পাঠক মিত্র

গল্প বলার ভঙ্গিমাই গল্পের সম্পদ 

‘আশপাশ চারপাশ’ গল্পের বইটি হাতে আসতেই শুধু এই নামের কারণে বইটির পাতা ওল্টাতে থাকি । পাতা ওল্টাতে ওল্টাতে উনত্রিশটি গল্পই পড়া হয়ে গেল । গল্পগুলো ছোট । গল্প ছোট হলে আগে পড়া শেষ করার তাগিদ থাকে সাধারণত । কিন্তু শ্রীমতী সেনে’র গল্পগুলোর সম্পর্কে সে কথা কখনোই বলা যায় না । এক একটি কাহিনীর চলনে একটার পর একটা গল্পে পাঠক নিজেই শেষ প্রান্তে পৌঁছে যাবেন । গল্পকারের সার্থকতা এখানেই । গল্পগুলো একেবারে অনুগল্পও নয়, কিন্তু পাঁচটি গল্প বাদ দিলে চব্বিশটি গল্প অনুগল্পের থেকে আকারে একটু বড়ই । তবে বেশিরভাগ গল্প গল্পকার দীপ্তি সেন তাঁর চলার পথ থেকে সংগ্রহ করেছেন । এত সহজ ভাষার বিন্যাস যে পাঠক প্রতিটি গল্পে একটা চেনা-স্বাদ চেনা-স্পর্শ পাবেন। পাঠ প্রক্রিয়ায় তা সহজেই অনুভূত হয়। তাঁর গল্প বলার ভঙ্গিমা পাঠককে অবশ্যই আটকে রাখবে । জীবনের হাসি, মজা, আনন্দ থেকে জীবনের ছোট ছোট দুঃখ-কষ্ট তুলে ধরেছেন লেখিকা । চলার পথের ঘটনা লেখকদের উপাদান হলেও এই গল্পকার এমন দুটি গল্প বলেছেন যা বিজ্ঞানের আবিষ্কার নিয়ে গল্পের কথায় হাজির করেছেন যার একটি হল ‘স্বপ্ন সার্থক’ যেখানে তাঁর ভাবনা যেন সহজ সমাধান চেয়েছে আগেই বিজ্ঞানের পথ ধরে । যদি তা একেবারেই কল্পিত বিজ্ঞান নয় । আর একটি গল্প ‘ভবিষ্যত সুন্দর’ একটি চিঠির আকারে । এই চিঠির গল্প বিজ্ঞানের ভাবনায় জারিত করে লেখিকা পাঠকের ভাবনাকে যুক্তি বিজ্ঞানের কষ্টিপাথরে হাজির করেছে । একটা ছোট্ট চিঠি বিজ্ঞানের গল্পে পরিণত করা অবশ্যই লেখিকার মুন্সিয়ানা। আরো একটি গল্প চিঠি লেখার মধ্যেই তুলে ধরেছেন লেখিকা । একটা চিঠি যখন গল্প হয়ে ওঠে তখন গল্পকার তাঁর প্রশংসার দাবি রাখে । 

এই বইয়ের প্রথম গল্প ‘রবির ভক্ত’ এমন মজার করে তুলেছেন গল্পকার যা পাঠককে বেশ আনন্দ দেবে । এই গল্পে রবীন্দ্রনাথের গানের কলিতে কর্মরতা বউয়ের বিরহে স্বামীর রোমান্টিকতা আলাদা মজা থাকলেও সময়কে অল্প চাবুক মেরেছেন গল্পকার । নারীর ব্যক্তিত্বে বিশেষত স্বামী-স্ত্রী র ক্ষেত্রে যখন পুরুষ নিজেকে হারিয়ে ফেলে, তখন সংসারের চিরাচরিত পরিবেশে একটা বৈষম্য দেখা দেয় । তা যেন পুরুষতান্ত্রিক সংসারকে উপহাস করে ।  এই গল্পে লেখিকা রসের মাধ্যমে সংসারের সেই  চিত্রটি দেখাতে চেয়েছেন ।  । আরেক মজার গল্প ‘পাল্টে গেছে সিস্টেম’ । যেখানে পাত্রের বাড়িতে পাত্রী দেখতে যাবে । এটা একটা নতুন ভাবনা যা পাঠককে এক সুন্দর মজা দেবে । মজার রসে লেখিকা চলমান পুরুষতান্ত্রিক সমাজভাবনা র বিপরীত ছবি এঁকে দেখালেন, পুরুষদের জন্য যা ভাবা হয় নারীর ক্ষেত্রে তা কেন নয় । তথাকথিত নারীবাদী বলতে যা বোঝায় লেখিকা তার মধ্য দিয়ে না গিয়ে কেবল সামাজিক অবস্থানকে প্রশ্নে তুলে ধরেছেন । এছাড়াও ‘হাঃ হিঃ’, ‘হাসো গো’ ও আরো অনেক গল্পই বেশ মজার । এছাড়া ‘সমাজের শত্রু’ গল্পটিতে ধূমপানের অপকারিতাকে তুলে ধরেছেন লেখিকা যা উপদেশমূলক বা শপথ নেওয়ার গল্প হতে পারে । অন্য ভাবনায় এ গল্পটিকে সমাজস্বাস্থ্য বিষয়ক বা পরিবেশ বিষয়ক গল্প বলা যেতে পারে । দুটি গল্পের নাম একই যা ইংরেজিতে লেখা । গল্প দুটির নাম ‘Report’ । গল্পদুটির নাম লেখিকা কেন এরকম রাখলেন, তা বোঝা গেল না । তবে প্রতিটি গল্প ক্রমিক সংখ্যা অনুসারে লেখিকা রেখেছেন । কুড়ি নম্বর গল্পটি ‘পৃথিবী যা দেখছ’ একই ক্লাসের ছাত্রছাত্রীদের মায়েদের তাঁদের ছেলেমেয়েদের নিয়ে প্রেস্টিজের প্রতিযোগিতায় সন্তানদের ওপর একটা খারাপ প্রভাব কেমন করে পড়ে তা দেখাতে গিয়ে এক ছাত্রের হাতে আরেক ছাত্রকে ছুরিকাহত হতে দেখিয়েছেন । এই গল্পের শেষটা যেভাবে করেছেন তা শিশু ও কিশোর মনে নেগেটিভ প্রভাব পড়ার সম্ভবনা থেকে যায় । গল্পটা অন্যভাবে শেষ করলে ভালো হত । আর শেষ গল্পটি ‘সত্যি ঘটনা’ । একটি বৈষ্ণব পরিবারের সংস্কারযুক্ত শ্বশুর-শাশুড়ি বেড়াতে যাওয়ার সময় বাড়ির দেখাশোনার জন্য আনোয়ার নামের মুসলমানের ওপর ছেড়ে রেখে যেতে আপত্তি করেননি যা তাঁরই ছেলে ও ছেলেবউ প্রথমে ভাবতেই পারেনি । এ গল্পটি এক সামাজিক ঐক্যের বার্তা দেয় । লেখিকা দীপ্তি সেন তাঁর চলার পথে মণিমাণিক্য নিয়ে নয়, নুড়ি পাথরে গল্পের ছোট্ট এই প্রাসাদ গড়ে তুলেছেন । গল্পকার দীপ্তি সেনের এই প্রাসাদে পাঠক একটু হলেও বেশ তৃপ্তি পাবেন ।        

আশপাশ চারপাশ

-দীপ্তি সেন

-সেন প্রকাশনী, কলকাতা- ৮

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *