আবার এই দূর্গটি ফরাসিদের তৈরি বলে দাবি করেন।
এর সত্যতা যাচাইয়ের জন্য কিছু ঘটনা প্রবাহের দিকে দৃষ্টি ফেরানো প্রয়োজন। পর্তুগিজ জলদস্যুদের যে ধরনের জীবনযাপন পদ্ধতি ছিল, তাতে তারা লুঠের সামগ্রী রাখার জন্য অত বড় একটা কেল্লা বানিয়ে ফেলবে এবং তৎকালীন মুসলিম শাসক মুঘলরা বিষয়টা মেনে নেবে, এমনটা বিশ্বাস করা বড়োই কঠিন। আবার এদিকে ফরাসিদের বিষয়টাও একেবারেই অসম্ভব।
এই অঞ্চলের এবং দূর্গের বিষয়ে লিখিত তথ্য পাওয়া যায় ১৮১৫ ও ১৯১৪ সালের ইস্ট ইন্ডিয়া গেজেটে। সেখানে বলা হয়েছে ইংরেজদের পণ্যবাহী জাহাজগুলির বোঝাই ও খালাসের কাজ এখানে হত। এছাড়া গেঁওখালি ও আসামগামী স্টিমার গুলি এই বন্দর ছুঁয়ে যেত।

বন্দর তৈরি করার সঙ্গে সঙ্গে ব্রিটিশরা হাজীপুরের নাম বদলে দেয়। সেই অঞ্চলের নাম হয় ডায়মন্ড হারবার। বন্দর হিসেবে এই অঞ্চলের ব্যবহার তখন যথেষ্টই হত। এর থেকে বোঝা যায় কলকাতা বন্দর চালু হওয়ার আগে ডায়মন্ড হারবার বন্দরের খ্যাতি যথেষ্টই ছিল। কলকাতা বন্দরে ঢোকার আগে জাহাজের অপেক্ষা করার জায়গা স্যান্ডহেড এই ডায়মন্ড হারবারেই অবস্থিত।
১৮৫১ খ্রিস্টাব্দে ডায়মন্ড হারবারে ভারতের প্রথম টেলিগ্রাফ স্টেশন স্থাপিত হয়। ডায়মন্ড হারবার বন্দরকে কলকাতার সাথে যুক্ত করেছিল ইস্ট বেঙ্গল স্টেট রেলওয়ে এবং ত্রিশ মাইল দীর্ঘ একটি বাঁধানো রাস্তা। এখানে অনেক সরকারি অফিস গড়ে উঠেছিল। ছিল একটি ছোট কয়েদখানাও।
এর আগে জনশ্রুতিতে ডায়মন্ড হারবারের চিংড়িখালি দূর্গের বিষয়ে আলোচনা করা হয়েছিল। এবার আসা যাক বাস্তবের পথে। ডায়মন্ড হারবার বন্দরের প্রায় এক মাইল দক্ষিণে ১৮৬৮-৬৯ সালে ব্রিটিশরা নির্মাণ করে এই দূর্গ। বারাকপুর থেকে সম্ভবত পাঁচটি কামান এনে এখানে বসানো হয় দূর্গ সুরক্ষিত করার জন্য। এগুলির মধ্যে সম্ভবত দু’টি কামানের ভগ্নাবশেষ পাওয়া যায় ২০১১ সাল নাগাদ।

পর্তুগিজ জলদস্যুদের হাত থেকে বন্দরকে রক্ষা করতে ও সাথে নুনের ব্যবসা করার উদ্দেশ্যে ব্রিটিশরা এই দূর্গ নির্মাণ করে। সেই সময়ে নিমক রাজস্ব বিভাগের প্রধান কার্যালয় ছিল এই দূর্গে। এছাড়াও মক্কা থেকে যে সব তীর্থ যাত্রীরা ফিরতেন, তাদের জন্য পৃথকীকরণ শিবির বা কোয়ারেন্টিন ক্যাম্প ছিল এই দূর্গে।
গত চার দশক ধরে নদীর পাড়ের ভাঙনের ফলে এই দূর্গ ক্রমশ লুপ্ত হয়ে নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যাচ্ছে। প্রতিভাস ম্যাগাজিন