অমিতাভ সরকার

সারারাত জ্বলে সন্ধ্যা প্রদীপ

সঙ্গীতশিল্পী ও সুরকার শচীন গুপ্ত 

যে সময়ের কথা বলছি সেটা ১৯৫২ সাল। ‘চিত্রবাণী’ তখনকার একটি বিখ্যাত পত্রিকা। এই পত্রিকার তৎকালীন সম্পাদক ছিলেন গৌর চট্টোপাধ্যায়। 

১৯৫২ সালে এই ‘চিত্রবাণী’ পত্রিকার শারদ সংখ্যায় (আশ্বিন ১৩৫৯) সে যুগের নামকরা শিল্পীদের সাক্ষাৎকার নেওয়া হতো। তেমনই একটি সাক্ষাৎকারে তখনকার একজন বিশিষ্ট শিল্পীকে  প্রশ্ন করা হয়েছিল, একজন শিল্পীর মূল্য রেকর্ড কর্তৃপক্ষ কিভাবে নির্ধারণ করেন? শিল্পী অকপটে উত্তর দিয়েছিলেন, রেকর্ড কত বিক্রি হলো তার ওপর বিবেচনা করেই এটা নির্ধারণ করা হয়। অধ্যাবসায়, শিল্পীর নিজস্ব দক্ষতা, কণ্ঠ -ব্যাপারগুলো এখানে অনেকখানি গৌণ। যার গানের বিক্রি বেশি, ব্যবসার বাজারে তিনি গুণী শিল্পী। রেকর্ডের বাজারদরের সাফল্য দিয়েই শিল্পীর কৃতিত্ব বিচার করা হয়। কে কত ভালো গান গাইছেন, সে বিচার অনেক পরে। সত্তর বছরেরও আগের এই সাক্ষাৎকার পড়তে গিয়ে বারবার মনে হচ্ছে, সেদিনের ওইসব  কথাগুলো এখনকার বিচারেও আজ কতটা প্রাসঙ্গিক! আজ হয়তো রেকর্ড নেই, ক্যাসেটেও কেউ গান শোনেন না, তবুও সিডি, ইউটিউবের যুগে এত অগ্রগতির মধ্যে দাঁড়িয়ে আজকেও তো ওই ভাবেই একজন শিল্পীর বিচার করা হয়। যে শিল্পীর কথা বলতে চাইছি, তাঁর নাম শচীন গুপ্ত। আজকে এই নাম বললে মুষ্টিমেয় কিছু মানুষ ছাড়া কেউ তাঁকে চিনবেনই না। কিন্তু সেই সময় তিনি অত্যন্ত জনপ্রিয় একজন গুণী শিল্পী ছিলেন। 

শচীন গুপ্তের বিখ্যাত একটি  গানের কথা উল্লেখ করলাম! ’সারারাত জ্বলে সন্ধ্যা প্রদীপ’- এই গানটি তাঁকে রাতারাতি বিখ্যাত করে দেয়। এছাড়া ‘কেন খেলাছলে শুধু স্বর্গ গড়িতে চাওয়া’, ‘অবহেলা সে তো নয়’,’মরমি গো অনুপম’-গানগুলোও সে আমলে যথেষ্ট জনপ্রিয়তা লাভ করেছিল। মাত্র ৩৯ বছর বয়সের স্বল্প জীবনকাল না হলে শচীন গুপ্তের গানের সংখ্যা আরও অনেক বেশি হতো। কিন্তু এই অল্প দিনেও সঙ্গীত জগতে তিনি একজন দিকপাল মানুষ হয়ে উঠেছিলেন, নেপথ্য কণ্ঠদানের পাশাপাশি গানে সুরও দিয়েছেন। শচীন গুপ্তের সুরে সে যুগের খ্যাতনামা শিল্পীরা গান গেয়েছেন। এই বিস্তৃতপ্রায় শিল্পীর জীবন সম্পর্কে ওঁর নিজের কথা থেকেই যতটুকু জানতে পারা গেছে- তার ওপর ভিত্তি করেই তাঁকে নিয়ে সামান্য কিছু কথা লেখা গেল। এরকমও দেখা গেছে, সেযুগের শিল্পীরা তাঁদের জীবনের বিভিন্ন ঘটনা, রেকর্ডের সঠিক সন, তারিখ সম্বন্ধে ভুল তথ্য দিয়ে ফেলেছেন। ব্যাপারগুলো ইচ্ছাকৃত নয়, শিল্পীর নিজের ভুলে যাওয়ার ফলেই এগুলো নিয়ে বিভ্রান্তি তৈরি হতো। তবে শচীন গুপ্তর ক্ষেত্রে তাঁর দেওয়া তথ্যকেই সঠিক বলে ধরে নেওয়া হয়েছে। কারণ, ওঁর প্রথম রেকর্ড বেরিয়েছিল ১৯৪২ সালে। ‘চিত্রবাণী’-র জন্যে শচীন গুপ্ত সাক্ষাৎকার দিয়েছিলেন ১৯৫২ সালে। উনি নিশ্চয়ই মাত্র দশ বছর আগের ঘটনা বিষয়ে ভুল তথ্য দেবেন না- তাই ওঁরই সাক্ষাৎকারের ওপরে ভরসা করেই ওঁর সম্বন্ধে যা কিছু তথ্য লেখা সম্ভব হয়েছে, বাকি ভাবনাটুকু পাঠকদের হাতেই ছেড়ে দিলাম। 

শচীন গুপ্তর জন্ম ১৯২২ সালের ২৭শে মে কলকাতার ভবানীপুর অঞ্চলে। বাবা বিখ্যাত হোমিওপ্যাথি চিকিৎসক 

বিজয়কৃষ্ণ গুপ্ত, মা হিরণময়ী গুপ্ত। কাকা বিপিন গুপ্ত ছিলেন  সেযুগের বাংলা এবং হিন্দি চলচ্চিত্রের নামকরা অভিনেতা। আরেক কাকা বিমলকৃষ্ণ গুপ্ত ওস্তাদ ছোটে খাঁ, গৌরীশঙ্কর মিত্রের কাছে গান শিখতেন। বাবা চিকিৎসক হলেও সঙ্গীতের বিশিষ্ট অনুরাগী মানুষ ছিলেন। এই পারিবারিক সাঙ্গীতিক পরিমণ্ডলের ফলে খুব ছোট বয়স থেকেই ছোট্ট শচীনের সঙ্গীতের প্রতি অনুরাগ জন্মায়। বাবার কাছেই প্রথম গানের হাতেখড়ি। বাবার কাছে পাঁচ বছর বয়স থেকে তবলাবাদন থেকে শুরু করে দ্বিজেন্দ্রগীতি, রজনীকান্ত, অতুলপ্রসাদের গান এ সবই -শেখা চলতে থাকে। তাছাড়া নিজের কাকা বিমলকৃষ্ণ গুপ্ত তো ছিলেনই, এমনকি নগেন দত্ত, ওস্তাদ ছোটে খাঁর কাছেও শচীন গুপ্ত শাস্ত্রীয় উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের তালিম নেন। তবে তখন প্রতি রবিবার বেতারের শিক্ষার আসরে পঙ্কজকুমার মল্লিক যেসব আধুনিক গান, ভজন শেখাতেন সঙ্গীতের একজন পরম অনুরক্ত শিক্ষার্থী হিসেবে শচীন গুপ্ত নিবিষ্ট মনে সেগুলোও আত্মস্থ করে নিতেন। আধুনিক গানের পঙ্কজকুমার মল্লিককে শচীন গুপ্ত চিরকাল নিজের ‘সঙ্গীতগুরু’-র আসনে বসিয়েছেন। ওঁর পড়াশোনা পদ্মপুকুর ইনস্টিটিউশন স্কুলে, সেখান থেকেই উনি প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। পরে লেখাপড়াটাকে আরও বেশিদূর এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার আর সুযোগ হয়নি। গান ভালবাসতেন ঠিকই, কিন্তু গানটা যে ভবিষ্যতে তাঁর জীবিকা হয়ে উঠবে, সেটা কিন্তু কোনোদিন ভাবেননি। তবে এই পদ্মপুকুর ইনস্টিটিউশনে ছাত্র থাকাকালীনই আকাশবাণীর ‘নবাগতর আসর’-য়ে প্রথম গান গাওয়ার যোগ্যতা অর্জন করে সে যুগের হিসাবে ২ টাকা পারিশ্রমিক লাভ করেছিলেন। পরপর আরো ৪-৫ বছর আকাশবাণীর নিয়মিত সঙ্গীতশিল্পী ছিলেন। ১৯৪৫ বাদ দিয়ে(এই সময়ে আকাশবাণীর কর্মকর্তাদের সঙ্গে শচীন গুপ্তের কিছু মতান্তর হয়েছিল বলে ১৯৪৫ সালে আকাশবাণীতে কোনো গান গাননি।) ১৯৪৬ থেকে জীবনের শেষ দিন অবধি বেতারে গান গেয়ে গেছেন। সংসারের কারণে তাঁকে ১৯৪২ সালে মিলিটারি ইঞ্জিনিয়ারিং সার্ভিসে চাকরি নিতে হয়েছিল, পরবর্তী কালে ১৯৪৫ সালে ফোর্ট উইলিয়ামে এমইএস বিভাগে কাজ করলেও সঙ্গীতই ওঁর ধ্যানজ্ঞান হওয়ায় পরবর্তীকালে চাকরি ছেড়ে দেন। বিকেবি ইনস্টিটিউশনের বাণী বিদ্যাবীথি ছাড়াও ৩৬ ল্যান্ডসডাউন রোডের ভাড়াবাড়িতে শচীন গুপ্ত অনেককেই গান শিখিয়েছেন। তাঁর ছাত্রছাত্রীরা অনেকেই (নিখিল চট্টোপাধ্যায়, ধীরেন বসু প্রভৃতি) পরবর্তীকালে যশস্বী হয়েছেন। মহানায়ক উত্তমকুমার (তখন নাম ছিল অরুণকুমার চট্টোপাধ্যায়) একদা শচীন গুপ্তের কাছে গানের তালিম নিতেন। তখনও তিনি অভিনয় জীবনে সেভাবে নাম করেননি। তবে নিজের ক্ষেত্রে শচীন গুপ্ত রেকর্ড জগতে আসার জন্য তৎকালীন আরেকজন বিখ্যাত কণ্ঠশিল্পী সত্য চৌধুরীকে কৃতিত্ব দিয়েছেন। ১৯৪২ সালে এইচএমভিতে শচীন গুপ্তের প্রথম রেকর্ড বার হয় প্রণব রায়ের রচনা আর গোপেন মল্লিকের সুরে ‘তুমি কি উঠেছো চাঁদ’ গানটি। অপর পিঠের গানটি ছিল ‘ভুলে যেও শুধু ক্ষণিকের তরে’। তবে প্রথম রেকর্ডে কণ্ঠশিল্পী হিসেবে শচীন গুপ্তের নিজের নাম ছিল না। সোমক চন্দ্রের প্রদত্ত তথ্য অনুযায়ী রেকর্ডে শিল্পীর নাম দেওয়া ছিল প্রসাদ গুপ্ত। ১৯৪৬ সালে মেগাফোন কোম্পানির শারদ অর্ঘ্যে কিশোরী গঙ্গোপাধ্যায়ের লেখা আর বীরেন ভট্টাচার্যের সুরে শচীন গুপ্তের রেকর্ড বেরোয় ‘শুধু দুদিনের দেখা’, ‘বিরহে যে ব্যথা দিয়ে গেলে’- এবার কিন্তু স্বনামেই।

১৯৪৭ সালে শচীন গুপ্তের কণ্ঠে বেরোলো তড়িৎ কুমার ঘোষের কথা, বীরেন ভট্টাচার্যের সুরে নিবন্ধের পূর্বেই উল্লিখিত ‘মরমি গো অনুপম’,’অবহেলা সে তো নয়’ -দুইখানি গান। ওই বছরের পুজোর গান হিসেবে গৌরীপ্রসন্ন মজুমদারের লেখা আর সুধীরলাল চক্রবর্তীর সুরে শচীন গুপ্তের গাওয়া ‘কেন খেলাছলে শুধু স্বর্গ গড়িতে চাওয়া’ ব্যাপক জনপ্রিয়তা ও প্রশংসা লাভ করে। এরপর শচীন গুপ্তর কলম্বিয়া থেকে প্রথম রেকর্ড বেরিয়েছিল গৌরীপ্রসন্ন সুধীরলালের কথা-সুরে ‘মোর অশ্রুসাগর কিনারে রয়েছে’ এবং ‘তব নামে জ্বালা দীপ’। এই সময় থেকেই তিনি কলম্বিয়া কোম্পানির  হয়ে গান গাওয়া শুরু করেন।

এইভাবে আধুনিক গানে যথেষ্ট জনপ্রিয়তার ফলে ছায়াছবিতেও নেপথ্য তিনি কণ্ঠদানের সুযোগ পান। ১৯৪৭ সালের ১৪ মার্চ ‘পরভৃর্তিকা’ চলচ্চিত্র দিয়ে শুরু। 

(বিবাহও সেইবছর। ১৯৪৭ সালে ছাত্র(পরবর্তীকালে বিশিষ্ট নজরুল গীতিশিল্পী) ধীরেন বসুর বোন মায়া বসুর সঙ্গে শচীন গুপ্ত পরিণয়সূত্রে আবদ্ধ হন।) একে একে ‘শৃঙ্খল’,’বাঁকা লেখা’,‘অনন্যা’, ‘অভিমান’,’দিগভ্রান্ত’ ইত্যাদি বহু চলচ্চিত্রে শচীন গুপ্ত গান গেয়েছেন। ‘বাঁকা লেখা’ ছবিতে শৈলেন রায়ের কথা, রবিন চট্টোপাধ্যায়ের সুরে তাঁর গাওয়া, ‘চল মুসাফির চল’ গানটি বিখ্যাত হয়ে যায়। এছাড়া ১৯৪৯ সালে ‘অনন্যা’ চলচ্চিত্রে ‘হারে রে রে’ (সহশিল্পী কানন দেবী), ১৯৫০ সালে ‘দিগভ্রান্ত’ ছবিতে ‘আহ্বান আসিল মহোৎসবে’, ‘শ্রাবণের গগনের গায়’(সহশিল্পী উৎপলা সেন) প্রভৃতি রবীন্দ্রসঙ্গীতেও গলা মিলিয়ে ছিলেন। এছাড়া ১৯৫০ সালে সেযুগের স্বনামধন্য গীতিকার সুরস্রষ্ঠা হীরেন বসুর ‘শ্রী তুলসীদাস’, কিংবা বিধায়ক ভট্টাচার্যের পরিচালিত ‘যুগদেবতা’, কিংবা ১৯৫২ সালে ‘এ যুগের মেয়ে’ চলচ্চিত্রে শচীন গুপ্তের গাওয়া গানগুলো বেশ প্রশংসা অর্জন করেছিল। 

১৯৪৯ সালের আগস্ট মাসে শচীন গুপ্তের হিন্দি বেসিক গানের রেকর্ড প্রকাশিত হয়। ‘থকনা হোগা চলনেওয়ালে’, ‘পিয়া কি দিওয়ানি তেরি’ গান দুটো বিখ্যাত হওয়ার ফলে শচীন গুপ্ত হিন্দি চলচ্চিত্রেও নেপথ্য কণ্ঠদানের সুযোগ পান। ১৯৪৯ সালে কালিপদ সেনের সুরে ‘শাদী কে বাত’ সিনেমায় গেয়েছিলেন ‘পরদেশী বালম যাও রে’ (সহশিল্পী জগন্ময় মিত্র, গৌরী মিত্র সুপ্রভা সরকার)। ১৯৫১ সালে ‘মালা’ সিনেমায় ‘মেরা সাঁঈ হ্যায় মুরগী চোর’(সহশিল্পী নীতা সেন), ১৯৫২ সালে ‘জলজলা’ সিনেমায় ‘পবন চলে জোর’,’জীবন নাইয়া বহতি যায়ে’(শিল্পী পঙ্কজ মল্লিক ও অন্যান্য) প্রভৃতি গানগুলো উল্লেখযোগ্য। মনে রাখতে হবে, তখনকার গাওয়ার পদ্ধতির সঙ্গে এখনকার সময়কে মেলালে চলবে না। তখন বেসিক গানও যেমন কম হতো, ফি বছরে মুক্তিপ্রাপ্ত চলচ্চিত্রের সংখ্যাও ছিল হাতে গোনা। গীতিকার সুরকার শিল্পী সহশিল্পী, যন্ত্রী সবাই নিষ্ঠাভরে তাঁদের সবটুকু উজাড় করে দিতেন, যেজন্য সেইসব গান আজও ‘স্বর্ণযুগের গান’, আমাদের ব্যস্ততম জীবনযাত্রার মধ্যেও একটা আবেগের, অনুভবের টান রেখে যায়, আর যতদিন মানুষ গান ভালোবাসবে, এইসব গান কোনোদিন পুরানো হবে না, গানের মধ্যে দিয়েই শিল্পীরা চিরদিনই বেঁচে থাকবেন, আমরা তাঁদের ভুল গেলেও…।

১৯৫৪ সালে শচীন গুপ্ত তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপন্যাস অবলম্বনে নির্মিত ‘না’ চলচ্চিত্রে প্রথমবার সঙ্গীত পরিচালক হিসাবে কাজ করেন। ১৯৫৫ সালে তাঁর সঙ্গীত পরিচালনায় ‘মুক্তি’ সিনেমায় হীরালাল সরখেলের কণ্ঠে ‘নয়নে বহে জল, রাধিকা বিহ্বল’ গানটি খুব চলেছিল। ১৯৫৭ সালে ‘ঘুম’ সিনেমাটির গানগুলিও শ্রোতাদের মনে বেশ দাগ কেটেছিল। গায়ত্রী বসু, রবীন মজুমদার, আলপনা বন্দ্যোপাধ্যায়, সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় প্রমুখ আরও অনেকেই শচীন গুপ্তের সুরে গান গেয়েছেন। সিনেমার গান ছাড়াও শচীন গুপ্তের সুরে বেশকিছু বাংলা বেসিক গান আছে। ১৯৫৩ সালে পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথায় সুপ্রীতি ঘোষের গাওয়া পুজোর গান,’মা এলো আজ ঘরে’,’আজ ছুটির হাওয়া’, কিংবা পরের বছর ১৯৫৪ সালে শ্যামল গুপ্তের কথায় রমা দেবী শচীন গুপ্তের সুরে গেয়েছিলেন,’স্বপ্ন দেখার যেন শেষ নাই’, বা শ্যামল ঘোষের বাণীতে ‘ওই জোৎস্না হাসে আকাশে’। এই সবগুলো গানেরই সুরসৃষ্টি শচীন গুপ্তের। এছাড়া তিনি নিজের সুরেও গান গেয়েছেন। যেমন-‘চরণ দুখানি কাজল আলোকে ঢেকে’ -শ্যামল গুপ্তের কথায় গানটি নিজের সুরে গানটি তিনি ১৯৫৫ সালে রেকর্ড করেন। এরকম আরও গান আছে।

সেই যুগে জলসায় সকলের পছন্দের আর্টিস্ট হিসাবে শচীন গুপ্ত ছিলেন বেশ নামজাদা। তবে শচীন গুপ্ত তাঁর ব্যক্তিগত পছন্দের তালিকায় গীতিকার হিসেবে গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার, শ্যামল গুপ্ত, শৈলেন রায়, সুরকার হিসেবে নৌওশাদ, হেমন্তকুমার, পঙ্কজকুমার মল্লিক, রবীন চট্টোপাধ্যায়, অনুপম ঘটক, রেকর্ডশিল্পী বা কণ্ঠশিল্পী হিসাবে ধনঞ্জয় ভট্টাচার্য, উৎপলা সেন, সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের কথা উল্লেখ করেছেন। শচীন গুপ্ত নিজের প্লে-ব্যাক করা উল্লেখযোগ্য সিনেমার মধ্যে মালা(হিন্দি), আজাদী কে বাদ(হিন্দি), ২৫ শে জুলাই(হিন্দি), পণ্ডিতমশাই, বসু পরিবার, আলাদিন ও আশ্চর্য প্রদীপ, দিগন্তের ডাক, প্রতিবাদ, স্বপ্ন ও সমাধি, সাত নম্বর কয়েদী-র নাম বিশেষ ভাবে উল্লেখ করেছেন। 

পরবর্তীকালে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের লোকরঞ্জন শাখা কলম্বিয়া থেকে শচীন গুপ্তের দুটো রেকর্ড বার করে। একটি রেকর্ডে বেরিয়েছিল -‘হে মহাপ্রাণ’(কথা বাণীকুমার, সুর পঙ্কজ মল্লিক), অন্য রেকর্ডে গানদুটো ছিল-’হে মহামানব’,’লহ প্রণাম হে মহাপ্রাণ’। দুটো গানেরই কথা ছিল শৈল চক্রবর্তীর, আর সুর পঙ্কজ মল্লিকের। এই সময় মেগাফোনের কোম্পানির প্রধান কমল ঘোষের অনুরোধে শচীন গুপ্ত পুনরায় মেগাফোনে যোগদান করেন এবং আগের মতো মেগাফোনে গান রেকর্ড করাও শুরু করেন। এখান থেকেই (মেগাফোন কোম্পানি) সলিল চৌধুরীর লেখায় এবং সুরে শচীন গুপ্তের গাওয়া ‘জানিনা জানিনা কোন সাগরের ঢেউ’,’এবার আমি আমার থেকে’ -গানদুটো শ্রোতাদের কাছে দারুণ ভাবে সমাদৃত হলেও ভাগ্যের নিদারুণ পরিহাসে এটিই হয়ে যায় শিল্পীর শ্রেষ্ঠ কিন্তু শেষ রেকর্ড। অসুস্থতা গ্রাস করে ফেলে শিল্পীর অবশিষ্ট  গোটা সঙ্গীতজীবনটাকেই। যে সময় নিজেকে আরও বেশি করে মেলে ধরার দরকার ছিল, তখনই শিল্পীর জীবনদীপ নির্বাপিত হয়। ১৯৬২ সালের নভেম্বরে বেতারের অনুষ্ঠানও করতে পারেননি তিনি। ১৫ ডিসেম্বর, ১৯৬২ তাঁর মৃত্যুর দিন। রেখে যান তাঁর অগণিত গুণমুগ্ধ শ্রোতাদের।

আজ গায়ক এবং সুরকার শচীন গুপ্তকে নিয়ে লিখতে বসে এটাই মনে হচ্ছে, সময় বড় নিষ্ঠুর। মানুষ চলে গেলে কেউ যেমন তাকে মনে রাখে না, যাঁরা তাড়াতাড়ি পৃথিবীর মায়া কাটিয়ে ফেলেন, পরবর্তী প্রজন্মের কাছে তাঁদের স্মৃতিটুকুই যা সম্বল। গুগলে সার্চ দিয়ে ‘শচীন গুপ্ত’ লিখতে গিয়ে দেখি, বর্তমান রক প্রজন্মের সুরকার গায়ক গিটারিস্ট শচীন গুপ্তর(জন্ম ১৯৮১) সম্বন্ধেই যাবতীয় তথ্য দেওয়া, পুরানো বিস্তৃতপ্রায় শচীন গুপ্ত সেখানে আর স্থানই পান না। সংঙস অব শচীন গুপ্ত লিখলেও গুগল বর্তমান প্রজন্মের এই নবীন সুরকারেরই সৃষ্টিগুলিই আগে দেখাচ্ছে। তবুও কোথাও যেন ‘রাতের নীরবতা’ নিয়ে ‘মনের গহনকোণে’ একলা মিটিমিটি তারার মতো আজও জ্বলজ্বল করে গান শুনিয়ে চলেন শচীন গুপ্ত, সেই কত যুগ আগে রেকর্ডে ধরা তাঁর স্নিগ্ধ অথচ মৃদু গম্ভীর কণ্ঠের জাদু নিয়ে।  প্রতিভাস ম্যাগাজিন

কৃতজ্ঞতা: 

১. দে, দিব্যেন্দু, স্মৃতি- বিস্মৃতির অন্তরালে, দ্বিতীয় খন্ড

২. গঙ্গোপাধ্যায়, জয়তী- ‘তোমার গীতি জাগালো স্মৃতি’

৩. গুগল, ইউটিউব

এবং 

আমার শিল্পী অনুভব

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *