পাঠক মিত্র
মানবিক-সত্তা ধ্বংসের এক ব্যাধি
‘সাম্প্রদায়িক’ শব্দটি আধুনিক ভারতবর্ষ তথা সারা বিশ্বে একটি বিড়ম্বনার শব্দ । যে বিড়ম্বনা প্রকৃত আধুনিক মানুষের রুচি অনুযায়ী তার উপস্থিতি থাকে না । সম্প্রদায়ে সম্প্রদায়ে বিশেষত হিন্দু আর মুসলমান ক্ষেত্রবিশেষে এ দেশে পরস্পরের শত্রু হিসেবে পরস্পর পরস্পরকে চিহ্নিত করে । যদিও এই চিহ্নিতকরণে দুই সম্প্রদায়ের আমজনতার প্রত্যক্ষ আচরণে বিরুদ্ধতা ক্রমশ প্রশস্ত হতে থাকে ।এমন প্রশস্ততার পথে তাঁরা বিধ্বস্ত হলেও এ পথ কিন্তু তাঁদের তৈরি নয় । এ পথের নকশা থেকে নির্মাণে থাকে এক নোংরা রাজনৈতিক স্পর্শ । যার স্পর্শে সাম্প্রদায়িক শব্দটি হয়ে ওঠে আরো স্পর্শকাতর । প্রাক-স্বাধীনতা থেকে এই সময় পর্যন্ত তার স্পর্শকাতরতা নানা রূপে হাজির । এই স্পর্শকাতরতায় ধর্মীয় সম্প্রদায়ের মধ্যে ধর্মনিষ্ঠার চর্চা অন্য ধর্মীয় সম্প্রদায়ের প্রতি শত্রুর মত আচরণ হতে পারে কিনা সে প্রশ্নে আজ আর কেউ বিব্রত হয়ে ওঠে না । ধর্মীয় বিষয় যখন রাজনৈতিক এজেন্ডা হয়ে যায় তখন তার মানবিক রূপ কেবল খোলস হয়ে পড়ে থাকে । এই খোলসে শিক্ষিত, অশিক্ষিত, অর্ধশিক্ষিত সকলেই থাকে । শিক্ষক, ব্যবসায়ী থেকে রাজনীতির ধর্মীয় মানুষ থেকে ধর্মীয় রাজনীতি এই খোলসে থেকে তৈরি করে এক আঁধার । এই আঁধার সভ্য সমাজের আঁধার । এমন আঁধারের কোলাজ হয়ে উঠছে যেন এই সমাজ । এই কোলাজের একটুকরো ছবির উপন্যাস ‘আঁধার মহিষ’ । আঁধারের স্রোত দেশের শিরা উপশিরায় কিভাবে বয়ে চলে তার প্রবাহধারার আখ্যান । ধর্ম ও ইতিহাসকে সুবিধাবাদী সুবিধাভোগীরা নিজেদের ব্যক্তিগত কিংবা দলীয় স্বার্থ চরিতার্থ করার পথকে এগিয়ে নিয়ে যেতে কেউই কুন্ঠিত নন আজ । সেখানে মানুষ হিসেবে সংখ্যাগরিষ্ঠের পথ অন্ধকার হলে কি যায় আসে । ‘আধার মহিষ’ উপন্যাসে লেখক অভিজিৎ সেন সেই অন্ধকারকে চিহ্নিত করেছেন । প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থা এ অন্ধকারের জীবনদীপ নিভিয়ে দিতে ব্যর্থ। সেই ব্যর্থতার প্রকাশ উপন্যাসের সুভদ্র নামক এক শিক্ষক চরিত্রের কথায় ব্যক্ত হয়েছে । কথা প্রসঙ্গে তাঁর এক ছাত্রকে বলছেন, ‘পড়াশোনার সঙ্গে গোঁড়ামির তফাত করা কঠিন । বহু ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, বিজ্ঞানী আছে দেখবে, বেশ গোঁড়া তারা । হালের বৈশিষ্ট্য বোধহয় এই যে ইস্কুল-কলেজে শিক্ষিত মানুষই বেশি গোঁড়া। আসলে আমাদের সমাজে অধিকাংশ মানুষের কাছে শিক্ষা পয়সা রোজগার ছাড়া কিছু নয় ।’ এ কথার জ্বলন্ত উদাহরণ তাঁরই কলেজের এক বিজ্ঞান শিক্ষক উপন্যাসের আর এক চরিত্র অনিরুদ্ধ ।
অনিরুদ্ধ পদার্থবিদ্যার অধ্যাপক। এই তেত্রিশ-চৌত্রিশ বছর বয়সেই তার দু-হাতে সাতটা আঙটি । ভাবতে আতঙ্ক হয়, যদি আরও চল্লিশ-পঁয়তাল্লিশ বছর বেঁচে থাকে ? হতেই পারে, কুপ্রহরের তো শেষ নেই। সেও একরঙের বামপন্থী ।
বামপন্থীরা বৈজ্ঞানিক যুক্তিনির্ভর হিসেবে নিজেদের পরিচিতি দেয় । তাঁরা মার্ক্সের বস্তুবাদী দর্শন দ্বারা প্রভাবিত বলেই পরিচিত । কিন্তু লেখক অনিরুদ্ধের মত বিজ্ঞানের শিক্ষক অথচ বামপন্থী বলে এমন চরিত্রের পরিচয় দিয়েছেন তা এই সমাজে আজগুবি চরিত্র একেবারে তা বলা যায় না । কাহিনীর মধ্যে ‘চম্পাতলা’ নামক স্থানের এক ধর্মীয় সংস্থার সদস্য হতে অনেক বামপন্থীদের বাধা না থাকার কারণ লেখক সেন পরিষ্কার করে দিয়েছেন । ‘বামপন্থীদের ঈশরভক্ত সদস্যরাও চম্পাতলার এই সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত । তারা চাঁদা দেয়, চাঁদা তোলে, উৎসবে অংশগ্রহণ করে এবং মার্কসবাদ কিংবা সমাজতন্ত্রের সঙ্গে এর কোনো বিরোধ খুঁজে পায় না । এরকম মানুষ বহু আছে ।’
এমন বহু মানুষের সংগঠন তথাকথিত ধর্মীয় সমাজ আঁধারে চিন্তার আলো বয়ে নিয়ে যেতে অক্ষম হয়ে পড়ে । সেই অক্ষমতায় মানুষের চেহারায় তাঁর ধর্ম খুঁজে বেড়ায় । ধর্মীয় স্থানের অপবিত্র ও বিধর্মীয় মানুষের ঘৃণাযুক্ত ঘটনার কল্পকাহিনী দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে । রামজন্মভূমি-বাবরি মসজিদ খবরের কাগজের পাতা ছেড়ে পশ্চিম বাংলার মানুষের চিন্তাজগতে উঁকি মারতে শুরু করে । আখ্যানের রচনাকাল গত শতাব্দীর শেষ দশকের ঠিক আগের মুহূর্ত, যখন বাবরি মসজিদের শেষ দেখে ছাড়ার হুঙ্কার তার উৎস থেকে গতি তুলতে শুরু করেছে । এই গতির তীব্রতা বেড়ে যাওয়ার পরিবেশ এ দেশের মাটিতেই আছে । আখ্যানের চরিত্র প্রশাসনের এক আধিকারিকের চিন্তার প্রতিফলন সে কথাই বলেছে । ‘ধারণার উৎপত্তি যেখানে, বিশ্বাস সেখানেই উৎপন্ন । এমনকি সন্দেহের উৎপত্তির সঙ্গে সঙ্গেই বোধহয় বিশ্বাসেরও গোড়াপত্তন। সন্দেহ বোধহয় অবচেতনের সংরক্ষিত প্রকোষ্ঠে গিয়ে জমা হয়ে রয়েছে । শিক্ষিত, সচেতন, মার্জিত, সতর্ক, ভজনী-তোলা চৈতন্য তাকে সবসময় চাপা দিয়ে রাখতে পারে না । অবিশ্বাস এবং অজ্ঞতা কি সর্বগ্রাসী ।’ অবিশ্বাস আর অজ্ঞতার গ্রাসে কামাল ও অলকানন্দার প্রেমের ঘর, বিশ্বাসের ঘর অস্তিত্বের সংকটে দুলতে থাকে । এই সংকট তৈরি হয় ধর্মবিদ্বেষে । ধর্মবিদ্বেষের চেহারা কেমন তা কামাল তাঁর শিক্ষকতার জগতের স্কুলের প্রাক্তন প্রধানশিক্ষক ধার্মিক আমজাদ আলির সাথে কথোপকথনে ব্যক্ত করেছেন । ‘পৃথিবীর যাবতীয় ধর্মই পরধর্মবিদ্বেষী । কোনো ধর্মই নিরপেক্ষ এবং সহনশীল নয় । একটি পৃথক ধর্মের অর্থই হল উপস্থিত অন্য ধর্মগুলোর সঙ্গে বিরোধ করা । যদি একথা সবাই মেনে নিত যে ধর্মীয় বিবর্তন আসলে পুরোনো নিয়ম-নির্দেশগুলো অকেজো হয়ে যাওয়ার কারণেই, তাহলেও অসুবিধা ছিল না । কিন্তু প্রত্যেক ধর্মই নিজের নিয়মগুলোকে অজর অমর করে রাখতে চায় । ফলে নিজের ধর্মের শ্রেষ্ঠত্ব দাবি করার অর্থই হল অন্য ধর্মকে হেয় করা । ধর্ম যেহেতু দর্শন নয়, এ নিয়ে বিতর্ক চলে না, যা চলে, তা হল, হানাহানি, কাটাকাটি, হত্যা, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ, তালাক, বহুবিবাহ, ফতোয়ার আধিক্য, ব্যক্তিগত আইন, ইত্যাদি মুসলমানি বিধানগুলোর মধ্যে ব্যভিচার, ভ্রষ্টাচার, স্বার্থপরতা, হিন্দুদের সতীদাহ, বিধবার জন্য অমানুষি বিধান, বহুবিবাহ, জাতপাত, হরিজনহত্যা ও নিগ্রহ, এবং খ্রিস্টানদের অনুরূপ প্রথাগুলোর ভ্রূণ তাদের ধর্মশাস্ত্রে বিধানগুলোর মধ্যেই আছে । তালাক নিয়ে মুসলমান পুরুষের একচেটিয়া হৃদয়হীন ভ্রষ্টাচারের কৌশল, অনিচ্ছায় হলেও, শাস্ত্রই তাকে দিয়েছে । ফলে শাস্ত্রীয় বিধান বাঁচিয়ে মানুষ যা খুশি প্রায় তাই-ই করতে পারে ।’
শাস্ত্রীয় বিধান দেখিয়ে ইসকান্দারের মত সুবিধাভোগী চরিত্র কামালের বাড়ি এসে কামালকে হেনস্থা করে যেতে পারে অতি সহজেই। এমনকি হিন্দুত্ববাদীরা কামালকে পথে নিগ্রহ করতে পারে । কামাল ও অলকানন্দার মানবিক বৃত্ত শাস্ত্রহীন হলেও শাস্ত্রীয় বিধানের জালে ধরে ফেলতে ইসকান্দাররা মানবিকভাবে নীচে নামতে দ্বিধা করে না । আসলে সমাজের প্রচলিত ব্যবস্থায় ধর্মীয় পরিচয়ের ঘেরাটোপে বেঁধে রাখার নিয়ম যেন স্বাভাবিক। সেই স্বাভাবিকতায় মুক্ত মনের কামাল দ্বিধাগ্রস্থ হয়ে পড়ে । অস্তিত্বের সংকট তাঁদের মুক্তভাবে বেঁচে থাকার লড়াইকে প্রতিনিয়ত ধ্বংস করতে এগিয়ে আসে । সংকটাপন্ন অবস্থায় থেকেও বাঁচার স্বপ্ন দেখে তাঁরা । স্বপ্নকে বাস্তব রূপের মাটিতে লালন করার প্রশ্নে কামাল দ্বিধাগ্রস্থ হয়ে পড়ে । নিজেদের প্রজন্ম প্রসঙ্গে অলকানন্দার কথার জবাবে সে বলে, ‘কি নাম হবে বলো তো আমাদের সন্তানের ? কার পরিচয় দেবে সে ? কী পদবি হবে তার ? সে কি পদবি ছাড়াই নাম লিখবে ? সব দরখাস্তের ফরমেই তো ধর্মের জন্য আলাদা একটা ফাঁকা জায়গা থাকে ? সেখানে কি লিখবে সে ? কী লেখার আমরা ? যদি মুসলমান লেখে তুমি কি খুশি হবে ? যদি হিন্দু লেখে–আমি? তুমি কি আকিকা, চুন্নৎ, বিসমিল্লাখনি ইত্যাদি–মুসলমানি আচার-আচরণ করবে ? আমি কি করব হিন্দু আচরণগুলো ? এবং এসবের পর ? যদি তোমার মতো আমার মতো মানুষ তার না জোটে, তাহলে কি সে এই আচারসর্বস্ব মূলস্রোতের যে-কোনো একটায় ঢুকে যাবে? ঢুকে গিয়ে নির্বিবাদে সাম্প্রদায়িক স্রোতে গা ভাসিয়ে নিজে জ্বলবে এবং প্রতিপক্ষকে জ্বালাবে ?–না কি সে উদ্বায়ী কিম্ভূত মানুষ হবে, অলকানন্দা ?’ কিন্তু কামাল দ্বিধাগ্রস্থ হলেও অলকানন্দা তাঁদের স্বপ্নকে ইতিবাচক পথে নিয়ে যেতে চায় । তাই অলকানন্দা বলতে পারে, ‘আমাদের সন্তান- সে হিন্দু নয়, মুসলমান নয়, সে হবে শুধু মানুষ । যে নামে তাকে ডাকা আমরা আদর করে, তাই হবে তার নাম । ইস্কুলভর্তির দরখাস্তে পদবির জায়গায় কিছু বসাব না। আমরা ধর্মের জায়গায় শূন্য রাখব । যদি এর জন্য আমাদের সব জায়গায় লড়াই করতে হয়, সব জায়গাতেই লড়াই করব । আমাদের সন্তান তার সঙ্গী খুঁজবে এই দেশের অসংখ্য মানুষের মধ্যে ।’ এই স্বপ্ন তাঁরা ফেরি করেনি । তবু তাঁরা এই স্বপ্ন নিয়ে তাঁরা ঘৃণ্যভাবে আক্রান্ত হয় পিশাচ দলের হাতে । এই পিশাচ দল মানুষের ধর্ম তারা জানে না, কিন্তু ধর্মের মানুষ তারা চেনে । সেই চেনার মধ্যেও লুকিয়ে রাখে এক বর্বর লোভ । সেই বর্বরতার শিকার অলকানন্দা ও কামাল ।
মানুষ ও মনুষ্যত্বের প্রেমে কামাল ও অলকানন্দাকে তাঁদের সমাজ মাথা তুলে দাঁড়াতে দেবে না । সেই সমাজ শুধু সুযোগের অপেক্ষায় থাকে । আর সুযোগ যখন ধর্মীয় উন্মাদনায় রাজনৈতিক স্পর্শ পায় তখন সুবিধাভোগীদের কাছে তা হয়ে যায় সোনায় সোহাগা । যার আগুনে পুড়তে থাকে মানুষ, কামাল, অলকানন্দারা । সাম্প্রদায়িক শক্তির হিংসার কাছে হার মানে মানুষের প্রেম, মানবিক সত্তা ।
সমাজের কোণায় কোণায় স্কুল, কলেজ, প্রশাসনিক স্তর, সাধারণ সমাজ থেকে ধর্মীয় সংস্থা থেকে রাজনৈতিক সংস্থার মধ্যে সাম্প্রদায়িকতার শক্তি কিভাবে সঞ্চিত হয় লেখক অভিজিৎ সেন তাঁর কাহিনী বিন্যাসে অত্যন্ত সাবলীলভাবে তুলে ধরেছেন । যা তথাকথিত সাহিত্যের সংসারে কলুষিত বলে কেউ বাঁকা চোখে তাকাতেই পারেন । কিন্তু এই সময়ে পাঠককে বাস্তব মাটির স্পর্শে অনেক প্রশ্নের সম্মুখীন করে দেবে তাঁর ‘আঁধার মহিষ’ যা থেকে পাঠক মানবিক-সত্তা ধ্বংসের ব্যাধিকে সহজেই চিহ্নিত করতে পারবেন ।
‘আঁধার মহিষ’
অভিজিৎ সেন
প্লাটফর্ম প্রকাশন, কলকাতা-৭৩