পাঠক মিত্র
দু’টি ভিন্ন স্বাদের বই
১.
সময়ের সাক্ষ্য বহন করে ইতিহাস। এ কথা নতুন কিছু নয় । কিন্তু সাহিত্যও তো সময়ের প্রতিফলনের বাইরে নয় । তবু সাহিত্য ইতিহাস নয় । সমাজের দর্পণ বলে সাহিত্য সর্বদা পরিচিত যেখানে মানুষের জীবন সময়ের টানাপোড়েনে সমাজের চিত্রে ধরা পড়ে । তাই সাহিত্য ও ইতিহাস পৃথক হলেও সাহিত্যের বিন্যাসে ধরা পড়ে সময়কালীণ সমাজজীবন । সময়ের ছবি ইতিহাসের পাতায় যেভাবে ভেসে ওঠে, সাহিত্যের পাতায় সেভাবে নয় । আবার স্মৃতিকথনও সময়ের এক প্রতিফলন । স্মৃতিকথকের ফেলে আসা জীবনের স্মৃতি সময়ের উজানে বয়ে চলে । সেই চলার পথে ফেলে আসা জীবনের চাপা পড়ে থাকা বিচিত্র ঘটনা থেকে নানা কথা যেন কুড়িয়ে রাখা ঝুলি থেকে একে একে বেরিয়ে আসে । ফেলে আসা ঘটনার লিপিবদ্ধ প্রকাশ কথকের জীবনস্মৃতি হিসেবে পাঠককে মুগ্ধ করবে কি করবে না, তা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে কথকের বিশিষ্ট পরিচিতির ওপর সচরাচর নির্ভর করে । বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিশিষ্ট মানুষের জীবনের স্মৃতি আমাদের পাঠ করার সাধারণত আগ্রহ থাকে । কিন্তু স্মৃতিকথক অপরিচিত হলে সেই আগ্রহ সেভাবে তৈরি হয়না । এটা অস্বাভাবিক কিছু নয় । আমাদের প্রায় সকলকেই এমন সীমানার মধ্যে থাকতে হয় যেখানে পরিচিত গন্ডি অতিক্রম করার আগ্রহ থাকে না । তবুও সেই আগ্রহ কখনো কারো কাছে সৃষ্টি হতে পারে কারো সহচার্য্যে । কিংবা ঘটনাক্রমে হাতের কাছে হঠাৎই কোন স্মৃতি-লিপিবদ্ধ কপি এলে অন্তত তার পাতা ওল্টাতে ওল্টাতে পাঠকের চোখ স্থিরভাবে পাতার পর পাতা শেষ পর্যন্ত চলতে পারে, কিংবা পাঠককে শেষ প্রান্তে নিয়ে যেতে পারে একমাত্র কথকের সাবলীল শব্দস্রোত । যে স্রোতে পাঠক অনায়াসে ভেসে যেতে পারে । ভাসতে ভাসতে কোন পাঠকের কাছে কথকের স্মৃতিঝুলি যেন বেশ চেনা-চেনা লাগে । কিংবা কারো কাছে যেন তা কাহিনীর মুগ্ধতা তৈরি করে । এই মুগ্ধতা আসতে পারে যদি বয়ে যায় শব্দের সাবলীল স্রোত ।
‘পাড়ার ছেলে’ মলাটবন্দী এমনই এক স্রোত । যৌবনের চিলেকোঠায় জমিয়ে রাখা কথকের শৈশবের স্মৃতিঝুলি সেই স্রোতের উৎস । সময়ের সিঁড়ি বেয়ে স্মৃতির শাখাপ্রশাখা সজীব করে তোলে সেই স্রোত । অথচ সেই সজীবতা আর স্পর্শ করা যায় না । কিন্তু স্পর্শহীন এই সজীবতা মনের মণিকোঠাকে অনুভূতির আলোয় আলোকিত করে। শৈশব ও কৈশোরকালীন অনুভূতি কথকের শব্দের স্পর্শে নিছক গল্প হয়ে ওঠে নি । বহমান সময়-স্রোতের পাড়ে সমাজ ও পরিবেশ হয়েছে পরিবর্তিত যা এগিয়ে চলা সময়ের সাথে এগিয়েছে কিনা, সুন্দরতর কিনা তা প্রশ্ন হয়ে ওঠে । হয়তো প্রশ্ন থাকে বলেই সময়ের উজান বেয়ে স্মৃতি চলতে পারে কথকের নিঃসঙ্গ সময়ে । কথকের শেষ দুটো অধ্যায় ‘পাড়াতুতো মহাজোট’ ও ‘আরো একবার শাদা ফুলের গন্ধ’ যেন সে-কথাই বলে ।
একুশটি ছোট অধ্যায় সমন্বিত ‘পাড়ার ছেলে’ নিছক স্মৃতিকথা বা গল্প হয়ে ওঠে নি । কথকের কথা দিয়েই বলতে হয়, ‘পাড়ার ছেলে পাড়ার গল্প নয়, ছেলেরও গল্প নয় বরং একটি অখ্যাত সময়ের গল্প ।’ অখ্যাত সময় বটে । এই অখ্যাত সময় ধরেই শৈশব, পাড়ার, সমাজ ও পরিবেশের চেহারার যে-পরিবর্তন তা পাঠকের কাছে স্পষ্ট হবে কথকের সাবলীল শব্দস্রোতের মুন্সিয়ানায় ।
পাড়ার ছেলে/অভিষেক বোস
উড়ান, মালদহ-৭৩২১০১
২.
আর একটি বই । একবিংশের ধ্বনি । একুশজন প্রবীণ ও নবীন গল্পকারের একুশটি ভিন্ন স্বাদের গল্পের সংকলনে সমৃদ্ধ এই বই । সব ধরণের পাঠকদের এই সংকলন মুগ্ধ করবে । যদিও সব গল্প নিছক গল্প পাঠের আনন্দ দেবে না সেই সমস্ত পাঠকদের যাঁরা নিছক পাঠ-আনন্দে মোহিত হতে চান । এই সংকলনে সব গল্পই সেই সব পাঠকদের জন্য সেই আনন্দ নয় । বিশেষ করে পরিবর্তিত সময়ে কাহিনী বিন্যাসের চিরাচরিত স্রোতের পরিবর্তনের উপস্থিতি থাকে যে-সমস্ত গল্পে, সেই গল্প তো সেই সব পাঠকদের জন্য নয়ই । এমন কথা বলে পাঠকদের পাঠ-প্রতিক্রিয়া বিচার করা সেভাবে কাম্য না হলেও, তবে ‘সিরিয়াস পাঠক’ বলে এই যুগে সাহিত্য আঙিনায় চর্চা চলছে । সেই চর্চায় ‘একবিংশের ধ্বনি’ আলাদাভাবে ধ্বনি তুলবে সে আশা করা যায় । ‘স্থিরচিত্র’, ‘মহাপ্রস্থানের পথে’, ‘হৃদি ভেসে যায়’, ‘অন্ধকারের বিন্দু’ এমনই গল্প সেই চর্চার বিন্দু হতে পারে । আবার সেই বিন্দু ছুঁয়ে যায় ‘ত্রাতা ও গর্দভ’ এবং ‘বর্ণপরিচয়’ ।
চর্চা যাই হোক না কেন, গল্পের জমি যদি ঠিক থাকে তার শাখাপ্রশাখা আরো সজীব হয়ে ওঠে । সেই সজীবতা পাঠকদের মনকে শুধু মুগ্ধ করবে না, তাঁদের মননে বিস্তার করবে নানা রঙের ছবি । যে ছবি প্রকৃতি-পরিবেশ, সমাজ, রজনীতি থেকে মানুষের সম্পর্ক বিষয়ক ছবি । ‘নিষাদ বৃক্ষ’ গল্পটি গাছ-মানুষ সম্পর্কে লোভ আর সংস্কারের মিশ্রণে পলাশ কীর্তণীয়ার নিথর দেহ স্বপ্নে না এসে আরো অন্যভাবে তার বিবেকে আঘাত হানার চিত্রায়ণ হলে হয়তো গল্পটা পরিবেশ বিষয়ক ভাবনার আলাদা মাত্রা বয়ে নিয়ে যেত বলে মনে হয় । তবে কথাকারের নিজস্ব ভাবনার স্বাধীনতাকে সম্মান দিয়েই এ কেবল ব্যক্তিগত অভিমত মাত্র ।
আবার অনেক সম্পর্ক গড়ে ওঠে পারিপার্শ্বিক নয় পারিবারিক নয় অথচ তা পারিবারিক । এমনকি রাজনৈতিক স্পর্শেও নয় । মানসিক আবেগে বা আরো অন্যকিছু হতে পারে সেখানে । রাজনীতির স্পর্শহীন মানুষের সম্পর্কের এমন আবেগ ঘনীভূত হতে দেখা গেছে ‘হৃৎকমল’ গল্পে যেখানে সন্তানহারা দম্পতিকে বাঁচিয়ে রাখে মৃত সন্তানের অঙ্গে বেঁচে থাকা অপর সন্তানের প্রতি ভালবাসার আবেগ । কাহিনী বিন্যাসে নতুনত্ব থাকলেও মনে হবে যেন এ ছবি তো চেনা । কেউ তাঁর নিজস্বতা খুঁজে পেতে পারে । কিংবা পারিপার্শ্বিক এই ছবি যা তাঁর চেনা পৃথিবীর । আবার পারিপার্শ্বিক ঘটে চলা অনেক চেনা ছবি যা রাজনীতির পাঁকে সমাজজীবন আঁকুপাকু করে অথচ তা মানুষের কাছে ততটাই বোধগম্য নয়, যার প্রতিফলন কয়েকটি কাহিনীর মাটিতে । রাজনীতির সাথে প্রকৃতি জোট বাঁধে যখন, তখন মানুষের সাবলীল জীবন তছনছ হয়ে যায় এক লহমায় । দেশভাগের এক খন্ড চিত্র ‘বকচর একটি ভিনদেশি গ্রাম’ সেই কথাই বলে । দেশ ভাগ হয় কিন্তু মানুষের হৃদয় ভাগ হয় কিনা তা কেউই গ্রাহ্য করে । তবু সুলেমান ও হারু এখন এক দেশের মানুষ নয় অথচ তাঁরা স্মৃতি আঁকড়ে একাত্ম হতে পারে । অথচ সৃষ্ট পরিস্থিতি মানুষের এই মননকে কলুষিত করে দেয়। দেশভাগের পর এ ধ্বনির অনুরণনের সমাপ্তি আজও-যে ঘটেনি গল্পটি তারই প্রতিফলন ।
দেশভাগ নয় অথচ চলমান রাজনীতির পরিবেশে চেনা পৃথিবীর ছবি মানুষের জীবন ও ভাবনার প্রতিফলন ‘জেব্রাইল’, ‘মিড ডে মিল ও লচ্চা ভূত’, ‘মহাপ্রস্থানের পথে’, ‘সরকার যেভাবে গ্রামে যায়’, ‘ভোট বড় বালাই’, ‘ঘাটের মেয়ে’ গল্পগুলি । রাজনীতির পাঁকে সমাজ ও সাধারণ মানুষের জীবন কিভাবে চলে তার নিদর্শন এ গল্পগুলো । অথচ প্রতিটি গল্পের স্বর পৃথক লয়ে চলেছে । এমনকি গল্পের চরিত্রগুলো যেন বাস্তব মাটির ওপর দাঁড়িয়ে । ‘জেব্রাইল’ গল্পে রাজনীতির নতুন সমীকরণে গ্রাম ও তার সংস্কৃতি শহুরে হাওয়ায় যখন উড়ে যায় তখন বিলাই আর ইব্রাহিম খানের মত চরিত্র তৈরি হয় একের পর এক সামাজিক এপিসডে । ‘মহাপ্রস্থানের পথে’ অমৃতলালের শহরমুখী পথ যন্ত্রণাময় চলমান সমাজের প্রেক্ষাপটে যেখানে অমৃতলালের মত চরিত্ররা কেবল স্বপ্নে বেঁচে থাকে । ‘ঘাটের মেয়ে’ ফুলকিদের ক্ষণিকের জন্য স্বপ্নের স্থানান্তর হয় মাত্র ।
‘মিড ডে মিল ও লচ্চা ভূত’ সমাজ চরিত্রের চলমান ছবির এক ব্যাঙ্গাত্মক উপস্থাপনা । ‘সরকার যেভাবে গ্রামে যায়’ ও ‘ভোট বড় বালাই’ গল্পদুটি সমাজকে এতটুকু ব্যঙ্গ না করে এক অন্তসার সংস্কৃতির চেহারাকে কটাক্ষ করেছে ।
‘একবিংশের ধ্বনি’ গল্প সংকলনের সবকটি গল্পের জমিতে ভাষা ও শব্দের চলন পাঠকদের অবশ্যই নজর কাড়বে । তবে এ কথা বলা যায় গল্পগুলো শুধু একবিংশের ধ্বনি নয়, এ যেন একবিংশ শতাব্দীর সূচনা থেকে এক সমাজের সংকট ধ্বনি যেন আরো উচ্চ ডেসিবেলে ধ্বনিত হচ্ছে বলে জানান দেয় ।
একবিংশের ধ্বনি
সংকলনে- শুভ মৈত্র, শুভময় সরকার
উড়ান, মালদহ