পাঠক মিত্র

ফ্যাসিবাদের ইতিহাসে বিজ্ঞান ও তারপর

বিজ্ঞান অভিশাপ না আশীর্বাদ । এ বিষয়ে পরীক্ষার খাতায় প্রবন্ধ লিখে নম্বর পাওয়া খুবই সহজ । কিন্তু বিষয়টি খুব সহজভাবে বিচার করতে গেলেও কোনো একদিকে তার রায় দেওয়া সম্ভব নয় । সকলের কাছেই তা কিন্তু বোধগম্য । কারণ বিজ্ঞান কেবল অভিশাপ তা কখনোই বলা যায় না । আবার বিজ্ঞানের কেবলই আশীর্বাদ আছে তা বাস্তবের অনেক ঘটনা তেমন বলে না । যে কোনও যুদ্ধ বিজ্ঞানের সমস্ত আশীর্বাদকে একেবারে-যে হেয় প্রতিপন্ন করে তা এখনও কারা বুঝতে পারছে ? এ প্রশ্ন এখন কি একেবারে অবান্তর বলা যায় ? অবান্তর-যে নয় তার প্রমাণ সম্প্রতি রাশিয়া ইউক্রেনের যুদ্ধ । আসলে বিজ্ঞান অভিশাপ না আশীর্বাদ, তা বিজ্ঞানের দিকেই ইঙ্গিত করা যায় কি ? বিজ্ঞান কি আপনা থেকেই মানুষের মঙ্গল করে, নাকি চেষ্টা করে তাকে সে-কাজে লাগাতে হয় ? তাই বিজ্ঞান আপনা থেকেই মানুষের মঙ্গল করে বা অমঙ্গল করে তা কিন্তু নয় । এ প্রশ্নের একপ্রকার উত্তর আশীষ লাহিড়ী’র প্রবন্ধের বই ‘ফ্যাসিবাদ মনুষ্যত্ব বিজ্ঞান’ বলে দেয় ।  বিজ্ঞান অভিশাপ না আশীর্বাদ, বিজ্ঞানীদের ওপরই কিন্তু নির্ভর করে । আর বিজ্ঞানীরাই বিজ্ঞানের দানবিক ও মানবিক এই দুটি মুখকেই ক্রমশ আরো জীবন্ত করে তোলে । বিজ্ঞানের এই দুটি মুখ বিজ্ঞানীদেরও দুটি মুখের পরিচয় দেয় । এই পরিচয়ে একদল বিজ্ঞানী বিজ্ঞানকে দানবিক করে তোলে । অবশ্যই তা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার প্রয়োজনে । আর সেই প্রয়োজনেই অনেক বিজ্ঞানী ভুলেই যান বিজ্ঞানের মানবিক মুখ । এডওয়ার্ড টেলর হলেন এমন এক বিজ্ঞানী যিনি মার্কিন হাইড্রোজেন বোমাসহ ক্ষেপনাস্ত্রের জনক । আশীষ লাহিড়ী’র প্রবন্ধের সংকলনে ‘মানবিক, দানবিক’ প্রবন্ধে যাঁকে বলেছেন ‘ঠান্ডা লড়াইয়ের বিবেকহীন মূর্তি’ । দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ফ্যাসিস্ট শক্তির পরাজয়ের পর ক্ষমতা দেখানোর দৌড়ে রাষ্ট্রে রাষ্ট্রে ঠান্ডা লড়াইয়ে আমেরিকা সবার থেকে এগিয়ে । তখন আমেরিকা বুঝে গিয়েছিল, পরমাণু অস্ত্র হাতে থাকা মানেই দুনিয়ার অধীশ্বর হয়ে ওঠা অসম্ভব নয় । যেখানে মানবজাতির ভালোমন্দের কোনো বিচার থাকে না । এই বিচারধারায় বিজ্ঞানী টেলর তাঁর বৈজ্ঞানিক সমস্ত প্রতিভা আমেরিকা রাষ্ট্রের রণকৌশলে ব্যয় করেছেন । আর রাষ্ট্রীয় প্রশাসন তাঁকে দু’হাত ভরে সহযোগিতা করেছেন । কারণ তাঁর বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি রাষ্ট্রের সামরিক ভাবনাকেই সমৃদ্ধ করেছে । এ সম্পর্কে তাঁর একটি সাক্ষাৎকারের উল্লেখে আরো পরিষ্কার হয় । জীবনের শেষ দিকের এই সাক্ষাৎকারে টেলর বলেছেন,- ‘সত্যি বলতে, আমার খুব বেশি খেদ নেই । কারণ আমি সচেতনভাবে এবং এক নাগাড়ে ল্যাবরেটরিতে একটাই প্রভাব খাটাবার চেষ্টা করে গেছি–সেটা হল, পারমাণবিক অস্ত্রর ভূমিকা, সাধারণভাবে বললে অস্ত্রের ক্ষেত্রে অগ্রসর প্রযুক্তির ভূমিকা যেন একটির বদলে দুটি ল্যাবরেটরিতে নিষ্পন্ন হয় । প্রথমে আমার উদ্দেশ্য ছিল প্রতিযোগিতার জন্ম দেওয়া, যাতে একই জায়গায় সবকটি ভুলের সমাবেশ না ঘটে, আর প্রতিযোগিতা এবং সহযোগিতার মধ্য দিয়ে যাতে ভবিষ্যতের সামরিক প্রয়োগগুলি আরও ভালোভাবে নিয়ন্ত্রিত ও সুষম হয় ।’ সুষমভাবে সামরিক প্রয়োগের কথা সাধারণত রাষ্ট্রের, কিন্তু সেই কথা যখন একজন বিজ্ঞানীর কথা হয়ে যায় তখন বিজ্ঞানের অভিশাপটাই রাষ্ট্রের ক্ষমতা হয়ে ওঠে । তার জন্য বিজ্ঞানী টেলরের কোন অনুশোচনা ছিল না । বরং মানুষ মারার লক্ষ্যে আরও কিছু বাকি রয়ে গিয়েছিল বলেই যেন তাঁর আফসোস ছিল বলে প্রবন্ধকার উল্লেখ করেছেন । টেলরের বিজ্ঞান মানে সামরিক বিজ্ঞান । সামরিক বিজ্ঞান কখনোই মানবিক হতে পারে না তার উদাহরণ অহরহ ঘটছে । প্রবন্ধকার তাই বলেছেন যে বিজ্ঞানীদের মধ্যে সবচেয়ে অমানবিক মুখ হচ্ছে টেলরের ।

টেলরের নামের পাশাপাশি আর এক বিজ্ঞানীর নাম এসে যায়, তিনি হলেন লিও সিলার্ড । দুইজনের নামই পরমাণু বোমা তৈরির ইতিহাসের সঙ্গে জড়িয়ে আছে । টেলর যে অমানবিক মুখের পরিচয় দিয়েছেন, সিলার্ডের কিন্তু সেই পরিচয় নয় । অথচ তিনিই পৃথিবীর প্রথম বিজ্ঞানী যিনি পরমাণু বোমার ব্যাপারে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগেই অবগত হন ।  কিন্তু তাঁর কাছে বিজ্ঞান মানে মানুষের শত্রুদের হারিয়ে দেবার হাতিয়ার, যুদ্ধজয়ের উপকরণ নয় । তবু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শুরুতেই সিলার্ড ফ্যাসিস্ট জার্মানির হাতে পরমাণু বোমা পৌঁছনোর আগেই যাতে আমেরিকা বোমা তৈরি করে, তার জন্য আইনস্টাইনের মুসাবিদা নিয়ে প্রেসিডেন্টের কাছে দরবার করেন আর তাঁকে বোঝান ফ্যাসিস্টদের হাতে এই বোমা তৈরি হলে সভ্যতা বলে কিছু আর থাকবে না । তাই পরমাণু বোমা তৈরির প্রয়োজন এখনই । তারপর মানহাটান প্রকল্প, পরমাণু বোমা আর হিরোশিমা-নাগাশাকির ইতিহাস । যে বিজ্ঞানী জাপানের চীন আক্রমণের প্রতিবাদে জাপানের বিরুদ্ধে বৈজ্ঞানিক বয়কটের কথা বলেন, সেই বিজ্ঞানী পরমাণু বোমা তৈরি করার প্রয়াস করেন  ফ্যাসিস্টদের হাত থেকে সভ্যতাকে বাঁচাতে । কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে তদানীন্তন সোভিয়েতের কাছে জার্মানির আত্মসমর্পণে ফ্যাসিস্টদের পরাজয় হলেও পরমাণু বোমার বিস্ফোরণ ঘটানো হল জাপানে । জার্মানির পরাজয়ের সাথে সাথেই জাপানও একপ্রকার হার স্বীকার করার পথে ছিল । তাই পরমাণু বোমার আর প্রয়োজন নেই বলে সিলার্ডের উদ্যোগে একদল বিজ্ঞানী বোমা-বিরোধী রিপোর্ট পেশ করেছিলেন । মানহাটান প্রকল্প বন্ধ করার প্রস্তাব দিলেন । কিন্তু তাঁর কোনো প্রস্তাব বাস্তবায়িত হল না । আমেরিকার রাজনৈতিক প্রশাসন তখন পরিবর্তন হয়ে গেছে । রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার কদরে পরমাণু বোমার প্রয়োজনীয়তা সেই প্রশাসন ততক্ষনে বুঝে গেছে । তারা বুঝে গেছে যে এই বোমা শুধু ফ্যাসিস্টদের নয় গণতন্ত্রীদেরও পকেটস্থ করতে অনেক সুবিধা করে দেবে ।  সুতরাং পরমাণু বোমা প্রকল্প বন্ধের প্রশ্ন অবান্তর হয়ে পড়ে । তাই পরমাণু বোমা শুধুই ফ্যাসিস্টদের পরাজিত করতে ফাটল না । পরাজিত ফ্যাসিস্টদের উদ্দেশ্যে বাকিদের দিকে ক্ষমতা দেখিয়ে ফাটানো হল বোমা । সিলার্ড বেদনায়, দুঃখে, অপমানে আহত হলেন । তিনি বুঝলেন বিবেক আর মানবিক যুক্তির কোনো মূল্য নেই সাম্রাজ্যবাদী শক্তির কাছে । অবশেষে তিনি নিজেই বিজ্ঞানচর্চার পথ পরিবর্তন করলেন । পদার্থবিদ্যার চর্চা ছেড়ে জীববিজ্ঞান চর্চা শুরু করলেন । শুধু তাই নয় । পরমাণু অস্ত্র-বিরোধী পাগ্ওয়াশ আন্দোলনে যোগ দিলেন । যুদ্ধ নির্মূল করার চেষ্টায় গঠন করলেন ‘কাউন্সিল ফর এ লিভেবল ওয়ার্ল্ড’ । একদা পরমাণু বোমার প্রবক্তা পৃথিবীকে বাসযোগ্য করে তুলতে আপ্রাণ চেষ্টা চালালেন । সেই চেষ্টার মর্ম টেলর বোঝেনি,  আমেরিকা বোঝেনি । পরমাণু বোমা বিস্ফোরণের ভয়ংকর ফলে সিলার্ড মর্মাহত হয়েছিলেন বলেই তিনি পৃথিবীকে বাসযোগ্য করে রাখার কথা প্রাধান্য দিয়েছিলেন । বোমা বানানোর পক্ষে মত দিয়ে আইনস্টাইনও ভুল করেছিলেন বলে স্বীকার করেছিলেন । যাঁরা মানুষের কথা প্রকৃত ভাবেন তাঁরা কোন ভুল করলে ভুল স্বীকার করার মধ্যে তাঁদের কোন ছলনা থাকে না ।  জীবনের শেষ প্রান্তে আইনস্টাইন তাই লেখেন– ‘আমার জীবনের একটা মস্ত ভুল হল প্রেসিডেন্ট রুজভেল্টের কাছে পরমাণু বোমা বানানোর সুপারিশ করে চিঠিখানায় সই করা । তবে তার পিছনে একটা যুক্তি ছিল–জার্মানরা ঐ বোমা বানিয়ে ফেলার বিপদ ।’

আসলে ফ্যাসিস্টদের হাত থেকে সভ্যতা বাঁচাতে ফ্যাসিস্ট-বিরোধী হওয়া কোন ভুল নয় । কিন্তু ফ্যাসিস্ট-বিরোধী শক্তি যখন অমানবিক হয় তখন চেনাটাই ভুল হয়ে যায় । চেনার এই ভুলে কোন বিজ্ঞানী ফ্যাসিস্ট সমর্থক, কোন বিজ্ঞানী ফ্যাসিস্ট -বিরোধী । ইতালির এনরিকো ফের্মি মুসোলিনীর সমর্থক ছিলেন । মুসোলিনীর অ্যাবসিনিয়া আক্রমণ আর ‘জাতি ইশতেহার’-এ ফের্মি প্রচন্ড নিরাপত্তাহীনতায় ভুগতে থাকা অবস্থায় ১৯৩৮ সালে নোবেল পুরস্কার নিতে গিয়ে ১৯৪৯’র আগে আর দেশে ফেরেননি । তিনি মানহাটান প্রকল্পের অন্যতম পরিকল্পক হয়ে উঠেছিলেন । ফ্যাসিস্ট মুসোলিনীর সমর্থক হয়েও তিনি মিত্রশক্তির হাত শক্ত করার প্রকল্পের পরিকল্পক হলেন ।  

ফ্যাসিস্ট শক্তি কি ইতালি কি জার্মানি বিজ্ঞানীদের ওপর ক্ষমতায়নের মাধ্যমে প্রভাব বিস্তার করতে গিয়ে বিজ্ঞানের মূল চর্চাকে ধ্বংস করেছে । যে কথা প্রবন্ধকার জে ডি বার্নালের ‘the social function of science’ বই থেকে তাঁর মন্তব্য তুলে ধরে তা দেখিয়েছেন । জাতি বিদ্বেষে নিজ দেশে ফ্যাসিস্ট শক্তি আরো ভয়ংকর হয়েছে । যেখানে সাধারণ মানুষ থেকে বিজ্ঞানী কেউই রেহাই পায় নি । দেশে একের পর এক বিজ্ঞানী নিরাপত্তাহীনতায় ইতালি, জার্মানি ছেড়েছেন । নিম্নতর যোগ্যদের হাতে সে দেশের বিজ্ঞানচর্চা ক্রমশ পিছিয়েছে । কেবলমাত্র হাইসেনবার্গ নানাভাবে অপমানিত অবহেলিত হওয়ার পরেও জার্মানি ছেড়ে যাননি । তিনি যদিও আমেরিকা সেনাবাহিনীর হাতে বন্দী হন । 

ফ্যাসিস্ট শক্তি ক্ষমতার দম্ভে বিজ্ঞানীদের হারিয়ে বিজ্ঞান চর্চার মূল সুর থেকে যেমন দূরে চলে গেছে, তেমন ফ্যাসিস্ট-বিরোধী শক্তি বিশেষ করে আমেরিকা সেই বিজ্ঞানীদের দিয়ে তাঁর সাম্রাজ্যবাদী শক্তিকে আরো মজবুত করেছে । জার্মানির মত আমেরিকারও মূল উদ্দেশ্য তদানীন্তন সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত রাশিয়ার থেকে নিজেদের শক্তিশালী প্রমাণ করা । প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর সমাজতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা অন্যতন্ত্রের মজ্জায় আঘাত করেছিল । তাই আমেরিকার মত যে কোন রাষ্ট্র বিজ্ঞান ও বিজ্ঞানীদের কদর করেছে তাঁর সামরিক শক্তি বৃদ্ধির সহায়ক হিসেবে । শুধু মানুষের জন্য বিজ্ঞান ও বিজ্ঞানী তাঁদের কাছে গৌণ হয়ে পড়ে । এমনকি পরবর্তীকালে তথাকথিত গণতন্ত্রকামী দেশের কাছেও তাই । তাই বিজ্ঞানী মেঘনাদ সাহা, আব্দুস সালাম এই ভারতে তাঁদের প্রাপ্য মর্যাদা পাননি । বিজ্ঞানীর মর্যাদা তাঁর কাজে । আর সেই কাজ তাঁর রাজনৈতিক পরিচয়কে ছাপিয়ে যায় যদি সে-পরিচয় তাঁর থাকে । তবে ক্ষমতা রাজনীতি এমন বিজ্ঞানীর কদর দিতে এখনো জানে না । তবুও বিজ্ঞানের কোন দেশ নেই, বিজ্ঞানীর কোন দেশ হয় না । এ কথা প্রমাণ করেছেন ডরোথি হজকিন তাঁর জীবন দিয়ে । প্রতিটি বিজ্ঞানীর জীবনচর্চাও তাই হওয়া উচিত। 

তবে রাষ্ট্র এবং পুঁজি বিজ্ঞানকে যেমনভাবে চায় বিজ্ঞানী তেমনভাবে হাঁটতে থাকলে সেই বিজ্ঞান মানুষের-যে মঙ্গল করে না তার প্রমাণ যে-কোন যুদ্ধ ও তার ব্যবসা ও নানাভাবে মুনাফার হাতছানি। আশীষ লাহিড়ী’র তেরোটি প্রবন্ধ সংকলন ‘ফ্যাসিবাদ মনুষ্যত্ব বিজ্ঞান’-এ তার ইঙ্গিত স্পষ্ট । আর এই ইঙ্গিত রাষ্ট্রের বিজ্ঞান-নীতি সম্পর্কে মানুষ সচেতন হতে হয়তো পারবে না । কিন্তু বিজ্ঞান সম্পর্কে সচেতন প্রতিটি মানুষজন ‘বিজ্ঞান শুধু সমাজ ও মানুষের’ এ-কথার প্রসার করতে পারলে বিজ্ঞানচর্চা সঠিক পথ ধরে চলতে পারে ।

ফ্যাসিবাদ   মনুষ্যত্ব   বিজ্ঞান 

আশীষ লাহিড়ী

আপন পাঠ, বেলেঘাটা, কলকাতা–১০

মূল্য–২৮০ টাকা 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *