পাঠক মিত্র
সমকালীন সমাজ ও সাহিত্যের এক আকর গ্রন্থ
সাহিত্য সমাজের আয়না-এ কথাটা নিয়ে নানাভাবে নানা সময়ে যে কোন সাহিত্য সভায় আলোচনা হয়ে থাকে । আর সেই আয়নায় ধরা পড়ে তার সমকালীন সময় । অর্থাত লেখক তাঁর সমকালীন সময় ও সমাজকে সাহিত্যের ঘরে বন্দী করে আগামী সময়ের কাছে সেতু হিসেবে পরিচিত দিতে । সময়ের আলো আর অন্ধকারে সমাজের সম্পৃক্ত ছবির উপস্থিতি সাহিত্যে হাজির থাকে । এই ছবি যে কোন সময়ের পাঠককে সমৃদ্ধ করে । পাঠক সমৃদ্ধ লাভ করে তার পড়ার আনন্দ নিয়ে । যদিও সাহিত্য-পড়া নিছক আনন্দ নয় । তবে ‘রিডিং ফর প্লীজার’ কথাটা সাহিত্যের ক্ষেত্রে শেষ কথা নয় ।
‘সাহিত্য সমাজের উপরিকাঠামো’ মার্ক্সের এই কথা ধরে বলা যায় যে এই কাঠামো গড়ে ওঠার ভিত্তি সাহিত্যের রসে ডুবে থাকলে তার প্রকৃত রূপ ধরা যেতে পারে । সেই রূপের অনুধাবনে সাহিত্য চর্চা শুধু সময়ের প্রতিবিম্বে মুগ্ধ করে না, তার গভীরে আরো কিছু খুঁজতে সাহায্য করে । ‘আরো কিছু’ শব্দবন্ধ নিয়ে অনেক কথাই বলা যায় বা বলার থাকে । কিন্তু এই শব্দবন্ধ সাহিত্য চর্চার পথে না থাকলে সময়ের প্রকৃত ধারাপাতে সমাজ অচেনা হয়ে পড়ার আশঙ্কা প্রকট হয়ে ওঠে ।
এমনই আশঙ্কার প্রতিফলন পড়েছে ‘সমকাল: সাহিত্য ও সমাজ’ নামক প্রবন্ধ গ্রন্থে । সাহিত্যতাত্বিক ও প্রাবন্ধিক তপোধীর ভট্টাচার্য তাঁর সতেরোটি নিবন্ধের সংকলনের এই গ্রন্থে সমকালীন সময়ের স্বর ও অন্তস্বরকে নানা আঙ্গিকে বিশ্লেষণ করেছেন । তিনি সময়কেই প্রকৃত স্রষ্টা বলেছেন, কবি ও লেখক হল তার অনুলেখক বা সূত্রধর মাত্র । কিন্তু একুশ শতকের প্রারম্ভিক দু’দশকে সেই অনুলেখকদের সূত্রধরদের যেন তিনি খুঁজে পাচ্ছেন না । এই দু’দশক পরে তিনি অনুভব করছেন অতি দ্রুত গতিতে চেনা পৃথিবী কেমন অচেনা হয়ে পড়ছে । ঘৃণা-বিদ্বষ-আক্রোশের আগ্রাসনে সমাজ যেন আজ জতুগৃহ । জাতিসত্তার স্বাতন্ত্রবোধ এবং জীবন-যাপনের অনন্যতা নিশ্চিহ্ন হয়ে যাচ্ছে সমাজের বিস্তীর্ণ চোরাবালিতে । যে চোরাবালিত দেশ হয়েছে টুকরো টুকরো । টুকরো দেশে জাত-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে হারিয়ে যাচ্ছে বাঙালি সত্তা । অথচ এই সময়ের অনুলেখকদের চোখে পড়ছে না সামাজিক অবক্ষয়ের প্রকৃত সূত্র । নাকি লেখকগণ নিজেদের চোখে নিজেরাই ঠুলি পরে আছে । এ সম্পর্কে প্রাবন্ধিক শ্রী ভট্টাচার্য বলছেন, ‘ বিনা পরিশ্রমে শিরোমণি হয়ে ওঠার সাধ লালন করি বলে লেখা-লেখা খেলায় বুঁদ হয়ে থাকি । ..কি চাই লেখার মধ্য দিয়ে, নিজের কাছে তা স্পষ্ট হয় না । আত্মপ্রতারণার মাদক আচ্ছন্ন করে রাখে সকাল সন্ধ্যা ।’ প্রাবন্ধিক আরো বলেন ‘পণ্যায়নের কুযুক্তিশৃঙ্খলায় বন্দী হয়ে যান সেইসব লিখিয়েরা, একদা যাঁরা বলেছিলেন প্রতিবাদ ও প্রতিরোধের কথা, বলেছিলেন বিকল্প চেতনা বিকল্প নন্দন বিকল্প বয়নের কথা । বড় কিছু পাওয়ার জন্যে স্খলন ঘটে না ।’ এইসব লেখকদের সম্পর্কে তার পরেই বলছেন, ‘সাধারণত টুকিটাকি লাভ, নগদ বিদায়ের আকাঙ্খা, যূথবদ্ধতার নিরাপত্তা–এইসব এত বেশি চোখে পড়ে যে ‘দ্রষ্টা চক্ষু’র উদ্ভাসনের জন্যে দীর্ঘ প্রস্তুতি, তিতিক্ষা ও ধৈর্য সম্পর্কে অনীহা ক্রমশ প্রবলতর হয়ে ওঠে ।’ শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের কথায় প্রাবন্ধিক মনে করিয়ে দিয়েছেন, এ বড় সুখের কথা নয় এ বড় আনন্দের সময় নয় । চারপাশকে দেখে নেওয়ার জন্য যতখানি শক্তি অর্জন করা আবশ্যিক, আজ এই সময়ের লেখায় তা জেগে ওঠে না । অথচ সুবিমল মিশ্রর লিখনপ্রণালীর মত লেখা হওয়া উচিত বলে প্রাবন্ধিক উল্লেখ করেছেন । শ্রীযুক্ত মিশ্রর ভাষায় বলেছেন ‘নাঙা হাড় জেগে উঠেছে’, যে বার্তায় লেখা শক্তিশালী হাতুড়ির বিকল্প যা-দিয়ে অচলায়তনের পাথুরে দেওয়াল ভেঙে ফেলা যায় ।’ কিন্তু প্রাতিষ্ঠানিক সাহিত্যে এমন ঘটনা ঘটতে পারে না । প্রাবন্ধিক বলছেন, ‘প্রাতিষ্ঠানিক সাহিত্যে মলাট পাল্টে যায় মুহুর্মূহ কিন্তু ভেতরের শাঁস বা শাঁসহীনতা একই থেকে যায় । ভেতরের এই শাঁসাভাসে যত পচন ধরতে থাকে, বাইরের মলাটে তত জটিল রঙ আর দামি এসেন্স যুক্ত হয় ।’ এই পচন ভয়ানকভাবে সংক্রামক বলে উল্লেখ করেছেন প্রাবন্ধিক । তিনি আরো বলেন, প্রাতিষ্ঠানিক সাহিত্য কর্মের বিপরীতে যাঁরা স্পন্দনময় জীবনের পক্ষে দাঁড়িয়েছেন, পণ্যায়নের সুবিধাবাদ প্রত্যাখান করে আত্মখনন করে লেখা আবিষ্কার করেছেন–এমনকি তাঁদেরও বাণপ্রস্থকালীন সময়ে এসে স্খলন হতে পারে ।’ এমন এক লেখকের স্খলন প্রাবন্ধিক উল্লেখ করেছেন তাঁর নাম নিয়েই । যিনি পণ্যায়নের বিধিবিধান মেনে নিয়েছেন অনায়াসেই । শুধু এই লেখক নন, আজ বহু লিখিয়েরা সেই পথেই । তাঁদের সম্পর্কে প্রাবন্ধিক ভট্টাচার্য বলেন, ‘বস্তুত ঠগ বাছতে গাঁ উজাড় হয়ে যাবে ।’ লেখকদের এমন অবস্থা, তাঁরা সময়ের ফাঁদে শিকার । এ ব্যাপারে বাঙালি লেখকদের সম্পর্কে শ্রী ভট্টাচার্য বিশেষভাবে বলেছেন, ‘ ভারতীয় উপমহাদেশ যখন তার সমস্ত সামন্ততান্ত্রিক পিছুটান ও আধা-ঔপনিবেশিক প্রাপ্তির লোভ নিয়ে পুঁজিবাদীর রূপান্তরের গন্তব্যহীন যাত্রায় প্ররোচিত হচ্ছে—তখন বাঙালি লিখিয়েদের কাছে অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠেছে প্রতাপের স্নেহধন্য হওয়ার বাসনা ।’ এ বাসনায় ‘লুপ্ত মানুষ খুঁজবার কোলাহল’ নেই প্রাতিষ্ঠানিক সাহিত্যে । মাসুদ খানের ‘টানেল’ কবিতার লাইন উল্লেখ করে প্রাবন্ধিক ভট্টাচার্য লেখার গৌরব সম্পর্কে নতুন করে অবহিত করার সংকেত দিয়েছেন । সেই সংকেতে সুবিমল মিশ্রর কথা দিয়ে ব্যক্ত করেছেন, লেখা একপ্রকার গেরিলাযুদ্ধ । সাহিত্যের ছদ্মবেশে আবৃত উৎপীড়ক প্রতিষ্ঠানিকতা, অবক্ষয় ও বিকারের বিপক্ষে যে যুদ্ধ স্থিতবস্থার শৃঙ্খলকে পোক্ত করার আয়োজনকে ভাঙতে পারে । যে যুদ্ধে মনুষ্যত্বের অভিজ্ঞানের অট্টালিকা গড়ে ওঠে । যেখানে ভেড়ার পালে মিশে না গিয়ে মেরুদণ্ডী মানুষের অবস্থান জেগে থাকে । তেমনভাবে জেগে ওঠার নামই লেখা বলে প্রাবন্ধিক বলেছেন ।
এমনই লেখা কবি শঙ্খ ঘোষ জীবনের শেষদিন পর্যন্ত লিখেছেন । তিনিই ‘বাঙালির শেষ বাতিঘর’ বলে বলেছেন তিনি। সত্যিই। এই নামাঙ্কিত নিবন্ধের কথাই বলতে হয়– এ মানুষটি উদ্ধত শাসকের আস্ফালনে অন্য অনেক সুযোগসন্ধানীর মতো প্রতাপের কাছে নতজানু হননি । জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত। এ সম্পর্কে বলতে গেলে তাঁরই কাব্যগ্রন্থ জুড়ে কয়েকটি লাইন বলতে হয় । ‘যমুনাবতীর চুল্লি এখনো নিভন্ত/ বাবরের প্রার্থনা জেগে আছে আজও /হাওয়ার স্রোতে জেগে উঠেছে সবই/নিজের মত গুছিয়ে নিতে ব্যস্ত কেউ/তাঁরা জানে কোথায় কখন ওঠে ঢেউ /সেইমত বাঁকায় তাঁদের শিরদাঁড়া /বাঁকেনি তোমার মেরুদণ্ড সেই স্রোতে/স্থির, নিস্তব্ধ অথচ ভাষা তার দৃঢ়/অন্ধবিলাপ ধুম তোলে হৃৎকমলে/বর্ম খুঁজেছে নিহিত পাতাল ছায়ায় /পিশাচ পোশাক খুলে মানব শরীর /অনায়াসে তোলে পাঁজরে দাঁড়ের শব্দ ।’
নিবন্ধটির শেষ লাইনে প্রাবন্ধিক ভট্টাচার্য বলেছেন, ‘দৈনন্দিন মিথ্যাচার যখন সমাজ-মনকে কলুষিত, নিঃশীল ও নিঃসাড় করে দিচ্ছে, কবি শঙ্খ ঘোষের যাবতীয় সৃষ্টিভুবনে আমরা খুঁজে নেব অনুভূতিপ্রদেশের গভীর থেকে উৎসারিত আলো । সংকটকালে, শঙ্খ বারবার দেখিয়েছেন, এই আলোর প্রত্যয়ই হল মনুষ্যত্বের স্পষ্টতম ঘোষণা ।’
মনুষ্যত্বের স্পষ্টতম ঘোষণার অনুসন্ধানে প্রাবন্ধিকের নিবন্ধে সাহিত্যপরিক্রমা লেখক ও সচেতন পাঠকের কাছে একটা বিশেষ আবেদন । গালিব থেকে দেশভাগ ও পরবর্তী সময় এবং এ পর্যন্ত সময়ের সাহিত্য ও শিল্পে এই পরিক্রমা । এক একটি নিবন্ধে তাঁর যুক্তিনিষ্ঠ বিশ্লেষণ পাঠকের সাহিত্য ক্ষুধা না বাড়িয়ে পারে না । বিশেষ করে দেশভাগ পরবর্তী সময়ের কথা । এ সময়ের কথা প্রসঙ্গে তিনি ঋত্বিক ঘটকের প্রসঙ্গ যেমন এনেছেন, তেমন নকশাল আন্দোলনের কথা বলেছেন । ঋত্বিক ঘটক শিল্পকলার প্রাতিষ্ঠানিকতাকে মাড়িয়েছেন বলে তিনি বাংলা চলচ্চিত্রে বহিরাগত হয়েছেন । দেশভাগে ছিন্নমূল মানুষ বিশেষত বাঙালিদের জন্য তাঁর চলচ্চিত্রের নন্দনতত্ত্বে মানবিক সংবেদনা তথাকথিত চলচ্চিত্র বোদ্ধারা মূল্যবান শিল্প বলে মনে করেনি । এ কথার সাথে প্রাবন্ধিক একটি মূল্যবান কথা বলেছেন যে দেশভাগের দুঃসময়ে রবীন্দ্রনাথ-নেতাজী-নজরুল কেউই ছিলেন না । যাঁরা মানুষের জয়গান গেয়েছেন । কিন্তু ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শক্তির চতুর স্বার্থের কাছে এঁদের কথা মনে রাখেনি স্বাধীনতা গ্রহীতারা । বাঙালি ভাগ হয়ে গেল হিন্দু আর মুসলমানে । সাম্প্রদায়িকতার দূষণে ভাষাভিত্তিক জাতীয়তা ভুলেছে দুজনেই । পরবর্তী মুক্ত বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্পে মৌলবাদীদের অন্ধত্বে বাঙালি জাতীয়তাবাদের সামাজিক-সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক কর্মকান্ডে নেমে এসেছে অন্ধকার বঙ্গবন্ধুর নৃশংস হত্যায় । অথচ মুক্তিযুদ্ধের মূল্যবোধে বাংলাদেশের অভ্যুদয়ে সাহিত্য সংস্কৃতি বিকশিত হয়েছে, কলুষমুক্ত হয়েছে । আজ বাঙালির সেই সংস্কৃতি আঞ্চলিক আধিপত্যবাদ ও আন্তর্জাতিক নয়া-উপনিবেশবাদে আক্রান্ত । এমনকি এ দেশেও বাংলাভাষীরা খোদ রাষ্ট্রযন্ত্র ও আঞ্চলিক প্রভুত্ববাদে একপ্রান্তে যখন বেপরোয়াভাবে আক্রান্ত হয় আর একপ্রান্তের বাংলাভাষী থাকে নিঃশব্দ । এই সময়ে প্রাবন্ধিক ভট্টাচার্যের ঋত্বিক ঘটককে নতুন করে মনে পড়ছে । বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের মূল্যবোধের চর্চা যা বাংলাভাষার জন্য আন্দোলনের উপর দাঁড়িয়ে । ‘কালের প্রবাহে বাংলাদেশ ও বঙ্গবন্ধু’ এবং ‘ মুক্ত বাংলাদেশ: দর্পণে পঞ্চাশ বছর’ নিবন্ধ দুটির আলোচনায় বাঙালি-সত্তার অন্ধকার অধ্যায় থেকে বিকশিত করা এখনো সম্ভব বলে মনে করেন শ্রী ভট্টাচার্য । বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষে চাই বাঙালির আত্মনিরীক্ষা । সেই আত্মনিরীক্ষা না হলে বিশ্বপুঁজিবাদের লোলুপ আগ্রাসনে বাঙালি সত্তার ঐক্যবদ্ধ থাকা সম্ভব হবে না । শুধু তাই নয় গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র-সমাজ-প্রশাসন সুপ্রতিষ্ঠিত হওয়ার নামে সামন্ততান্ত্রিক অন্ধকার প্রসারিত হবে দ্রুত। যেখানে প্রাতিষ্ঠানিকতার কাছে বিভিন্ন ক্ষেত্রে তথাকথিত নামিদামি বলে পরিচিত মানুষজন নতজানু হয়ে পড়ে ব্যক্তিগত স্বার্থে । শঙ্খ ঘোষ, ঋত্বিক ঘটকের মত মানুষরা এ সময়ে এর ঊর্ধ্বে থেকেছেন । এমনকি কবি জীবনানন্দ দাশ তথাকথিত সাহিত্যের প্রাতিষ্ঠানিকতাকে গুরুত্ব দেননি বলে তাঁর সময়ে তিনিও ব্রাত্য ছিলেন । রূপসী বাংলা’র কবি, ধূসরতা’র কবি, মৃত্যুচেতনার কবি, বিষন্নতার কবি ইত্যাদি আখ্যানে ভূষিত হয়েছেন । কিন্তু কবি ইতিহাস চেতনার, সমাজ ও সময়চেতনার ও জীবনবোধেরও কবি । ‘কালবেলার কবিতা’য় জীবনানন্দ’ নিবন্ধটি রূপসী বাংলা’র কবির সময়কে এক বিশিষ্ট রূপ ও সত্তায় পরিবেশিত করে পাঠককে অবশ্যই সমৃদ্ধ করবে । কবি জীবনানন্দ শুধু রূপসী বাংলা’র রূপ দেখেননি । তিনি দেখেছেন মানুষ ও পৃথিবীর সংকট । নিবন্ধটিতে তাঁর ‘অদ্ভুত এক আঁধার’ কবিতাটির উল্লেখ না থাকলেও। আজকের সময় সত্যিই এক আঁধার । একুশ শতকের প্রথম দুই দশকে শুধু এ দেশ নয় পৃথিবীজুড়ে মানবসত্তা উন্মূল ও উৎকেন্দ্রিক । যার মূলে একদিকে আধিপত্যবাদী সাংস্কৃতিক রাজনীতির বিশ্বায়িত প্রক্রিয়া যা ভোগবাদের মাদক কুহকে জাতিগত, ভাষাগত, অঞ্চলগত অনন্যতাকে মুছে ফেলছে । আর একদিকে যন্ত্রপ্রযুক্তির বেড়াজালের আধিপত্যবাদে মূল্যবোধ বিপন্ন, মানবসমাজ বিপন্ন । রাষ্ট্রযন্ত্রের তদারকিতে পৃথিবী আজ বিপন্ন। প্রাবন্ধিক ‘বিপন্ন পৃথিবী: যন্ত্রপ্রযুক্তি: মূল্যবোধ: মানবসমাজ’ নিবন্ধে পৃথিবীর বিপন্নতা সম্পর্কে একটি চমৎকার শব্দ উল্লেখ করেছেন । তা হল ‘মাফিয়া পুঁজি’ । এ সময়ের অত্যন্ত উপযোগী শব্দ । পৃথিবী বিপন্ন হওয়ার কারণ বিশ্লেষণে একটি শব্দই যথেষ্ট ।
পৃথিবী বিপন্নতা রুখতে বিশ্বপুঁজিবাদের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ প্রতিবাদ, প্রতিরোধ প্রয়োজন । মূল্যবোধ ও ভাবাদর্শের আয়ুধ নিয়ে গ্রেটা থুনবার্গের সাথে নিরস্ত্র যুদ্ধের শরিক হতে পারলে বাসযোগ্য পৃথিবীকে রক্ষা করা যেতে পারে বলে প্রশ্ন রেখেছেন প্রাবন্ধিক। কিন্তু বিশ্বপুঁজি, মাফিয়া-পুঁজি র কাছে মূল্যবোধ ও ভাবাদর্শ মূল্যহীন । এদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে প্রতিরোধ করে দেখিয়েছেন একমাত্র রাশিয়ার লেনিন নভেম্বর বিপ্লবের মধ্য দিয়ে।
প্রাবন্ধিক তাঁর ‘বসন্তের বজ্রনির্ঘোষ: পুনরবলোকন’ নিবন্ধে একশ বছর আগে রাশিয়ায় সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের কথা উল্লেখ করেছেন । এর পাশাপাশি উল্লেখ করেছেন এ দেশের নকশালবাড়ি আন্দোলন । রাষ্ট্রযন্ত্রের বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রাম । দু’টি সংগ্রামের তুলনামূলক আলোচনা চলতে পারে । কিন্তু তুল্য বিচার করা যায় কিনা তা নিয়ে তর্ক থাকুক । রাশিয়ার মানুষকে লেনিন বিপ্লবী চেতনার স্তরে নিয়ে যেতে পেরেছিল । তা সম্ভব হয়েছিল মার্ক্সের পথ নির্দেশে ও তার সঠিক প্রয়োগে লেনিনের সঠিক নেতৃত্বে । এ দেশে নকশালবাড়ী আন্দোলনসহ স্বাধীনতা পরবর্তী গণ আন্দোলন যা গড়ে উঠেছিল তার সমস্ত কি সেই বিপ্লবী চেতনায় ? তবুও সেই সময় শ্রেণী সংগ্রামের হাতিয়ার হিসাবে সাহিত্যের আঙিনায় ব্যক্ত হয়েছে । যার অজস্র উদাহরণ দিয়ে প্রাবন্ধিক দেখিয়েছেন। কিন্তু আজ যখন নিপীড়ক রাষ্ট্রীয় প্রতাপের হিংস্রতায় মানুষ কোণঠাসা, তখন সঠিক বিপ্লবী চেতনা নিয়ে রাজনৈতিক দৈনতা এখনও কাটেনি । এমনকি সাহিত্যেও আজ তার দৈনতা । একসময় স্বাধীনতা আন্দোলনে বিপ্লবীদের উদ্বুদ্ধ করেছিল সাহিত্য । আজকের পরিবর্তিত বিশ্ব-পরিস্থিতিতে তার অভাব আরো প্রকট হয়ে পড়ছে । অথচ পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে শত্রুপক্ষের চক্রব্যূহ আজ দুর্ভেদতর বলে প্রাবন্ধিক উল্লেখ করেছেন । এবং তা ঠিকই । বিপ্লবের পথেই তাকে প্রতিহত করতে হবে । তাই তিনি বলছেন ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্রশক্তির আক্রমণ সম্পর্কে সচেতনতা না জাগালে বিপ্লবী চেতনার পথ অর্জন দুরূহতর হবে । বিপ্লবী চেতনার এখন একমাত্র পথ মার্ক্সবাদ-লেনিনবাদ ।এই মার্ক্সবাদ-লেনিনবাদ ধনতান্ত্রিক মৌলবাদ নয় ।নতুনভাবে রূপান্তরপ্রবণ সময়ের তালে-লয়ে সম্পৃক্ত প্রয়োগ চান প্রাবন্ধিক । কিন্তু তা বিজ্ঞানভিত্তিক প্রয়োগ হতে হবে । আর সেজন্য চাই সঠিক রাজনৈতিক নেতৃত্ব । প্রতিটি মুহূর্তে তাকে টিকিয়ে রাখার লড়াইও প্রয়োজন হবে । ইতিহাস তাই শিক্ষা দেয়। রাজনৈতিক সত্যের বিপ্লবী অন্তর্বস্তু পুনরবলোকনে উদ্ভাসিত হোক বলে প্রাবন্ধিক বলেছেন ।
তবে প্রাবন্ধিকের পুনরবলোকনে দেশভাগের রাজনৈতিক চক্রান্তের সত্যতায় সবচেয়ে বিপন্ন জাতি বাঙালী । বিপন্ন তার বাঙালি সত্তা । এই বিপন্নতার সত্যতা নিয়ে বাঙালি বুদ্ধিজীবীদের অধিকাংশই ধর্মীয় অনুষঙ্গর বাইরে বের হতে পারে নি বলেই প্রাবন্ধিক মত প্রকাশ করেছেন। বাঙালি জাতি, বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতি বিভিন্ন ধর্ম ও সম্প্রদায়ের সম্মিলিত ও নিরবিচ্ছিন অবদানের ফসল এ কথাটা মুখে বললেও অন্তরে অনেকেই স্বীকার করেন না । বৈষয়িক স্বার্থে সামাজিক ও রাজনৈতিক স্তরে নিতান্ত সুবিধাবাদী অবস্থান নিয়ে বাঙালির বিভিন্ন গোষ্ঠী বারবার মিলনের আসল সত্যটা অস্বীকার করেছে । ফলে দ্বিজাতিতত্ত্বে ক্ষমতালোভী রাজনৈতিক নেতৃত্বের হাতিয়ারে দেশভাগ ও বাংলাভাগে বাঙালি বিচ্ছিন ভাগে বিভক্ত হয়েছে । বাঙালি বুদ্ধিজীবীরা কোথাও নির্লীপ্ত ও উদাসীন থেকেছে আবার কেউ প্রচ্ছন্ন সাম্প্রদায়িক মনোভঙ্গির শিকার হয়েছেন । মুক্তচিন্তার অগ্রদূত নেতাজির বিশ্ববীক্ষাকে কোন দিক থেকেই কেউ বুঝতে চায় নি । চরম বিশ্বাসঘাতকতার শিকার হলেও বাঙালি নির্লিপ্ত থেকেছে । পরবর্তী সময়ে মুজিবর রহমানও চরম বিশ্বাসঘাতকতার শিকার হয়েছেন । বাঙালি সত্তা নির্লিপ্ত তখনও । আজ এ দেশে বেপরোয়া দক্ষিণপন্থী অভ্যুত্থানের অভিঘাতে সময়-পরীক্ষিত ভাবাদর্শ অবান্তর বালির বাঁধে রূপান্তরিত হচ্ছে । প্রাবন্ধিক বলছেন, হিন্দুস্থানীভূত ভারতে ছন্নছাড়া বাঙালিরা রামায়ণের মারীচের মতো রাম ও রাবণের মধ্যে ত্রিশঙ্কুর মতো দোদুল্যমান । এমতাবস্থায় ২০২২ সাল এক ক্রান্তিকাল যেখানে বিধ্বংসী চেহারা ও চরিত্র নিয়ে বাংলাভাষীর বিরুদ্ধে ঘৃণা ও বিদ্বেষে শুধু আসামে নয়, সারা দেশজুড়ে তার মৃত্যুশিবির তৈরির চেষ্টা চলছে । অথচ বাঙালিদের বড় অংশ আজ ধর্মীয় মৌলবাদের শিকারে পরিণত হয়েছে । এমন অবস্থায় আমাদের মধ্যে কোন দেশবন্ধু নেই, নেতাজী নেই, বঙ্গবন্ধু নেই । এমনকি কোন রবীন্দ্রনাথ নেই, নজরুল নেই । অথচ কবির শরণে পুনরায় জাগতে পারি । ‘সাহিত্য আমাদের ওষধি’ সংকলনের প্রথম নিবন্ধের প্রথম লাইনে প্রাবন্ধিক কবির কথা দিয়ে জেগে ওঠার সংকেত দিয়েছেন– ‘তোমার কাছে এ বর মাগি, মরণ হতে যেন জাগি গানের সুরে’ । ‘বাঙালির সত্তা: নিজেরে হারায়ে খুঁজি’ শেষ নিবন্ধে প্রাবন্ধিক বাঙালি সত্তার ওষধি হিসেবে উল্লেখ করেছেন রবীন্দ্রনাথ ও নজরুল নিঃসৃত বাক্য । যে ওষধি ‘হিন্দু না ওরা মুসলিম’-এ প্রশ্নে নয়, খাঁটি বাঙালি হয়ে মানববিশ্বের শরিক হতে এগিয়ে নিয়ে যাবে ।
প্রাবন্ধিক শ্রী ভট্টাচার্য তাঁর নিবন্ধের এই সংকলন গ্রন্থ সমকাল সাহিত্য ও সমাজের নানা স্বর ও তার অন্তস্বরকে বিশ্লেষণে সামাজিক- সাংস্কৃতিক-মানবিক বিষয়ে নানা প্রশ্ন তুলে পাঠকের চেতনাকে নাড়া না দিয়ে পারে না । তবে এ সংকলন একপ্রকার সময়ের পথে সাহিত্য ও সমাজ বিষয়ক আকর গ্রন্থ হিসেবে বিবেচিত হতে পারে ।
সমকালঃ সাহিত্য ও সমাজ
–তপোধীর ভট্টাচার্য
নবজাতক প্রকাশন,
কলকাতা–৭