সৌমিতা রায় চৌধুরী

সরস্বতী পুজো দিয়ে যে বসন্ত উৎসবের সূচনা, তার সমাপ্তি ঘটে রং-আবির-পিচকিরির দোল উৎসব পালনের মধ্যে দিয়ে। সরস্বতী পুজো যদি হয় কৈশোরের আনন্দ, দোল তবে যৌবনের উচ্ছ্বাসের বিকাশ। বসন্তকালের সূচনায় মাঘ মাসের পঞ্চমী তিথিতে সরস্বতী পুজো যেমন বিদ্যার দেবীর আরাধনা, দোল উৎসব তেমনই রাধাকৃষ্ণের প্রেম লীলার আরাধনা। 

বৈষ্ণব বিশ্বাস অনুসারে ফাল্গুনী পূর্ণিমার দিন বৃন্দাবনে শ্রীকৃষ্ণ রাধিকা ও অন্যান্য গোপিনীদের সঙ্গে রং খেলায় মেতেছিলেন। সেই থেকেই দোল খেলার উৎপত্তি। রাধাকৃষ্ণের বিগ্রহকে দোলায় চড়িয়ে, আবির উড়িয়ে কীর্তন গান সহযোগে শোভাযাত্রা বের হয়। দেবতাকে আবির নিবেদনের পর ভক্তরা পরস্পর রং খেলায় মেতে ওঠেন। ফাল্গুনী পূর্ণিমার দিন এই উৎসব অনুষ্ঠিত হয় বলে দিনটি দোল পূর্ণিমা নামে পরিচিত। আবার এই তিথিতে চৈতন্য মহাপ্রভুর জন্মতিথি বলে দিনটি গৌর পূর্ণিমা নামেও অনেকের কাছে পরিচিত। 

দোলের আগের দিনের সন্ধ্যায় খড়-কাঠ-বাঁশ সহযোগে মেড়া বেঁধে, সেই মেড়ায় আগুন জ্বালিয়ে এক বহ্নি উৎসবের আয়োজন করা হয়, যা হোলিকা দহন অথবা মেড়া পোড়া, চলতি কথায় নেড়া পোড়া নামে পরিচিত। 

পৌরাণিক কাহিনী অনুসারে দৈত্যরাজ হিরণ্যকশিপু অপরাজেয় থাকার বর পেয়েছিলেন। তাই কোনো দেবতাকেই মানতেন না। হিরণ্যকশিপুর বোন ছিলেন হোলিকা। দুই ভাইবোনই নিষ্ঠুর প্রকৃতির ছিলেন। হিরণ্যকশিপুর পুত্র প্রহ্লাদ ছিলেন বিষ্ণুর ভক্ত। প্রহ্লাদকে শাস্তি দেওয়ার উদ্দেশ্যে হোলিকা প্রহ্লাদকে নিয়ে জ্বলন্ত চিতায় বসেন। আগুন জ্বলে উঠতেই অগ্নিদগ্ধ হন হোলিকা। বিষ্ণু ঘটনাস্থলে এসে উপস্থিত হয়ে দৈত্যরাজ হিরণ্যকশিপুকে হত্যা করে তাঁর ভক্ত প্রহ্লাদকে রক্ষা করেন। ঘটনাটি প্রকৃতপক্ষে অশুভের বিরুদ্ধে শুভের জয়ের প্রতীক। অশুভ শক্তির বিনাশ করে শুভ শক্তির আবাহনের জন্য দোল পূর্ণিমার আগের দিনের সন্ধ্যায় হোলিকা দহন বা নেড়া পোড়া অনুষ্ঠিত হয়। 

হিন্দুধর্মে দোল একটি প্রাচীন উৎসব। ‘নারদ পুরাণ’, ‘ভবিষ্য পুরাণ’ এবং ‘জৈমিনি মীমাংসায়’ রং উৎসবের বিবরণ পাওয়া যায়। সপ্তম শতাব্দীর এক শিলালিপিতে রাজা হর্ষবর্ধন কর্তৃক হোলিকা উৎসব পালনের বিবরণ পাওয়া যায়। হর্ষবর্ধনের নাটক ‘রত্নাবলী’-তে হোলিকা উৎসবের উল্লেখ আছে। ইতিহাসবিদ আল বেরুনীর লেখা থেকে জানা যায় মধ্যযুগে কোনো কোনো অঞ্চলে মুসলিমরাও হোলিকা উৎসবে সামিল হতেন। 

বৈষ্ণব কবি গোবিন্দ দাসের রচনায় দোল পূর্ণিমায় শ্রীকৃষ্ণ রাধিকা ও গোপিনীদের রং খেলার অপূর্ব বিবরণ মেলে। 

“খেলত ফাগু বৃন্দাবন-চান্দ।। 

  ঋতুপতি মন মথ মন মথ ছান্দ। 

  সুন্দরীগণ কর মণ্ডলী মাঝ। 

  রঙ্গিনি প্রেম তরঙ্গিনী সাজ। 

  আগু ফাগু দেই নাগরি-নয়নে। 

  অবসরে নাগর চুম্বয়ে বয়নে।।”

সারা ভারতবর্ষেই বৈষ্ণব সম্প্রদায় অধ্যুষিত রাজ্যগুলিতে দোল উৎসব পালন করা হয়। অবাঙালি রাজ্যগুলিতে এই দোল উৎসব ‘হোলি’ বলে পরিচিত। ঋতুরাজ বসন্তের আগমন প্রকৃতিকে করে তোলে রঙিন। শিমুল, পলাশ সহ নানান বর্ণের ফুলের সমাহারে প্রকৃতি সেজে ওঠে। মানুষের মনে লাগে দোল। 

বাংলায় এই দোল উৎসবের সূচনা হয়েছিল গৌড়বঙ্গে বৈষ্ণব ভাবধারার বিস্তারের মাধ্যমে। বৈষ্ণব ভাবধারার বিশ্বাস অনুযায়ী দোল পূর্ণিমার দিন ভগবান শ্রীকৃষ্ণ আবির ও গুলাল (রং মিশ্রিত জল) নিয়ে শ্রীরাধা ও অন্যান্য গোপিনীদের সঙ্গে রঙের খেলায় মেতেছিলেন। সেই কারণে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ, শ্রীরাধা ও তাঁদের সখী গোপিনীরা এই দোল উৎসবের কেন্দ্রবিন্দু। দোলনায় দোল খাওয়ার সঙ্গে রঙ খেলার উৎসবে মেতে ওঠার মাধ্যমেই এই দোল যাত্রা বা হোলি উৎসবের উৎপত্তি। শ্রীকৃষ্ণের এই লীলাবিলাস কবে শুরু হয়েছিল, সেই বিষয় সঠিকভাবে জানা না গেলেও বিভিন্ন আখ্যান ও পদে সেই কাহিনী বর্ণনা করা হয়েছে। 

হিন্দু পুরাণ অনুসারে প্রায় দু’হাজার বছর আগে উত্তরপ্রদেশের বৃন্দাবনে এই উৎসবের প্রচলন হয়েছিল বলে মনে করা হয়। বেদ, ভবিষ্য পুরাণ ও নারদ পুরাণে এই উৎসবের বর্ণনা রয়েছে। মহাকবি কালিদাসের ঋতুসংহার কাব্যের বসন্ত বর্ণনায় দেখা গিয়েছে যুবতী ও রমণীরা চন্দন, কুসুম রং ও কুমকুম মিশ্রিত রঙে নিজেদের রাঙিয়ে তুলতেন। দক্ষিণ ভারতের বিজয়নগরের হাম্পির মন্দিরের দেয়ালগুলোয় রাজকুমার ও রাজকুমারীর রঙের  উৎসবে মেতে ওঠার দৃশ্য খোদাই করা আছে। 

প্রজাদের মনোরঞ্জনের জন্য ১৬৬০ খ্রিস্টাব্দে কলকাতার জমিদার সাবর্ণ রায় চৌধুরী পরিবারের বিদ্যাধর রায় চৌধুরী লাল দিঘির পাড়ে বর্তমানে রাইটার্স বিল্ডিং যে স্থানে অবস্থিত, সেখানে কলকাতার প্রথম দোতলা কাছাড়ি বাড়িতে ওই পরিবারের শ্যামরাইয়ের মন্দিরে শুরু করেন দোল উৎসব। এটিই কলকাতার প্রথম দোল উৎসব। দোল পূর্ণিমায় নয়, সপ্তম দোলে এই দোল উৎসব পালন করা হত। সাবর্ণ রায় চৌধুরী পরিবারের মহিলারা রং খেলে কাছাড়ি বাড়ির সামনের এই দিঘিতে স্নান করতেন। দোল খেলার রং মিশে সেই দিঘির জলের রং হয়ে উঠত লাল। সেই কারণে এই দিঘির নামকরণ হয় ‘লাল দিঘি’। 

আধুনিক বাংলায় দোল উৎসবের সূচনা করেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। ১৯২০ সালে শান্তিনিকেতনে এই দোল উৎসবের সূচনা হয়। তবে দোল উৎসব নয়, বসন্ত উৎসব নামে শান্তিনিকেতনের এই উৎসব পরিচিতি লাভ করে। দোল পূর্ণিমার দিন এই বসন্ত উৎসব পালন করা হত। বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা আবির খেলার মধ্যে দিয়ে রবীন্দ্রনৃত্য ও গানে এই বসন্ত উৎসবকে শান্তিনিকেতন কার্নিভালের রূপ দিয়েছেন। দেশবিদেশ থেকে দলে দলে মানুষ এসে ভিড় করতেন শান্তিনিকেতনের এই বসন্ত উৎসবে। পশ্চিমবঙ্গ সরকার ও বিশ্বভারতী কর্তৃপক্ষের মধ্যে সমস্যার কারণে এই বসন্ত উৎসব গত কয়েক বছর ধরে বন্ধ হয়ে রয়েছে। 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *