অমিতাভ সরকার
আমি গানের মাঝে বেঁচে থাকবো
প্রতিমা বন্দ্যোপাধ্যায়
‘একটা গান লিখো আমার জন্য,
/না হয় আমি তোমার কাছে ছিলেম অতি নগণ্য।’- এ গান শুনলেই যাঁর কথা মনে পড়ে, তিনি প্রতিমা বন্দ্যোপাধ্যায়। একটা দীর্ঘ সময় ধরে যিনি অসম্ভব অনুশীলন, নিষ্ঠা, দরদ দিয়ে বাংলা গানে সুরের প্রতিমা নির্মাণ করে গেছেন, সেই নিরহংকারী, অজাতশত্রু, সাবলীল, সারল্যের প্রতিমূর্তি মাতৃহৃদয়া মানুষটি আপাতদৃষ্টিতে নিজেকে নগন্য হিসাবে দেখালেও ওঁর গাওয়া গান আজও সুরসিক বাঙালিকে সাবলীল মুগ্ধ স্বরপ্রক্ষেপণ, নির্মল সাবেকীয়ানা অথচ কী গভীর অনুভবী সুরসঞ্চালনের মুগ্ধ আবেশে ভরিয়ে তোলে। যে কোনো ধরনের গানেই রীতিমতো মুন্সীয়ানা দেখিয়েছেন। হেমন্ত মুখোপাধ্যায় এই সঙ্গীতসাধিকাকে লতা-আশারও আগে স্থান দিয়েছেন। কণ্ঠ বেসুরো, বিকৃত না করে বারোটা সুর অবিকল ভাবে কণ্ঠে ধারণ করার অপূর্ব ক্ষমতা ছিল তাঁর। প্রতিমা বন্দ্যোপাধ্যায়ের গান লতাজি নিজের সংগ্রহে রেখেছিলেন।(ছয়ের দশকে একবার এইচএমভির শারদ অর্ঘ্যে প্রতিমা বন্দ্যোপাধ্যায় সম্বন্ধে লেখা হয়েছিল, ‘যাঁর প্রত্যেকটি গান সুরের দেবতার উদ্দেশ্যে শ্রদ্ধার অঞ্জলির মতো উৎসর্গিত, সেই সুকণ্ঠী গায়িকা প্রতিমা বন্দ্যোপাধ্যায় এবারের গান দু’খানিও প্রাণ ঢেলে গেয়েছেন।’

কথাগুলো যেন প্রতিমা বন্দ্যোপাধ্যায়ের জন্য যথাযথই সত্য।)। ‘বাঁশরি গো বাজ কেন রাধা নেই’, ‘সজনী গো রজনীকে চলে যেতে দাও’, ‘ভ্রমরা গুন গুন গুঞ্জরিয়া আসে’,’সাতরঙা এক পাখি পাতার ফাঁকে’-যেন পাখির কণ্ঠে তীক্ষ্ণ অথচ আবেগময় সগভীর এক আওয়াজ, যা অন্তরকে নাড়িয়ে দিয়ে যায়। বাঁশির মতোই ছিল ওঁর কণ্ঠ। ওঁর গাওয়া সব গানগুলোই তাই অতুলনীয়। উদাহরণটা আরও বাড়ানো যায়। সে কথায় আবারও আসছি।
হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের সুরে প্রতিমা বন্দ্যোপাধ্যায় প্রচুর গান গেয়েছেন। সুরসাগর হেমন্ত নিজের প্রযোজিত ও সুরসৃষ্ট চলচ্চিত্র ‘অনিন্দিতা’-য় এই দুই কিংবদন্তীকে একসঙ্গে গান গাইয়েছিলেন( গানটি ছিল- ‘কেমনে তরিব তারা’,কথা- প্রচলিত)। কিন্নরকণ্ঠী প্রতিমার সুরে হেমন্ত নিজেও দুটো গান রেকর্ড করেন। গানদুটো ছিল ‘তন্দ্রাহারা রাত ওই’,’শেষের কবিতা মোর’। আবার হেমন্তও নিজের সুরে প্রতিমাকে হিন্দি ছবি ‘সাহারা’-তে গাইছিলেন ‘এক বাত কহুঁ তুমসে’। এছাড়া ‘নিক্কি’(১৯৫৮) সিনেমায় প্রতিমার কণ্ঠে ‘তেরি ইয়াদ কে সাহারে কাটতে হ্যায় দিন’ গানটিও খুব জনপ্রিয় হয়।
শুধুমাত্র প্লেনে চড়তে ভয় পেতেন বলেই বিদেশে অনুষ্ঠান
বাতিল করে দিতেন। গীতা দত্ত, লতা মঙ্গেশকর প্রমুখ কিংবদন্তী শিল্পীরা প্রতিমা বন্দ্যোপাধ্যায়কে পাকাপাকিভাবে বোম্বেতে চলে আসতে বলেছিলেন। সাধাসিধে আটপৌরে জীবনে অভ্যস্ত আপাত মুখচোরা প্রতিমা বন্দ্যোপাধ্যায়
একবারই বোম্বেতে গিয়ে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের বোম্বের বাড়িতে মাসখানেক থাকলেও স্বামীসহ দুই সন্তানের সংসার ফেলে নিজের খ্যাতি, যশের মোহে সেখানে থেকে যাওয়ায় প্রতিমা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মনে সায় দেয়নি। কিছু সময় পর মাটির টানে আবার কলকাতায় ফিরে আসেন। তবে আপাতভাবে দুর্বল স্নায়ুর মানুষ হলেও নিকট বন্ধু জনের কাছে এই সুরসম্রাজ্ঞী ছিলেন আন্তরিক, খোলামেলা। আলপনা বন্দ্যোপাধ্যায়, নির্মলা মিশ্র, উৎপলা সেন, বাণী ঘোষাল, মাধুরী চট্টোপাধ্যায়সহ প্রায় সব মহিলা শিল্পীদের সঙ্গে ওঁর আন্তরিক হৃদ্যতা ছিল। মনটাও ছিল অনেক বড়ো। কেউ কোনোদিন ওঁর মুখে কারো সমালোচনা শোনেননি। মানুষ যেখানে নিজের দুর্বলতার কথা সর্বসমক্ষে স্বীকার করতে চায় না, এমনও হয়েছে, যে এই সহজ সরল মাতৃময় শিল্পী নিজের ইংরেজি না জানার কথাও ঘনিষ্ঠ মহলে বলে নিজেই হেসে ফেলতেন। আসলে ভালো মানুষ না হলে বড়ো শিল্পী হওয়া যায় না।
দীর্ঘ সঙ্গীত জীবনে প্রচুর বেসিক গান গেয়েছেন। শেষ জীবনের ব্যক্তিগত কষ্ট, একাকীত্ব ওঁকে কুঁড়ে কুঁড়ে গ্রাস করলেও গলায় যখন গান ধরেছেন, তখনও স্বর এক চুলও এদিক-ওদিক হয়নি।
১৯৯৬ সালে রবীন্দ্র সদনে একটি সঙ্গীতানুষ্ঠানে প্রিয় বান্ধবী নির্মলা
মিশ্রের হাত ধরে স্টেজে উঠে ওই বয়সেও মাতিয়ে দিয়েছিলেন গোটা প্রেক্ষাগৃহ। এটাই ছিল ওঁর শেষ ফাংশন।
একজন শিল্পীর কাজকে চিনতে গেলে তার জীবনকে একটু হলেও জানতে হয়। ভাবতে পারেন, মাত্র আঠারো বছরে বিধবা হওয়া একটি কিশোরী তার একরত্তি কন্যাকে ভালো মানুষ করার সঙ্গে শুধুমাত্র একটু ভালো করে গান শেখানোর চেষ্টা করতে গিয়ে কতটা কষ্ট করেছেন। সংসারের দুঃখ, আর্থিক কষ্টের মধ্যেও টাকা জমিয়ে হারমোনিয়াম কেনা, আর তাতেই গানের হাতেখড়ি হয়েছিল শিশু প্রতিমার। মা কমলাদেবী কীর্তন গাইতেন। বাবা মণিভূষণও ছিলেন ওস্তাদ বদর খানের শিষ্য। শচীনদেব বর্মনের সুরে(গানটি হলো -‘যৌবনে হায় ফুল দলে পায়’) এবং হিমাংশুর দত্তর সুরে(‘স্বপনে কোন মায়াবী’) হিন্দুস্তান কোম্পানি থেকে ওঁর রেকর্ডও বেরিয়েছিল।(তাছাড়া কম বয়সেই মণিভূষণ কক্স এন্ড কিংস কোম্পানিতে চাকরি করতেন, ফুটবল খেলাতেও পারদর্শী ছিলেন, তবে গান ছিল ওঁর প্রথম ভালোবাসার জায়গা।)
যার মা-বাবাই এরকম গুণের অধিকারী, তাঁদের মেয়ে যে ওইরকম বড়ো মাপের শিল্পী হবে, এ তো বলাই বাহুল্য। দুর্ভাগ্য, যে, মাত্র এক বছর বয়সেই মণিভূষণ মারা গেলে প্রতিমা পিতৃহারা হন।
মা কমলা দেবী অনেক কষ্টের মধ্যে দিয়ে মেয়ে প্রতিমাকে(ওঁর ডাকনাম ছিল রুনি) মানুষ করেন।
বিক্রমপুরের বাহেরক গ্রামের মানুষ হলেও দেশভাগের অনেক আগে কলকাতায় ভবানীপুরে চলে আসা। ১৯৩৪ সালের ২১শে ডিসেম্বর টালিগঞ্জে মামার বাড়িতে প্রতিমার জন্ম। মায়ের কাছে গানের প্রাথমিক শিক্ষাটুকুর পর ভীষ্মদেব চট্টোপাধ্যায়ের শিষ্য প্রকাশকালী ঘোষালের কাছে পাঁচ বছর বয়স থেকেই সঙ্গীত শিক্ষা শুরু করেন। গুরুর কাছেই শাস্ত্রীয় সঙ্গীত, ভজন, রাগ-রাগিনী সজ্জিত বিভিন্ন গানের তালিম শুরু। পরে এই গুরুই প্রতিমাকে ভীষ্মদেবের কাছে নিয়ে যান। প্রকাশকালী ঘোষালের প্রতি প্রতিমা বন্দ্যোপাধ্যায় সারাজীবনই অটুট শ্রদ্ধা বজায় রেখে গেছেন।
সাত-আট বছরের প্রতিমা দেশে গিয়ে মায়ের সঙ্গে আত্মীয় বাড়ি ঢাকায় গান শুনিয়ে মাত করেছিলেন খোদ সুধীরলাল চক্রবর্তীকেও। ওঁরই সুপারিশে ঢাকা রেডিওর শিশু বিভাগে প্রতিমা গান রেকর্ড করেন। কলকাতায় এসে কমলাদেবীর প্রচেষ্টায় গিরীন চক্রবর্তীর সঙ্গেও প্রতিমার যোগাযোগ হয়। গিরীনবাবুর উদ্যোগে কলকাতা রেডিওতেও গান গাওয়ার সুযোগ আসে। অনেক ছোটো বয়স থেকেই শিক্ষক এবং মায়ের ইচ্ছেয় আর্থিক কারণে ছোটো-বড় যে কোনো ধরনের গানের অনুষ্ঠানে কিশোরী প্রতিমাকে গান গাইতে হয়েছে। বেতারে গান গাওয়ার ফলে প্রতিমার গানের প্রশংসা চারিদিকে ছড়িয়ে পড়তে থাকে৷
এই গানের সূত্র ধরেই তের-চোদ্দ বছর বয়সে অমিয় বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে দেখা এবং ১৯৪৭ সালে মাত্র ষোল বছর বয়সে বিবাহ। কিশোরী প্রতিমা চট্টোপাধ্যায় হলেন প্রতিমা বন্দ্যোপাধ্যায়। শিল্পী হিসাবে প্রতিমাকে সাহচর্য দিয়েছিলেন তাঁর স্বামী। বিয়ের পর শ্বশুরবাড়ি টালিগঞ্জের সাহানগরেই আমৃত্যু বাস। এই দম্পতির দুই সন্তান। মেয়ে রাইকিশোরী এবং ছেলে অশোক। বিয়ের পর গানের জীবন আরও এগিয়ে যেতে থাকে। দক্ষিণ কলকাতার মিলনচক্রে সুধীরলাল আবার প্রতিমার গান শোনেন এবং মোহিত হয়ে যান, যে ঢাকায় ছোট্ট মেয়েটির গান শুনেছিলেন, সে আজ গানে এত উন্নতি করেছে,
এত সুন্দর সে গাইছে। সুধীরলালই
১৯৫১ সালে ‘সুনন্দার বিয়ে’ সিনেমায় প্রতিমাকে নেপথ্যে গান করান। গানগুলো হিট হয়। ১৯৫৪ সালে ‘ঢুলি’ সিনেমায় রাজেন সরকারের সুরে প্রতিমা গাইলেন ‘নিঙাড়িয়া নীল শাড়ি শ্রীমতী চলে’। ১৯৫৫-য় সুচিত্রা সেন, উত্তমকুমারের সুপারহিট ছবি ‘শাপমোচন’-য়ে প্রতিমা তাঁর শ্রদ্ধেয় হেমন্তদার সুরে চিন্ময় লাহিড়ীর সঙ্গে গাইলেন ‘ত্রিবেণী তীর্থ পথে কে গাহিল গান’(‘শাপমোচন’ সিনেমার সুরসৃষ্টি হেমন্তের হলেও এই গানটির সুর শোনা যায়, চিন্ময় লাহিড়ী নিজেই দিয়েছিলেন।), ‘ক্ষুধিত পাষাণ’ সিনেমায় ওস্তাদ আলি আকবর খানের সুরে ওস্তাদ আমির খানের সঙ্গে গাইলেন ‘ক্যায়সে কাটে রজনী ইয়ে সজনী’, ১৯৫৪ সালে পন্ডিত জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষের সঙ্গীত পরিচালনায় ‘যদুভট্ট’ সিনেমায় ব্যবহার করা ওয়াজিদ আলি শা’র সুরসৃষ্ট ‘বাবুল মোরা’ গেয়ে প্রতিমা বিএফজেএ পুরস্কার পান।
(এছাড়া পরবর্তীকালে সঙ্গীতশিল্পী হিসাবে পরপর তিনবার ‘ছুটি’,’পরিণীতা’,’চৌরঙ্গী’ চলচ্চিত্রে নেপথ্য কণ্ঠদানের জন্য বিএফজেএ পুরস্কার পাওয়ার কৃতিত্বও ওঁর ভাগ্যে জুটেছিল।)
এছাড়াও ‘নতুন ফসল’(১৯৬০) সিনেমায় রাইচাঁদ বড়াল এবং ওস্তাদ বিলায়েত খানের সঙ্গীত পরিচালনায় প্রতিমা গাইলেন, ‘যেমন বেণী তেমনি রবে’।
আগেই উল্লেখ করা হয়েছে, এই সুরসাধিকার কণ্ঠে সব ধরনের গানের জন্য তৈরি ছিল- শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের রাগরাগিণী থেকে শুরু করে লোকায়ত সুরের গান, ভজন, ছায়াছবির গান, বাউল -সব গানেই তিনি সসম্মানে উত্তীর্ণ হয়েছেন। যে প্রতিমা হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের সুরে ‘পরিণীতা’(১৯৬৯) চলচ্চিত্রে ‘কুসুম দোলায় দোলে শ্যাম রায়’ গেয়েছেন, তিনিই ‘নীলাচলে মহাপ্রভু’ সিনেমায় ‘মাধব বহুত মিনতি’, ‘কী রূপ দেখিনু’-র মতো কীর্তনও গেয়েছেন, আবার ‘মায়ার সংসার’(১৯৬২) চলচ্চিত্রে রবীন চট্টোপাধ্যায়ের সুরে ‘আমার প্রভাত মধুর হলো’, বেসিক গানের মধ্যে সুধীন দাশগুপ্তের সুরে ‘সাতরঙা এক পাখি’, ‘এপারে গঙ্গা ওপারে গঙ্গা’-র মতো সুরের গানের সঙ্গে ‘প্রেম শুধু এক মোমবাতি’- র মতো গানও প্রতিমা বন্দ্যোপাধ্যায়কে দিয়ে গেয়েছিলেন, আর সুরের প্রতিমানির্মাণকারী শান্ত নিভৃত সাধিকা প্রতিমাও ঠিকই সাবলীলভাবে গানগুলোর যথাযথ বিচার করেছিলেন। এখানেই ওঁর কৃতিত্ব। প্রতিমা বন্দ্যোপাধ্যায়কে বলা হতো ‘গায়িকাদের গায়িকা’’।
অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়, শ্যামল মিত্র প্রতিমার গানের গুণগ্রাহী ছিলেন। প্রতিমা প্রায় সব স্বনামধন্য গীতিকার, সুরকারের সুরেই গান গেয়েছিলেন। মোহিনী চৌধুরী, প্রণব রায়, শৈলেন রায়, অরূপ ভট্টাচার্য, ভাস্কর বসু, মঙ্গলাচরণ চট্টোপাধ্যায়, প্রবোধ ঘোষ, শিবদাস বন্দ্যোপাধ্যায়, পবিত্র মিত্র, সুবীর হাজরা, বাণীকুমার, শ্যামল গুপ্ত, মিল্টু ঘোষের মতো গীতিকারদের লেখায় যেমন গেয়েছেন, তেমনি সুধীন দাশগুপ্ত, নচিকেতা ঘোষ, প্রবীর মজুমদার, শৈলেন মুখোপাধ্যায়, প্রশান্ত চৌধুরী, মৃণাল বন্দ্যোপাধ্যায়, মান্না দে, দিনেন্দ্র চৌধুরী, মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়, শ্যামল মিত্র, অশোক রায়, অনল চট্টোপাধ্যায়, রবীন চট্টোপাধ্যায়, জয়দেব সেন, ভূপেন হাজারিকা প্রভৃতি সুরকারদের
সুরসৃষ্টিতে প্রতিমা বন্দ্যোপাধ্যায় সাফল্যের সঙ্গে কাজ করেছেন, যা মোটেই সহজ ব্যাপার নয়।
রতু মুখোপাধ্যায়ের সুরে ‘মন যে খুশি খুশি আজ’,’বিষের বাঁশি কে বাজায় গো’, অনল চট্টোপাধ্যায়ের সুরে ‘ছলকে পড়ে কলকে ফুলের মধু’,’মেঘ রাঙানো অস্ত আকাশ’, কিংবা ভূপেন হাজারিকার সুরে ‘তোমায় কেন লাগছে এত চেনা’-এসবই কালোত্তীর্ণ হয়ে গিয়েছে, যা আজও মনকে মাতিয়ে রাখে। এছাড়া পঙ্কজ মল্লিকের সুরে মহিষাসুরমর্দিনীর জন্য প্রতিমার গাওয়া ‘অমল কিরণে ত্রিভুবন মনোহারিনী’ গানটিও অসাধারণ একটি কাজ। মীরার ভজন, চন্ডীদাস, বিদ্যাপতি, গোবিন্দদাসের রচনা, প্রচলিত লোকগান (যেমন -বন্ধু সময় জানো না অসময়ে বাজাও, আমি বন্ধুর প্রেমাগুনে পোড়া), শ্রীরাধিকার মানভঞ্জন ইত্যাদি গানও প্রতিমা বন্দ্যোপাধ্যায় রেকর্ড করেছিলেন।
তবে রবীন্দ্রসঙ্গীত, নজরুলগীতি তুলনায় কম গেয়েছেন, কিন্তু যা গেয়েছেন সবই প্রশংসিত হয়েছে। ছায়াছবিতে প্রথম রবীন্দ্রসঙ্গীত রেকর্ড করেছিলেন ‘বৌ ঠাকুরাণীর হাট’ ছবির জন্য ১৯৬৮ সালে। গানটি ছিল ‘চাঁদের হাসির বাঁধ ভেঙেছে’(এই চলচ্চিত্রে ব্যবহৃত ‘ওকে ধরিলে তো ধরা দেবে না’-গানের সমবেত কণ্ঠেও ছিলেন)। এরপর ১৯৬৭ সালে ‘ছুটি’ সিনেমায় ‘এই লভিনু সঙ্গ তব’(সহগায়ক চিন্ময় চট্টোপাধ্যায়), ’চৌরঙ্গী’(১৯৬৮) সিনেমায় ‘এই কথাটি মনে রেখো’, ’বিসর্জন’(১৯৭৪) সিনেমায় ‘আমি একলা চলেছি এ ভবে’ -প্রতিমার কণ্ঠে এইসব রবীন্দ্রসঙ্গীত শ্রোতারা দারুণভাবেই গ্রহণ করেছে। এছাড়া বেসিক গানের রেকর্ডে প্রতিমা বন্দ্যোপাধ্যায় ‘তোমারি ঝরনাতলার নির্জনে’(রেকর্ডকাল ১৯৬৮), ‘আমার মল্লিকাবনে’ এই দুটো রবীন্দ্রসঙ্গীতও রেকর্ড করেছিলেন। এছাড়া ‘এখানে পিঞ্জর’(১৯৭১) সিনেমায় ভূপেন হাজারিকার সঙ্গীত পরিচালনায় প্রতিমার কণ্ঠে অতুলপ্রসাদ রচিত ‘একা মোর গানের তরী’ শ্রোতাদের কাছে আজও স্মরণীয়। তারপর ‘অসময়’(১৯৭৬) চলচ্চিত্রে আনন্দ শঙ্করের সঙ্গীত পরিচালনায় ‘দখিন সমীরণ সাথে’, এবং ‘ভুলি কেমনে আজও যে’(সহশিল্পী মান্না দে) এই দুটি নজরুলগীতি প্রতিমা বন্দ্যোপাধ্যায় রেকর্ড করেছিলেন। আর বেসিক গানের রেকর্ড হিসাবে ‘রাঙামাটির পথে লো বাদল বাজে’,’চল টুসু চল খেলতে যাব’(সহশিল্পী নীলিমা বন্দ্যোপাধ্যায়), ‘চল চল ঊর্ধ্ব গগনে বাজে মাদল’,’দুর্গম গিরি কান্তার মরু’,’নহে নহে প্রিয় এ নয় আঁখিজল’,’যাও যাও তুমি ফিরে যাও’,’মোর না মিটিতে ভাঙিল খেলা’, ‘শুকনো পাতার নূপুর পায়ে’,’রুম ঝুম রুম ঝুম খেজুর পাতার’,’পথহারা পাখি কেঁদে ফেরে একা’,’যবে তুলসীতলায় প্রিয় সন্ধ্যা বেলায়’, ‘শ্যাম তুমি যদি রাধা হতে শ্যাম’-প্রভৃতি নজরুল গীতি,
অতুলপ্রসাদের গানের মধ্যে ‘আর কতকাল থাকবো বসে’,’ক্ষমিও হে শিব’ – লালন ফকিরের লেখা ‘আর আমারে মারিস নে মা’,’এ বড় আজব কুদরতি’,’আমার মনের মানুষের সনে’,’আয় কে যাবি আয় কে যাবি ওপারে’-এইসব কাব্যগীতি তো প্রতিমার কণ্ঠের মণিমাণিক্যে আজও যেমন উজ্জ্বল, তেমনি ওঁর অজস্র আধুনিক গানের মধ্যে ১৯৫৫ সালে রেকর্ডকৃত সলিল চৌধুরীর কথা এবং সুরে ‘নাও গান ভরে নাও কান ভরে’, কিংবা যতীন্দ্রমোহন বাগচির লেখা এবং সুধীন দাশগুপ্তর সুরকৃত ‘বাঁশ বাগানের মাথার উপর চাঁদ উঠেছে ওই’- আজও প্রতিমার স্বর্ণকণ্ঠকে বারবার মনে পড়ায়।
প্রতিমা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বেসিক রেকর্ডের গানের প্রসঙ্গে বলা যায়, ১৯৪৫ সালে সুকৃতি সেনের কথায় ও সুরে ‘প্রিয় খুলে রেখো বাতায়ন’,আর ‘প্রিয় মালাখানি দিও’ সেনোলা কোম্পানি থেকে বেরোনো এই দুটি গানই ছিল ওঁর প্রথম রেকর্ড। তখন তিনি কুমারী প্রতিমা চট্টোপাধ্যায় (মাত্র এগারো বছর বয়স।)। একে একে ‘হায় রে আমার ঘর ছিল ঘরে ভাত ছিল(বাস্তবগীতি, কথা- মোহিনী চৌধুরী, সুর- নিতাই ঘটক),
‘আমার সোনা চাঁদের কণা ভুবনে তুলনা নাই’(কথা- প্রণব রায়, সুর-নিতাই ঘটক), ‘ঘুম আয় রে আয়’(কবি মঙ্গলাচরণ চট্টোপাধ্যায়ের লেখায় সলিল চৌধুরীর সুর), ‘তুমি এলে আজ কী দিব তোমায়’(কথা-অরূপ ভট্টাচার্য, সুর-দুর্গা সেন), কিংবা পরবর্তীকালে ‘কঙ্কাবতীর কাঁকন বাজে ইছামতীর কূলে’(গীতিকার- অনল চট্টোপাধ্যায়, সুর- শ্যামল মিত্র), ‘মেঘলা ভাঙা রোদ উঠেছে’(গীতিকার পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়, সুর- নচিকেতা ঘোষ), ‘একটা গান লিখো আমার জন্য’(কথা সুবীর হাজরা, সুর-সুধীন দাশগুপ্ত),’কই গো কই গো কই আমার বকুল ফুল কই’(কথা- গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার, সুর শ্যামল মিত্র), ‘মালা থেকে ফুল চোখ থেকে জল’,’ও চাঁদ মামা শোন’(দুটো গানেরই কথা ও সুর প্রশান্ত ভট্টাচার্যের),’বড় সাধ জাগে একবার তোমায় দেখি’(কথা-পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়, সুর- হেমন্ত মুখোপাধ্যায়),’আমি অনেক চেয়েও পারিনি ভুলিতে’,’আমি মন হারালাম তার কাজল চোখে’(দুটো গানেরই কথা ও সুর জয়দেব সেনের),’জীবনের তাপে শুধু কথার প্রদীপ’(কথা ও সুর- মানস চক্রবর্তী), ‘আমার দুচোখ কেন স্বপ্ন দেখে তোমাকে’,’নীরব নিঝুম নিশি রাত মনের কথাই বলা বাকি’(দুটো গানেরই কথা- মোহিনী চৌধুরী, সুর- রতু মুখোপাধ্যায়ের)-এরকম আরো অজস্র আধুনিক গান প্রতিমা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দক্ষতা বারবার চিনিয়ে দেয়। গুরু প্রকাশকালী ঘোষালের কথা এবং সুরে ‘পথ ডাকে ওরে আয়’,’মিলন বাসরে আন’(রেকর্ডকাল ১৯৫৪), ‘সবই যদি ভুল ছবি যদি যাও ভুলে’(রেকর্ডকাল ১৯৮০)-গানগুলো গুরুর সুযোগ্যা শিষ্যা প্রতিমা গেয়েছিলেন। এছাড়া ‘ছুটি’(১৯৬৭) চলচ্চিত্রে সঙ্গীত পরিচালিকা হিসাবে অরুন্ধতী দেবী
প্রতিমাকে দিয়ে রিমেক করিয়েছিলেন, দুটি বিখ্যাত গান- ‘আমার হাত ধরে তুমি নিয়ে চলো সখা’(কথা-ধীরেন চট্টোপাধ্যায়, সুর-ভূতনাথ দাস), ‘আমার জীবন নদীর ওপারে’(কথা- বরদাপ্রসন্ন দাশগুপ্ত, সুর-ভূতনাথ দাস)। গানদুটো বেশকিছু আগে কিংবদন্তী শিল্পী আঙুরবালা রেকর্ড করলেও প্রতিমার ঈশ্বরপ্রদত্ত কণ্ঠে ওইসময় থেকে খুবই জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। উল্লেখ্য, যে প্রতিমা বন্দ্যোপাধ্যায়ের গাওয়া ‘আমি জেগে থাকি আর রাত ঘুমায়’ গানটি পরবর্তীকালে পণ্ডিত অজয় চক্রবর্তী গেয়েছেন। ১৯৬৬ সালে প্রতিমা বন্দ্যোপাধ্যায়ও হিমাংশু দত্ত স্মরণে শৈলেন রায়ের কথা ও হিমাংশু দত্তের সুরকৃত ‘বনের চামেলি ফিরে আয়’,’রাতের দেউলে জাগে’ গান দুটো রেকর্ড করেছিলেন।
অনন্য প্রতিভার অধিকারী এই মানুষটি সাধারণ জীবনযাপন করতেন, যা এখনকার দিনে ভাবাই যায় না। সংসার সামলেছেন, ছেলেমেয়েকে মানুষ করেছেন, গান রেকর্ড করে আবার গৃহস্থালির কাজে হাত লাগিয়েছেন, রান্নাবান্না করেছেন -সহজ সরল নিয়মমাফিক জীবনযাপন করে গেছেন চিরটা কাল। আত্মমনস্ক ছিলেন। দূরদর্শনে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে সাক্ষাৎকার নেওয়া প্রতিমা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথায় ও সুরে অনুষ্ঠানটি বেশ আন্তরিকতাপূর্ণ ছিল। ইউটিউবে এখনো সাদা কালো এই ভিডিওটি দেখতে পাওয়া যায়। ছেলেমেয়েরা বড়ো হয়ে নিজেদের পায়ে দাঁড়ালেও ১৯৮৬ সালে স্বামীর মৃত্যুর পর প্রতিমা কার্যত মনের দিকে একলা হয়ে পড়েন। নিজের মধ্যে নিজেকে গুটিয়ে ফেলেন। হয়তো মানসিক সমস্যাও তৈরি হয়েছিল। সময়টাও ওঁর সঙ্গ দিচ্ছিল না। শেষ বছরগুলোতে বেশ কষ্টে কেটেছিল। পায়ে বাতের ব্যথায় কষ্ট পেতেন। কলকাতার সাহানগর রোডের বাড়ির পাশে মলিন কাপড় পরে মুদির দোকানের সামনে বসে থাকতে দেখা যেত। তবে সমস্ত শারীরিক মানসিক প্রতিবন্ধকতার মতো মধ্যেও সামনে হারমোনিয়াম ধরিয়ে দিলে পরিণত বয়সেও সুরের একচুলও এদিক-ওদিক হতো না। ১৯৯৬ সালে শেষবারের মতো অনুষ্ঠানে গান শুনিয়েছিলেন। চেহারায় মানসিক জড়তা থাকলেও গলায় গান ধরতেই যেন বাংলা গানের প্রতিমা যেন স্বমহিমায় আবারও…। কিন্তু এই-ই শেষ।
২০০৪ সালের ২৯শে জুলাই সব কষ্টের অবসান ঘটিয়ে সুরলোকে পাড়ি দেন বাংলা গানের চিরভাস্বর প্রতিমা।
গানকেই জীবনের সাধনা মনে করেছেন। (শোনা যায় মধ্যরাতে গানের রেওয়াজে বসতেন।) উনসত্তর বছরের জীবনের সব সংগ্রামেই সুরের মধ্যেই প্রাণের শান্তি পেতে চেয়েছেন। সময় বদলালেও সাধনা ছিল অটুট।
তাই আজ এতদিন পরেও অন্যান্য শিল্পীদের কণ্ঠের অনুকরণ করা গেলেও প্রতিমার কণ্ঠের অনুকরণ করা কার্যত অসম্ভব। ওঁর গাওয়া গান রিমেকও হয় না। কারণ তিনি সুরের প্রতিমা।
সাধারণ মধ্যবিত্ত চেহারার আড়ালে সুরমঞ্জরীর সম্পদ- এতকিছু যেন প্রতিমার মধ্যেই সম্ভব। ঈশ্বর যেন সব রকম সুর ওঁর মধুকণ্ঠে ভরিয়ে দিয়েছিলেন। যোগ্যতা অনুযায়ী আরও সম্মান দেওয়া উচিৎ ছিল। কিন্তু স্বভাবগত সারল্য সততা সাধনাকে সাক্ষী করে প্রতিমা যেন আঁধারেই রয়ে গেলেন – হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের সুরে তাঁর গাওয়া বিখ্যাত এই গানটিতে যেন প্রতিমা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নিজের কথাই বারবার ফিরে ফিরে আসে-
‘আঁধার আমার ভালো লাগে তারা দিয়ে সাজিও না আমার আকাশ।’
যতদিন পৃথিবীতে সুর থাকবে, ততদিন এই সঙ্গীতসাধিকাকে আপামর বাঙালি শ্রোতা চিরকাল মনে রাখবে। কালের যন্ত্রণা নিয়ে শিল্পী হয়তো চলে যান, কিন্তু শিল্পের সাধনা যেমন যে কোনো যুগের কাছে একটা নিদর্শন হয়ে থাকে, তেমনি কোনোদিনই সঙ্গীতের মৃত্যু বলে কিছু হয় না। এই সুধাকণ্ঠীকে আমার সশ্রদ্ধ প্রণাম। প্রতিভাস ম্যাগাজিন
তথ্য:
১.সাধারণ প্রতিমা: অসাধারণ গান, শৌনক গুপ্ত
২. বাংলা লাইভ
৩. আনন্দবাজার
৪.গুগল