অমিতাভ সরকার

কাহারবা নয় দাদরা বাজাও

বাংলা গানের মজরুহ সুলতানপুরী গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার

তিনি গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার। দশ হাজারের মতো বাংলা গান তাঁর কলম থেকেই। সর্বকালের সেরা দশটি বাংলা গানের মধ্যে প্রথম পাঁচটা গানই ওঁর লেখা। আধুনিক গানের পাশাপাশি বাংলা সিনেমাতে তাঁর গান মানেই সেই সিনেমা সুপারহিট। এটা এমন সময়ের কথা, যখন গান হিট হওয়া মানে শুধু গায়ক-গায়িকাদেরই নাম হতো, তাদের আড়ালে সেইসব গানের গীতিকার, সুরকার, বাদ্যযন্ত্রী সবার পরিশ্রমই ঢাকা পড়ে যেত। এমনও হয়েছে, প্রযোজক, চিত্রপরিচালক, এমনকি সঙ্গীত পরিচালকরাও তাঁদের সিনেমা হিট করানোর জন্য গৌরীপ্রসন্নকে দিয়ে গান লিখিয়েছেন, এবং সেইসব সিনেমাও সুপারহিট হয়েছে।’মৌ বনে আজ মৌ জমেছে’, ‘আমার স্বপ্নে দেখা রাজকন্যা’, ‘গানে মোর ইন্দ্রধনু’,’এই রাত তোমার আমার’,’কেন দূরে থাকো’, ‘এই পথ যদি না শেষ হয়’- আরও কত…! এ তালিকা অনেক। কখনো সুরেও কথা বসিয়ে গানটি কালজয়ী হয়ে গেছে, কখনো কথাতেই বাজিমাৎ। আর সঙ্গে সুরের স্বচ্ছন্দ চলন তো ছিলই। তখন গীতিকার সুরকার শিল্পী সবাই অনেক পরিশ্রম করে অনেক সময় দিয়ে গানগুলো তৈরি করতেন। মতানৈক্যের পরেও পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধই ছিল বড়। এঁরা মানুষ হিসেবেও ছিলেন বড় মাপের। যেমন নচিকেতা ঘোষ। ওঁর সুরকৃত ৭০ শতাংশ গানের রচয়িতা গৌরীপ্রসন্ন। ‘স্মরণের এই বালুকাবেলায়’, ’তুমি আমার চিরদিনের’,’মানুষ খুন হলে পরে’,’যা খুশি ওরা বলে বলুক’,’এবার ম’লে সুতো হবো’,’কাহারবা নয় দাদরা বাজাও’,’সাক্ষী থাকুক ঝরা পাতা’-এসব গান আজও  চিরস্মরণীয়। এই বরেণ্য জুটির পাশাপাশি হেমন্ত-গৌরীপ্রসন্ন, মান্না-গৌরীপ্রসন্ন বা শ্যামল-গৌরীপ্রসন্ন জুটিও শ্রোতাদের প্রচুর ভালো ভালো বাংলা গান উপহার দিয়েছে। 

শ্যামল মিত্রের গাওয়া ৯০ শতাংশ গানের কথা গৌরীপ্রসন্নের। এছাড়া মান্না দে’কে বাংলা গান গাওয়ার ব্যাপারে উৎসাহ দেওয়ার কৃতিত্বও তাঁরই। কাকতালীয়ভাবে, মান্না দের প্রথম বাংলা গানের রচয়িতা গৌরীপ্রসন্ন আর গৌরীপ্রসন্নের জীবনের সর্বশেষ লেখা গানের শিল্পী মান্না দে, স্বয়ং। লতা, আশা, কিশোরকুমার, রফি থেকে শুরু করে প্রতিমা বন্দ্যোপাধ্যায়, সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়, আরতি মুখোপাধ্যায়, আল্পনা বন্দ্যোপাধ্যায়, তরুণ বন্দ্যোপাধ্যায়, ভূপেন হাজারিকা- সবাই ওঁর লেখায় কণ্ঠ দিয়েছেন। পরবর্তীকালে গৌরীপ্রসন্নের লেখা,  নীতা সেনের সুরে ‘কৃষ্ণ সুদামা’ ‘সোনার বাংলা’,’জঙ্গল পাহাড়ি’, ‘সতী সাবিত্রী সত্যবান’,’বাবা তারকনাথ’ প্রভৃতি সিনেমার গানগুলোও বেশ জনপ্রিয় হয়। শক্তি সামন্তের ‘আরাধনা’ সিনেমার বাংলা ভার্সানটিতেও গানের কথা ওঁরই লেখা। উল্লেখ্য, যে হলিউডের ইংরাজী ছবিতে ব্যবহার করা প্রথম বাংলা গানের রচয়িতাও কিন্তু এই আত্মভোলা মানুষটি। ১৯৭২ সালে কনরাড রুকস হারম্যান হেসের লেখা উপন্যাস অবলম্বনে ‘সিদ্ধার্থ’ নামের একটি ইন্দো-আমেরিকান সিনেমায় গৌরীপ্রসন্নের লেখা ‘ও নদী রে, একটি কথা’, আর ‘পথের ক্লান্তি ভুলে’ গানদুটো ব্যবহার করেছিলেন সঙ্গীত পরিচালক সুরকার বাংলার আরেক কিংবদন্তি হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। এটা কিন্তু কম গর্বের ব্যাপার নয়।   

তাছাড়া যে কোনো সিচুয়েশনের উপর নির্ভর করে বিভিন্ন ধরনের গান লিখে ফেলতে পারার তাঁর এক অদ্ভুত ক্ষমতা ছিল। এভাবেই যেমন গৌরীপ্রসন্ন মজুমদারের লেখা ‘ভাদর আশ্বিন মাসে ভ্রমর বসে কাঁচা বাঁশে’ কিংবা ‘দাদা পায়ে পড়ি রে, মেলা থেকে বৌ এনে দে’, অংশুমান রায়ের কণ্ঠে গানদুটো আজও অমর হয়ে আছে (অধিকাংশ মানুষ জানেন, যে গান দুটোর কথা প্রচলিত। কিন্তু আসল সত্যিটা হলো দুটো গানই গৌরীপ্রসন্নের লেখা), তেমনি  বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় লেখা ‘শোনো একটি মুজিবরের’, বা ‘মা গো, ভাবনা কেন’ গানগুলো তো একেকটা মাইলফলক। ১৯৬৫ সাল থেকে পাকাপাকিভাবে কলকাতায় চলে এসে রামগড়ে বসবাস করতেন। বাংলাদেশ স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে তৈরি হলে বঙ্গবন্ধু মুজিবুর রহমানের আহ্বানে শেষবারের মতো বাংলাদেশ যান। 

আবার গানের কথায় ফিরে আসি।

তবে শুধুই গান লেখা নয়, নিজে  সব ধরনের সাহিত্যচর্চাই পছন্দ করতেন। ছোটোবেলায় ইংরেজিতে কবিতা লিখতেন। মাত্র ষোল বছর বয়সেই রবীন্দ্রনাথের অনেক কবিতা ইংরেজিতে অনুবাদ করেছিলেন। শোনা যায়, কবি অমিয় চক্রবর্তীকে দিয়ে কবিগুরুও ওঁর সঙ্গে দেখা করতে চেয়েছিলেন, কিন্তু সে বছরই কবি মারা যান, বলে এই সাক্ষাৎ আর ঘটেনি। আগেই বলেছি, ছোটোবেলা থেকেই ইংরেজি ভাষাতে ওঁর দারুণ দখল ছিল। কালিদাসের ‘মেঘদূত’-এরও ইংরেজি অনুবাদ করেছিলেন। এমনকি দীনেন্দ্র চৌধুরীর ‘পদ্মানদীর মাঝি’(মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপন্যাস ‘পদ্মানদীর মাঝি’-র গীতিরূপ) ইংরেজিতে অনুবাদ ওঁর করা। এমনকি গৌরীপ্রসন্নের অনুবাদকৃত জয়দেবের ‘গীতগোবিন্দ’-র পাণ্ডুলিপি কলেজ স্ট্রিটের পাবলিশিং হাউস প্রকাশ করবে বলে নিয়ে আর ফেরত দেয়নি।  ‘মেঘনাদবধ কাব্য’-র অনুবাদও প্রায় শেষ করে এনেছিলেন। পরবর্তীকালে ওঁর বাড়ির বিভিন্ন জিনিসপত্রের সঙ্গে এটিও চুরি হয়ে যায়। 

মানুষটা নিজেও বেশ ফিটফাট ছিলেন। মানুষ হিসেবেও ছিলেন দরাজ মনের। গান লেখার জন্য তিনি সব সময় যেমন একই কলম ব্যবহার করা পছন্দ করতেন না, তেমনই শব্দের উচ্চারণের ব্যাপারে যথেষ্ট খুঁতখুঁতানি ছিল। পাবনার বাঙাল দীর্ঘদেহী এই মানুষটি শিঙি, বোয়াল মাছ, বিউলির ডাল, আলু পোস্ত খেতে ভালোবাসতেন। পরনে পাজামা-পাঞ্জাবি, হাতে চারমিনার সিগারেট এই ছিলেন গৌরীপ্রসন্ন। পরে অবশ্য চারমিনারের বদলে মুখে পানমশলা দিয়ে রাখতেন।  

হাতের লেখা ছিল মুক্তোর মতো সুন্দর। সঙ্গীত রচনার পাশাপাশি অন্যান্য লেখার হাতও ছিল বেশ চমৎকার। বাংলা সিনেমার জন্য প্রায় দশটি মতো উপন্যাসের রচয়িতা স্বয়ং গৌরীপ্রসন্ন। অনেকেই জানেন না, যে উনি সিনেমার চিত্রনাট্যও লিখেছেন। ছায়াসঙ্গিনী(১৯৫৬),সূর্যতোরণ(১৯৫৮),বিপাশা(১৯৬২),সূর্যতপা(১৯৬৫), শুধু একটি বছর(১৯৬৬),চিরদিনের(১৯৬৯),প্রক্সি(১৯৭৭), নন্দন(১৯৭৯),সূর্য সাক্ষী(১৯৮১) -প্রভৃতি সিনেমার চিত্রনাট্য ওঁরই করা। এছাড়া  ‘ছায়াসঙ্গিনী’, ‘শুধু একটি বছর’, ‘সূর্যতোরণ’,’সূর্যতপা’,’দেয়া নেয়া’, ’চিরদিনের’,’সূর্যসাক্ষী’,’প্রক্সি’,’নন্দন’-সিনেমাগুলোর কাহিনীও  গৌরীপ্রসন্নের লেখা। 

জন্ম ১৯২৪ সালের ৪ ডিসেম্বর কলকাতার ইডেন হিন্দু হোস্টেলে। বাবা গিরিজাপ্রসন্ন মজুমদার, মা সুধা দেবী। বাবা প্রেসিডেন্সি কলেজের উদ্ভিদবিদ্যার অধ্যাপক হলেও সাহিত্যে অনুরক্ত ছিলেন। মা ছিলেন বিএ পাশ, তিনি একটি  উপন্যাসও লিখেছিলেন। বাবা গিরিজাপ্রসন্নও ছোটোদের জন্য গল্প, প্রবন্ধ, বই লিখেছেন।  

বাড়িতে পড়াশোনার পরিবেশ থাকার কারণে স্কুল বইয়ের পাশাপাশি ছোটোর থেকেই গৌরীপ্রসন্নের দেশি-বিদেশি সবরকম বই পড়ার প্রতি একটা আগ্রহ গড়ে উঠেছিল। পৈত্রিক বাড়ি বর্তমান বাংলাদেশের পাবনা জেলার গোপালনগরে। সেখানকার জগবন্ধু ইনস্টিটিউশন থেকে পড়াশোনা করে কলকাতায় প্রেসিডেন্সি কলেজে ভর্তি হয়েছিলেন। বাবার ইচ্ছে ছিল সিভিল সার্ভিস পাশ করা, কিংবা আইনজ্ঞ হওয়ার, কিন্তু ইংরেজি এবং বাংলা দুটোতেই যথেষ্ট পারদর্শী ছিলেন গৌরীপ্রসন্ন, দুটো বিষয়েই স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। কিছুদিন ইংরেজি সাহিত্যের শিক্ষক হিসাবে কলকাতার কোনো এক কলেজে পড়িয়েওছিলেন। নিজেও পড়াশোনাতে খুব ভালো ছিলেন। তবে ছোটবেলায় মা মারা যাওয়ায় ওদের দুই ভাই দুই বোনকে নিজেদের মতো করে বড় হতে হয়। তবে ছোটোবেলায় গৌরীপ্রসন্ন ছবি আঁকা, লেখালেখির পাশাপাশি ঘুড়ি ওড়াতে বেশ পছন্দ করতেন, এমনকি ক্রিকেট, ফুটবল- এসব ভালোবাসলেও গানের প্রতি আগ্রহ কিন্তু বরাবরই ছিল। কাকা জে এন তালুকদার ওঁর মাকে বিলেত থেকে গ্রামফোন কিনে দিয়েছিলেন। গৌরীপ্রসন্নের সঙ্গীত জীবনে আসার জন্য এই কাকার অবদান যথেষ্ট। এই গ্রামোফোনে বিভিন্ন ধরনের গান বাড়িতে সব সময়ই বাজতো। গান শিখেছিলেন অনুপম ঘটকের কাছে। অনুপম ঘটককে তিনি গুরু বলে স্বীকার করতেন। তাছাড়া কলেজে পড়ার সময় পার্ক স্ট্রিটে গিরিজাশংকর চক্রবর্তীর কাছে সঙ্গীত এবং মিহিরকিরণ ভট্টাচার্যের কাছে বেহালা শিখেছিলেন। প্রেসিডেন্সি কলেজে পড়াকালীন সতীর্থরূপে  বিমলভূষণের সঙ্গে ওঁর আলাপ হয়।  ১৯৪৬ সালের জুলাইয়ে গৌরীপ্রসন্নর লেখা -’আমি বুঝিতে পারি না কী আছে তোমার মনে’,’শুধু পত্র ঝরায় অলস চৈত্র বেলা’ গান দুটো বিমলভূষণ রেকর্ডে গেয়েছিলেন। এছাড়া গৌরীপ্রসন্নের লেখা শচীনদেব বর্মনের সুরে ও কণ্ঠে ‘বঁধু গো এই মধুমাস’-গানটি প্রকাশিত ও জনপ্রিয় হয়। একে একে ‘পূর্বরাগ’,’প্রিয়তমা’, ‘অরক্ষনীয়া’, ‘স্বামী’,’তুলসীদাস’ -প্রভৃতি সিনেমাতে গান রচনার সুযোগলাভ এবং গীতিকার হিসাবে অনেক অল্প বয়সেই যথেষ্ট কৃতিত্ব অর্জন। আর তাঁকে পিছনে ফিরতে হয়নি। তখন থেকেই সিনেমার গানের পাশাপাশি অধিকাংশ বাংলা বেসিক গানের কথাকার এই – গৌরীপ্রসন্নই।

‘আমার গানের স্বরলিপি’, ‘মেঘ কালো আঁধার কালো’,’তীর ভাঙা ঢেউ’, ‘অলির কথা শুনে বকুল হাসে’,’এই মোম জোছনায় অঙ্গ ভিজিয়ে’, ‘চলো রীনা ক্যাসুরিনা’,   

‘প্রেম একবারই এসেছিল নীরবে’,  ’জানি একদিন আমার জীবনী লেখা’,’বনে নয় মনে মোর’,

‘আমার মনের এই ময়ূর মহলে’, ’মহুয়ায় জমেছে আজ মৌ গো’ -গানগুলোর কোনো তুলনা হয়! যিনি শ্যামল মিত্রের জন্য লিখছেন, ‘যদি ডাকো এপার হতে এই আমি আর ফিরবে না’, তিনিই কিশোরকুমারের জন্যে লিখছেন  ‘সিং নেই তবু নাম তার সিংহ’,’চাম চিকে বম বম’। অভিনেতা বিশ্বজিতের স্বকণ্ঠে গাওয়া ‘তোমার চোখের কাজলে’,’বলাকা ও বলাকা’ গানদুটোর কথাও তাঁরই। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের পাশাপাশি গীতিকার প্রণব রায়কেও তিনি শ্রদ্ধা করতেন। 

সময়টা তখন ছিল তো অন্যরকম। 

গৌরীপ্রসন্নের সময় গীতিকার হিসেবে বিখ্যাত ছিলেন অজয় ভট্টাচার্য, শৈলেন রায়, মোহিনী চৌধুরী (মোহিনী চৌধুরী এবং গৌরীপ্রসন্ন গীতিকার হিসাবে একসঙ্গে সর্বপ্রথম বোম্বে টকিজের ‘সমর’ এবং শেষবারের মতো ১৯৬৭ সালে অগ্রদূত পরিচালিত ‘নায়িকা সংবাদ’ সিনেমায় কাজ করেছিলেন। একই সিনেমায় একাধিক গীতিকার বা সুরকারকে ব্যবহার করা হয়েছে, এমন নিদর্শন সত্যিই ব্যতিক্রমী।)। 

পরবর্তীকালে অনেক অভিমান আক্ষেপ থেকেই বলেছিলেন, ‘কাব্য সাহিত্যের ইতিহাসে গীতিকারদের স্থান দেওয়া হয় না।…কবিসম্মেলনে কোনো গীতিকারকে ডাকা হয় না। কবিতায় সুর দিলেই গান হয় না। গানের ভাষা সম্পূর্ণ আলাদা।’ রবীন্দ্রনাথের কথা বলতে গিয়ে বলেছেন, ‘তিনি যে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন তা একটি গানের বইয়ের জন্য।’ জীবন সায়াহ্নে এসে তাঁর বলে যাওয়া  কথাগুলো আজও প্রাসঙ্গিক।      

ওঁর কথা বসানো ‘কফি হাউজের সেই আড্ডাটা’ নচিকেতা ঘোষের পুত্র শ্রদ্ধেয় সুপর্ণকান্তি ঘোষের সুরে মান্না দের গাওয়া (১৯৮৩ সালে রেকর্ডকৃত) অসম্ভব জনপ্রিয় এই গানটি ২০০৬ সালের বিবিসির রেকর্ড অনুযায়ী সর্বকালের শ্রেষ্ঠ বাংলা গান হিসেবে চতুর্থ স্থান লাভ করেছে। দীর্ঘ চল্লিশ বছরের সঙ্গীত জীবনে পঞ্চাশের দশক থেকে টানা তিন দশকে গৌরীপ্রসন্ন শচীনদেব বর্মন- রাহুলদেব বর্মন, নচিকেতা ঘোষ-সুপর্ণকান্তি ঘোষ এইরকম দুই প্রজন্মের সঙ্গেই কাজ করেছেন। এছাড়া পাবনায় ওঁর পারিবারিক ভিটের কাছাকাছিই থাকতেন আরেক বিখ্যাত সুরের পরিবার অপরেশ লাহিড়ী-বাপি লাহিড়ী, গৌরীপ্রসন্নের সঙ্গেও ওঁদের পারিবারিক সখ্য থেকে গিয়েছিল। গান লিখে নাম করার আগে থেকেই শচীনদেবের ভক্ত ছিলেন ছোট্ট বাচ্চু(গৌরীপ্রসন্নের ডাকনাম)। পরে কেরিয়ারের শুরুতে শচীনদেব বর্মনের জন্য গান লেখার সূত্রে পরিচয়টা দৃঢ় হয়, যা শেষদিন পর্যন্ত বজায় ছিল। আর সুরস্রষ্টা নচিকেতা ঘোষের বাড়িতে গৌরীপ্রসন্নের অবাধ যাতায়াত ছিল। নিজের সন্তান ছিল না বলে সুপর্ণকান্তি ঘোষকে নিজের ছেলের মতো ভালোবাসতেন। এছাড়া সেই সময়ের অগ্রজ-অনুজ শিল্পী সবার সঙ্গে ওঁর আন্তরিকতা ছিল নিবিড়। সবার মধ্যে পারস্পরিক শ্রদ্ধা, সম্মানটা বজায় ছিল। যার ফলে প্রচুর ভালো ভালো গানও এইভাবে তৈরি হয়েছে, মানুষগুলো হয়তো আজ আর অনেকেই নেই, কিন্তু কাজগুলো রয়ে গেছে পরবর্তী নতুন প্রজন্মের কাছে এক অদ্ভুত দৃষ্টান্ত হয়ে, যেজন্য আজও ওইসব মানুষগুলোর কাছে মাথা নত করতে হয়, যে কীভাবে কত ত্যাগ, কষ্ট সহ্য করে দিনের পর দিন বছরের পর বছর অসামান্য সব সৃষ্টি করে গেছেন, এক কথাই সত্যিই অনবদ্য। তবে প্রত্যাশা, বা পুরস্কারের কথা ভাবেননি কেউই।

নিরন্তর কাজ, অধ্যাবসায়, আর শ্রোতাদের ভালোবাসার মধ্যেই ওঁরা আনন্দের খোরাক খুঁজে পেতেন। হয়তো সেইজন্যই এত বড় একজন গীতিকার হলেও গৌরীপ্রসন্ন মজুমদারকেও পরবর্তীকালে অর্থকষ্টে ভুগতে হয়েছে। ’ঘুম বলেছি, নিঝুম এ নিশীথে’,‘কথা দিয়ে এলে না’, ‘এই সুন্দর পৃথিবী ছেড়ে মন যেতে নাহি চায়’,’যদি কাগজে লেখো না, কাগজ ছিঁড়ে যাবে’- এইসব সৃষ্টি যাঁর হাত থেকে, বড়োই বেদনার কথা যে সেই নিরংহকারী, মাটির মানুষটিও জীবনের শেষ দশ বছর দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়েছিলেন এবং তাতেই ১৯৮৬ সালের ২০শে আগস্ট মুম্বাইয়ে এক রকম অবহেলার মধ্যেই মাত্র ৬১ বছর বয়সে আরব সাগরের তীরে গিয়েই তাঁকে অমৃতের সাগরে পাড়ি জমাতে হলো, এবং শেষ সময় এই কিংবদন্তীর যত্ন নেওয়ারও কেউ ছিল না। এর থেকে কষ্টের আর কিছু হতে পারে! 

আজও তার গানগুলো এত বিখ্যাত, কিন্তু আমরা ভুলে গিয়েছি, সেই গানগুলোর রচয়িতাকেই। যশ, খ্যাতি, প্রচার -এসবের মধ্যেও মানুষ গৌরীপ্রসন্ন মজুমদারের সারাটা জীবন বড্ড একলা, বড্ড কষ্টের। শিল্পীর জীবন আর বেশি কী হবে! 

ওঁর স্মৃতির উদ্দেশ্যে ১৯৮৬ সালে গীতিকবি গৌরীপ্রসন্নের মৃত্যুর বছরই শিল্পী ও সুরকার নীতা সেন  ‘গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার স্মৃতি সংসদ’ প্রতিষ্ঠা করেন। এই প্রবাদপ্রতিম স্রষ্টার অপ্রকাশিত বিভিন্ন গানের সংকলন, তার অনুবাদ ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে তুলে ধরার চেষ্টা নিয়ে এই সংস্থা আজও কাজ করে চলছে।  

পরিশেষে এই ক্ষণজন্মা কবির লেখা লাইন উল্লেখ করেই এ লেখার উপসংহার টানলাম, ‘যেতে দাও আমায় ডেকো না, কবে কী আমি বলেছি মনে রেখো না।’

স্রষ্টাকে আমার বিনম্র শ্রদ্ধা, আর সবার জন্য রইলো আমার অন্তরের অনেক অনেক ভালোবাসা। প্রতিভাস ম্যাগাজিন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *