পাঠক মিত্র
লিটল ম্যাগাজিনের স্রোতে অন্য মাত্রায় ‘প্রবাহ’
আমাদের স্কুলবেলায় দেওয়াল পত্রিকা প্রকাশ করার চল চোখে পড়ার মত ছিল । সুন্দর হস্তাক্ষরে আর্ট পেপারে লেখা পত্রিকা স্কুলের বারান্দায়, ক্লাব ঘরের বারান্দায় কিংবা কারো বৈঠকখানার বারান্দায় এই পত্রিকা প্রকাশিত হত । এক একটি পত্রিকার সদস্যরা একপ্রকার নিস্তব্ধ প্রতিযোগিতা করতো যে পত্রিকার উপস্থাপনা কে কত ভালো করতে পারে । বিষয় ভাবনা কিংবা লেখা নিয়ে একই অঞ্চলের সব পত্রিকার লেখক ও পাঠকদের মধ্যে আকস্মিক আড্ডায় আলোচনা করতে দেখা যেত । এমন পত্রিকায় নিজের কোন লেখা দেখে নিজেকে লেখক লেখক বলে মনে মনে একটা গর্ব তৈরি হত । দেওয়াল পত্রিকায় যাঁরা লেখালেখি করতো তাঁদের সকলের কমবেশি এমনটা যে হত না তা বলা যায় না । তবে এই পত্রিকায় যাঁর প্রথম লেখা যে সংখ্যায় প্রকাশ পেত, তাঁর সে আনন্দের স্বাদই ছিল আলাদা । আমাদের গ্রামবাংলায় সাহিত্য চর্চার প্রথম সোপান এই দেওয়াল পত্রিকা ছিল । তখন গন্ড গ্রামে ছাপা সাহিত্য পত্রিকা তো দূর অস্ত বাংলা দৈনিকের দেখা মিলত না । শহরের সাথে সম্পর্ক যে সব পরিবারের ছিল, যদিও তা অতি নগন্য, তাঁদের ঘরে ছুটির দিন হয়তো দৈনিক কাগজ আসত কখনো সখনো কিংবা কোন মাসিক পত্রিকা । সেটাই হয়তো কয়েক মাস ধরে বিভিন্ন পাঠকের হাতে ঘুরতো । দেওয়াল পত্রিকার সাহিত্য চর্চাই আমাদের মফস্বলের লেখকদের ও পাঠকদের সাহিত্য চর্চার হাতেখড়ি । আমাদের মফস্বলে ছাপা পত্রিকা ছিলই না । ছোটদের পত্রিকা ‘সন্দেশ’ এর সাথে প্রথম পরিচয় ঘটে । তখন তার পরিচিতি নিয়ে আমাদের কোনও মাথাব্যাথাই ছিল না । একটা পত্রিকা হাতে পেলে সবাই সময় করে পড়ার জন্য উসখুস করতো ।
লিটল ম্যাগাজিনের কথার সাথে তখনও পরিচয় হয়নি । স্কুলের গন্ডি পার হয়ে কলেজে পড়ার সময় প্রথম শোনা গেল লিটল ম্যাগাজিন নামক শব্দটি । ছোট পত্রিকা বলে তার নাকি এমন নাম । এই পত্রিকা সাধারণত বই বাজারে বা দোকানে পাওয়া যায় না । বাজারে যে পত্রিকা পাওয়া যায় তা নাকি বাণিজ্যিক পত্রিকা । এভাবে দেওয়াল পত্রিকার পরিচয় থেকে লিটল ম্যাগাজিন ও বাণিজ্যিক পত্রিকা সম্পর্কে একটা ধারনা তৈরি হয়েছে । শহরের পথে পথে যত পা বাড়িয়েছি তখন বিভিন্ন পত্রিকার সাথে পরিচয় হতে লাগলো । তখন লিটল ম্যাগাজিন ও বাণিজ্যিক ম্যাগাজিনের পার্থক্য ধীরে ধীরে বোঝা গেল । বাণিজ্যের স্বার্থে বাণিজ্যিক পত্রিকা এগিয়ে চলে । সেই চলার পথে অনেক কিছুই তাকে এড়িয়ে যেতে হয়, নইলে অনেক অলিখিত চুক্তি ধরে তাকে চলতে হয় । এখানে এজরা পাউন্ডের একটি কথা বলতে হয় । তিনি বলেছেন, কোন পত্রিকা যখন লভ্যাংশের প্রতি মূল্য দেয়, তখন পাঠকদের কাছে গ্রহণযোগ্য নয় এমন জিনিস নিয়ে তারা পরীক্ষায় যেতে রাজি নয়। লিটল ম্যাগাজিন ঠিক এর বিপরীত । কেবল সাহিত্যের স্বার্থ ছাড়া লিটল ম্যাগাজিন আর কিছুই জানে না । সেখানে বাণিজ্য বসতি করে না ।
পশ্চিমবঙ্গ জুড়ে প্রায় ছ’শ বাংলা লিটল ম্যাগাজিন আছে । বাংলা ছাড়া অন্যান্য রাজ্যেও বাংলা ভাষায় এমন পত্রিকা প্রকাশিত হচ্ছে। বিশেষত আসাম ও ত্রিপুরা অগ্রগণ্য, এছাড়া অন্য রাজ্য ছাড়িয়ে দেশের বাইরেও বাংলা ভাষার চর্চার জন্য এই পত্রিকা সাক্ষ্য দিয়ে যায় । অনেক এমন পত্রিকা পরিচিতি লাভে এখন অনেক বড় বলে মান্যতা পেয়েছে । লিটল ম্যাগাজিন নামে হলেও সেই সব পত্রিকা আর লিটল নয় । বাংলা সাহিত্যের দিকপাল লেখকগণের অনেকেই লিটল ম্যাগাজিনের সোপান ধরে আপামর পাঠকের মনে জায়গা করে নিয়েছেন । বাণিজ্যিক পত্রিকার পাশাপাশি এমন পত্রিকায় লেখা প্রকাশিত হলে অনামি লেখকদের একটা আলাদা অনুভূতি অবশ্যই তৈরি হয় । এখনও।
লিটল ম্যাগাজিন প্রকাশ করার পিছনে প্রথম কারণ হল, সাহিত্যের প্রতি নিবেদিত প্রাণ না থাকলে তা হয় না । তারপর তার বিষয় ও বিন্যাস নিয়ে একটা ভাবনা অবশ্যই কাজ করে । সামাজিক সমস্যা, সাহিত্য ও তার সমালোচনামূলক অনুসন্ধানের জন্য নিবেদিত প্রাণ না থাকলে লিটল ম্যাগাজিন বছরের পর বছর প্রকাশিত করা অসম্ভব হয়ে পড়ে । এখন এমন অনেক ম্যাগাজিনই সেই কাজটা সুচারুভাবে করতে পারছে কিনা তা লিটল ম্যাগাজিন গবেষকরা বলবেন । তবে এই বাংলায় শুধু নয়, বাংলার বাইরে যখন বাঙালি ও বাংলা ভাষার অস্তিত্ব নিয়ে একটা সংশয় তৈরি হয়, তখন বাংলা ভাষা ও সাহিত্য চর্চার নিরিখে লিটল ম্যাগাজিন ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ করা বেশ দুঃসহ হয়ে পড়ে । কিন্তু এমনই দুঃসাহসিক পদক্ষেপে বাংলার বাইরে আসামের বরাক উপত্যকা থেকে ‘প্রবাহ’ নামক পত্রিকাটি বিগত আটত্রিশ বছর ধরে নিয়মিত প্রকাশিত হয়ে আসছে ।
আসামের এই ‘প্রবাহ’ পত্রিকাটি একটি বিশেষ ধরণের লিটল ম্যাগাজিন । এটি একটি ব্যতিক্রমী পত্রিকা হিসেবে নিজেদের পরিচয় বহন করে চলেছে । গবেষণাধর্মী লিটল ম্যাগাজিন হিসেবে এর পরিচয় এখন আর শুধু আসামের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই, তা অতিক্রম করে সমস্ত বাংলাভাষীদের কাছে পৌঁছে গেছে । পত্রিকাটি তার চলার পথে এপার বাংলা থেকে অলরেডি দুটি সম্মাননা অর্জন করেছে । যদিও সম্মাননা অর্জন শ্রেষ্ঠত্বের একমাত্র মাপকাঠি নয় । বিষয় ও বিন্যাসকে বাদ রেখে তা কখনোই হতে পারে না । পত্রিকাটির জুন,২০২৪ সংখ্যাটি এমনই এক সংখ্যা যা শুধু নিবিড় সাহিত্য পাঠকদের সমৃদ্ধ করবে না, সাহিত্য-গবেষক ছাত্রদের আলাদাভাবে উৎসাহী করে তুলতে পারবে ।
‘প্রবাহ’ জুন, ২০২৪ সংখ্যাটি আসাম ও পশ্চিমবাংলার বিশিষ্ট কবি ও কথাকারদের সৃজনের ভুবন সম্পর্কে আলোকপাত করেছে । ক্রোড়পত্রে আলোকিত হয়েছে বরাক উপত্যকার গবেষক ও প্রাবন্ধিক তুষারকান্তি নাথ । ক্রোড়পত্রে প্রকাশিত তাঁর প্রবন্ধ তাঁর গবেষণার বিষয়বস্তু সম্পর্কে পাঠকের জানার আগ্রহকে আরো ত্বরান্বিত করবে । তার জন্য তাঁর সামগ্রিক সৃষ্টিকর্ম পাঠকের সামনে তুলে ধরার প্রয়াস প্রয়োজন । যদিও কথামুখে তার উল্লেখ করেছেন সম্পাদক । বরাক উপত্যকার সমাজ জীবন, কৃষ্টি-সংস্কৃতি তুষারকান্তির গবেষণার বিষয় হলেও বাংলা ভাষার সাহিত্য চর্চার আঞ্চলিক ইতিহাসকে প্রতিষ্ঠিত করার প্রয়াসে পুঁথি সাহিত্যের জগতে প্রবেশ করেছেন । ক্রোড়পত্র তার নিদর্শন দিয়েছে । আসলে ভাষা, সাহিত্য, কৃষ্টি-সংস্কৃতি স্রোতধারার মত । সেই স্রোত নানা ভৌগলিক অবস্থানকে স্পর্শ করে তার নিদর্শন তৈরি করে । ‘প্রবাহ’ পত্রিকার এ সংখ্যায় মণিপুর সম্পর্কে তুষারকান্তি নাথের ‘মাতৃকা-উপাসনা: মণিপুরি ঐতিহ্য’, ব্রজকুমার সরকারের ‘মৈতি সমাজ-জীবন ও বৈষ্ণব ধর্ম’, রাখি পুরকায়স্থের ‘বৈশাখি উৎসব-বিবিধের মাঝে মিলনের সুর’ প্রবন্ধগুলি সেদিকেই আলোকপাত করেছে ।
কৃষ্টি-সংস্কৃতি ভৌগলিক স্থান অতিক্রম করে মিলনের সুরে যেমন বাঁধা পড়ে, তেমনই সাহিত্য ভাষা ও স্থানকে অতিক্রম করে মানুষের স্বরের মিলন স্থল হয়ে ওঠে । ‘প্রবাহ’ পত্রিকার এই সংখ্যাটি বাংলা ভাষার সৃজন শিল্পীর ভুবনের মিলনক্ষেত্র হয়ে উঠেছে । আসাম, ত্রিপুরা ও পশ্চিমবাংলার কথাকার ও কবির ভাবনা ও সৃষ্টির আলোকরশ্মি ‘প্রবাহ’ স্রোতে প্রতিফলিত হয়ে আপামর বাংলাভাষী পাঠকদের আলোকিত করেছে । আসামের মিথিলেশ ভট্টাচার্য, রণবীর পুরকায়স্থ, অমিতাভ দেব চৌধুরী, ত্রিপুরার বিমল সিংহ, পশ্চিমবাংলার শরদিন্দু সাহা প্রমুখ ভাষাশিল্পীদের সৃষ্টি সম্পর্কে যেভাবে পাঠকদের সামনে উপস্থাপিত হয়েছে, তা শুধু বাঙালী পাঠক মাত্রই সমৃদ্ধ হবে না, সাহিত্য-গবেষকদেরও সমৃদ্ধ না করে পারবে না । এছাড়াও চিন্ময় গুহ’র ‘এক আকাশ হাইকু’ অনুবাদ গ্রন্থ নিয়ে জাপানী হাইকু কবিতার উপর আলোকপাত ‘প্রবাহ’ পত্রিকার এই সংখ্যায় বাংলা ভাষার স্রোতে বিশ্ব সাহিত্যের মিলনের এই অংশ এক আলাদা মাত্রা দিয়েছে ।
বাংলা ভাষা ও সাহিত্য চর্চার ভুবনে ‘প্রবাহ’ পত্রিকার প্রবাহ এক অন্য মাত্রায় নিরলসভাবে আটত্রিশ বছর ধরে এগিয়ে চলেছে । জুন,২০২৪ সংখ্যাটি তার প্রকৃষ্ট ও অন্যতম উদাহরণ।
প্রবাহ
জুন, ২০২৪
হাইলাকান্দি, আসাম-788163