পাঠক মিত্র
রূপসী বাংলার কবি কেবল বাংলার রূপ দেখেননি
কবি ও লেখকের পরিচিতি কখনো তাঁর উপাধিতে আমরা সহজেই তাঁর নাম বলে দিতে পারি । যেমন অমর কথাশিল্পী বললে শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় তা সকলেই জানে এবং চেনে । তবুও প্রশ্ন এসে যায়, তিনি কি শুধুই কথাশিল্পী ? তিনি এই শিল্পের জন্যই কি অমর হয়ে আছেন ? লেখক মাত্রই ত কথাশিল্পী । তাহলে তাঁর শিল্প অন্য সকল লেখকের শিল্প থেকে শ্রেষ্ঠতম বলতে হয় । এ বিষয়ে তর্ক হতে পারে । কিন্তু শরৎচন্দ্র শুধুই কথাশিল্পী হিসেবে অমর তা কি একেবারে বলা যায় ? রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ক্ষেত্রেও কবিগুরু বা বিশ্বকবি পরিচয় কি শেষ কথা হতে পারে ? সকলের উত্তর ‘না’ হবে তা বলা যায় । এভাবে ‘পল্লীকবি’ জসীমউদ্দীন, ‘বিদ্রোহী’ কবি কাজী নজরুল ইসলামের ক্ষেত্রেও বলা যায় তাঁদের এই পরিচয় তাঁদের সামগ্রিক লেখক সত্তার পরিচয় তা কি বলা যায় ? কবি জীবনানন্দ দাশ সম্পর্কেও এমন প্রসঙ্গ সহজেই এসে যায় । কারণ নানা আখ্যানে বা উপাধিতে তাঁর পরিচয় দিয়েছেন কবিগুরু থেকে তাঁর সমসাময়িক সহকবিরা ।
কবি জীবনানন্দ দাশ সম্পর্কে স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘মৃত্যুর আগে’ কবিতাটি পড়ে বলেছিলেন, তিনি ‘চিত্ররূপময় কবি’ । ‘ধূসর পান্ডুলিপি’ পড়ে কবিগুরু উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করে এক চিঠিতে বলেছিলেন, ‘তোমার লেখা পড়ে খুব খুশি হয়েছি । তোমার লেখায় রস আছে, স্বকীয়তা আছে এবং তাকিয়ে দেখার আনন্দ আছে।’ সময়ের সাথে কবি দাশ সম্পর্কে কেউ বলেন ‘প্রকৃতির কবি’, কেউ বলেন ‘সৌন্দর্যের কবি’, কেউ বলেন, ‘নির্জনতার কবি’ বা ‘বিষন্নতার কবি’ । এভাবে তিনি ‘ধূসরতার কবি’, ‘মৃত্যুচেতনার কবি’ সহ নানা নামেও চিহ্নিত হয়েছেন । সব উপাধি তাঁর প্রশংসার এ কথা বলা যায় না । তাঁর সমসাময়িকের অনেকেই তাঁকে কাঁটার মুকুট পরাতে একবিন্দু দ্বিধা করেনি তখন। তবে তাঁর নাম ও ‘রূপসী বাংলা’ সমার্থক বলেই আজ সাধারণ পাঠকের কাছে সবথেকে বেশি পরিচিত । কিন্তু এত নামের সমাহারের পাশাপাশি তিনি ‘ইতিহাস চেতনার কবি’, ‘সমাজ ও সময়চেতনার কবি’, ‘পরাবাস্তববাদী কবি’ থেকে ‘জীবনবোধের কবি’ হিসেবেও চিহ্নিত হয়েছেন । এমনকি অন্নদাশংকর রায় বলেছেন, তিনি হলেন ‘শুদ্ধতম কবি’ । এই কবি কবিতাকে গদ্যের স্পন্দনতায় মুক্ত আঙ্গিকে উত্তীর্ণ করে জীবনবোধকে আলাদাভাবে নাড়িয়ে দিয়েছেন । শব্দের নিস্তব্ধ ঢেউয়ে বিচিত্র চেতনার সময়োত্তর গমনে হয়তো তিনি ‘শুদ্ধতম কবি’ । কাব্যগ্রন্থ এবং কবিতার বিষয়ে শব্দের রঙে কবি নানা পরিচয়ের রঙে ধরা পড়েছেন । বাংলার প্রকৃত মুখ যে কবি দেখেছেন তিনিই গ্রাম বাংলার প্রাকৃতিক রূপ, সংস্কৃতি, ইতিহাসের কাব্যিক রূপের অনন্য ধারায় হয়ে উঠলেন ‘রূপসী বাংলা’র কবি, ‘প্রকৃতির কবি’ । কবি তাঁর এক একটি কাব্যগ্রন্থে নিজেকে ধরা দিলেন এক একটি রূপে । ‘সাতটি তারার তিমির’ গ্রন্থে তাঁর পরিচয় ‘তিমির হননের কবি’ । ‘ধূসর পান্ডুলিপি’ থেকে ‘ধূসরতার কবি’ ‘মৃত্যুচেতনার কবি’ । ‘বনলতা সেন’ বলে দেয় কবি প্রেমের, প্রকৃতির, উপমার । ইতিহাস ও সময়চেতনায় তাঁর ‘মহাপৃথিবী’, ‘বেলা অবেলা কালবেলা’ ।
প্রকৃতির সিঁড়ি ধরে হেঁটে গেছেন যে কবির জীবন চেতনা, সেই সিঁড়ির ধাপে ধাপে প্রেম, ভালবাসা, দুঃখ-কষ্ট-যন্ত্রণাকে ফেলে কখনো মানুষহীন আবার কখনো উদ্ভিদময় হয়ে উঠতে চেয়েছেন তিনি । আবার জীবনে জর্জরিত সময়ে বুনো হাঁস হতে চেয়েছেন । প্রকৃতি চেতনার সংগে জীবন চেতনার এই সহবাসে আমরা পেয়েছি কবি জীবনানন্দর সৃষ্টি । তবুও এ সৃষ্টির শাখাপ্রশাখায় তাঁর আবহমান মৃত্যুচিন্তা আবার গ্রাস করে নেয় কবির জীবনের সব সাহস-সংকল্প-প্রেমকে । এই সন্ধিক্ষণে একে একে কবি দেখেছেন দাঙ্গা, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, দেশবিভাগ । এই ঘটনাগুলো প্রকৃতিচেতনা থেকে কবির ইতিহাসচেতনা ও সমাজচেতনার প্রতিফলনের ছাপও পড়েছে তাঁর সৃষ্টিতে । তখন কবির ভাবনায় এসেছে মানুষ, মানুষের বেদনা । সেই বেদনার স্রোতে বয়ে গেছে মানবত্বের ধারা ।
যুদ্ধ বিধ্বস্ত ও যুদ্ধের কারণে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং মূল্যবোধের অবক্ষয়ে মানুষের জীবনের পরিবর্তনের ছবি ‘বেলা অবেলা কালবেলা’ । কবির চৈতন্যে মনন-প্রতিভার কেলাসন সনাক্ত করে ‘বেলা অবেলা কালবেলা’ । আবার কখনো সময়ের বিপন্নতা তাঁর মুক্ত আবেগ থেকে বিকর্ষিত হয় । ‘আলোপৃথিবী’ কাব্যগ্রন্থের কবিতাগুলিও যুদ্ধোত্তর পর্বে মানবসমাজের সংকটের উপলব্ধির ইতিহাস । ‘আলোকপত্র’ কবিতায়- ‘মানুষের জ্ঞানালোক সীমাহীন শক্তিপরিধির/ভিতরে নিঃসীম;/ক্ষমতায় লালসায় অহেতুক বস্ত্তপুঞ্জে হিম;/ সূর্য নয়–তারা নয়–ধোঁয়ার শরীর ‘ । ‘অনেক মৃত বিপ্লবী স্মরণে’ কবিতার একটি অংশে তা আরো ব্যাপ্ত হয় । ‘সবারই জীবনে আলো প্রয়োজন জেনে/সকলের জন্যে স্পষ্ট পরিমিত সূর্য পেতে গিয়ে/ তবুও বিলোল অন্ধকারে–/তারা আজ পৃথিবীর নিয়মে নীরব ।’ আবার ‘পৃথিবী ও সময়’ কবিতার লাইনে ব্যক্ত করছেন, ‘ভাই-বোন-স্মৃতি-শান্তি হননের ঘোরে উদ্বেলিত/ বহতা নদীর মতো আজও এই পৃথিবীতে চলেছে ।’ এই চলার পথেও কবি মানুষের চেতনাকে সূর্যের চলার পথের দিকে নিয়ে যেতে চেয়েছেন । বলেছেন, ‘অস্তগতিহীন শুভ্র জনহৃদয়ের/ সূর্যনগরীর দিকে যেতে হবে চেতনায় মানুষের সময় চলেছে ।’
‘সুদর্শনা’ গ্রন্থের ‘অনির্বাণ’ কবিতায়–‘পৃথিবীর কাছে আমাদের/সব কথা‐-সব কথা বলা/…যুদ্ধ শান্তি বিরতির নিয়তির ফাঁদে চিরদিন/ বেধে গিয়ে ব্যাহত রণনে/ শব্দের অপরিমেয় অচল বালির—/মরুভূমি সৃষ্টি করে গেছে;’ । এমন পরিস্থিতির মাঝেই ‘পৃথিবী, জীবন, সময়’ কবিতায় আশার আহ্বান করেছেন–‘এসো জাগো হৃদয়, তুমি বিষয় জেনেছিলে,/ গিয়েছিলে অনেক দূরে স্থির বিষয়ের দিকে,/ সে সব আলোয় গ্রহণ করো আরেকরকম ব্যবহারের মানবপৃথিবীকে ।’
মানবসমাজের সংকট ও হতাশা নিয়ে কাব্যগ্রন্থ ‘মহাপৃথিবী’ । ‘মনোকণিকা’ কবিতার কয়েকটি লাইনে সে সংকেত ধরা পড়ে । ‘একটি বিপ্লবী তার সোনা রূপো ভালোবেসেছিল;/একটি বণিক আত্মহত্যা করেছিলেন পরবর্তী জীবনের লোভে;/একটি প্রেমিক তার মহিলাকে ভালোবেসেছিল;/তবুও মহিলা প্রীত হয়েছিল দশজন মূর্খের বিক্ষোভ ।’
প্রকৃতি, প্রেম, হতাশা, ক্লান্তি ও অবসাদ, ইতিহাস ঐতিহ্য এবং সময়কে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে খুঁজেছেন কবি তাঁর ‘বনলতা সেন’ কাব্যগ্রন্থে । ‘বনলতা সেন’, ‘সুচেতনা’, ‘সবিতা’, ‘সুরঞ্জনা’ নারী-নামক কবিতাগুলি শুধু একক নারীর কথা নয় । সমাজ-সংস্কারের বেড়াজালে এই নারীর অস্তিত্ব আজও সমাজ-সভ্যতা ও যুগের প্রতীক হয়ে বেঁচে আছে । কবির কথায়, ‘সুরঞ্জনা, আজও তুমি আমাদের পৃথিবীতে আছো;/পৃথিবীর বয়সিনী তুমি এক মেয়ের মতন;/…গ্রীক হিন্দু ফিনিশিয় নিয়মের রূঢ় আয়োজন/শুনেছ ফেনিল শব্দে তিলোত্তমা নগরীর গাঁয়ে/ কি চেয়েছে ? কি পেয়েছে—গিয়েছে হারায়ে ।’ আবার ‘সবিতা’ য় বলছেন, ‘তোমার মুখের রেখা আজও/ মৃত কত পৌত্তলিক খৃষ্টান সিন্ধুর/ অন্ধকার থেকে এসে নব সূর্যে জাগার মতন/ কত কাছে—কত দূর ।’ ‘আবহমান’ কবিতা মানুষের সংকটের কথা বলে অন্যভাবে । মানুষের লোভের কাছে তার সংকট থাকে অচেনা । ‘পৃথিবীর মহত্তর অভিজ্ঞতা নিজের মনের মুদ্রাদোষে/ নষ্ট হ’য়ে খ’সে যায় চারিদিকে আমিষ তিমিরে;’।…আমাদেরও জীবনের লিপ্ত অভিধানে/ বর্জাইস অক্ষরে লেখা আছে অন্ধকারে দলিলের মানে ।/ সৃষ্টির ভিতরে তবু কিছুই সুদীর্ঘতম নয়–এই জ্ঞানে/লোকসানী বাজারের বাক্সের আতাফল মারীগুটিকার মতো পেকে/ নিজের বীজের তরে জোর ক’রে সূর্যকে নিয়ে আসে ডেকে ।’ বাজার বাক্সের হিসেবের হাতছানিতে ‘যুগে যুগে ক্ষুধা লোভ-লালসার হানাহানি/ অপমৃত্যু অন্ধকার স’য়ে/ মাঝে মাঝে দিগন্তের আজ পূর্ণা মরীচিকা হয়ে/ জলের লেখার মতো বুদবুদে হারাতে শিখেছিল–‘ ।
বেলা অবেলা কালবেলায় আলো পৃথিবী নিয়ে কবির উপলব্ধি আশা-নিরাশার ডানায় ভর করে দেশ-দেশান্তরে বিচরণ করে । ‘আশা-নিরাশার থেকে মানুষের সংগ্রামের জন্মজন্মান্তর/—-উর ময় লন্ডনের আলো ক্রেমলিনে/ না থেমে অভিজ্ঞভাবে চলে যায় প্রিয়তর দেশে ।’ ‘সময় বৃত্তের মতো গোল ভেবে চুরুটের আস্ফোটে জানুহীন, মলিন সমাজ/ সেই দিকে অগ্রসর হয় রোজ–একদিন সেই দেশ পাবে ।’ ‘তোমাকে আমেরিকার কংগ্রেস-ভবনে দেখতে চেয়েছিলাম,/কিংবা ভারতের;/ অথবা ক্রেমলিনে কি বেতসতন্বী সূর্যশিখার কোনো স্থান আছে/ যার মানে পবিত্রতা শান্তি শক্তি শুভ্রতা—সকলের জন্যে !’ কিন্তু ‘যে-সমাজ নেই তবু রয়ে গেছে, সেখানে কায়েমী/ মরুকে নদীর মতো মনে ভেবে অনুপম সাঁকো/ আজীবন প’ড়ে তবু আমাদের প্রাণে/ প্রীতি নেই—প্রেম আসে নাকো ।’ ‘মানবের কথা বিরচিত হয়ে চলে—/সেইসব দূর আতুর ভঙ্গুর সুমেরীয় দিন থেকে আজ/ জেনিভায়,–মস্কো—ইংল্যান্ড–আতলান্তিক চার্টারে,/ ইউ.এন.ওয়ের ক্লান্ত প্রৌঢ়তায়—সতর্কতার,/ চীন–ভারতের–সব শীত পৃথিবীর/ নিরাশ্রয় মানবের আত্মার ধিক্কারে–অন্তর্দানে ।’ এক একটি কবিতার লাইনে লাইনে সামাজিক অবক্ষয়ের সূক্ষ্ম প্রতিবাদ যেমন করেছেন, তেমন আবার স্বাধীন রাষ্ট্রের প্রতি কবির মোহভঙ্গ হয়েছে । তাই তো তিনি আশা-নিরাশা নিয়ে শব্দের স্তরে স্তরে ঘুরেছেন দেশ থেকে দেশান্তরে । রাষ্ট্র স্বাধীন হলেও নিঃসহায় মানুষের বিপন্নতা কমতে দেখেনি । বরং কবি দেখালেন দুর্বলের আশ্রয় আর রাষ্ট্র নয় । মানব গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে প্রলয়ঙ্করী ভূমিকায় রাষ্ট্র হয়ে ওঠে নিরাশ্রয়ের জনক । ‘উত্তরসাময়িকী’ কবিতায় কবি বলছেন, ‘…ভালবাসা চায় না কি মানুষ নিজের/পৃথিবীর মানুষের ?../মনে হয় অনেকেরই—/আত্মসমাহিতিকূট ঘুমায়ে গিয়েছে হৃদয়ের ।/তবু কোনো পথ নেই এখনও অনেক দিন, নেই।/ একটি বিরাট যুদ্ধ শেষ হয়ে নিভে গেছে প্রায় । /আমাদের আধো-চেনা কোনো-এক পুরোনো পৃথিবী । /নেই আর ! আমাদের মনে চোখে প্রচারিত নতুন পৃথিবী/ আসে নি তো ।’ প্রচারিত নতুুন পৃথিবী নিয়ে কবির আশঙ্কা ছিল বলেই কবি বলেন , ‘সেই শূণ্য অন্ধকার দিকের ভিতরে/আমাদের ইতিহাস পিরামিড ভেঙে ফেলে,–/ লন্ডন—ক্রেমলিন গড়ে ।’ এমন পৃথিবীর উত্তরণে কবির উপলব্ধি–‘এই পৃথিবীর মুখ যত বেশি চেনা যায়—চলা যায় সময়ের পথে,/ তত বেশি উত্তরণ সত্য নয়—জানি..।’ রূপসী বাংলা’র কবি শুধু বাংলা’র প্রকৃতির রূপ দেখেননি । তিনি রূপ দেখেছেন মানুষ ও পৃথিবীর সংকটের ।