পাঠক মিত্র

শরদিন্দু সাহা’র এক ব্যতিক্রমী গল্পগ্রন্থ

আজকের চলমান সময়ের পথ যেন ধোঁয়াশাপূর্ণ। এই ঘোলাটে সময়ের পথে সকলে দিশেহারা যেন কোন পথে চলবে । তবু মানুষ খুঁজে মরে তার পরিত্রাণ। পরিত্রাণের পথ চেনাও সহজ নয় এই ঘোলাটে সময়ে । সে পথ অবশ্য সেই সব মানুষদের যাঁরা সংখ্যাগরিষ্ঠ এই সমাজে । তাঁদের পথের সেই ধোঁয়াশায় আলোর রশ্মি যদিও অনুভুত হয়, অথচ সে আলো পথ দেখাতে পারে না । তবু সেই পথেই তাদেরকে চলতে হয় । সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষদের চলার পথে জড়িয়ে থাকে তাদের জীবনের অনুচ্চারিত কত প্রশ্ন, কত কথা । কখনো নিজের কাছে, কিংবা চেনা অচেনা মানুষের কাছে সেই কথা সেই প্রশ্ন কোন উত্তরের আশা না করেই বলতে থাকে । হয়তো সেই কথা বলার স্রোতে তাদের উপলব্ধি ঠিকভাবে তারা ব্যক্ত করতে পারে না । কিংবা তার প্রয়াস থাকে না । তবু কুয়াশা পথে হেঁটে চলাটাই তাদের প্রয়াস । কুয়াশা পথে হেঁটে চলা মানুষের অব্যক্ত কথামালার বিন্যাসে ‘কুয়াশা যখন’ । কথাকার শরদিন্দু সাহার এই গল্পগ্রন্থের চরিত্র সেই সব মানুষদের হদিস দিয়েছে । ‘অসময়ের পাঠাশালা’ গল্পে মতলেব চাচা আর বসন্ত সেই চরিত্রদের একজন। করোনাকালে মোবাইল ফোন আর টিভি তাদের কাছে দুঃসময়ের পাঠশালা হয়ে উঠেছিল । চারিদিকে মৃত্যমিছিলের হাতছানি তারা উপেক্ষা করতে পারেনি । নতুন শব্দে জীবনের অর্থটা ক্রমশ বদলে যাচ্ছে । তারা তা উপলব্ধি করেছে পরবাসে । কেউ আত্মীয় পরিজন নিয়ে কিংবা পরিজন ছেড়ে বেঁচে থাকার ঠিকানা খুঁজতে খুঁজতে অসময়ের পাঠশালায় মোতলেব চাচা ও বসন্ত বেঁচে থাকার আশ হারিয়ে ফেলেছে । যে আশ নিয়ে আলম, আবুল, বসন্ত, মোতলেব চাচা গায়ে গা ঘেঁষে থেকেছে পরবাসে, করোনাকালে তার ব্যতিক্রম হয়নি । অসময়ের পাঠশালার  সাবধানবাণী ‘পারস্পরিক দূরত্ব বজায় রাখা’ মানতে পারেনি তারা । মেনে চলার পরিস্থিতি না থাকলেও তাদের আত্মিক বাঁধন আলগা হয়ে যায়নি । মৃত্যু জেনেও তারা সম্প্রীতিচ্যুত হয়নি ।  কথাকারের শব্দবিন্যাসে এ গল্প যে সম্প্রীতির বার্তা দিয়েছে তা কথাকারের মুন্সিয়ানার ধারাবাহিক পরিচয়কে বহন করে চলেছে ।

‘বাস্ত্তঘুঘু’ গল্পে রবি আর এক চরিত্র, যে সারা জীবন শিক্ষার মানে খুঁজে চলেছে । শিক্ষার সঠিক মানে খুঁজে না পেয়ে জনপ্রতিনিধির কাছেই প্রশ্নটা রাখে । কিন্তু রবির চিন্তার জগতে তাঁরা বিচরণ করতে পারে না । যে শিক্ষা বাঁচার মত বাঁচার পথ খুঁজে দিতে পারে সেই শিক্ষাই তো খুঁজতে চেয়েছে । কিন্তু এ প্রশ্ন নিয়ে সে দিল্লীর সংসদে সাপ খুঁজে চলার বাসনায় এগিয়ে যায় । শিক্ষার সঠিক মানে হারিয়ে যাওয়ার উৎস খুঁজতে কথাকার রবির চরিত্র নিয়ে সংসদে সাপ খোঁজার কাহিনী অনন্যভাবে সৃষ্টি করেছেন। বর্তমান শিক্ষানীতি ও শিক্ষাব্যবস্থার আসল রহস্য সাপ খোঁজার প্রতীকী রহস্যের কাহিনী বিন্যাস কথাকারের নিজস্বতার এক অনন্য শৈলী ।  

সুবিমল ছিয়াত্তর বছর ঘৃণাবোধের ইতিহাস না জানলেও তবুও সে ঘৃণাবোধ তাকে আপন করে নিয়েছে । ঘৃণাবোধে তৈরি হয়ে যায় হয়নার দল । যারা ওত পেতে থাকে রক্তের ঘ্রাণ নিতে । এই পরিবেশের কথায় রক্ত নদী, ঘৃণার সমুদ্র আর বিভাজনের উন্মত্ত আহ্বান জন্ম নেয় । সেই আহ্বানে সুবিমলরা বুঝতে পারে বিষটা

 ঠিক কোথায় । সেই প্রশ্ন নিয়ে তারা বুঝতে পারে পৃথিবীটা পুড়ে যাচ্ছে । তবুও তারা মনে করে শুধু শুধু না মরে বেঁচেই মরতে চায় । ছিয়াত্তর বছর শব্দটির মধ্য দিয়ে কথাকার স্বাধীনতার বয়সকালীন সময় ধরে হায়না দলের রক্ত খিদের কাছে মানুষের এই বেঁচে মরে থাকার গল্প বলার ধরণটাই তো আলাদা মাত্রার ছবি হয়ে ওঠে । কথাকারের এমনতর সৃষ্টি সম্পর্কে  বিশিষ্ট সাহিত্য সমালোচক তপোধীর ভট্টাচার্যের কথায় বলতে হয়–‘বাস্তবের সংগে সংলগ্ন অথচ সমান্তরাল অন্তর্বাস্তবের দ্বিরালাপে মথিত হয়েছে শরদিন্দু সাহার গল্পকৃতি ।’

‘অঘোষিত বার্তার সমীকরণ’ গল্পের মৃন্ময়ী চরিত্র বাস্তব পরিবেশের রাজনৈতিক চরিত্রের প্রতিফলন দেখা যায় । অথচ মৃন্ময়ী রাজনৈতিক চরিত্রে হাজির করেন নি কথাকার । নিজের মত করে মানুষ গড়তে চায় মৃন্ময়ী । সে মানুষ তার হাতের পুতুল হয়ে থাকবে । মানুষ অথচ তার সংবেদনশীলতা বলে কিছু থাকবে না । আজকে অস্থির রাজনৈতিক পরিবেশ এমনটাই চায় । কথাকারের মৃন্ময়ী চরিত্র রাজনৈতিক নয় অথচ সেই পরিবেশের রঙের বর্ণনায় কথাকার শরদিন্দু সাহার তুলি রঙে এক বার্তা হয়ে উঠেছে ।

এ গল্পগ্রন্থের বারোটি গল্পের মধ্যে একটি গল্প ‘মহৌষধির বিপন্নতা’ বাদ দিলে আর সব গল্পের কাহিনী রসে রাজনৈতিক অস্থিরতার রসে নিমজ্জিত মানুষের জীবন ও ভাবনা থাকলেও গল্পগুলি রাজনৈতিক গল্প হয়ে ওঠেনি । এ যেন রক্তের এক অংশ সিরামের মত । তবে ‘বাইরের মানুষ ঘরের মানুষ’ গল্পে রাষ্ট্রীয় রাজনীতির অন্তর্দ্বন্দ্ব মৌমাছির আক্রমণাত্মক চেহারার সাথে অসাধারণ তুলনায় কথাকার যেভাবে তুলে ধরেছেন তা বাংলা সাহিত্যের আঙ্গিকে এক অভিনবত্ব দাবি রাখে । যদিও অরণি চরিত্রের কাছে রাশিয়ার পুতিন ও ইউক্রেনের জেলেনেস্কির দ্বন্দ্বের চরিত্রের যে সংকট প্রত্যক্ষভাবে এসেছে যা তার কাছে মৌমাছির প্রবৃত্তির প্রতিফলন তার বিশ্বচিন্তার পোকার মতই । 

শরদিন্দু সাহার এই গল্পগ্রন্থের গল্পগুলোর নাম বলে দিয়েছে চলমান অস্থির সময়কে । এমনকি গল্পগ্রন্থের নামকরণেও যা স্পষ্ট । এই সময়ের ধোঁয়াশাপূর্ণ যে ঢেউ সাধারণ মানুষের ভাবনায় আসছে, অথচ তা আছড়ে পড়তে পারছে না; কথাকার সাহার গল্পগুলো সেই সম্ভাবনাকে সাহিত্যের আগুনে শব্দের রসে ফুটিয়ে তুলেছে ।  কোন কোন গল্পে না-মানুষের প্রতীকী উদাহরণ সেই সম্ভাবনার প্রতিফলন এমনভাবে উপস্থাপনা করেছেন যা কথাকারের নিজস্ব শৈলীর পরিচয় শুধু বহন করে না, তা কথাকারের দৃষ্টিভঙ্গির স্পষ্ট ইঙ্গিতকেই বহন করে ।

নিছক গল্প বলার জন্য কিংবা জীবন যেমন তেমন দেখানোটা কথাকার কখনোই তিনি চাননি । যার প্রতিফলন থেকে এ গল্পগ্রন্থ ব্যতিক্রম হয়ে ওঠেনি। কথাকার খুঁড়ে খুঁড়ে দেখতে চান অন্তর্জগতের হাল হকিকত। কখনো চিনেছেন, কখনো চিনতে চেয়েও তার কুলকিনারা খুঁজে পান নি। কখনো তাঁর মনে হয়েছে মানুষ যা-বলতে চাইছেন তা আসলে বলছেন না, মানুষ যা-দেখতে চাইছেন তা দেখতে পাচ্ছেন না। তিনি খুঁজে বেড়াতে ভালোবাসেন বিচ্ছুরিত আলোর উৎসস্থল। মানুষের সমস্যাগুলো তাঁর কাছে মনে হয়েছে মানুষেরই তৈরি করা অপূর্ণতার দীর্ঘ সময়চর্চার ফসল, নানা দিক থেকে ছুটে আসে। কোন কৌণিক বিন্দু দিয়ে বিচার্য নয়। স্থানিক বিন্দু শেষ সীমানা টেনে দিতে পারে না। হয়তো জীবনের ভূগোলটাই ইতিহাসকে টেনে নামাতে পারে নিজের মতো। তাঁর গল্পে সমাজ চেতনার জন্ম হয় নিজের মতো করে ভিন্ন ভিন্ন আঙ্গিকে। রাজনৈতিক ভাবনার নির্যাস জীবনকে নিয়ন্ত্রণ করে ঠিকই, মানবিক চেতনাকে অস্বীকার করবে আর জীবন চালিত হবে এমন কল্পনা মানুষের বিড়ম্বনাকেই বাড়িয়ে তোলে। শরদিন্দু সাহার সৃষ্টি সম্পর্কে বিশিষ্ট কথাকার সাধন চট্টোপাধ্যায়ের কথা থেকেই বলতে হয় । তিনি বলছেন, ‘শরদিন্দুর গল্পের বিষয়বস্তু প্রতিদিনকার ঘটে যাওয়া অজস্র চিৎকারে গাঁথা নয় ।..সংবাদপত্র যখনই যে সমস্যা নিয়ে মাতামাতি শুরু করে দেয়, তা দিয়ে গল্প বানানোর লোভ শরদিন্দুর নেই। নিছক ‘টাইম-সারভার’ নন তিনি । বরং শাশ্বত সমস্যাকেই আধুনিক বিশ্লেষণে লেখক বেশি উৎসাহী ।..ব্যষ্টি ও সমষ্টির অদ্ভুত টানাপোড়েনে তাঁর গল্পের প্লট বুনে ওঠে ।’

সত্যিই সময়ের ধোঁয়াশাপূর্ণ পথ মানুষের কাছে যেন আরো শাশ্বত হয়ে উঠছে । এই সময়কে কথাকারের আধুনিক বিশ্লেষণে তাঁর সৃষ্ট ‘কুয়াশা যখন’ গল্পগ্রন্থে যে অদৃশ্য রাস্তার প্রতিবিম্ব দৃশ্যমান, তা অবশ্যই এক সম্ভাবনার সূত্রের বার্তাও বটে । এ বিষয়ে কথাকারের এ গল্পগ্রন্থ অবশ্যই ব্যতিক্রম ।

কুয়াশা যখন-শরদিন্দু সাহা

উড়ান, মালদহ-৭৩২১০১

প্রতিভাস ম্যাগাজিন | Prativas Magazine

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *