পাঠক মিত্র

রহস্যের ঘেরাটোপ অতিক্রম করানোর যাদু

কাহিনী নানা শাখা-প্রশাখা পথে বিচরণ করে । আর সেই পথ যখন প্রকৃতি, ইতিহাস, মিথ আর বিজ্ঞানের মেলবন্ধনে কল্পনার ভুবনকে সমৃদ্ধ করে, তখন সেই কাহিনীর একটা আলাদা আকর্ষণ তৈরি হয় । তেমনই আকর্ষণের এক ক্ষেত্র গড়ে তুলেছেন কাহিনীকার পুষ্পেন মন্ডল তাঁর ‘কাবাক্রব্যাদ’ বইয়ে । দুটি কাহিনী নিয়ে এই বই । বইয়ের নামেই এক কাহিনী । আর একটি ‘ভয়াল রাক্ষসতাল ‘ । 

‘কাবাক্রব্যাদ’ নামের রূপে যেন লুকিয়ে আছে এক রহস্য । এই রহস্যঘিরে রোমাঞ্চকর পথ চলার কাহিনী ‘কাবাক্রব্যাদ’ । দু’হাজার বছর আগের এক ঘটনা দিয়ে কাহিনীর বিস্তার । মৌর্য আমলের ইতিহাসের স্পর্শ দিয়ে কাহিনীর অলৌকিক রূপকে এক রোমাঞ্চকর পথে এগিয়ে নিয়ে যেতে কাহিনীকারের মুন্সিয়ানা অবশ্যই প্রশংসার দাবি রাখে ।

‘কাবাক্রব্যাদ’ এক মূর্তি । শুধু মূর্তি নয় । আজীবীকদের উপাস্য দেবতা । এই দেবতাকে জাগিয়ে তোলা যায় চন্দ্রগ্রহণে । এই দেবতার উপাসনায় এক আজীবীক তন্ত্রসাধক জিগাসু এমন শক্তি অর্জন করেছিল, যার সেই পরাক্রম শক্তি সম্রাট অশোকের কপালে দুশ্চিন্তার ভাঁজ ফেলে দিয়েছিল । এই দেবতার মূর্তি ধ্বংস হলে জিগাসুর ক্ষমতা ধ্বংস । কিন্তু সেই মূর্তির খোঁজ তাঁর একার পক্ষে সম্ভব হয়নি । ভাতৃঘাতী সম্রাট অশোকের এক ভাই বীতশোক তার যাত্রাপথে জিগাসুর হাতে বন্দী হলেও সে তার শেষ শক্তি দিয়ে লড়ে যায় । সেই লড়াইয়ে জিগাসুর হাতে বীতশোকের মৃত্যু ঘটে । কিন্তু জিগাসুকে লক্ষ্য করে বীতশোকের ছোঁড়া বর্শায় কাবাক্রব্যাদ মূর্তির মুন্ডচ্ছেদ হয়ে যায় ।

দীর্ঘ দু’হাজার বছর আগের চাপা পড়া এই ইতিহাস ব্রিটিশ প্রত্নতাত্ত্বিকের সংগ্রহ চলে আসে ছাপড়ার রাজপরিবারে । আবার পরে তা চলে আসে এই সময়ে মাফিয়াচক্রের হাতে । কাবাক্রব্যাদের মাধ্যমে অলৌকিক শক্তির অধিকার অর্জন করার বাসনা ছড়িয়ে পড়ে ছাপড়ার রাজবাড়ির প্রাচীন সম্পদের সাথে ব্রাহ্মলিপিতে লেখা একটি কাগজের টুকরো টুকরো অংশ থেকে যার একটি অংশ রাজস্থানের শেখওয়াতের হাতে আর একটি অংশ মুম্বইয়ের চৌহানের কাছে । ধূর্ত শেখওয়াত এই ব্রাহ্মলিপি উদ্ধারে পৃথিবীর নানা দেশের ইতিহাসবিদের সাহায্য নিয়ে তাঁদেরকে খুন করে দিলেও তার নাম উঠে আসেনি । চৌহান খুনের কিনারায় অবশেষে ধরা পড়ে সে । 

চৌহান খুনের সাথে জড়িয়ে পড়ে কলকাতার ইতিহাসের অধ্যাপক ও গবেষক রাতুলের নাম । তাঁর একসময়ের স্কুলের বন্ধু অনিমেষের মাধ্যমে চৌহানের হাতে থাকা ব্রাহ্মলিপিতে লেখা টুকরো কাগজের লেখার অর্থ উদ্ধার করার অনুরোধ ও সেই কাজের জন্য অনুসন্ধানের তথ্যে তাঁর নাম স্বাভাবিকভাবে চলে তদন্তকারীদের হাতে ।  

দু’হাজার বছরের এই কাহিনীর সচলতা ইতিহাসের বর্ণনায় যেমন সমৃদ্ধ হয়েছে, তেমন কলকাতার ইতিহাসের অধ্যাপক রাতুলের হাত ধরে পাটনা, বেনারস, রাজস্থান, মুম্বই থেকে রতনলালের দূরদর্শিতা কাহিনীকারের ক্যানভাসে এমনভাবে ফুটে উঠেছে যেখানে পাঠকের কল্পনায় কখনোই কাল্পনিক বলে মনে হবে না । 

‘ভয়াল রাক্ষসতাল’ নামই বলে দেয় ভয়ের কথা । এই ভয় যেমন তার পথে তেমন আবার তার বাসিন্দার থেকে । তাই হয়তো নাম রাক্ষসতাল । তবে এই পথ তিব্বত যাওয়ার পথে লিপুলা-পাস থেকে সোজা গেলে মানস সরোবর, আর বাঁয়ে গেলে রাক্ষসতাল । ভৌগলিক পরিক্রমার এক রোমাঞ্চকর পথের কাহিনী । সেই পথে ভৌগলিক ইতিহাসের বর্ণনার সাথে কাহিনীর পথচলা । 

রাক্ষসতালের নীচে এ পৃথিবীর মধ্যে আর এক পৃথিবী, আর এক জগৎ । যে জগতের সঙ্গে এ পৃথিবীর কোন সম্পর্ক নেই । যে পৃথিবীতে বাস করে ‘সিরিঞ্জু’ নামক এক গোষ্ঠী । যারা এই জগতের প্রহরী ।  এরা ভয়ঙ্কর।  এ জগতের সন্ধানে যারা আসে তারা কেউ প্রাণ নিয়ে ফিরে আসতে পারে না বলে বিশ্বাস । তবু অতি-উৎসাহী মানুষ কোনো তথ্য পেলে তার অনুসন্ধানে নেমে পড়ে । তাদের অনুসন্ধানের পথে জীবন সংকট জেনেও আবিষ্কারের আকাঙ্খায় সেই পথ থেকে ফেরার কথা বিসর্জন দেয় । 

এ কাহিনীর শুরু দুই হিমালয় পর্যটকের সঙ্গে হিমালয়ের কোলে ‘বনি’ নামক এক প্রান্তে পরিচয় ঘটে জীবনচন্দ্র দাস নামক এক অদ্ভূত কঠিন চেহারার মানুষের । এই কাহিনীর বিস্তার এই তিনজনের কথোপকথনে । সব কথাই জীবনবাবুর মুখ থেকে । কিভাবে তার জীবন থেকে মুছে গেছে পঞ্চাশ বছর সেই কাহিনী বলতে গিয়ে হিমালয়ের ইতিহাস থেকে তার গুপ্ত কথা থেকে উঠে এসেছে সিরিঞ্জুদের কাহিনী । সেই কাহিনী যাত্রায় জীবনবাবুর সঙ্গে পরিচয় ঘটে রাশিয়ান অধ্যাপক পেত্রোচিভের । তারপর আরো চারজন তাদের সঙ্গে যোগদান করে-ম্যাথু, জন, রিক আর ওলি । এক পর্বতারোহীর চিঠির বর্ণনা থেকে পৃথিবী সৃষ্টির পরেও কোন মিসিং লিঙ্ক থেকে যেতে পারে বলে তার যুক্তির মান্যতা স্বীকার করে জীবনবাবু । এভাবে তারা নানা দুর্গম পথ ও ঘটনার সম্মুখীন হয়ে এগোতে থাকে রাক্ষসতালের উদ্দেশ্যে । পথে ওলি, পেত্রোচিভকে হারায় অজ্ঞাত কারণে আর রকিকে হারায় তিব্বতি ডাকাতের হাতে । তবু হাল ছাড়েনি ম্যাথু, জন আর জীবনবাবু । নানা সঙ্কটপূর্ণ অবস্থার মধ্য দিয়ে রাক্ষসতাল হ্রদের নীচে যাওয়ার পথ খুঁজে পায় । এক সময়ের সন্ধিক্ষণে সেই পথে প্রবেশ করে তারা । সেই পথের নানা দুর্গম স্তর পার হয়ে অবশেষে সিরিঞ্জুদের মুখোমুখি হয়ে লড়াই চালিয়ে জনকে হারায় । তারপর এমন এক স্তরে পৌঁছে যায় যে ম্যাথু আর জীবনবাবুর কোন এক মায়াবলে নিজেদের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে যায় । এমনকি তারা পরস্পরের মধ্যে শব্দহীন কথায় বাক্যালাপ করে । অর্থাত শুধু মনের কথা বুঝতে পারছে অথচ বলতে পারছে না । এভাবে তারা পৌঁছে যায় সিরিঞ্জুদের অদৃশ্য পরিচালকের কাছে । । তার কাছেই ওলির সিরিঞ্জুদের সাথে মিশে যাওয়ার কাহিনী তাদের বোধগম্য হয় । জীবনবাবুর বাবার ইতিহাস জানতে পারে । 

জীবনবাবুর মুখে এ কাহিনীর পরিক্রমায় ভৌগলিক মানস দর্শনের সাথে মিথ ও বিজ্ঞানের মিশ্রণে যে কাল্পনিক পরিবেশ কাহিনীকার তৈরি করেছে তা পাঠকের যুক্তি চিন্তাকে আবেশিত না করে পারে না ।  

দুটি কাহিনীর উৎস লেখক দেখিয়েছেন লিপি থেকে । প্রথমটির ব্রাহ্মলিপি আর দ্বিতীয়টির সংস্কৃত।  আর এ কাহিনী দুটির রহস্যে আছে সময়ের বৈচিত্র্য । কাবাক্রব্যাদ জাগ্রত হয় চন্দ্রগ্রহণে । আর রাক্ষসতালের জল শুকিয়ে অন্য জগতের দ্বার খুলে যায় পূর্ণিমায় । দুটি কাহিনীর ভিন্ন রূপের পরতে পরতে রহস্যের ঘেরাটোপে পাঠককে রুদ্ধশ্বাসে অতিক্রম করানোই কাহিনীকারের কলমের যাদু ।

‘কাবাক্রব্যাদ’ 

পুষ্পেন মন্ডল 

একপর্ণিকা প্রকাশনী

ত্রিপুরা-৭৯৯১০৫  

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *