পাঠক মিত্র

চেনা ঘেরাটোপের বাইরে উন্মেষিত গল্পমালা

গল্প নিয়ে কল্পকথা, কিংবা কল্প নিয়ে গল্পকথা সম্পর্কে বলতে গেলে আমাদের ছোটবেলায় মা ঠাকুমা দিদিমা র মুখ থেকে শোনা গল্পের কথা মনে পড়ে যায় । সে গল্পের কল্পকথার আকর্ষণ শিশু বয়সের কাছে আলাদা মাত্রা তৈরি করে । আবার অ্যাডভেঞ্চার কিংবা গোয়েন্দা কাহিনী কিশোর বয়সের আকর্ষণ । এই সমস্ত গল্পের কল্পকথা শিশু কিশোর ভাবনায় এমন ছায়া ফেলতে পারে যে সেই ছায়ার আকর্ষণে তাদের রোমাঞ্চভরা গল্পযাত্রায় তারা এগিয়ে চলে । যৌবনের প্রারম্ভ থেকে পরবর্তী কিছু সময় গল্পের নায়ক নায়িকার সম্পর্কের সবুজ আস্তরণে নিজেরা অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে, তখন গল্পের স্বাদ সময়ের বিচারে অত্যন্ত মধুর হয়ে ওঠে । গল্প মানেই সম্পর্কের টানাপোড়েনে মান অভিমান বিরহ দুঃখ কষ্ট সবকিছুর মিশ্রণে তৈরি করা জারক রস পাঠককে মুগ্ধ করে । সম্পর্ক টানাপোড়েনের শব্দ বিন্যাসে পাঠকের মন যাচাই করতে পারে তার বিচার কৌশল । কিন্তু গল্প যখন তথাকথিত নর-নারী’র সম্পর্কের টানাপোড়েনের ঘেরাটোপে আবদ্ধ থাকে না, তখন পাঠকের মন জয় করা সহজ হয়ে ওঠে না । তবে এমন গল্পের পাঠক সাধারণ গল্পপিপাসু পাঠক হতে পারে না । তার মানে গল্প ও পাঠক সম্পর্কে এমন বিভাজন রেখা তৈরি হয়ে যায় যে কোন কোন গল্প সব পাঠকের জন্য নয় । তাহলে গল্প ও পাঠক পরস্পরের পরিপূরক হতে এক একটি শ্রেণী বিভাজনের ঘেরাটোপে হয়তো রুদ্ধ হয়ে যায় ।

নর-নারী’র প্রেম ও ভালবাসার সম্পর্কের টানাপোড়েন নিয়ে গল্পের পটভূমি সাধারণ পাঠকের কাছে আলাদাভাবে এক মানসিক স্বাদ আনতে পারে । কিন্তু এই পটভূমিতে যখন সমাজ ও সংস্কৃতির কাছে নর-নারীর সম্পর্কের অস্তিত্বের সংকট দেখা দেয়, তখন তার স্বাদ অন্য মাত্রা পায় । কিন্তু সমাজ ও সংস্কৃতির প্রেক্ষাপটে যখন শুধু নরনারীর সম্পর্ক নয়, মানুষ হিসেবে তার অস্তিত্বের সংকটে পড়ে তখন গল্প পাঠকের মননকে প্রভাবিত না-করে পারে না । অবশ্যই এই পাঠকগণ মনের স্বাদে কেবল গল্প পাঠ করেন না ।

পাঠকের মননকে প্রভাবিত করার সমস্ত উপকরণ আছে কথাকার রাজেশ ধর-এর গল্পে। তাঁর ‘উন্মেষ গ্রন্থমালা-২’ সেই অস্তিত্ব প্রমাণ করে । কথাকার রাজেশ ধর-এর গল্প রাজনৈতিক সংকট ও পরিবেশ সংকটের গহ্বর থেকে মানুষের অস্তিত্বের সংকটকে তুলে ধরেছে । রাজনীতির সংকটে আদর্শ হারিয়ে যায় । হারিয়ে যায় গণতন্ত্র । গণতন্ত্রের নামে প্রহসন। পরিবর্তে চলে ক্ষমতাতন্ত্রের নিষ্পেষণ খেলা । সেই খেলায় ‘সহদেব লস্কর’-এর মত ‘লেবার ক্লাসের’ মানুষ  হারিয়ে ফেলে তার আত্মপরিচয় । আসলে আত্মপরিচয় ছিনিয়ে নেয় সমাজসেবী নামধারী রাজনৈতিক গুন্ডা । আর তাদের চালনাকারী নেতা নির্লিপ্তের হাসি হাসে । এ ছবি প্রত্যন্ত গ্রামের চেনা ছবি । তার এক টুকরো কাহিনী ‘আমি কে’ গল্পের সহদেব লস্করের আত্মপরিচয়ের সংকট, অস্তিত্বের সংকট। যে সংকটে তার পরিবার তার নয় । মানুষের জীবন সংকটের সমাধানে যে রাজনীতি কাজ করার কথা, সেই রাজনীতি অতি সাধারণ মানুষের জীবনকে সংকটময় করে তুলছে । তারই আঙ্গিকে এই গল্প কথা বলেছে । গল্পের সেই কথায় সহদেব লস্কর নিজেকে নিজেই প্রশ্ন করে ‘আমি কে’ ।

রাজনৈতিক আদর্শের সংকটে আর এক চরিত্র ভুট্টো । যে সংকটে সুবিধাবাদী রাজনীতির খেলায় এই ভূট্টোরা কখনো খেলে আবার এই ভুট্টোকে কেউ খেলায় । পরস্পরের সুবিধাবাদী চরিত্রের পরিপূরক পটভূমি ‘ভুট্টো কি কহানি’ । পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ভুট্টো যাঁর ফাঁসি হয়েছিল, তাঁর নামেই এই ভুট্টোর নাম । দলীয় সুবিধাবাদী রাজনীতির চরিত্র কেবল আঞ্চলিক স্তরে নয়,  রাষ্ট্র রাষ্ট্রের সম্পর্কও আজ সেই সুবিধাবাদের ঊর্ধ্বে নয় । শুধু আকারে হেরফের । সব স্থানেই কথায় কথায় গরীবের কথা, মানুষের কথা, কিন্তু সুবিধার ভাগাভাগি মানুষের জন্য নয় । ‘ভুট্টো কি কহানি’ দেখিয়ে দেয় সেই রাজনীতিকে । 

আর এক রাজনীতির খেলায় ‘জলমুক্তি’ আন্দোলনের নেতা বিষাণ গ্রেফতার হয়ে যায় । সে দামোদর নদীর জলের স্রোত আগের মত যাতে বয়ে যেতে পারে,  সেই দাবি নিয়ে তার আন্দোলন । যাতে বাঁচে চাষী, মাছ ধরে বেঁচে থাকে যারা তাদের জন্য এ আন্দোলন । এ আন্দোলনে মানুষ সাথ দিয়েছে বিষাণের সাথে । ‘জলমুক্তি জিন্দাবাদ’ আওয়াজ তুলেছে তারা । চাষী, জেলে, পরিবেশ রক্ষার জন্য যে লড়াই বিষাণ ও তার সাথীরা লড়ছিল তা কি জনস্বার্থের লড়াই ছিল না । অথচ এক জনস্বার্থ মামলায় বিষাণকে হাজতবাস করতে হল । বিষাণ মুক্তি পেয়েছে । কিন্তু দামোদরের জল মুক্তি পায়নি । বাঁধে স্রোত হারানো নদী কলকারখানার আবর্জনায় ততদিনে কলুষিত হয়ে উঠেছে । নদীর জল বলতে মাত্র কয়েকফুট চওড়ায় বড়জোর হাঁটূজল । নদীর বুকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পাথরের বুকে আঁজলা আঁজলা কালো জল । এই দামোদর বাঁচাতে আবার আন্দোলন, পদযাত্রা । বিষাণ আবার হাঁটতে শুরু করেছে সে যাত্রায় । তার নাতনি যমুনা নদীকে ভালোবাসে । সে নদীর স্রোতে যেতে চায় শেষ পর্যন্ত । মাছেদের সাথে কথা বলতে চায় । নাতনির এই ভালোবাসা তাকে দামোদর বাঁচাতে আবার পথে নামিয়েছে । যে রাজনীতি উন্নয়নের নামে নদীতে বাঁধ দেয়, নদীকে জলবিহীন করে, তার জল নোংরা করে, সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের জীবন বিপন্ন করে, সেই নদীকে বাঁচাতে গেলে বাধা দেয়, আবার সেই রাজনীতি মানুষের নদী বাঁচানোর আন্দোলনকে নিজের করে দেখিয়ে দেয়, ক্ষমতাবলে। এ খেলা বিষাণ বুঝতে পারে নি । উন্নয়ন ও ক্ষমতা রাজনীতির এ খেলার প্রতীকী এই গল্প ‘জলমুক্তি জিন্দাবাদ’ । 

‘আর কতদিন’ গল্পটি তিন দেবীর স্থানান্তরের কাহিনীতে কথাকার সুন্দরভাবে ইঙ্গিত দিয়েছেন মুখোশধারী মানুষের গল্প কিভাবে রাজনীতির ব্যক্তি ক্ষমতার হস্তান্তরে পর্যবসিত হয়ে যায় । পরিবেশ স্বাভাবিকভাবেই বিনষ্ট করে তার এমন কর্মকান্ড চলে যেখানে গ্রাম্য জাগ্রত দেবতাও হার মানতে বাধ্য হয় যা গল্পটিকে অন্য মাত্রা দিয়েছে । ‘কালো জলে রাঙা চিঠি’ গল্পটি গ্রামে ফিরে আসা পরিযায়ী শ্রমিকের গল্প । অদূর শহরের দূষণ গ্রামের জল জমিকে যখন গ্রাস করে নেয়, তখন মানুষকে  কর্মসংস্থানের জন্য অন্যত্র ছুটে যেতে হয় । যাদের হয়ে কথা বলার মুরুব্বি বলে কেউ থাকে না। অসংগঠিতভাবে তাদের কাজ করে যেতে হয় । এই গল্পে বশিরুদ্দি, হাফিজার, সরিফুল দের অসংগঠিতভাবে পাথরের কাজ করতে হয়েছে । প্রথম প্রথম সাংসারিক অবস্থা ফিরলেও পাথরধুলোর আক্রমণে তারা এমনই রোগগ্রস্থ হয়ে পড়েছে যে মৃত্যু হলেও মৃত্যুর সেই কারণ ডাক্তার লেখে না । সরকারি চিকিৎসা অপ্রতুল হলেও তাদের কথা কেউ কান দেয় না । তাই এই রোগে গ্রামে কাউকে যাতে না মরতে হয় তার জন্য সেবাকেন্দ্র গড়ে তোলার লড়াইয়ের গল্প এই ‘কালো জলে রাঙা চিঠি’ । তবে সেই সুবিধাবাদী মানুষের নোংরা রাজনীতি তাদের প্রচেষ্টা সফলতার স্বপ্নকে ধুলিসাৎ করে দেয় ।

আর এক লড়াইয়ের গল্প ‘ফাইটার’ । ‘গোকো’র ভাড়ায় নেওয়া অটোরিক্সা চালিয়ে সংসার বাঁচানোর লড়াই। এ গল্প সম্পর্কে কথাকার সাধন চট্টোপাধ্যায়-এর মন্তব্য উল্লেখ করতে হয় । সুবোধ ঘোষের ‘অযান্ত্রিক’ গল্পের সাথে শ্রী চট্টোপাধ্যায় এই গল্পটিকে তুলনা করেছেন । তিনি আরো বলেছেন,’বর্তমানে গ্লোবালাইজেশনের যুগে, আমাদের অসংগঠিত শ্রমবাজারে, একটি অটো এবং চালক গোকো চরিত্রটির প্রতিনিয়ত জীবন সংগ্রামের যে ছবি রাজেশের কলমে উঠে এসেছে তার প্রেক্ষিত ভিন্ন, ভাষার দ্যোতনা আলাদা, জীবনের ট্রাজেডিও ভিন্ন মাত্রার ।’

শহর শহরতলির গোকোর জীবনের ট্র্যাজেডি আর নদীমাতৃক গ্রামবাংলার মানুষের জীবনের ট্রাজেডি আলাদা হলেও কেবল বেঁচে থাকার ট্রাজেডি তাদের এক । ‘ভাঙন’ গল্পে সুন্দরবনের রায়মঙ্গলের ভাঙনের শব্দ মিশে গেছে প্রকৃতি ও মানুষের জীবনের ভাঙন । ‘ফাইটার’ এবং ‘আমি কে’ গল্পদুটি ছাড়া এ গল্পগ্রন্থের বাদবাকি পাঁচটি গল্পে নদী এসেছে । শহরের আবর্তে নদী কোথাও শুকিয়ে শীর্ণ যা স্রোত হারিয়ে পূতিগন্ধময় আবার ‘ভাঙন’ গল্পে নদীর ভাঙন এগিয়ে মানুষের জীবনের ভাঙন প্রতীকী হয়ে ভাঙতে ভাঙতে পূতিগন্ধময় জীবনযাপন করতে হচ্ছে ।

চেনা ছকের ঘেরাটোপের বাইরে সাতটি আখ্যানের উপস্থাপনায় গল্পগুলো যেভাবে উন্মেষিত হয়েছে, সাহিত্য আকাশে রামধনুর ঈশৎ আভা বিচক্ষণ পাঠকের দৃষ্টিতে অবশ্যই ধরা পড়বে । প্রতিভাস ম্যাগাজিন

উন্মেষ গল্পগ্রন্থমালা-২

— রাজেশ ধর

–আবিষ্কার, কলকাতা-৭০

2 thoughts on “বই আলোচনা

  1. খুব ভালো আলোচনা, পড়ে সমৃদ্ধ হলাম। সমালোচক এবং গল্পকার দুজনকেই শুভেচ্ছা আর অভিনন্দন জানাই।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *