অমিতাভ সরকার
বাংলা গানের দখিন হাওয়া
শচীন দেববর্মন
গানের অনুষ্ঠান, মঞ্চে গান পরিবেশন করছেন দীর্ঘকায় একজন মানুষ, ধবধবে ফর্সা, টিকালো নাক, গলার আওয়াজ সানুসিক, শ্রোতারা মুগ্ধ, আসর জমে উঠেছে, কিন্তু রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইতে বললে সবিনয়ে প্রত্যাখ্যান করছেন। ব্যক্তিগতভাবে কবিগুরুকে শ্রদ্ধা করলেও, সঙ্গীতপিপাসু পিতার পরিচিত হলেও ত্রিপুরা রাজ পরিবারের উত্তরাধিকারগত দ্বন্দ্বের জন্য পরবর্তীকালে অভিমানী এই দৃঢ়চেতা মানুষটি রবীন্দ্রনাথকে এড়িয়ে গেছেন। ত্রিপুরার রাজবংশের সঙ্গে পরম কাছের সম্পর্ক হলেও রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে এই মানুষটির তেমন কিছু স্মৃতিচারণও নেই।
এমনকি, ত্রিপুরা রাজপরিবারের ওই সকল আত্মীয়দের সঙ্গেও পরে আর তিনি তেমন যোগাযোগও রাখেননি।
স্বনামধন্য সুরকার নিজে, কিন্তু তাঁর গানের সুরে রবীন্দ্রনাথের প্রভাব তেমন খুব একটা নেই বললেই চলে।
বরং কাজী নজরুল ইসলামের সঙ্গে তাঁর সখ্য ছিল। নজরুলের গানে তিনি সুরও করেছেন। ‘কুহু কুহু কোয়েলিয়া’, ‘পদ্মার ঢেউ রে’ -তাঁর গাওয়া এইসব নজরুলগীতি আজও বেশ বিখ্যাত।
নাম শচীন দেববর্মন। ‘এসডি’ নামে বম্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সুরকার হিসাবে
তিনি আজও অমলিন। ত্রিপুরার রাজবংশের ছেলে হয়েও সঙ্গীতকে ভালোবেসে সমস্ত বৈভব ছেড়ে তিনি সঙ্গীতের সাধনায় সারাটা জীবন উৎসর্গ করেছিলেন। জন্ম ১৯০৬ সালের ১লা অক্টোবর, তৎকালীন ত্রিপুরা রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত কুমিল্লায়। ত্রিপুরায় চন্দ্র বংশীয় মাণিক্য রাজ পরিবারের নবম সন্তান। মা নিরুপমা দেবীও রাজ পরিবারের মেয়ে, বাবা নবদ্বীপ চন্দ্র দেববর্মন। সঙ্গীত শিক্ষার প্রাথমিক শুরুটা বাবার কাছেই। ছোট্ট শচীনদেব আগরতলার বোর্ডিং স্কুলের পড়া শেষ করে কুমিল্লার ইউসুফ স্কুলে কিছুদিন পড়ার পর বাবার ইচ্ছেয় পঞ্চম শ্রেণীতে কুমিল্লা জেলা স্কুলে ভর্তি হন, এখান থেকেই ম্যাট্রিক পাশ করে কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজে আইএ পাশ করে বিএ ক্লাসে ভর্তি হন, তারপর কলকাতায় চলে আসলে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে এমএ ক্লাসে ভর্তি হন। কুমিল্লায় থাকাকালীন হিমাংশু দত্ত, অজয় ভট্টাচার্য, মোহিনী চৌধুরী, নজরুল ইসলামের মতো বিভিন্ন সঙ্গীতজ্ঞের সঙ্গে তাঁর সখ্য গড়ে ওঠে। ওখানে ইয়ংমেন্স ক্লাব, নাট্যশালা, টাউন হল, লাইব্রেরী বিভিন্ন সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল যেমন ছিল, তেমনি ভোরকীর্তন, নগরকীর্তন, ঢপকীর্তন, কবিগান প্রভৃতি বিভিন্ন ধরনের গানের চর্চা হতো। ১৯২৫ সালে শচীনদেব বাবার সঙ্গে কলকাতায় এলেও পড়াশোনার পরিবর্তে সঙ্গীতের দিকেই বেশি ঝোঁকটা দেখা গিয়েছিল।
সুরস্রষ্টা হিসেবে সমধিক প্রসিদ্ধি লাভ করলেও কুমার শচীনদেবের প্রথম পরিচয় বংশীবাদক হিসেবে, তারপর গায়ক হিসেবে। নিজে ভাল গাইতেন। সঙ্গীত জীবনে প্রতিষ্ঠা লাভের জন্য প্রচুর সংগ্রাম, ত্যাগ, কষ্ট স্বীকার করতে হয়েছে। তবুও পিছিয়ে আসেননি। বাংলাভাষায় তাঁর গাওয়া ১৩১ টি বেসিক গানের রেকর্ড পাওয়া যায়, তন্মধ্যে ১২৭ টি শচীনকর্তা নিজেই গেয়েছেন, বাকি ৪ টি স্ত্রী মীরা দেবীর সঙ্গে দ্বৈতকণ্ঠে। স্ত্রী মীরা দেবী, গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার, অজয় ভট্টাচার্য, রবি গুহ মজুমদার প্রভৃতির কথায় অধিকাংশ ক্ষেত্রে নিজেই সুর করেছেন, আবার চলচ্চিত্রের প্রয়োজনে নিজেই কখনো কখনো কণ্ঠদান করেছেন। বলিউডে প্রচুর গানে সুরসংযোগ করলেও বাংলা সিনেমায় তাঁর কাজ খুবই সামান্য। প্রথমে কিন্তু ত্রিপুরা থেকে বাংলাতেই কাজের জন্য এসেছিলেন। তিনি প্রথম যে রেকর্ড করেন, তা ছিল- হিন্দুস্থান রেকর্ড কোম্পানি থেকে, যার এক পিঠে ছিল ‘এ পথে আজ এসো প্রিয়া’(গীতিকার শৈলেন রায়), আর অন্য পিঠে ‘ডাকলে কোকিল রোজ বিহানে’(হেমেন্দ্রকুমার রায়)। সুর নিজের। রেকর্ডটি খুব জনপ্রিয় হয়। রাগাশ্রয়ী গান এবং লোকগীতির গানে একই সঙ্গে তাঁর মুন্সীয়ানার ছাপ প্রথম রেকর্ডটিতেই বোঝা গিয়েছিল। ১৯২৩ সালে শচীনদেব কলকাতা বেতারে গান গেয়েছিলেন। তবে সঙ্গীতের একনিষ্ঠ ছাত্র শচীনদেব ভীষ্মদেব চট্টোপাধ্যায়, সারেঙ্গীবাদক ওস্তাদ বাদল খাঁ, সরোদবাদক ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ, কৃষ্ণচন্দ্র দে প্রভৃতি সঙ্গীতসাধকের কাছে কণ্ঠ ও যন্ত্রসঙ্গীতের তালিম নিয়েছেন। কলকাতায় যখন গায়ক হিসাবে তাঁর একটু একটু নাম হচ্ছে, তখনই কুমার শচীনদেবের পিতৃবিয়োগ হয়। সালটা ১৯৩১। ‘সরগমের নিখাদ’ আত্মজীবনীতে শচীনদেব উল্লেখ করেছেন, সেই সময় পিতা নবদ্বীপচন্দ্র ছিলেন ত্রিপুরার প্রধানমন্ত্রী। শচীনদেব থাকতেন কলকাতার ত্রিপুরা প্যালেসে। কিন্তু পিতা গত হওয়ার পর অথৈ জলে পড়ে যান। ত্রিপুরার রাজপ্রাসাদ ছেড়ে একখানা ঘরে ভাড়া নিয়ে কলকাতায় সঙ্গীতকে সঙ্গী করে এক অন্যরকম সংগ্রাম শুরু করলেন। এইসময় তাঁকে জীবনধারণের জন্য গানের টিউশনিকে রোজগারের মাধ্যম করতে হয়। চাইলেই দাদাদের কথামতো ত্রিপুরার রাজকার্যে উচ্চপদে চাকরি নিতে পারতেন। কিন্তু নিজের পায়ে গান করে দাঁড়ানোটাই ছিল ওঁর মনোগত ইচ্ছা।
রঙ্গমঞ্চ থেকে ডাক পেয়ে নাটকেও সুরারোপ করেছিলেন। আবার এটাও ঠিক, ১৯৩২ সালে এইচএমভি প্রথমে তাঁর গান রেকর্ড করতে চায়নি, শচীনকণ্ঠ নাকিসুরযুক্ত বলে আপত্তি করেছিলেন (পরবর্তীকালে অবশ্যই এইচএমভি ওঁর রেকর্ড বার করেছিল)। সাফল্যও চট করে আসেনি। গানের প্রচার নিয়ে গুরু কৃষ্ণচন্দ্রের সঙ্গে মনান্তর হয়। তবে চেষ্টা চালিয়ে গেছেন। ১৯৩৪ সালে অল ইন্ডিয়া মিউজিক কনফারেন্সে গান গেয়ে শচীনদেব বিদগ্ধজনের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন, এবং ১৯৩৫ সালে বেংগল মিউজিক কনফারেন্সে ঠুংরি গেয়ে ফৈয়াজ খাঁর প্রিয়ভাজন হয়ে ওঠেন। ওই বছরই শেখ ভানু বিরচিত দেহতত্ত্বমূলক গান ‘নিশীথে যাইও ফুলবনে’ জসীমউদ্দীনের সাহায্যে নতুন প্রেমের গানে রূপান্তরিত করে নতুন ভাবে রেকর্ড করলেন। ১৯৩৭ সালে একসময়ের ছাত্রী ও পরবর্তীকালে প্রেমিকা মীরা ধরকে বিবাহ করেন। ওই বছরই ‘রাজগী’ নামক চলচ্চিত্রের মাধ্যমে সুরকার হিসাবে প্রথম আত্মপ্রকাশ। পুত্র রাহুল দেবের জন্ম ২৭ শে জুন, ১৯৩৯। একটা সময় কলকাতাতেই থাকতে চেয়েছিলেন, কিন্তু সেভাবে সুযোগ আসছিল না। কতটা অভিমানে, কতকটা বাধ্য হয়েই
১৯৪৪ সালে স্ত্রী মীরা দেবী, এবং শিশুপুত্র রাহুলকে নিয়ে ভাগ্যান্বেষণে বোম্বে পাড়ি দেন এবং সেখানেই স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন।
শচীনদেবের উত্থানের পিছনে মীরা দেবীর ভূমিকা অনস্বীকার্য। শচীন দেববর্মন এত বড়ো হতেন না, যদি স্ত্রী মীরা না থাকতেন, মীরা দেবী
নিজেও সম্ভ্রান্ত ধনী পরিবারের মেয়ে হয়েও শচীনদেবকে ভালোবেসে বিয়ে করে, আজীবন সুখে-দুঃখে স্বামীর পাশে ছিলেন, এবং পুত্র রাহুল দেব বর্মনকেও অত বড়ো মাপের সুরকার হিসাবে তৈরি করেন। মীরা দেবী নিজেও রীতিমতো ভালো গান গাইতেন। শচীনদেবের ট্রেনিংয়ে কিছু গান রেকর্ডও করেছিলেন। মীরা দেবী একসময় ভীষ্মদেব চট্টোপাধ্যায়ের কাছে উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত, শান্তিনিকেতনের ক্ষিতিমোহন সেনের মেয়ে অমিতা সেনের কাছে নাচ, পরে ধীরেন্দ্রচন্দ্র মিত্রের কাছে ঠুংরি, কীর্তন, অনাদি দস্তিদারের কাছে রবীন্দ্রসঙ্গীত শিখেছিলেন। তাছাড়া পরবর্তীকালে শচীনদেবের সুরসৃষ্টি, চলচ্চিত্রে আবহ সঙ্গীতের ব্যবহার, যন্ত্রাণুসঙ্গ প্রভৃতি বিভিন্ন কাজে স্বামীকে অকুণ্ঠ সহযোগিতা করে গেছেন। এই নীরব সঙ্গীতসাধিকা কিন্তু সারাটা জীবন প্রচারের আড়ালেই থেকে গেলেন। সমস্ত সম্ভাবনাকে জলাঞ্জলি দিয়েছেন, উৎসর্গ করেছেন স্বামী-পুত্রের জন্য, নিজের কথা একবারও ভাবেননি। দুর্ভাগ্য, যে মীরা দেবীর শেষ জীবন খুব কষ্টে কাটে। পুত্র রাহুলদেবের অকাল মৃত্যুর শোক তিনি সইতে পারেননি। পুত্রবধূ আশা ভোঁসলে মীরা দেবীকে বৃদ্ধাশ্রমে রেখে আসেন। শোনা যায়, ঠিকমতো যত্নআত্তিও পাননি।(হয়তো এটাও ঠিক, কর্মব্যস্ত জীবনে আশাজির পক্ষেও সবটা সম্ভব ছিল না। তবুও মানুষের শেষ বয়সটাই তো আসল যুদ্ধ। আর সবার ভাগ্য তো একরকম হয় না। কার কপালে যে কী আছে, কেউ কী বলতে পারে! মানুষ ভালোটাই চায়। বাকিটা ভবিষ্যতের হাতে।) ওখানেই একদিন মীরা দেবী মারা গেলে প্রচারমাধ্যমের কাছে খবরটা জানাজানি হতেই কিংবদন্তি গায়িকা তড়িঘড়ি চলে এসে পরিস্থিতি সামাল দেন।
যাই হোক, আবার শচীনদেবের কথায় ফিরে আসি। বোম্বেতে গুরু দত্ত, দেব আনন্দের সঙ্গে আলাপ হয়। ১৯৫৩ -য় ‘ট্যাক্সি ড্রাইভার’-ছবির সুরের জন্য ফিল্ম ফেয়ার পেয়েছিলেন। আবার শচীনকর্তার শেষ ছবি ‘অভিমান’-র জন্য ফিল্ম ফেয়ার পুরস্কার পান। (পুত্র রাহুল দেববর্মনের সঙ্গেও এ ব্যাপারে শচীনদেবের মিল আছে। আর ডি বর্মনও ওঁর শেষ ছবি ‘নাইনটিন ফর্টি টু- এ লাভ স্টোরি’-র জন্য ফিল্ম ফেয়ার পুরস্কার পান। কিন্তু দেখে যেতে পারেননি।)
১৯৩৪ সালে কলকাতায় বাংলা সর্বভারতীয় সংগীত সম্মেলনে স্বর্ণপদক লাভ, তাছাড়া ১৯৫৮- য় সংগীত নাটক একাডেমী, ১৯৫৯ -তে ‘পিয়াসা’-সিনেমায় সুরারোপের জন্য এশিয়াড ফিল্ম সোসাইটি পুরস্কার, ১৯৬২ -তে হেল সিঙ্কি, ফিনল্যান্ড আন্তর্জাতিক সংগীত প্রতিযোগিতার বিচারক, ১৯৬৪-তে ‘ক্যায়সে কঁহু’ সিনেমার জন্য সুরশৃঙ্গার সংসদ কর্তৃক ‘সন্ত হরিদাস’ পুরস্কার, ১৯৬৯ -তে ‘পদ্মশ্রী’ পান এসডি। সহজ সুরে, গানের আবেদনকে সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তোলার দিকেই এসডির লক্ষ্য ছিল। বাংলার বাইরে থাকলেও বাংলার জল, মাটি, বাতাসকে কোনোদিন ভোলেননি। শচীনদেবের হিন্দি সুরেও বাংলা লোকগীতির প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। বাংলা লোকগীতির গানে যে সব যন্ত্র ব্যবহার করা হয়, তিনি সেগুলো ব্যবহার করতে ভালোবাসতেন। গানের ব্যাপারে গুরুত্ব দিতেন সর্বাগ্রে শ্রোতাদের মতামতকে। শিল্পী নির্বাচনের ব্যাপারে ছিলেন বেশ খুঁতখুঁতে। এমনও হয়েছে, একই গান কখনো হেমন্ত, মান্না, তালাত মাহমুদ, রফিকে দিয়ে গাইয়েছেন, কিন্তু ফাইনাল রেকর্ডিং তাঁকে দিয়েই করাবেন, যাঁর গলায় গানটা সবচেয়ে ভালো লাগবে। রেকর্ডিং কয়েক সপ্তাহ আগে থেকে বারবার ফোন করে দেখে নিতেন শিল্পীর গলা ভালো আছে কিনা। কৃষ্ণচন্দ্র দের ভাইপো হওয়ার সুবাদে মান্না দে(ডাকনাম মানা)’র সঙ্গে অনেক আগে থেকেই যোগাযোগ ছিল। মান্নাদের এসডির সহকারী ছিলেন। এমন অনেক গান আছে, যেগুলো মান্না দে-কে দিয়ে তুলিয়ে
কিশোরকুমারকে দিয়েই গাইয়েছেন। গানের জগতে কিশোরকুমারকে দাঁড় করানোর পিছনে তাঁর ভূমিকা অনস্বীকার্য। এসডির সুরে কিশোরকুমার প্রচুর গান গেয়েছেন। তাছাড়া, লতা মঙ্গেশকর, গীতা দত্ত, আশা ভোঁসলে, সুমন কল্যাণপুর, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, রফি, মান্না দে, মুকেশ -কে না তাঁর সুরে গেয়েছেন! একটা সময়ে যখন নৌশাদ, মদনমোহন, শংকর-জয়কিশান প্রভৃতি সমকালীন সঙ্গীত পরিচালকরা আগের মতো নিজের নামের সুনাম অনুযায়ী কাজ করতে পারছেন না, তখন পরিণত বয়সে এসেও শচীনদেব সুরের একের পর ভেল্কি দেখিয়েছেন। ‘গাইড’,’অমর প্রেম’,’প্রেম পূজারী’ -একের পর এক
হিট। এসডির ব্যক্তিগত পছন্দ ছিল লতার গান। একটা গান একবার লতাকে দিয়ে গাওয়ানোর পর এসডির পছন্দ না হওয়ায় আবারও অন্য দিন লতাজিকে গাইতে বললে লতাজি সময় দিতে পারেননি বলে ক্ষুব্ধ হয়ে সেই গান এসডি আশা ভোঁসলেকে দিয়ে গাওয়ান। এভাবেই আশাজির সঙ্গীত জগতে সময়ের কিছু আগেই প্রবেশ ও তাড়াতাড়ি প্রতিষ্ঠা লাভ- বলা যায়।
এসডি বলিউডে গানের জগতে এসে বিভিন্ন মিথ ভেঙে দেন। যেমন, আগে গান লেখা হতো, পরে তার সুর করা হতো। এসডির আশি শতাংশ গান আগে সুরকৃত, পরে তাতে কথা বসানো। তাছাড়া বোম্বেতে নিয়ম ছিল, মুকেশ গাইবেন রাজ কাপুরের জন্য, রফি গাইবেন দিলীপকুমার, শাম্মি কাপুরের জন্য, দেবানন্দ গাইবেন কিশোরকুমারের জন্য। কিন্তু এসডি বর্মন যেমন ‘নটি বয়’ (১৯৬২) সিনেমায় নায়ক-গায়ক কিশোরকুমারের জন্য মান্না দেকে দিয়ে গাইয়েছিলেন, তেমনি রফিকেও ‘অভিমান’ সিনেমায় অমিতাভ বচ্চনের জন্য গাইয়েছিলেন। ‘আরাধনা’ সিনেমায় নিজের সুরে নেপথ্য কণ্ঠশিল্পী হিসেবে এসডি জাতীয় পুরস্কারও পেয়েছিলেন (কাহে কো রোয়ে, ১৯৭২)। কিন্তু তিনি এতটাই ভূয়োদর্শী ছিলেন, যে বুঝতে পেরেছিলেন, ভবিষ্যতে সেভাবে তাঁর কণ্ঠের গান কেউ মনে রাখবে না। সেই জন্য ওঁর বাংলা গাওয়া অনেক গান বোম্বের হিন্দি ভার্সানে অন্যদের দিয়ে গাইয়েছেন। পোষাক-পরিচ্ছদেও তিনি ছিলেন, আপাদমস্তক বাঙালি। পরনে ধুতি-পাঞ্জাবি, কাঁধে শান্তিনিকেতনী ব্যাগ, পায়ে কোলাপুরি চটি বা পাম্প সু, চোখে চশমা।
নিজে খেলাধুলাও খুব ভালবাসতেন। ফুটবল, ক্রিকেট, টেনিস খেলেওছেন। আর ছিল খুব মাছ ধরার শখ। বোম্বেতেও পুকুর পেলেও ছিপ হাতে নিয়ে বসে পড়তেন, ঠিক মনের অতলে গিয়ে সুর খোঁজার মতোই। ইস্টবেঙ্গলের উগ্র সমর্থক ছিলেন এসডি। কলকাতায় থাকাকালীন ইস্টবেঙ্গলের খেলা থাকলেই মাঠে দেখতে চলে আসতেন। মান্না দে ছিলেন মোহনবাগানের সমর্থক। এ নিয়ে দুজনের মধ্যে টানটান উত্তেজনা, বাকবিতণ্ডা এসব লেগেই থাকতো।
উনি ছোটোদের যেমন ভালোবাসতেন, তেমনি মানুষ হিসেবেও বেশ রসিক ছিলেন। বিভিন্ন ঘটনা থেকে শচীনদেবের রসিকতার বিচিত্র সব প্রমাণ পাওয়া যায়। নিজে অল্প কিছু হলেও লেখালেখি করেছেন। ১৯৩৯ সালে ডি.এম লাইব্রেরি থেকে শচীনকর্তার ‘সুরের লিখন’ নামে একটি গানের বই বেরিয়েছিল। স্বরলিপি সহ মোট ২৫ টি গান এই বইটায় ছিল। বইটা তিনি বাবাকে উৎসর্গ করেছিলেন। বাবা চেয়েছিলেন ছেলেটি গান করলেও শিক্ষিত হয়ে উচ্চপদে কর্মরত হোক। কিন্তু শচীনকর্তা সঙ্গীতেই আত্মনিয়োগ করায় বাবার এই ইচ্ছে পূরণ করতে পারেননি। তাছাড়া পরিচালক মধু বসুর ‘সেলিমা’ নামের একটি চলচ্চিত্রে এক ভিখারির ছোট্ট চরিত্রে অভিনয়ও করেছিলেন। ওই সময় শচীনদেব আইপিটিএ-র সঙ্গেও জড়িত এবং বাংলা লোকসঙ্গীত শাখার সভাপতিও হয়েছিলেন। এভাবে সলিল চৌধুরী, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, হেমঙ্গ বিশ্বাস, ভূপেন হাজারিকা প্রভৃতির সঙ্গে যোগাযোগও তৈরি হয়। পরবর্তীকালে সলিল চৌধুরীকে বলেছেন, ছেলে পঞ্চম(রাহুলদেব) ওঁর নিজের গানের ধরন অপেক্ষা সলিল চৌধুরীর গানের ধরন বেশি পছন্দ করে। উনি যেমন ভারতীয় রাগরাগিণীর সঙ্গে বাংলাদেশের সহজ সরল মাটির লোকসুরের আদলে অর্থাৎ পূর্ব বা উত্তর-পূর্ব ভারতের পল্লীগীতির স্টাইলে সুর তৈরি করতেন, ছেলে রাহুলের পছন্দ ছিল ভারতীয় রাগ সঙ্গীতের সঙ্গে পাশ্চাত্য ঘেঁষা সুর। শচীনদেবের একদিকে যেমন আক্ষেপ ছিল, পরবর্তীকালে এটা ভেবে গর্বিত হয়েছেন, ছেলে বলিউডের সঙ্গীত জগতে স্বতন্ত্র ঘরাণা তৈরি করতে ভালোভাবেই সক্ষম হয়েছে, বাবাকে কপি করেনি। তবে এতকিছুর পরও শচীনদেব বাংলাকে ভোলেননি। ‘বর্ণে গন্ধে ছন্দে গীতিতে’,’আমি তাকদুম তাকদুম বাজাই’,’শোনো গো দখিন হাওয়া’ প্রভৃতি যেমন শচীনদেবের বাংলায় গাওয়া অবিস্মরণীয় গান, তেমনি বলিউডে হেমন্তের কণ্ঠে ‘এ রাত এ চাঁদনী’, মান্না দের কণ্ঠে ‘পুছো না ক্যাইসে ম্যায়নে’, কিশোরকুমারের কণ্ঠে ‘রূপ তেরা মস্তানা’,’ফুল কি রং সে’, রফির জন্য ‘দিন ঢল যায়’, লতাজির জন্য ‘আজ ফির জিনে কি তামান্না হ্যায়’, আশাজির জন্য ‘কালিঘাটা ছায়’ প্রভৃতি অসংখ্য গান আজও এসডির জাত চিনিয়ে দেয়। সেই সঙ্গে চলচ্চিত্রের প্রয়োজনে কখনো স্বকণ্ঠেও শচীনকর্তা গান গেয়েছেন, যেমন- আল্লাহ মেঘ দে(গাইড), ওরে মাঝি(বন্দিনী) প্রভৃতি।
তবে সবকিছুরই একটা শেষ থাকে।
১৯৭৫ সালে প্যারালিটিক স্ট্রোক হয়ে শেষ ছ’মাস কোমায় চলে যান। সুরের এই কাণ্ডারী চিরকালের জন্য জীবন নদীর ওপারে নাও ভাসান ১৯৭৫ সালের ৩১ শে অক্টোবর।
আজ অনেকেই তাঁকে ঠিক ভাবে চেনে না, বা শচীনদেবের এত বৃহত্তর কর্মকাণ্ড সম্বন্ধে অবহিত নয় । সময়ও বদলে গেছে। অনেকেই হয়তো তাকে আরডি বর্মনের বাবা হিসেবে জানে। কিন্তু এসডি নামের মহীরূহকে সঠিক ভাবে জানাটা এ প্রজন্মের জন্য বিশেষ প্রয়োজন। নিজের অধ্যাবসায় দিয়ে সমস্ত রাজৈশ্বর্য্য ত্যাগ করে নিজের প্রতিভার এরকম সুবিচার করা সেই সময়ে দাঁড়িয়ে কতটা কঠিন ছিল, কঠিন ছিল সেটা হয়ে দেখানো, যে যে মহীরূহের ছায়ায় আরও অসংখ্য গাছ ছায়া পেয়ে এসেছে, এবং আজও পাচ্ছে।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, যে, বিখ্যাত ক্রিকেটার সচিন তেন্ডুলকারের বাবা ছেলের নাম রেখেছিলেন এই কিংবদন্তি সুরকারের নামেই কিন্তু, তাঁর প্রতি অসম্ভব শ্রদ্ধা থেকেই। আবার ২০০৭ সালে শচীনদেব স্মারক ডাকটিকিট প্রকাশ করা হয়েছে। তবে আজও ইউটিউব, রেডিও, টিভি চ্যানেলে এসডির গান মানে মনের মধ্যে যেন একটা আলাদা অনুভব। আর অক্টোবর তো পুজোরই মাস। সাধনাটাই যখন পুজো, শচীনদেব বর্মন সেখানে স্বার্থক প্রেমপূজারী। সময় যেমনটাই হোক, কোনো কালেই এই প্রেমের ক্ষয় হয় না, বরং আরও বাড়ে। কিন্তু তবুও কোথায় যেন সেই অন্তরের উন্মাদনাটা বর্তমান প্রজন্মের সঙ্গীতপ্রেমীদের মধ্যে ততোটা দেখা যায় না। টানটাও যেন কমে আসছে। শচীনদেবের গানের লাইন ধার নিয়েই আজ তাই বলতে ইচ্ছে করে, ‘বাজে না বাঁশি গো’।
খুব ভালো তথ্য সমৃদ্ধ লেখা। শুভেচ্ছা রইল।