পাঠক মিত্র

নীরব কাহিনী নীরব রবে না

ইতিহাস আশ্রিত কাহিনী নিয়ে গল্প বা উপন্যাস পাঠকের দরবারে হাজির হলে পাঠক যেমন সমৃদ্ধ হন, তেমন সাহিত্যের শব্দ বিন্যাসে ইতিহাস নিছক কাহিনী হয়ে থাকে না । কিন্তু ইতিহাসের কাহিনী অথচ লোকশ্রুত হয়ে সময়ের স্রোতে বয়ে চলা কাহিনী যা ইতিহাসের পাতায় সেভাবে ধরা থাকে না, সেই লোকশ্রুত কাহিনী যখন কোন ইতিহাস গবেষক সাহিত্যের রসে লিপিবদ্ধ করেন, তখন পাঠকের কাছে সেই কাহিনী নতুন মাত্রা পাবে, এটাই স্বাভাবিক। ‘বিস্মৃত কিছু নীরব কাহিনী’ এই স্বাভাবিকতাকে স্পষ্ট করেছে । লেখক কমল বসাক এই কাহিনীর মধ্যে তাঁর শব্দের জাদুতে লোকশ্রুত চলমান ঐতিহাসিক ও পৌরাণিক কাহিণীকে জীবন্ত করে তুলেছেন । কাহিনীকে জীবন্ত করে তার চরিত্রেরা । ঐতিহাসিক ও পৌরাণিক চরিত্রদের লেখক তাঁর শব্দ মঞ্চে এমনভাবে হাজির করেছেন, পাঠরত অবস্থায় পাঠকের সামনে তার দৃশ্যমান অনুভূতি সৃষ্টি না করে পারে না । 

‘বিস্মৃত কিছু নীরব কাহিনী’ সাতটি কাহিনীর নীরবতা বিস্মৃতির অতলকে যেন ভেঙে দিয়েছেন শব্দের ঝংকারে । বিস্মৃত কাহিনীগুলি শব্দের অলঙ্কারে পাঠককে অবশ্যই মুগ্ধ করবে । লেখকের প্রতিটি গল্প মালদহ ও তার পারিপার্শ্বিক ভূমি স্পর্শ করে আছে । লেখক আঞ্চলিক ইতিহাস গবেষক হিসেবে মালদহের ভূমিপুত্র হিসেবে নিজের পরিচিত প্রতিটি গল্পের বিন্যাসে উপস্থিত করেছেন । তবে তিনি শুধু মালদহের লোকশ্রুত প্রাচীন ইতিহাসের আশ্রয়ে গল্পগুলির কাহিনীর বিস্তার করেননি । তাঁর কয়েকটি গল্পের বিস্তারে প্রাচীন মালদহের সাথে ভারত তথা সুদূর মধ্য প্রাচ্যের একটা মেলবন্ধনের ছবি তুলেছেন।  যদিও কাহিনীর প্রেক্ষাপটে সেই ছবি এসে যায়, তবুও তাঁর শব্দের তুলিতে তা আরো যেন তিনি প্রাণবন্ত করে তুলেছেন । ‘পীর জালালুদ্দীন’ গল্পটির নামাঙ্কিত চরিত্রটি ইরান ইরাকের মাটি অতিক্রম করে মালদহের মাটিকে স্পর্শ করেছে । তাঁর ভবিষ্যদ্বাণী দৈববাণীরূপে পরিণত হওয়ার কাহিনী লোকশ্রুত হতে পারে বলে পাঠকের মনে কখনো উদয় হবে না । পীর জালালুদ্দীন মালদহের মাটি যেন আজও স্পর্শ করে আছে । ‘একটি গজলের জন্মকাহিনী’ গল্পটিও সুদূর ইরানের সংস্কৃতি স্পর্শ করে আছে । বিখ্যাত কবি হাফিজের স্পর্শে বাংলার কাব্যমোদী সুলতানের অতৃপ্ত অসম্পূর্ণ গজলটির প্রকৃত পূর্ণরূপে জন্মলাভ করার কাহিনী । সুলতানের কাব্যপ্রিয়তায় বাংলার সংস্কৃতির সমৃদ্ধ হওয়ার গল্প এক সাহিত্যের ইতিহাসকে সূচিত করে । লোকশ্রুত হয়ে বেঁচে থাকা এই ইতিহাসকে শব্দের গারদে বেঁধে লেখক আগামীদিনে তার অস্তিত্বকে দীর্ঘজীবী করার ব্যবস্থা করেছেন । আবার ‘মধুরেণ সমাপয়েৎ’ গল্পে কাশ্মীরের সাথে গৌড় বঙ্গের সম্পর্ক গড়ে ওঠার কাহিনী আর এক মেলবন্ধনের সাক্ষ্য দেয় । কাশ্মীররাজ জয়াপীড় আর গৌড়রাজ জয়ন্তের সাথে পারিবারিক সম্পর্ক স্থাপনের গল্পটি কেবল পারিবারিক হয়ে ওঠেনি । একদিকে এ দেশের পূর্বের সাথে পশ্চিমের মিলন যেমন ঘটেছে, তেমন যোগ্য বীরের প্রতি মর্যাদা, রাজা রাজার প্রতি মর্যাদা জ্ঞাপনের উচ্চ সংস্কৃতি অক্ষুণ্ন থেকেছে । এই মর্যাদার সংস্কৃতি অবশ্যই ক্ষমতার অহঙ্কারকে খর্ব করে যা এই গল্পে সুন্দরভাবে উপস্থাপিত হয়েছে । 

তাঁর শব্দের তুলিতে পৌরাণিক বা ঐতিহাসিক চরিত্রের বর্ণনা লেখকের মুন্সিয়ানা তাঁর গবেষকের পরিচয়কে অতিক্রম করে যায় । প্রথম গল্প পৌরাণিক কাহিনীর অংশবিশেষ। ‘উপেক্ষিত উপাখ্যান’ গল্পটি অসুররাজ বাণাসুর ও যদুবংশজাত শ্রীকৃষ্ণের নাতির প্রণয় ও পরিণতির গল্প । এই গল্পে বাণাসুরের সদ্য যুবতী কন্যা ঊষা’র বর্ণনায় লেখকের মুন্সিয়ানা অবশ্যই তাঁর শব্দ-শিল্পে । বর্ণনায় বলছেন,’ সবে মাত্র কৈশোর পেরিয়ে যৌবনে পদার্পণ করেছে সে । কিন্তু কী আশ্চর্য! কৈশোরের তুলনায় যৌবনের কি দ্রুত গতি । ইতিমধ্যে যৌবনের উদ্দাম তরঙ্গ তার দেহের প্রতি ভাঁজে ভাঁজে সুপরিস্ফুট । এই সেদিনের কিশোরী আজ যৌবনবতী লাবণ্যময়ী ললনা । কিন্তু চলনের উদ্দাম ভঙ্গি, নয়নের উচ্ছল চাহনি, কানের সহজ আবেদন, হাস্যের সৌন্দর্য্য লহরী-এ সবেরই মধ্যে এখনও প্রকাশ পাচ্ছে কৈশোরসুলভ চঞ্চলতা ও চপলতা ।’ তাঁর এই সহজ ও সাবলীল শব্দ স্রোতের শিল্পে ‘মধুরেণু সমাপেয়ৎ’ গল্পে নৃত্যশিল্পী কমলা’র রূপ ও এঁকেছেন। ‘রূপের জৌলুসে বিভ্রম সৃষ্টি করে চঞ্চল তটিনীর মত নৃত্যরতা সেই নটিনী । সূক্ষ্ম অঙ্গাবরণ ভেদ করে প্রকাশিত তার কমনীয় স্নিগ্ধ কান্তি ।..অধরে তার ভুবন ভোলানো হাসি । তার নিটোল নিতম্ব সঞ্চালনে কামনার ইঙ্গিতে দর্শকবৃন্দের অঙ্গে খেলে যায় এক বিদ্যুত শিহরণ ।’ ‘এক নর্তকীর অভিশাপ’ গল্পে ফৈজী নামক বাঈজী’র বর্ণনায় এক জায়গায় বলছেন, ‘..কামিজের উপর আসমানী রঙের অতিসূক্ষ্ম মসলিনের ওড়না । তার আড়ালে প্রজ্বলিত সেই নারীরূপ যেন আগুনের ফুলকিহার, যেন বেহেস্তের বাগিচার বুলবুল।’ লেখকের এমন শব্দ বিন্যাসে নারী চরিত্রের বর্ণনায় ইতিহাস গবেষকের পাশাপাশি তিনি যে একজন যথার্থ শব্দ-শিল্পী, এই গল্পগুলি তারই পরিচয় ।

‘বিস্মৃত কিছু নীরব কাহিনী’ গল্পগ্রন্থের শেষ গল্পটি ‘এক নর্তকীর অভিশাপ’ । এ গল্পে বাংলার শেষ স্বাধীন নবাবের শেষ পরিণতি সম্পর্কিত এক অজানা কাহিনী । নর্তকী ফৈজী’র প্রেমে সিরাজদ্দৌলা মগ্ন থেকেও তাকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিতেও কুন্ঠাবোধ করেনি । এমনকি প্রাণের আকুতি নিয়ে ফৈজীর কোন আবেদনই সিরাজ গ্রাহ্য করেনি । তাই সিরাজকেও সেই কথাই বলেছে সে, একদিন  প্রাণের আকুতি নিয়ে তোমার দুর্গতি আমার মতই হবে । সিরাজ সেদিন বুঝবে প্রাণের মূল্য । পলাশী যুদ্ধের পর সিরাজের মনে পড়েছিল সে কথা । সিরাজের এই কাহিনী বাঙালি পাঠকের কাছে এক অন্য মাত্রা পাবে, যেহেতু সিরাজের কাহিনী পলাশী যুদ্ধের কাহিনী বাংলার রক্তে মিশ্রিত হয়ে আছে । তাই সিরাজ সম্পর্কে অশ্রুত কোন কাহিনী আজও বাঙালি পাঠকের কাছে আলাদা মর্যাদা পায় । এই গল্পটি বিস্মৃত কাহিনীমালার অন্যতম কাহিনী হিসেবে আপামর বাঙালি পাঠকের হৃদয় স্পর্শ করবে । 

বিস্মৃত নীরব কাহিনীগুলি লেখক কমল বসাক মহাশয়ের গল্পগ্রন্থে যে রব তুলেছে তা বাঙালির হৃদয়ে নীরব রবে থাকবে না । তাঁর শব্দ মঞ্চে শৈল্পিক উপস্থাপনায় বিস্মৃত কাহিনীর বিস্মৃতির নীরবতা একেবারেই ভেঙে গেছে ।

বিস্মৃত কিছু নীরব কাহিনী 

–কমল বসাক

উড়ান, মালদহ–৭৩২১০১

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *