পাঠক মিত্র
প্রথম আলোর দ্যুতি রামমোহন রায়
‘মহান মানুষ’ কথাটি উত্থাপিত হলে নানাভাবে তার উত্তর হতে পারে । বিভিন্ন জনের কাছে তাঁদের ক্ষেত্র অনুসারে তার উত্তর হতে পারে । যেমন রাজনীতির মানুষ একরকম বলতে পারেন । সাহিত্যের মানুষ একরকম বলতে পারেন। আবার একেবারে সাধারণ মানুষ আরেকরকম বলতে পারেন । কিন্তু ‘মনীষী’ শব্দের উত্থাপনে কি নানাভাবে উত্তর হতে পারে ? এমন প্রশ্নের উত্তরে সীমাবদ্ধতা ছাড়াই একটি কথা মনে রাখতে হবে ‘মহান মানুষ’ বা ‘মনীষী’ তিনি, যিনি কোন ব্যক্তিগত, দলগত, গোষ্ঠীগত স্বার্থের ঊর্ধ্বে মানুষকে, সমাজকে, দেশকে পথ দেখান । তাঁর চিন্তাভাবনা, কর্ম তাঁর সময় থেকে তিনি অনেকটাই এগিয়ে যেতে পারেন, এগিয়ে গিয়ে মানুষ ও সমাজের জন্য কাজ করতে পারেন । কিন্ত সেই কাজ কখনোই মসৃণভাবে তাঁরা সম্পন্ন করতে পারেন বা পেরেছেন এমন নয় । প্রতিটি পদক্ষেপে বাধার সম্মুখীন যেমন হতে হয় তেমন কখনো কখনো তাঁদের পথ বিপদসঙ্কুল হয়ে ওঠে । বিপদসঙ্কুল অবস্থা তাঁর আশেপাশে থাকা মানুষজনের কাছ থেকেই শুরু হয় । তবু তাঁরা সত্যের পথ থেকে বিচ্যুত হন না । এ দেশের ভূখন্ডে এমনই এক মানুষ জন্মেছিলেন আড়াইশো বছর আগে যিনি এ দেশের মানুষের জন্য প্রথম আলোকবর্তিকা হয়ে জ্বলে উঠেছিলেন । কুসংস্কারগ্রস্থ সমাজের অন্ধকারাচ্ছন পাহাড়ে আলোর সুড়ঙ্গ প্রথমে তিনিই তৈরি করে দিয়েছিলন । সেই আলোর সুড়ঙ্গ ধরে উনবিংশ শতাব্দীর শুরুতে সূচনা হল এক নতুন যুগের । শত শত বছরের অন্ধকার যুগের বন্ধ জানালা খোলার পথ তৈরি করে দিলেন । সেই পথ ধরে এ দেশে এল আধুনিকতা । যা এ দেশে মানুষদের চিন্তা ও যুক্তির বিচরণ ক্ষেত্রে বিপ্লব এনে দিয়েছিল।
সমাজনীতি, রাজনীতি, অর্থনীতি, শিক্ষানীতি থেকে সাহিত্য, সাংবাদিকতা সর্বক্ষেত্রে তাঁর বিপ্লবী চিন্তাধারা এই দেশের অন্ধকারের জগদ্দল পাহাড়কে টলিয়ে দিয়েছিল । শুধু তাই নয় তাঁর চিন্তাধারার ঢেউ প্রাচ্য থেকে পাশ্চাত্যে আছড়ে পড়েছিল যেখানে চিন্তার বালুতট ভরে উঠেছিল তাঁর চিন্তা ও কর্মের দ্যুতি । কবিগুরুর কথায় যিনি ভারতপথিক । যাঁর নাম ও ‘সতীদাহ প্রথা নিবারণ’ সমার্থক হয়ে আছে । তিনি হলেন রাজা রামমোহন রায় ।
আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু বলেছেন, ‘রামমোহন রায়ই সেই মানুষ যিনি বিশ্বের সামনে ভারতবর্ষের চিন্তাগত ও আধ্যাত্মিক জ্ঞান-অভিজ্ঞতার বিপুল ভান্ডার উন্মোচিত করেছিলেন।
কেবল সত্যানুসন্ধানের গভীর চিন্তায় তিনি তৃপ্ত ছিলেন না । বরং তার মাধ্যমে তিনি তাঁর সমগ্র জীবনকে এক সর্বজনীন লক্ষ্যে পরিচালিত করতে চেয়েছিলেন । আর সেই সর্বজনীন লক্ষটি হল ন্যায়ের প্রতিষ্ঠা । কোনও সঙ্কীর্ণ সম্প্রদায়ে তিনি আবদ্ধ ছিলেন না, কোনও ধর্মীয় পক্ষপাতিত্বকেও উৎসাহ দেননি । সমস্ত রকমের বিশ্বাসকে তিনি এক উদার চোখে দেখেছিলেন এবং তাঁর সেই দূরদৃষ্টিতে জ্ঞানানুসন্ধানের সমস্ত ক্ষেত্রে পূর্ণ স্বাধীনতার প্রয়োজনীয়তাটিকে তিনি উপলব্ধি করেছিলেন। আজ আধুনিক ভারতে বিজ্ঞানের যে-অগ্রগতি সম্ভব হয়েছে, তা ঘটেছে রামমোহনের চিন্তার প্রভাবেই ।’ সত্যের অনুসন্ধানে রামমোহন রায়ের জীবনের লক্ষ্য সম্পর্কে যা উল্লেখ করেছেন আচার্য বসু যার মর্মার্থ বিশিষ্ট দার্শনিক, সমাজত্ত্ববিদ ভারত বিশারদ ফ্রেডরিখ ম্যাক্সমুলারের কথা স্পষ্ট করে দেয় । তাঁর কথায়, ‘…রামমোহন রায়কে আমি একজন মহান মানুষ বলতে চাই। এবং সেটা কোনো সঙ্কীর্ণ অর্থে নয়; একটি তাৎপর্যহীন অর্থে নয় । পুরুষোচিত মহত্ত্বের তিনটি আবশ্যক উপাদান অর্থাৎ নিঃস্বার্থতা, সততা ও সাহসিকতার অর্থে তিনি এক মহান মানুষ ।..উৎকৃষ্ট অর্থে এক মহত্ত্বম মানুষ ।’
রামমোহন রায়ের মহত্ত্ব সবার চোখে যে ধরা পড়েছে তা কিন্তু নয় । তাঁর মহত্ত্ব নিয়ে প্রশ্ন চিহ্ন তুলেছিলেন বিশ শতকের ইতিহাস গবেষক লেখক সুপ্রকাশ রায়, সমাজবিজ্ঞানী সাহিত্য-সমালোচক গবেষক বিনয় ঘোষ প্রমুখ ব্যক্তিত্ব । রাজা রামমোহনের হাত ধরে এদেশে নবজাগরণ যে এসেছিল তা তাঁরা মান্যতা দিতে পারেনি । এমনকি ইতিহাসবিদ রমেশচন্দ্র মজুমদার এবং গান্ধীজীর মত ব্যক্তির কাছেও রাজার মহত্ত্ব তেমন কিছু নয় । রমেশচন্দ্র মজুমদারের মতে রামমোহন কোন inspiration হতে পারে না কারণ হিসেবে তাঁকে ‘sturdy spirit of Hindu nationalism’ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন । আর গান্ধীজী রাজা রামমোহন রায়কে কবীর চৈতন্যের তুলনায় ‘পিগমি’ বলে উল্লেখ করেছেন । গান্ধীজী তাঁর ধর্মীয় চিন্তাভাবনার সমান্তরালে রামমোহন রায়কে বুঝতে চেয়েছিলেন । ইতিহাসবিদ হয়েও রমেশচন্দ্র মজুমদার হিন্দুয়ানার বাইরে বের হতে পারেনি । ভারতবর্ষের স্বাধীনতা আন্দোলন একেবারে হিন্দুয়ানার পথের বাইরে ঘটেনি । গান্ধীজী ছিলেন সেই হিন্দুধর্মভিত্তিক জাতীয়তাবাদের অন্যতম পুরোধা । রামমোহন রায়কে ‘পিগমি’ বলতে তাঁর আটকায়নি। তাঁর এমন মন্তব্যে রবীন্দ্রনাথ ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন এবং বলেছিলেন, ‘যে কারণ ভিতরে থাকাতে রামমোহন রায়ের মত অত বড় মনস্বীকেও মহাত্মা বামন বলতে কুন্ঠিত হননি–অথচ আমি সেই রামমোহনকে আধুনিক যুগের মহত্তম লোক বলেই জানি‐-সেই আভ্যন্তরীণ মনঃ-প্রকৃতি-গত কারণই মহাত্মাজীর কর্মবিধিতে এমন রূপ ধারণ করেছে যাকে আমার স্বধর্ম আপন বলে গ্রহণ করতে পারছে না ।’ গান্ধীজীর মন্তব্যের প্রতিবাদ করেছিলেন তাঁরই বন্ধু দীনবন্ধু এন্ড্রুজ । তিনি প্রতিবাদে বলেছিলেন, ‘… I hail Rammohan, who in his day and generation welcomed….the light which unites mankind. He was no pygmy who thus rose out of the narrowest groove of convention to such heights, he was one of the great ones of the human history.’
গান্ধীজীর মত সেদিন গোঁড়া হিন্দুসমাজ বিশেষত হিন্দুত্ববাদীরা রামমোহন রায়ের বিরোধিতা করেছে । এমনকি বঙ্কিমচন্দ্রও হিন্দুমননে রামমোহন রায়কে সম্পূর্ণ সমর্থন করতে পারেন নি ।
অথচ বিপ্লবী অরবিন্দ ঘোষ যাঁর পরিচয় ঋষি, তিনিও বলেছেন, ‘Raja Rammohan Roy was a great man in the first rank of active genius and set flowing a stream tendencies which have transformed our national life. But what was the only possible policy for him in his times and without a century of experience behind him–is neither the only policy nor the best policy for us at the present juncture.’ সত্যিই রামমোহন রায় তাঁর চিন্তাধারা, কর্ম দিয়ে আমাদের জাতীয় জীবনকে পরিবর্তনের পথ তৈরি করে দিয়েছে । এ সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাষায় রামমোহনকে জানা আরো সহজ হয়ে ওঠে । রবীন্দ্রনাথ বলছেন, ‘নিবিড় প্রদোষান্ধাকারের মধ্যে আমাদের দেশে রামমোহন রায়ের জন্ম একটা বিস্ময়কর ব্যাপার। পাশ্চাত্য শিক্ষার অনেক পূর্বেই তাঁর শিক্ষা ছিল প্রাচ্য বিদ্যায় । অথচ ঘোরতর বিচ্ছেদের মধ্যে ঐক্যের সন্ধান লাভ করবার মতো বড়ো মন তাঁর ছিল । বর্তমানকালে অন্তত বাংলাদেশে ভারতীয় সংস্কৃতির সর্বপ্রথম দূত ছিলেন তিনি ।..অসাধারণ দূরদৃষ্টির সঙ্গে সার্বভৌমিক নীতি এবং সংস্কৃতিকে তিনি গ্রহণ করেছিলেন। শুধু ধর্ম এবং আধ্যাত্মিকতার ক্ষেত্রে নয়, কর্মের ক্ষেত্রেও তাঁর বুদ্ধি ছিল সর্বজনীন । এদেশে রাষ্ট্রবুদ্ধির তিনিই প্রথম পরিচয় দিয়েছেন । আর নারীজাতির প্রতি তাঁর বেদনাবোধের কথা কারও অবিদিত নেই।…’
এমন মহত্ত্বম মানুষের সার্ধ দ্বিশত জন্মবর্ষে (দ্বিমত অনুসারে যদিও আরো দু’বছর অতিক্রান্ত) ‘সংবর্তক’ পত্রিকার জানুয়ারি,২০২৪ ‘রামমোহন রায় বিশেষ সংখ্যা’ হিসেবে প্রকাশিত যা রাজা রায়ের প্রতি যথার্থ শ্রদ্ধার্ঘ অর্পিত হয়েছে । সেই শ্রদ্ধার্ঘের ডালি থেকেই এই প্রতিবেদন বা আলোচনা । এই বইয়ের ভূমিকার একটি অংশে রামমোহন রায়ের পরিচয় সুন্দরভাবে ব্যক্ত হয়েছে । ‘আমাদের বর্তমান আমাদের অতীত থেকে বিচ্ছিন্ন নয়, আমাদের আগামী আজকের ঘটমান থেকেও বিযুক্ত হতে পারে না । সমাজবিকাশের আছে এক ধারাবাহিকতা; সেখানে ছেদ হিসেবে দাঁড়িয়ে আছেন এদেশের নবজাগরণের পথিকৃৎ রামমোহন । ..যাঁর হাত ধরেই প্রথম আমাদের আধুনিকতার আলোয় প্রবেশ, যাঁর কাছেই প্রথম আমাদের চিন্তার অবাধ স্বাধীনতা ও যুক্তির পাঠ, যিনিই প্রথম আমাদের দাঁড়াতে শেখাতে দেশাচার ও কুসংস্কারের শৃঙ্খল ছিন্ন করে মানবতাবাদী আদর্শের ভিত্তিতে, যিনি জাত-পাত ধর্ম-সম্প্রদায়ে বিভক্ত এই দেশে প্রথম সন্ধান দিলেন অখণ্ড জাতীয়তাবোধের, যিনি প্রথম এদেশের মানুষকে সচেতন করে তুললেন তাদের গণতান্ত্রিক অধিকার সম্পর্কে, দেখালেন রাজনৈতিকভাবে দাবি উত্থাপনের পথ, যিনি প্রথম কূপমন্ডূকতার দেশ থেকে প্রবেশ করলেন আন্তর্জাতিকতার আঙিনায়, প্রাচ্যের অন্ধকার থেকে বিশ্বকে শোনালেন কীভাবে ‘Liberty’র পক্ষে এবং ‘Depotism’-এর বিরুদ্ধে কথা বলতে হয়, যিনি এদেশের মেয়েদের জীবনের অধিকারের জন্য লড়াই চালিয়ে গেলেন আজীবন, তাঁর চর্চা তো আমাদের নিরন্তর করেই যেতে হবে ।’ এই অংশের শেষ লাইন থেকে বলা যায়, সত্যি কি আমরা সেই চর্চা করতে পারছি । আজকে যখন আধুনিকতার উন্নয়ন নামক পরিবেশে ধর্মীয় উন্মাদনার আগুন ছড়িয়ে দেওয়ার প্রয়াস ক্রমশ প্রকটতর হচ্ছে, তখন তাঁর চর্চা কতটুকু আমরা করতে পারছি । সে চর্চার ছেদ যেন ক্রমবর্ধমান । সেই অতীত থেকে তার ধারাবাহিকতার স্রোতের গতি বেড়ে চলেছে । অক্ষয়কুমার দত্তের কথাটি যেন আজও প্রাসঙ্গিকতা হারায়নি, ‘অনেকে শৃগাল-প্রতিমা নির্ম্মাণ করিয়া পূজা করিবেন, তথাচ সিংহ-প্রতিমূর্তি-দর্শনে অনুরাগী ও উদযোগী হইবেন না । এদেশে মানব-প্রকৃতির কি বিকৃতি ও বিপর্য্যয়ই ঘটিয়াছে !–ও ইয়ুরোপ! ও আমেরিকান ! একবার এদিকে নেত্রপাত কর । যদি রামমোহন রায়ের স্বদেশীয়-বর্গের কতদূর অধঃপাত ঘটিতে পারে দেখিতে চাও, তবে আমাদের প্রতি একবার দৃষ্টিপাত কর ।’ আমাদের অধঃপাত ঘটছে কিনা তা নিয়ে তর্ক জোড়া অনেক সহজ । এই তর্ক নিয়েই বিজ্ঞানী সি ভি রমনের একটি কথা স্পষ্ট করে দেবে যে আজকের দিনের পরিপ্রেক্ষিতে রামমোহন রায়ের মৃত্যু-শতবর্ষে তাঁর (রমন) কথার রেশ শেষ হয়ে যায়নি । এ দেশের আনাচে-কানাচে তাঁর আদর্শের বাণী–সংশয় কুসংস্কার রহস্যবাদ সব দূর হঠুক–ধ্বনিত হয়েছিল । আমি মনে করি, আজকের দিনেও তাঁর আদর্শ সমান প্রাসঙ্গিক। ভারতবর্ষে আমরা নানা বিষয়ে সেই আঠারো শতকের সামাজিক অবস্থানে এখনও বাস করছি । রামমোহন রায়ের চিন্তাভাবনা তাঁর মৃত্যুর একশো বছর পরেও আমাদের চেতনাকে স্পর্শ করতে পারেনি । তাই এখনও আমাদের উপলব্ধি করার বাকি আছে যে, ভারতবর্ষকে যদি সত্যিই নিজেকে রক্ষা করতে হয় তবে আমাদের সমস্ত পুরোনো ধ্যান-ধারনাগুলিকে পবিত্র করে তোলা হয়েছে; অথচ এর জন্যে আমাদের লজ্জিত হওয়া উচিত । আমাদের বর্তমান সামাজিক ও ধর্মীয় ভাবনায় এমন সব আচরণ আর অভ্যাস সহজেই খুঁজে পাওয়া যাবে যেগুলি সম্পূর্ণরূপে যুক্তিহীন ।..এই ধরনের মানুষ সমাজে যতদিন থাকবে–যারা দেশের জনগণের মানসিকতাকে নিয়ন্ত্রণ করে –ততদিন রামমোহন রায়কে আমাদের স্মরণ করতেই হবে ।’
রামমোহন রায়কে শুধু স্মরণ করা নয়, তাঁর প্রকৃত চর্চা আজকের দিনে আমাদের অত্যন্ত প্রয়োজন। আর সেই চর্চাকে সমৃদ্ধ করবে ‘সংবর্তক’ পত্রিকার রামমোহন রায় বিশেষ সংখ্যা ।
সংবর্তক
রামমোহন রায় বিশেষ সংখ্যা
জানুয়ারি, ২০২৪