পাঠক মিত্র
‘ঘরে বাইরে’ পুনঃপাঠে আজ
‘ঘরে বাইরে’ উপন্যাসটি সকল সাহিত্যপ্রেমী মানুষজন মাত্রই জানেন না বা পাঠ করেননি তা কখনোই হতে পারে না। আবার এই উপন্যাসটি ১৯৮৪ সালে চলচ্চিত্রায়নের মাধ্যমে সিনেমাপ্রেমীদের কাছেও পৌঁছে দিয়েছেন বিশিষ্ট চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায় । যদিও সত্যজিৎ রায়ের ছবিটির আলোচনা করার জন্য এ লেখা নয় ।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের এই উপন্যাসটি একটি রাজনৈতিক উপন্যাস হিসেবে বিবেচিত হয় । রাজনৈতিক উপন্যাস হলেও নারী ও পুরুষ কিংবা স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কের টানাপোড়েনে তথাকথিত সমাজের প্রেক্ষিতে এক ভিন্ন সুরের প্রকাশ ঘটেছে এই কাহিনীতে । নিখিলেশ বিমলাকে কেবল স্ত্রীর অধিকারে কিংবা স্বামীর অধিকারে পেতে চায়নি । মুক্ত মনের আকাশে নক্ষত্রের ভিড়ে ধ্রুবতারার অস্তিত্বকে যেন বোঝা বা চেনা যায়। সেই বোঝা বা চেনার প্রসঙ্গ চর্চার সঙ্গী হয়ে উঠুক বিমলা এমন ভাবেই নিখিলেশের চাওয়া-পাওয়া । আর একদিকে নিখিলেশের বন্ধু সন্দীপ তার একেবারেই বিপরীত । তার কাছে নারী মানেই সে পুরুষত্বের দাবির কাছে বশ্যতা স্বীকার করাই নারীর ধর্ম । সন্দীপ তাই অনায়াসে বলতে পারে, ‘আমরা পুরুষ কেবল আমাদের দাবির জোরে মেয়েদের আজ উদঘাটিত করে দিয়েছি । কেবলই আমাদের কাছে আপনাকে দিতে দিতে তারা ক্রমে ক্রমে আপনাকে বড়ো করে বেশি করে পেয়েছে । তারা তাদের সমস্ত সুখের হীরে এবং দুঃখের মুক্তো আমাদের রাজকোষে জমা করে দিতে গিয়েই তবে তার সন্ধান পেয়েছে । এমনি করে পুরুষের পক্ষে নেওয়াই হচ্ছে যথার্থ দান, মেয়েদের পক্ষে দেওয়াই হচ্ছে যথার্থ লাভ ।’ সন্দীপ তার কথার জাদুতে শুধু নারীকে নয় সে যে কোন মানুষকে বশ করতে পারে । সেই বশ করতে পারার নেশায় রাজনৈতিক জীবন ও ব্যক্তিগত জীবনকে সত্যের পথে সম্পৃক্ত করার বাসনা তার চরিত্রে ছিল না । রাজনীতির আড়ালে ব্যক্তিগত প্রয়োজন, লোভ, লালসা, কামনা ও অস্তিত্বের প্রক্ষেপণে কাহিনীর বিস্তারে একশো আট বছর আগে সন্দীপের মত রাজনৈতিক চরিত্র এঁকে কবিগুরু দেখিয়েছেন স্বাধীনতা আন্দোলনের আকাশে এক সিঁদুরে মেঘ । যেহেতু কাহিনীর প্রেক্ষাপট বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন । রচনকাল ১৯১৬ সাল । প্রথম বিশ্বযুদ্ধ চলছে তখন । মানুষের সংকটে যখন মানুষই দায়ী নয় । সত্য বানিয়ে তোলার পলিটিক্সের রান্নাঘরে আগুন জ্বলছে । ‘মানুষের মধ্যেই ভগবানের সত্যকার প্রকাশ, তেমনি দেশের মধ্যে’ সন্দীপের এ কথার প্রেক্ষিতে নিখিলেশ ব্যক্ত করে, ‘তাহলে এক মানুষের সঙ্গে অন্য মানুষের সঙ্গে এবং এক দেশের সঙ্গে অন্য দেশের ভেদ নেই ।’ এই ভেদ বানিয়ে তোলাই তো আজ সত্য বানিয়ে তোলা ।
একশো আট বছর আগে যে উপন্যাস রচিত হয়েছে তার পুনঃপাঠে এই সময়ের প্রাসঙ্গিকতা কিই বা আছে ? এ প্রশ্ন অত্যন্ত স্বাভাবিক । রবীন্দ্রনাথের গান মানুষের কাছে সঞ্জীবনী সুধা । কিন্তু তাঁর উপন্যাসে আজকের সময়ের সাথে প্রাসঙ্গিকতা খুঁজতে গেলে অনেকের কাছে হয়তো হাস্যকর হতে পারে । যেহেতু রবীন্দ্রনাথের সময় আর এখনকার সময়ের ব্যবধান বহু যোজন দূর । রবীন্দ্রনাথের সময়ে রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট আর এখনকার প্রেক্ষাপট এক নয় । এটা ঠিক যে কবিগুরুর সময়ে এ দেশের রাজনীতি স্বাধীনতা আন্দোলনের পথের সূচনা হয়েছে । স্বাধীনতা পরবর্তী আজকের রাজনীতি পুরোপুরি তার থেকে একেবারেই যে আলাদা তা বলাই বাহুল্য । সময়ের বিচারে রাজনীতির এই পৃথকীকরণ করা অত্যন্ত সহজ । সময়ের এই বিচারে থাকা সত্ত্বেও কিন্তু সন্দীপের চরিত্রটি যেন আজও অচেনা নয় । একশো আট বছর পূর্বে রচিত উপন্যাসে সন্দীপের মত চরিত্র এই সময়েও রাজনীতির মাঠে হেঁটে চলে ।
সন্দীপের মত রাজনৈতিক চরিত্রের কাছে সত্য সম্পর্কে যেভাবে বিবেচিত বলে কাহিনীর বিন্যাসে কবিগুরু প্রকাশ করেছিলেন, সে কি শুধু সেই সময়ের রাজনীতি ও নেতৃত্বের প্রতি তাঁর কাল্পনিক প্রতিফলন ? যদি তাই হয় তাহলে তাঁর কল্পনা আজকের রাজনীতির আকাশে কালো মেঘ হয়ে শুধু ভেসে বেড়াচ্ছে না, তা যেন বৃষ্টি হয়ে বাস্তবের মাটি ভাসিয়ে দিতে চাইছে । সন্দীপ আইডিয়ার জাদুকর । যা মিথ্যার রসায়নে সৃষ্টি তার জাদু । সন্দীপের চরিত্র যেন রাজনীতির আকাশকে আজও ঢেকে ফেলতে চাইছে ।
কাহিনীর বিন্যাসে সন্দীপের কথোপকথনের অংশে যদি আলোকপাত করা যায়, তাহলে তার চরিত্র আজ শুধু কাল্পনিক, এ কথা বলাটা খুব সহজ হবে এ কথা মনে করা যায় না ।
সন্দীপের কথায়, ‘ …পৃথিবীতে যারা সৃষ্টি করতে এসেছে তারা সত্যকে মানে না, তারা সত্যকে বানায় ।’ সত্য বানিয়ে ফেলার কর্মকান্ড আজ আর গল্প নয় । চারিদিকে চোখ খুলে রাখলে তা ধরা পড়ে না এমন নয় । কিন্তু সত্যের মধ্যে রয়েছে শাসকের লোহার শিকল । এ কথা কাহিনীর সময়কে উপস্থাপন করলেও চলমান সময়ের উপস্থাপনায় নেই সে কথা কি জোর দিয়ে বলা যায় ? সন্দীপের কথাটার মধ্যে যেন ক্ষমতা রাজনীতির পাঠ । সে বলছে, ‘..যারা শাসন করবে তারা মিথ্যাকে ডরায় না, যারা শাসন মানবে তাদের জন্যেই সত্যের লোহার শিকল ।…পৃথিবীর বড়ো বড়ো রান্নাঘরে যেখানে রাষ্ট্রযজ্ঞে পলিটিক্সের খিচুড়ি তৈরি হচ্ছে সেখানে মসলাগুলো সব মিথ্যে ?’ এই মিথ্যে দিয়েই সন্দীপের কাছে যেনতেনভাবে ফললাভ করাটাই লক্ষ্য, সত্যের ফললাভ নয় । তার কাছে সারকথা, ‘…এই ধর্মনীতিকেই সার জেনেছি যে, সত্য মানুষের লক্ষ্য নয়, লক্ষ্য ফললাভ ।..সেই ফসল মিথ্যার আবাদের ফলে ।..আর যা সত্য, যা আপনি জন্মায়, সে হচ্ছে আগাছা, কাঁটাগাছ; তার থেকেই যারা ফলের আশা করে তারা কীটপতঙ্গের দল ।’ এই দলকে কেবল নয় সকল মানুষকে মিথ্যা পলিটিক্সের খিচুড়ি জোর করে খাওয়ার আয়োজনটাই টিকে থাকার সত্যে যেন গড়ে উঠছে । সন্দীপ তাই জোর গলায় তার পলিটিক্স বলতে পারে, ‘…তোমাদের টুঁটি চেপে ধরে খিচুড়ি গেলাবে । বঙ্গবিভাগ করবে, বলবে তোমাদের সুবিধের জন্যেই; শিক্ষার দরজা এঁটে বন্ধ করতে থাকবে, বলবে তোমাদেরই আদর্শ অত্যুচ্চ করে তোলবার সদভিপ্রায়ে; তোমরা সাধু হয়ে অশ্রুপাত করতে থাকবে, আর আমরা অসাধু হয়ে মিথ্যের দুর্গ শক্ত করে বানাব । তোমাদের অশ্রু টিকবে না, কিন্তু আমাদের দুর্গ টিকবে ।’ মানুষের লক্ষ্য বলে সন্দীপের দৃষ্টিতে যা ধরা পড়েছে তাকে উন্নত করার লক্ষ্য নিয়ে তার শিক্ষার চর্চা নয় । কেবল মিথ্যের দুর্গ টিকিয়ে রাখার শিক্ষা গ্রহণ করার গুরুদের কথাই সন্দীপ স্বীকার করে, ‘…চোখের পাতায় দেখছি বাইরের জিনিসকে স্তূপাকার করে তোলাই মানুষের চরম লক্ষ্য । আর সেই লক্ষ্যকে যারা বড়োরকম করে সাধন করছে তারা ব্যবসার বিজ্ঞাপনে প্রতিদিন বড়ো অক্ষরে মিথ্যা কথা বলে, তার রাষ্ট্রনীতির সদর-খাতায় খুব মোটা কলমে জাল হিসাব লেখে, তাদের খবরের কাগজ মিথ্যার বোঝাই জাহাজ, আর মাছি যেমন ক’রে সান্নিপাতিক জ্বরের বীজ বহন করে তাদের ধর্মপ্রচারকেরা তেমনই করে মিথ্যাকে ছড়িয়ে ছড়িয়ে বেড়ায় । আমি তাদেরই শিষ্য–‘ ।
এই শিক্ষায় সাম্প্রদায়িক বিভেদ বাড়িয়ে দেওয়াই যার কাজ । সেই বিভেদ থেকে যখন বিরোধ জোর কদমে এগিয়ে আসে তখন সন্দীপ নিজের অহং অস্তিত্বকে সেই বিরোধের আগুন থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখে । শুধু মুখে তার স্বদেশপ্রেমের ভড়ং । তার এই ভড়ংয়ের অংশীদারী হয়ে যায় নিখিলেশের প্রতিবেশী জমিদারেরা । কিন্তু তার বন্ধু নিখিলেশ জমিদার হয়েও স্বদেশ প্রেমে সন্দীপের থেকে অনেক ঊর্ধ্বে, অথচ নেতা নন । সাম্প্রদায়িক বিরোধের আগুন নেভাতে সেই সচেষ্ট হয় । সন্দীপের মত কথার জাদুর দেশপ্রেম নয় নিখিলেশের । নিখিলেশ জমিদার, অথচ তার জীবনদর্শনে মানুষের প্রতি দেশের প্রতি ভালবাসা সন্দীপের মত নেতার থেকে অনেক উচ্চ পর্যায়ের । নিজের গৃহে সন্দীপকে আশ্রয় দিলেও সে সন্দীপের পথের সহযাত্রী নয় । এমনকি সন্দীপের উপস্থিতি নিজের পরিবারের সংকট ক্রমবর্ধমান দেখেও স্থির থেকেছেন । সন্দীপকে তার আশ্রয় ত্যাগ করতে একবারও বলেন নি । কিন্তু সন্দীপের রাজনীতির পথ যখন সামাজিক পরিবেশে সংকট ঘনীভূত করে চলেছে, তখন নিখিলেশের আশ্রয় সন্দীপের ত্যাগ করাই শ্রেয় বলতে একমূহুর্ত দ্বিধা করেনি। তবু নিখিলেশের শিক্ষা সন্দীপের কাছে বইয়ের পাতার শিক্ষা ছাড়া আর কিছু নয় ।
সন্দীপের শিক্ষা তার জীবনচর্চার ফসল । সেই চর্চায় নেতার আমীরি স্বভাবকে প্রকাশিত করেছে । যার কাছে দারিদ্রতা কেবল আত্মঘাত । প্রণয়ের সুযোগ নিয়ে বিমলাকে দেশের নামে মোহাচ্ছন্ন করে নিখিলেশের বৈভব থেকে টাকা আদায়ের কৌশল সেই শিক্ষার প্রতিফলন । তার স্বগোক্তি, ‘ আমি জীবনে অন্তত একবার পঞ্চাশ হাজার টাকা হাতে নিয়ে নিজের আরামে এবং দেশের প্রয়োজনে দু দিনে সেটা উড়িয়ে দিতে চাই। আমি আমীর, আমার এই গরীবের ছদ্মবেশটা দু দিনের জন্যেও ঘুচিয়ে একবার আয়নায় আপনাকে দেখে নিই, এই আমার শখ আছে ।’ সন্দীপের মত দেশসেবক সম্পর্কে তারই শিষ্য অমূল্যের মনে সে ধারণা তৈরি করে দিয়েছে, দেশসেবকদের সেবার জন্যেও টাকার দরকার । তাই অমূল্যের মত শিষ্যরা বলতে পারে, ‘তারাই (সন্দীপ) যে আমাদের রাজা, দারিদ্র্যে তাদের শক্তিক্ষয় হয় । তাই সে বলে, সন্দীপবাবুকে ফার্স্ট ক্লাস ছাড়া অন্য গাড়িতে কখনো চড়তে দিই নে । রাজভোগে তিনি কখনো লেশমাত্র সংকুচিত হন না । তাঁর এই মর্যাদা তাঁকে রাখতে হয় তাঁর নিজের জন্যে নয়, আমাদের সকলের জন্যে । সন্দীপবাবু বলেন, সংসারে যারা ঈশ্বর ঐশ্বর্যের সম্মোহনই হচ্ছে তাদের সব চেয়ে বড়ো অস্ত্র । দারিদ্র্যব্রত গ্রহণ করা তাদের পক্ষে দুঃখগ্রহণ করা নয়, সে হচ্ছে আত্মঘাত ।’
‘ঘরে বাইরে’ কাহিনীর এই সন্দীপের চরিত্র আজকের সময়ে ঘরে বাইরে সত্যি কি চোখে পড়ে না ? তার কথাগুলো রাজনীতির আকাশে ক্রমশ সত্যি হয়ে উঠছে কি ? এ প্রশ্নের উত্তরে উভয় সংকট দেখা দিতে পারে । কিন্তু সংকট যাদের চোখে পড়ে না, তাদের কাছে রবীন্দ্রনাথের চর্চা তো দূরের কথা তাদের কাছে রবীন্দ্রনাথ কেবল নাম ছাড়া আর কিছু নয় । আর যাদের চোখে পড়ে তাদের কাছে রবীন্দ্রনাথের নাম শুধু নয় তাঁর চর্চার প্রয়োজনীয়তা প্রতি মুহুর্তে অনুভূত হবে । এই অনুভবে একটি প্রশ্ন না এসে পারে না, রাজনীতির আকাশে রবীন্দ্রনাথের দেখা মেঘ একশো বছর পরেও না কেটে গেলে আমরা কিভাবে এগিয়ে চলেছি ? এই প্রশ্নের উত্তরে বলা যায়, রবীন্দ্রনাথকে শুধু গানে গানে ছাড়া আমরা তাঁর চর্চা সত্যি করতে পারিনি । তাহলে এ প্রশ্ন ভাবাচ্ছে কি– ‘অন্যায় যে করে আর অন্যায় যে সহে তব ঘৃণা তারে তৃণসম দহে’ কথাটি আমাদের জীবনচর্চায় প্রতিনিয়ত প্রতিফলিত হচ্ছে কি ? জীবনে অনুভবে রবীন্দ্রনাথের প্রাসঙ্গিকতার কথা কেবল কথার কথাই থেকে যায় । আর সন্দীপের মত চরিত্রের কালো মেঘে ঢেকে যায় রাজনীতির আকাশ ।