অমিতাভ সরকার
ঐ তো এলো ঝড়ের রাত্রি
বাংলা গানে অনুপম সুরের জোয়ারি অনুপম ঘটক
ছোট্ট থেকেই ছেলেটির গানের উপর টান। বাড়িতেও ছিল গানের পরিবেশ। তখন থেকেই ছেলেটি বিভিন্ন গানের আসরে গান শুনতে যেতো। গানের গলাও ছিল তেমনি।
পড়াশোনা চললেও সঙ্গীতচর্চা কোনোদিন বন্ধ হয়নি।
ছেলেটি তখন কিশোর। দেশ-গাঁ ছেড়ে কলকাতায় থেকে বিএ পড়ছেন। কলেজে এসেও গায়ক, খেলোয়াড় হিসাবে তার বেশ নাম।
একবার বাংলা নববর্ষে সে পয়লা বৈশাখের অনুষ্ঠানে বালিগঞ্জের সোনার দোকানে গান গাইতে এসেছে। সেখানেই এই প্রতিভাবান কিশোরের গান শুনে মুগ্ধ হয়ে যান হীরেন বসু। উনি নিজেও ছিলেন বাংলা চলচ্চিত্রের একজন বিশিষ্ট ব্যক্তি একাধারে গীতিকার, সুরকার, গায়ক, কাহিনী রচয়িতা, অভিনেতা, চিত্রপরিচালক -সব একসঙ্গে( বাংলা সবাক চলচ্চিত্রে নেপথ্য সঙ্গীতের আবিষ্কার ওঁর হাত ধরেই এবং তাতে প্রথম কণ্ঠদানও তিনিই করেছিলেন।)। এই হীরেন বসুর তত্ত্বাবধানেই ১৯৩০ সালে মাত্র উনিশ বছর বয়সে সেই কিশোরটির রেডিওতে প্রথম গান গাওয়া। ১৯৩২ সালে ‘হিন্দুস্থান’ রেকর্ড প্রকাশিত হয়, যার প্রথম শিল্পী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, দ্বিতীয় এবং তৃতীয় শিল্পী অতুলপ্রসাদ সেন, রেনুকা দাশগুপ্ত। চতুর্থ শিল্পী সেদিনের এই কিশোরটিই। হীরেন বসুর সহায়তায় ১৯৩২ সালেই আগস্ট মাসে ‘হিন্দুস্থান’ থেকে তার রেকর্ড বেরলো-’আজি সখি ঝরো ঝরো’(লেখা -তারাপদ রাহা), ’জানি তোমার সাথে দেখা হবে সাগর কিনারায়’(কথা-নৃসিংহ নারায়ণ মুখোপাধ্যায়)। প্রথম রেকর্ডটি বেশ জনপ্রিয় হওয়ায় ‘হিন্দুস্থান’ থেকে পরবর্তীকালে ওঁর আরো অনেক রেকর্ড বেরোয়। পরবর্তীকালে কিশোরটি সুরকার হিসাবে খ্যাতিলাভ করে। ১৯৩২ সালে ‘আজি এ শারদ বিজয়া গোধূলি’ তার নিজের সুরেই গাওয়া। ১৯৩৩ সালের জুনে আবার নিজের সুরে গাইলো, ‘আয় আয় বাদল পিয়াসী’(লেখা-অনিল কুমার বিশ্বাস), ‘ঐ তো এলো ঝড়ের রাত্রি’(কথা-মোশায়ের হোসেন চৌধুরী)। এছাড়া অন্যান্য রেকর্ডে গীত, ভজন, আগমনী গান, শ্যামা সঙ্গীত সব ধরনের গানই গেয়েছিল। পরে অবশ্য সুরকার হিসাবেই প্রভূত নাম করে।

যাঁর সম্বন্ধে এইসব কথা- তিনি আর কেউ নন, অনুপম ঘটক। হিন্দি গানের পাশাপাশি বাংলা চলচ্চিত্র ও আধুনিক গানে সুর নিয়ে নানান পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে সেই সময় (বাংলা গানে তখন রাইচাঁদ বড়াল, কমল দাশগুপ্ত, হিমাংশু দত্ত, শৈলেশ দত্তগুপ্ত, পঙ্কজকুমার মল্লিক প্রভৃতি সুরস্রষ্টাদের পাশে নিজের নামটি জনপ্রিয় করে তোলা মোটেও সহজ ছিল না।) যথেষ্ট কৃতিত্বের পরিচয় দিয়েছেন।
জন্ম ১৯১১ সালের ১১ই এপ্রিল বর্তমান বাংলাদেশের ময়মনসিংহ জেলার টাঙ্গাইল মহাকুমার পাথরাইল গ্রামে। বাবা অতুলচন্দ্র ঘটক, মা সুকুমারী দেবী দুজনেই গান ভালোবাসতেন। পিতামহ মাধবচন্দ্র ছিলেন চিকিৎসক, তাছাড়া কাকা ধীরেন ঘটকও কীর্তন গাইতেন। বাড়িতে গান এবং পড়াশোনা -দুটোরই পরিবেশ। ছোট্টর থেকে অনুপম ভালো বাঁশি বাজাতে পারতেন। সঙ্গে খেলাধূলাতেও ছিলেন তুখোড়। বাবার চাকরির কারণে দু’বছর বয়সে এলাহাবাদে চলে এলেও ১৯১৪ সালে আবার সবাই মিলে কলকাতায় এসে বাদুড়বাগানে বাড়িভাড়া নেন। ১৯১৬ সাল থেকে কসবার পৈতৃক বাড়িতেই আমৃত্যু সবার সঙ্গে বসবাস করেছেন।
গানের হাতেখড়ি বাবার থেকেই। এছাড়া ওস্তাদ মস্তান গামা, কেশব গণেশ ঢেকনের কাছে শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের প্রশিক্ষণ নেন। এছাড়া ভারতীয় বিভিন্ন আঞ্চলিক সঙ্গীতের প্রতিও অনুপম ঘটকের আগ্রহ লক্ষ্য করা যেত। শুরুটা কলকাতাতে হলেও কসবায় গানচর্চা বেশি হয়ে গেছিল বলে, (কসবার রায় বাবুদের
পুকুরঘাটে বন্ধুদের নিয়ে বাঁশি বাজানো, কিংবা গ্রামের মাঠঘাটে লোকগান, বাউল, চাষি, চারণ-কবি, মাঝি-মাল্লাদের গান এসব শুনে বেড়ানো ছিল কিশোর অনুপম ঘটকের পছন্দের কাজ।) পড়াশোনায় ঘাটতি হচ্ছে দেখে উচ্চশিক্ষিত বাবা ছেলেকে টাঙ্গাইলে পাঠিয়ে দেন। সেখান থেকে ম্যাট্রিক পাশ করার পর কলকাতায় ফিরে আশুতোষ কলেজে আইএ ক্লাসে ভর্তি হন।
বাবার ইচ্ছেয় পরবর্তীকালে পরীক্ষা দিয়ে এআই রেলের আসানসোল শাখায় চাকরি পান। তবে গানের জন্য চাকরিটা ছেড়ে দিয়েছিলেন।
হোমিওপ্যাথিক ডাক্তার ও সেকালের বিখ্যাত চলচ্চিত্র ব্যক্তিত্ব হীরেন বসুর (হীরেন্দ্রকুমার বসু) হাত ধরেই অনুপম ঘটকের বাংলা গানে প্রবেশ। এই মানুষটিকে অনুপম ঘটক নিজের গুরু বলে মানতেন এবং ওঁর প্রতিটি কথা শ্রদ্ধাভরে পালন করেছেন। হীরেন বসুর পরিচালনা ও সঙ্গীত নির্মাণে
নির্মিত ‘মহুয়া’(১৯৩৪) চলচ্চিত্রে ওঁর সহকারী হিসাবে কাজ করেছিলেন, তাই নয়, এই চলচ্চিত্রে অনুপম ঘটক অভিনয় এবং স্বকণ্ঠে গান করারও সুযোগ পান। ১৯৩৫ সালে ‘বিদ্রোহী’ চলচ্চিত্রে অভিনয় ও গান করেছিলেন। উল্লেখ্য, এই চলচ্চিত্রে হিমাংশু দত্ত, কৃষ্ণচন্দ্র দে -দুজন সুরকার ছিলেন, এবং অনুপম ঘটক ছাড়াও শচীনদেব বর্মন চারণ কবির ভূমিকায় রূপদান করেছিলেন। ‘বিদ্রোহী’ চলচ্চিত্রে হিমাংশু দত্তের সুরে চারণকবির ভূমিকায় অভিনয় করে নিজেরই গাওয়া ‘জাগো জাগো হে সুপ্তবীর’ গানটি খুব বিখ্যাত হয়। পরের বছর মুক্তিপ্রাপ্ত ‘গৃহদাহ’, ‘কালপরিণয়’ ‘পরপারে’,’পল্লীবধূ’ চলচ্চিত্রেও অনুপম ঘটক নেপথ্য কণ্ঠদান করেছিলেন। রাইচাঁদ বড়াল ‘বিদ্যাপতি’ চলচ্চিত্রেও তাঁর সহযোগী সঙ্গীত পরিচালক হিসেবে অনুপম ঘটককে কাজে নিয়েছিলেন। মুম্বাইয়ে চলচ্চিত্রটি খুব নাম করে। তবে ‘পায়ের ধুলো’(১৯৩৫) চলচ্চিত্রে অনুপম ঘটক প্রথমবার এককভাবে সঙ্গীত পরিচালনার দায়িত্ব পান। সর্বসাকুল্যে এই চলচ্চিত্রে আটটি গান ছিল। গীতিকার ছিলেন হেমেন্দ্রকুমার রায়। গান গেয়েছিলেন কমলা দে, বীণাপাণি দেবী, জহর গাঙ্গুলী। ১৯৩৭ সালে হীরেন বসুর আগ্রহে গেলেন মুম্বই। সাগর মুভিটোনের ছবিতে সঙ্গীত পরিচালক হিসাবে সুর দিলেও বাবা অসুস্থ হয়ে পড়ায় কলকাতা চলে আসতে হয়। এরপর ১৯৪৪ সালে লাহোরে যান। সেখানে গৌরী পিকচারস, মহেশ্বরী পিকচারসের
ছবিতে সুরসৃষ্টি করেন। হিন্দি, উর্দু প্রভৃতি সর্বভারতীয় ভাষায় তাঁর তৈরি সমস্ত সুরগুলোই সারা দেশে বেশ জনপ্রিয় হয়। ‘ভোলেভালে’,’সাধনা’,’লেডিস অনলি’,’উসকি তমান্না’,’আয়া বাহার’,’বদনামী’,’খুশনসীব’,
’ফয়সালা’,’অ্যায়সা কিউ’- প্রভৃতি চলচ্চিত্রে বিভিন্ন ধরনের সুরের ওপর স্বতন্ত্র কাজ অনুপম
ঘটককে খ্যাতির শীর্ষে নিয়ে গেলেও ১৯৪৬ সালে দেশজুড়ে সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষ শুরু হওয়ার কারণে কলকাতায় ফিরে এসে ছাত্র-ছাত্রীদের গান শেখানো, বিভিন্ন জলসা, রেডিওয় সঙ্গীত পরিবেশন, চলচ্চিত্রের গানে সুর দেওয়া প্রভৃতির মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করতে থাকেন। ১৯৪০ সালে প্রমথেশ বড়ুয়া ‘শাপমুক্তি’ চলচ্চিত্রে অনুপম ঘটকের সুরে ‘বাংলার বধূ বুকে তার মধু’,’তোমার গোপন কথা’,’একটি পয়সা দাও গো বাবু’,’বনে নয়, মনে রঙের আগুন’,’পথে যাবে চলি’ প্রভৃতি গানগুলো খুবই জনপ্রিয় হয়। শৈল দেবী, সুপ্রভা ঘোষ (সরকার), প্রতিভা (আন্না) সেন প্রভৃতি শিল্পীদের গাওয়া, অজয় ভট্টাচার্যের কথায় গানগুলো বাংলা সিনেমার মাইলস্টোন হয়ে যায়। এই চলচ্চিত্রেই নায়ক গায়ক হিসেবে রবীন মজুমদার আবির্ভূত হন। ‘শাপমুক্তি’-চলচ্চিত্রে অনুপম ঘটকের সহকারী ছিলেন রবীন চট্টোপাধ্যায়, যিনি পরবর্তী কালে নিজের নামের প্রতি যথেষ্ট সুবিচার করবেন। কর্ণাজুন, মায়ের প্রাণ(১৯৪১), পাষাণদেবতা(১৯৪২), তুলসীদাস(১৯৫০), অভিশপ্ত(১৯৫১), সঞ্জীবনী, কার পাপে(১৯৫২), কল্যাণী, অগ্নিপরীক্ষা(১৯৫৪), অনুপমা, পরেশ, দৃষ্টি(১৯৫৫), কীর্তিগড়, একটি রাত, অসমাপ্ত, শংকর নারায়ণ ব্যাঙ্ক, নাগরদোলা(১৯৫৬), একতারা, সুরের পরশে, পরের ছেলে, মাধবীর জন্য(১৯৫৭)- ইত্যাদি চলচ্চিত্রে অনুপম ঘটক সুরসৃষ্টির অনবদ্য নিদর্শন রেখে গেছেন। তবে
‘তুলসীদাস’, ‘অগ্নিপরীক্ষা’ চলচ্চিত্র দুটির কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করতে হয়। (সঙ্গীত সমালোচকরা এমনও বলে থাকেন, অনুপম ঘটক যদি শুধু এই দুটো চলচ্চিত্রে সুর দিয়ে আর অন্য কোনো চলচ্চিত্রে সুরারোপ নাও করতেন, তবুও এই দুটো চলচ্চিত্রের গানের কালজয়ী সুরসৃষ্টির জন্য শ্রোতারা সানন্দে তাঁকে মাথায় করে রাখতো। ‘তুলসীদাস’ চলচ্চিত্রে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের কণ্ঠে ‘লিখিনু যে লিপিখানি’ এবং ‘অগ্নিপরীক্ষা’-য় সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের কণ্ঠে ‘গানে মোর ইন্দ্রধনু’ কিংবা মরমি শিল্পী সতীনাথ মুখোপাধ্যায়ের কণ্ঠে ‘জীবননদীর জোয়ারভাটায়’ অনুপম ঘটকের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সুরসৃষ্টি বলে আজও মনে করা হয়, যা এই আধুনিক ডিজিটাল যুগেও এতটুকু ম্লান হয়ে যায়নি।
অনুপম ঘটকের সুরের প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো, সুরে মেলোডিনির্ভর হলেও সুরের চলন সহজ পথে এগোবে না, সেখানে মীড়ের ব্যবহার থাকবে, সুরবিস্তার ক্রোমাটিক হবে, সুরে শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের প্রচ্ছন্ন প্রভাব থাকলেও কখনো তা শ্রোতার কানে রসবিকৃতি ঘটাবে না। শ্রোতারা গানের মধ্যে হারিয়ে গিয়ে সুরের ভাবে একাত্মতা লাভ করে গানের শেষে গিয়ে আবার বাস্তবে ফিরে আসবে। উদাহরণস্বরূপ, ‘দৃষ্টি’ চলচ্চিত্রে শ্যামল মিত্র ও সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের দ্বৈতকণ্ঠে গাওয়া – ‘কুহু কুহু বোলে কোয়েলা’, কিংবা বেসিক গানের মধ্যে পাঞ্জাবি ‘হীর’ গানের প্রভাব নিয়ে সুর করা
হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের গাওয়া ‘শুকনো শাখার পাতা ঝরে যায়’- গানদুটির কথা উল্লেখ করা যায়। তবে রবীন্দ্রনাথের ‘মায়ার খেলা’ গীতিনাট্যে ‘কেন এলি রে’-গানের সুরে ওইরকম প্রয়োগ থাকলেও যেহেতু, কবিগুরু যে ‘হীর’ গানের দ্বারাই প্রভাবিত হয়ে উক্ত
রবীন্দ্রসঙ্গীতের সুর করেছিলেন, সেরকম কোনো প্রামাণ্য তথ্য পাওয়া যায় না, সেজন্য বাংলা গানে এধরণের ব্যবহারকে নতুনই বলা যায়, যার পথিকৃৎ সুরকার অনুপম ঘটক স্বয়ং। হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ও সুরের সূক্ষ্ম কাজগুলো সুন্দর এবং নির্ভুলভাবে ফুটিয়ে তুলেছিলেন। মানুষের ধারণা প্রচলিত আছে হেমন্ত মুখোপাধ্যায় সহজ সহজ সব গান গেয়েছেন, এ ধারণা মোটেই সঠিক নয়।)
হীরেন বসুর লেখা, চিত্রনাট্য, পরিচালিত এই চলচ্চিত্রে ২৮ টি গান ছিল। ‘লিখিনু যে লিপিখানি’ তেওড়া তালে নিবন্ধ
গানটি হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের কণ্ঠে আজও স্মরণীয়। এছাড়া জগন্ময় মিত্র, অখিলবন্ধু ঘোষ, সাবিত্রী ঘোষ প্রভৃতি শিল্পীরাও এই চলচ্চিত্রে গান গেয়েছিলেন। ‘আমি তনু-চন্দন বাটি’,’কমল নয়নাওয়ালে’,’রামজি তুম চাহ তো’ – ‘তুলসীদাস’ চলচ্চিত্রের এসব গান সুরকার অনুপম ঘটককে নতুনভাবে প্রকাশ করে। পরের সাত বছরে প্রায় ১৭ টা ছবিতে কাজ করেছিলেন। ‘অগ্নিপরীক্ষা’ ছবির ‘গানে মোর ইন্দ্রধনু’- গানে ডিমিনিশিং কর্ড সিস্টেমের অদ্ভুত সুর রচনা করেন। সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের কণ্ঠে গানটি আজও অমর। শোনা যায়, চলচ্চিত্রের পরিচালক ‘অগ্রদূত’ -এর বিভূতি লাহার এই সুরটি প্রথমে একদমই পছন্দ হয়নি। অনুপম ঘটক জোর করেই নিজের সিদ্ধান্তে অটল ছিলেন। তারপর যা হয়েছে, সেটা তো ইতিহাস।
গৌরীপ্রসন্ন মজুমদারের লেখা গানগুলো এ চলচ্চিত্রের সম্পদ।
পূর্বোক্ত গানটি ছাড়াও ‘অগ্নিপরীক্ষা’-র ‘কে তুমি আমারে ডাকো’,’ফুলের কালে ভ্রমর আনে’,’যদি ভুল করে ভুল মধুর হলো’(তিনটিই সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের কণ্ঠে), ‘আজ আছি কাল কোথায় রব’(আল্পনা বন্দ্যোপাধ্যায়),’জীবননদীর জোয়ারভাটায় কত ঢেউ ওঠে পড়ে’(সতীনাথ মুখোপাধ্যায়) গানগুলোও যথেষ্ট প্রশংসা অর্জন করেছিল। শেষ ছবি ‘মাধুরীর জন্য’, এছাড়া ‘একতারা’-র শিরোনামের গানের সুরটি ওঁর সহকারী দুর্গা সেন করেছিলেন, কারণ চলচ্চিত্রটি মুক্তিলাভের আগেই অনুপম ঘটকের জীবনাবসান হয়।(এই চলচ্চিত্রের সুর তৈরি করার সময় অনুপম ঘটক শরীরে অসুস্থতা অনুভব করেন। এদিকে সঙ্গীতনির্ভর চলচ্চিত্র, শিল্পীও অনেক- কৃষ্ণচন্দ্র দে, রাধারানী দেবী, ছবি বন্দ্যোপাধ্যায়, আলপনা বন্দ্যোপাধ্যায়, গায়ত্রী বসু, শ্যামল মিত্র, সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়, মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়, পান্নালাল ভট্টাচার্য, ধনঞ্জয় ভট্টাচার্য। সবাইকে দিয়ে ঠিকঠাক গানগুলো গাওয়াতে পারলেও ‘একতারা’ চলচ্চিত্রটির মুক্তি দেখে যাওয়া আর নিয়তিতে হয়ে ওঠেনি।)
সমগ্র জীবনে হিন্দি চলচ্চিত্র ছাড়া মোট ২৯ টি বাংলা চলচ্চিত্রে সুরকার হিসেবে কাজ করেছিলেন, এবং তার মধ্যেই সুরস্রষ্টা হিসেবে অনন্য নজির দেখিয়ে গেছেন। পরিশ্রম, প্রতিভা ও তার উপযুক্ত প্রয়োগ ঘটানো -এই তিনটি কীভাবে করতে হয়, অনুপম ঘটক সেটা জানতেন। তাই বাংলা চলচ্চিত্রের পাশাপাশি আধুনিক বাংলা গানেও অনন্য নজির রেখে গেছেন।
একবার, হিন্দুস্তান রেকর্ডিংয়ের যামিনী মহিলাল হীরেন বসুকে দুটো গান লিখতে বলেন। লেখা হয়ে গেলে ‘শুকনো শাখার পাতা ঝরে যায়’,’প্রিয়ার প্রেমের লিপি লেখনী তরে’ -গানদুটো হিমাংশু দত্ত ব্যস্ততার কারণে আর সুর করতে পারেননি। পরে অনুপম ঘটক এতে সুর করলে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের কণ্ঠে গানদুটো বিখ্যাত হয়ে যায়। এছাড়া হেমন্তের কণ্ঠে ‘আকাশ মাটি ঐ ঘুমালো’, ‘আমি তো তোমারি ওগো’,’হংসমিথুন চলে’,’মেঘ মেদুর বরখারে’ -গানগুলো যথেষ্ট সুনাম অর্জন করেছিল। এছাড়া জগন্ময় মিত্রের ‘সমাধি’,’বাসর’,’অশ্রুমুকুতা কেন তোমার চোখে’, তরুণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘শেষ প্রহরের ভীরু নয়ন ব্যথায় ছল ছল’, কিংবা ‘কত কথা প্রাণে জাগে’, নীতা বর্ধনের(সেন) ‘প্রভুজী তুমি চন্দনসম’, শচীন গুপ্তের ‘সারা রাত জ্বলে সন্ধ্যাপ্রদীপ’, বিনতা চক্রবর্তীর ‘নব মেঘ নামে সুদূর বলাকায়’, সাবিত্রী ঘোষের ‘কাঙালের অশ্রুতে যে রক্ত ঝরে’,সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের ‘গানে তোমায় আজ ভোলাবো’, কৃষ্ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের কণ্ঠে ‘এই হাসি এই বাঁশি’ – এইসব গানগুলো সুরকার অনুপম ঘটকের সুরসৃষ্টির বিভিন্ন নিদর্শন। সিচুয়েশন অনুযায়ী কথার ভাবের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে চলচ্চিত্রের জন্য সুররচনা, পাশাপাশি আধুনিক বাংলা গানে নতুনভাবে নতুন রীতিতে সুর তৈরি করা ওঁর নিজস্ব কৃতিত্ব। অনুপম ঘটক কমল দাশগুপ্তের সমসাময়িক হলেও কৃতিত্ব পেতে সময় লেগেছিল। কিন্তু যখন সাফল্য পেয়েছিলেন, তখন আর পিছনে ফিরতে হয়নি৷ সমকালের অনেক শিল্পীরাই গান তোলার উদ্দেশ্যে তাঁর বাড়িতে যেতেন।
গান ভালবাসলেও অনুপম ঘটক সাহিত্যচর্চাও করেছেন। নিজস্ব লেখালেখির হাতও ছিল ভালো।
এখানে অনুপম ঘটকের লেখার কিছু অংশ উল্লেখ করলাম, ‘অন্তর জানতে পারে সংগীত আন্তরিক হলো কিনা? আন্তরিক সংগীতে আত্মসমর্পণের বীজ থাকে। এই বীজ হতে সৃষ্টি হয় তিনটি বিশিষ্ট ধারা। প্রথম হৃদয় থেকে উঠে সে হয় ঊর্ধ্বমুখী -যায় সে আত্মার অন্বেষণে, দ্বিতীয় ধারা সুন্দর পৃথিবীকে সুন্দরতর করে, তৃতীয় ধারা- হৃদয় থেকে উঠে আবার হৃদয়ে ফিরে আসে।‘
-এই ছিল সুরসাধক অনুপম ঘটকের অনুপম সুরোপলব্ধি, যেজন্যই সুরসাধনার কঠিন পথ পেরিয়ে আসা এবং এভাবেই শ্রোতাদের অন্তর পাওয়া ভবিষ্যতের চিরকালের জন্য।
হীরেন বসু আর তিনি মিলে কসবার বাড়িতে প্লানচেট করার শখে মেতে থাকতেন। বিবাহিত জীবনে স্ত্রী হেনা দেবী, ছয় কন্যা এবং এক পুত্র সন্তান নিয়ে তাঁর ভরা সংসার ছিল।
নিজে যথেষ্ট আত্মবিশ্বাসী ছিলেন, সম্ভ্রমবোধ ছিল যথেষ্টই, অধিকাংশ মানুষ যেটাকে দাম্ভিকতা ভেবে ভুল করতো। নিজের ব্যক্তিগতভাবে প্রিয় শিষ্যা সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়কে পছন্দ করতেন। এটা অন্যরা পছন্দ করছে না, বুঝতে পেরে ১৯৫০-র মাঝামাঝি সময় একটা শক্ত গান সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় কে না দিয়ে আরেকজন জনপ্রিয় শিল্পীকে দিতে বললেন। শিল্পী সুরকারের মনঃপুত করে আশানুরূপ গাইতে পারলেন না। সহকারী হীরেন ঘোষকে আরও কয়েকজন শিল্পীকে দিয়ে চেষ্টা করতে বললেও গীতশ্রী কিন্নরকণ্ঠীর নাম ইচ্ছাকৃতভাবেই একটিবারের জন্য উচ্চারণ করলেন না। পরে সেই গান সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ই গেয়েছিলেন। এই ছিলেন অনুপম ঘটক। সুরের দারুণ মুন্সিয়ানায় গানকে যে অনুভবের কোন জায়গায় নিয়ে যেতে পারতেন, সেটা আজও শুনলে অবাক যেতে হয়। কত পুরানো সব গান -কিন্তু ভাবলে আশ্চর্য লাগে, কীভাবে সেই সময় ওইসব সুরগুলো তৈরি করেছিলেন! কোনো সুরের সঙ্গে কোন সুরের মিল নেই। নচিকেতা ঘোষ, সলিল চৌধুরী প্রমুখ কিংবদন্তীরাও অনুপম ঘটকের সুরে প্রভাবিত হয়েছিলেন।
এমনকি পরবর্তীকালে বিখ্যাত সুরস্রষ্টা নৌশাদ ১৯৮০-র দশকে দূরদর্শনের এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘I was an assistant of a musical genius named Anupam Ghatak at Lahore radio Station…’। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত এই সর্বভারতীয় সুরস্রষ্টার মুম্বাইয়ে ফিরে আরো বেশি করে কাজ করা আর সম্ভব হয়নি। আগেই বলা হয়েছে, বাল্যকাল থেকেই উনি ক্রীড়াকর্মে পারদর্শী ছিলেন। এছাড়া নিয়মিত শরীরচর্চা করা, সাঁতার কাটা, সাইকেল চালাতেও পছন্দ করতেন। সারাজীবন সুস্বাস্থ্য ধরে রাখলেও অদৃষ্টের নিষ্ঠুর পরিহাসে রক্তের বিরল অসুখে জীবনটা কীভাবে শেষ হয়ে যায়। অনেক চেষ্টা করা হয়েছিল, শেষরক্ষা হয়নি। লিউকেমিয়ায় ১৯৫৬ সালের ১২ই ডিসেম্বর মাত্র পয়তাল্লিশ বছর বয়সে মারা যান।
দুঃখের বিষয়, যে এই সুরস্রষ্টা আজ যেন কিছুটা বিস্মৃতির অতলে। কিন্তু একদিন যিনি সময়ের অত আগে গানের জগতে ইন্দ্রধনু ফুটিয়েছেন, তিনি কীসের ভুলে এত দূরে চলে গেছেন- বাঙালি তার খোঁজও নিল না, পরিচর্যাও করে না, এটাই আরও আশ্চর্যের। সঙ্গীতের আলোচনায় অনুপম ঘটক নামটা তাই আরও আবিষ্কারের প্রয়োজন।প্রতিভাস ম্যাগাজিন
কৃতজ্ঞতা :
১.সুরস্রষ্টা অনুপম ঘটক, বাবু বন্দ্যোপাধ্যায়, কলকাতা পুরশ্রী ডিসেম্বর, ২০১০
২. এক গীতিকার চার সুরকার, সোমেন ঘোষ, কোরক সাহিত্য পত্রিকা শারদ সংখ্যা ২০২৪
৩. অনুপম সুরে, অভীক চট্টোপাধ্যায়, বাংলা লাইভ অনলাইন, এপ্রিল ১১, ২০২২
৪. গানে তাঁর ইন্দ্রধনু -স্বপন সোম, পেজ ফোর ওয়েব, ২১ নভেম্বর, ২০২০