পাঠক মিত্র
দ্বিশতবর্ষে মাইকেল মধুসূদন
মাইকেল মধুসূদন দত্ত নামটি মনে পড়লে একটি লাইন স্বতঃস্ফূর্তভাবে মনে এসে যায় । অন্ততপক্ষে এ প্রতিবেদকের তা হয় । সাধারণ পাঠকের কাছে ‘হে বঙ্গ ভান্ডারে তব বিবিধ রতন’ লাইনটির পরিচিতি নিয়ে আজও তার সংশয় নেই বলেই মনে হয় । তবে এ কথা ঠিক যে এ প্রজন্ম যারা ‘ফোর জি’ ও ‘ফাইভ জি’ হিসেবে জানান দেয় তাদের কাছে মাইকেল মধুসূদন দত্ত একটি অপরিচিত নাম হতে পারে । কিন্তু সাহিত্যের সঙ্গে সংস্পর্শ যাদের আছে তাদের কথা একটু আলাদা হতে পারে । বাংলা সাহিত্যের রেণেসাঁ শুরু তাঁর হাত ধরেই । বাংলা কাব্যে বিপ্লব তিনিই এনেছিলেন । অমিত্রাক্ষর ছন্দের প্রবর্তক তিনিই, চতুর্দশপদী কবিতার সার্থক রূপকার তিনিই । তাঁর সম্পর্কে শ্রী অরবিন্দ ঘোষ বলেছিলেন, ‘Poet, who first with skill inspired did teach/Greatness to our divine Bengali speech–‘. বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় বলেছিলেন, ‘..এই প্রাচীন দেশে দুই সহস্র বৎসরের মধ্যে কবি একা জয়দেব গোস্বামী । …জয়দেব গোস্বামীর পর শ্রীমধুসূদন ।’ তিনি আরো বলেছিলেন, ‘..ধর্ম্মোপদেশকের মধ্যে শ্রীচৈতন্যদেব, দার্শনিকের মধ্যে রঘুনাথ, কবির মধ্যে শ্রীজয়দেব ও শ্রীমধুসূদন ।’ দ্বিজেন্দ্রলাল রায় বলেছেন, ‘মাইকেল অমিত্রাক্ষর ছন্দ সৃষ্টি করিলেন, ‘সনেট’ সৃষ্টি করিলেন, মহাকাব্য সৃষ্টি করিলেন, খন্ডকাব্য সৃষ্টি করিলেন, নাটক সৃষ্টি করিলেন, নূতন বৈষ্ণব কবিতা সৃষ্টি করিলেন । বলিলে অত্যুক্তি হয় না যে, বঙ্কিমচন্দ্র আধুনিক বাঙ্গালা গদ্য সাহিত্যের ও মাইকেল আধুনিক পদ্য সাহিত্যের সৃষ্টিকর্ত্তা । তাঁহাদের স্মৃতি অমর হউক ।’ তাঁহাদের স্মৃতিকে তাঁহাদের সৃষ্টি অমর করেছে । মাইকেল মধুসূদন দত্তের অমর সৃষ্টি ‘মেঘনাথবধ কাব্য’ আজও সাহিত্য ও সংস্কৃতির আকাশে বহমান । তদানীন্তন এই কাব্যের সমালোচনা পক্ষে ও বিপক্ষে দুটোদিকেই হয়েছিল । প্রথমে রবীন্দ্রনাথ এ কাব্যের ভাব ও ভাষাগত সাংকর্যের দিক থেকে প্রশংসা করতে পারেননি বলে কেউ কেউ তাঁর সমালোচনার মধ্যে খুঁজে পান মধুকবির সাহিত্য নিষ্প্রাণ । কিন্তু রবীন্দ্রনাথ আবারো বলেছেন,”.. ‘মেঘনাথবধ কাব্য’-এ কেবল ছন্দোবন্ধে বা রচনা প্রণালীতে নহে, তাহার ভিতরকার ভাব ও রসের মধ্যে একটা অপূর্ব পরিবর্তন দেখিতে পাই। এ পরিবর্তন আত্মবিস্মৃত নহে । ইহার মধ্যে একটা বিদ্রোহ আছে ।” মাইকেলের এই বিদ্রোহে স্বামীজী দেখেছেন ‘মেঘনাথবধ কাব্য’ বাংলা ভাষার মুকুটমণি । তিনি তাঁর এক শিষ্যকে বলেছেন, ‘….তোদের দেশে কেউ একটা নতুন কিছু করলেই তোরা তাকে তাড়া করিস । আগে ভাল করে দেখ লোকটা কি বলছে, তা না—যাই কিছু আগেকার মতো না হলো অমনি দেশের লোকে তার পিছু লাগল । এই ‘মেঘনাথবধ কাব্য’— যা তোদের বাঙলা ভাষার মুকুটমণি– তাকে অপদস্থ করতে কিনা ‘ছুঁচোবধকাব্য’ লেখা হল ! তা যত পারিস লেখ না, তাতে কি ? সেই ‘মেঘনাথবধ কাব্য’ এখনো হিমাচলের ন্যায় অটলভাবে দাঁড়িয়ে আছে ।’ যদিও বুদ্ধদেব বসু মাইকেলের কীর্তির মধ্যে তাঁর গুণাবলীর চিহ্নমাত্র পাননি । তিনি বলেছেন, ‘সত্যি বলতে, মাইকেলের মহিমা বাংলা সাহিত্যের প্রসিদ্ধতম কিংবদন্তী, দুর্মরতম কুসংস্কার । কর্মফল তাঁকে পৌঁছিয়ে দিয়েছে সেই ভুল স্বর্গে, যেখানে মহত্ত্ব নিতান্তই ধরে নেয়া হয়, পরীক্ষার প্রয়োজন হয় না । এ-অবস্থা কবির পক্ষে সুখের নয়, পাঠকের পক্ষে মারাত্মক । আধুনিক বাঙালি পাঠক ‘মাইকেলের রচনাবলি’ পড়ে এ মীমাংসায় আসতে বাধ্য যে তাঁর নাটকাবলি অপাঠ্য এবং যে-কোনো শ্রেণীর রঙ্গালয়ে অভিনয়ের অযোগ্য, ‘মেঘনাথবধ কাব্য’ নিষ্প্রাণ, তিনটি কি চারটি বাদ দিয়ে ‘চতুর্দশ-পদাবলি’ বাগাড়ম্বর মাত্র, এমনকি তাঁর শ্রেষ্ঠ রচনা ‘বীরাঙ্গনা কাব্য’–এও জীবনের কিঞ্চিত লক্ষ্মণ দেখা যায় একমাত্র তারার উক্তিতে ।….এবং প্রহসন দুটিও সর্বাঙ্গসম্পূর্ণ নাটক নয়, নবিশের কাঁচা হাতের কৃশাঙ্গ নকশা মাত্র, অনেকটাই তার ছেলেমানুষি ।’ শ্রী বসু সুধীন্দ্রনাথ দত্তের সমালোচনার কথাও তুলে ধরেছেন তাঁর বক্তব্যে । সুধীন্দ্রনাথ দত্ত বলেছেন যে প্রাচীন বাংলা সাধারণত অপাঠ্য, তেমনি..মাইকেল বাংলা ভাষাকে ভালোবাসতেন বটে, কিন্তু তার প্রকৃতি বুঝতেন না; তাই তিনি বঙ্গভারতীর সেবক মাত্র, তার ত্রাণকর্তা নন ।’
মধুকবির প্রহসন দুটি ‘একেই কি বলে সভ্যতা’ আর ‘বুড়ো শালিকের ঘাড়ে রোঁ’ ছেলেমানুষির কাঁচা হাতের নকশা বলেছেন বুদ্ধদেব বসু । অথচ এই দুটি প্রহসন তদানীন্তন গোঁড়া সমাজের ভিতকে যেভাবে বিদ্রুপ করেছে যা নবজাগরণের আলোর ছটা হিসেবে অনেকেই মত ব্যক্ত করেছেন । শুধু তাই নয় ‘বীরাঙ্গনা কাব্য’ মধুকবির শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি হিসেবে যেখানে সর্বদা আলোচিত সেখানে বুদ্ধদেব বসুর কাছে তার কিঞ্চিতমাত্র লক্ষ্মণ ছাড়া কিছু নয় । এগারোটি নারী চরিত্রের বীরত্বকথা যা তদানীন্তন প্রচলিত সমাজ বহির্ভূত নারীর চিন্তাকে ব্যক্ত করেছে । নারীর তাঁর চিন্তার স্বাধীনতায় বেঁচে থাকার কাহিনী এই ‘বীরাঙ্গনা কাব্য’ । মধুকবি এই কাব্য নারীমুক্তি আন্দোলনের জনক বিদ্যাসাগরকে উৎসর্গ করেছিলেন ।
বুদ্ধদেব বসু মধুকবির নাটক একেবারে অপাঠ্য শুধু বলেননি, তিনি বলেছেন যে তাঁর নাটক যে-কোনো রঙ্গালয়ে অভিনয়ের অযোগ্য । যদিও এই সময়ে ‘মেঘনাথবধ কাব্য’র মঞ্চ সফলতা নিয়ে সংশয় একেবারে নেই । নান্দীকারের প্রযোজনায় গৌতম হালদারের একক অভিনয় দিয়ে তার সূচনা শুধুই হয়নি, গৌতম হালদারের সেই একক অভিনয় আজও মঞ্চসফল । মেঘনাথবধ কাব্যের এই মঞ্চ সফলতা তার রচনাকালীন সময়কে মনে করিয়ে দেয় না । এমনকি বুদ্ধদেব বসুর মন্তব্যকে অনায়াসে খারিজ করে দিয়েছে ।
বুদ্ধদেব বসু কিংবা সুধীন্দ্রনাথ দত্ত মধুকবির শতবর্ষ পরে তাঁর মূল্যায়ন করেছেন । উনবিংশ ও বিংশ শতাব্দীর বাংলা এক নয় । সাহিত্যের বিচারও একধারায়ও বইতে পারে না । বুদ্ধদেব বসু এবং সুধীন্দ্রনাথ দত্ত কিংবা এখন যখন মধুকবির সমালোচনা চলছে তখন বাংলা ভাষার সমৃদ্ধির কাল সম্পর্কে ইঙ্গিত না থাকলে তা সাহিত্যের বিচারধারার পথ সঠিক হতে পারে না । তাই মধুকবি বাংলাভাষার ত্রাণকর্তা নন বলে যতই মত ব্যক্ত হোক, অথচ বাংলা কাব্যের রেণেসাঁ তিনিই এনেছিলেন। বাংলাভাষার প্রকৃত ত্রাণকর্তা বিদ্যাসাগর । অথচ বিদ্যাসাগর টুলো পন্ডিত বলে এখনো উল্লেখ করেন অনেকেই । বিদ্যাসাগর ও মধুকবি অনেকের কাছে অচেনা থাকলেও, এই দুই ব্যক্তি পরস্পরকে চিনেছিলেন । রামমোহন রায়ের পর এই দুজন মানুষ বাঙলা ভাষা ও সমাজের স্থপতি ।
বিদ্যাসাগর ও মধুকবি আচরণে দুই মেরুর হলেও তাঁদের বন্ধুত্বের সম্পর্কে সেভাবে ভাটা পড়েনি । মতান্তর মনান্তর স্তর পর্যন্ত ঘটেনি । আজও তাঁদের নিয়ে নানা মতান্তর থাকলেও তাঁদের সৃষ্টি বাংলা ও বাঙালির সম্পদ । তাঁরা আমাদের কাছে চির স্মরণীয়। দ্বিশতবর্ষে মাইকেল মধুসূদন দত্ত স্মরণে শ্রদ্ধার্ঘ অর্পণে কলকাতা পুরসভার উদ্যোগে কলকাতা পুরশ্রী বিশেষ সংখ্যা ‘দ্বিশতবর্ষে মাইকেল মধুসূদন’ প্রকাশে কবির প্রতি এক শ্রদ্ধার্ঘ যা মধুকবির মূল্যায়নে নানা বিষয় প্রতিফলিত হয়েছে । বইটি তিনটি অধ্যায়ে বিভক্ত । প্রথমটি ‘নবনিরীক্ষণ’ । দ্বিতীয়টি ‘উজ্জ্বল উদ্ধার’ । আর তৃতীয়টি ‘আলেখ্য’ । ‘উজ্জ্বল উদ্ধার’ বিভাগে মধুকবির মূল্যায়ন উনবিংশ ও বিংশ শতাব্দীর সময়কালীণ । ‘আলেখ্য’ অংশটিও দুটি শতাব্দীর সময়কালীণ মিশ্রণ । কিন্তু ‘নবনিরীক্ষণ’ অংশটি কবির দ্বিশতবর্ষ উপলক্ষে লিখিত । এই অংশটি বইটির প্রথম পর্বের পরিবর্তে যদি দ্বিতীয় পর্বে রাখা হত তাহলে রচনার ক্রমাণুসার ধারাবাহিকতায় পাঠকের কাছে মূল্যায়নের সময়কাল বিচারে হয়তো আরো সহজ হত । আসলে ‘উজ্জ্বল উদ্ধার’ নামক অংশটি প্রথম পেশ করাটা তার শব্দবন্ধ বলে দেয় সেই কথা । কিন্তু তা হয়নি । আর একটি কথা । প্রতিটি নিবন্ধের লেখক পরিচিতির উল্লেখ নেই বইটিতে যা বর্তমান প্রজন্মের পাঠকদের জন্য অত্যন্ত প্রয়োজন ছিল । আরো একটি কথা । বইটিতে অরবিন্দের একটি ইংরাজি কবিতা সহ মোট আটটি ইংরাজি লেখা রয়েছে যার অনুবাদ পাশাপাশি থাকলে সাধারণ পাঠক আরো সমৃদ্ধ হতে পারতো । তবুও সামগ্রিকভাবে বইটি থেকে পাঠক মধুকবি-চর্চায় নিবিষ্ট হতে পারবে ।
দ্বিশতবর্ষে মাইকেল মধুসূদন
(কলকাতা পুরশ্রী বিশেষ সংখ্যা)
কলকাতা পুরসভা